■ সুশান্ত কুমার রায় | ধন-ধান্য আর নবান্নের প্রতীক অগ্রহায়ণ

■ সুশান্ত কুমার রায় | ধন-ধান্য আর নবান্নের প্রতীক অগ্রহায়ণ

ষড়ঋতুর দেশ আমাদের দেশ / রূপের যে তার নাইকো শেষ / গ্রীষ্ম আসে তাপদগ্ধ প্রকৃতি নিয়ে / বর্ষা আসে বারি বর্ষণে / শরৎ আসে কাঁশফুলের নরম ছোঁয়ায় / হেমন্ত আসে কৃষকের হাসি আর গানে / শীত আসে হৃদয়ে কাঁপুনি দিয়ে / বসন্ত আসে কোকিলের সুমধুর ডাকে / ছয়টি ঋতু বিচিত্ররূপে আসে / আমাদের মাঝে এইখানে। বাংলার রূপ সৌন্দর্যে কবি শিল্পীরা মুগ্ধ হয়ে কবিতা রচনা করেন। শিল্পী তার তুলির আঁচড়ে ছবি আঁকেন অকপটচিত্তে অবলীলায়। তাইতো কবি জীবনান্দ দাশের ভাষায় বলতে হয়- “আবার আসিব ফিরে / ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়”....। অকুতোভয় বাঙালি ভাষাসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধার দেশ, নদীমাতৃক বাংলার আঁকাবাঁকা মেঠোপথ আর সোনালী আঁশের দেশ, গাংচিল শঙ্খ-শালিকের দেশ, বিজ্ঞানী-শিল্পী, কবি- সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের দেশ, ব্রিটিশ শাসন-শোষণ, নিপীড়ন-নির্যাতন, লাঞ্চনা-বঞ্চনা ও গঞ্জনার দেশ, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্র-ভাওযাইয়া, কীর্ত্তন, আউল-বাউল, জারি-সারি, মুর্শিদী, ভাটিয়ালী, ভাটির দেশ- কৃষি প্রধান দেশ-বাংলাদেশ।

অগ্রহায়ণ ধন আর ধান্যের প্রতীক । আবহমান গ্রামবাংলার উৎসব মুখর মাস অগ্রহায়ণ। বাংলা সনের অষ্টম মাস। কার্তিক আর অগ্রহায়ণ মিলে হেমন্ত। আর ঋতু বদলের পালায় ষড়ঋতু পর্যায়ে অগ্রহায়ণ হেমন্তের দ্বিতীয় মাস। 

বাতাসে বাতাসে নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধ আর আবহমান গ্রামবাংলায় বাঙালি গৃহস্থের গোলা ভরে ওঠার সেই আঘন মাস। অতীতে এক সময় এই মাসটিকে বছরের প্রথম মাস ধরা হতো বলে জানা যায়। ‘অগ্র’ শব্দের অর্থ ‘আগে’ আর ‘হায়ণ’ শব্দের অর্থ ‘বছর’। “ অগ্রহায়ণ শব্দের আভিধানিক অর্থ বছরের যে সময় শ্রেষ্ঠ ব্রীহি (ধান) উৎপন্ন হয়। অতীতে এই সময়ে প্রচুর ধান উৎপন্ন হতো বলে এই মাসটিকে বছরের প্রথম মাস ধরা হতো। তখনকার দিনে নানা বাহারী দেশী জাতের ধান গ্রাম বাংলার জমিতে চাষাবাদ হতো। সেই সব ধানের মধ্যে পানি শাইল, ইদুর শাইল, পাইজাম, ঢেপা, জলঢেপা, কালোজিরা, খিরশাপাত, বিন্দিপাকড়ি, যশোয়া, গাঞ্জিয়া, বেতো, কাটারীভোগ, উকনিমধু, নাইজার শাইল, কার্তিক শাইল, জিগাশাইল, ভাসামালী, উড়কি, বিন্নি, দুধকলম, নীলকুমোর, শীলকুমোর, সূর্যউজাল, ঢলকাসাই, বেগুনবিচি, বকরী, দারকেশাইল ও বলদারের মতো আরো অনেক নাম না জানা দেশি জাতের ধান চাষাবাদ হতো। এসব দেশি জাত আজ বিলুপ্ত প্রায়।  অন্যদিকে স্বরবর্ণের আদ্যাক্ষর আদি অ-তে অগ্রহায়ণ শব্দটি রচিত বলে বাংলা বছরের সূচনা মাস হিসেবে অগ্রহায়ণকে ধরা হয় । এই মাসের আরেক নাম মার্গশীর্ষ। মৃগশিরা নামক তারা থেকে মার্গশীর্ষ নামটি এসেছে। সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এটি ধনের দেবী লক্ষ্মীর মাস। বাঙালি আর লোকসমাজে বিশ্বাস অনুযায়ী বিবাহ পক্ষে বিশেষ শুভ মাস। শীতের আলতো পরশ, কুয়াশার চাঁদর আর আবহমান গ্রামবাংলায় নবান্ন মাতোয়ারায় আসে অগ্রহায়ণ।“কার্তিক গেলো অগ্রহায়ণ মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান / সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান / ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়ায় বায়ু / কলমি লতায় দোলন লেগেছে, ফুরাল ফুলের আয়ু”...॥ হেমন্তের প্রকৃতিতে গ্রামীণ জীবনের নিখুঁত চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের এই কবিতায়। অগ্রহায়ণে সোনার ধানে ভরে উঠেছে কৃষকের জমি। হেমন্তের মৃদুমন্দ বাতাসে খেলা করছে পাকা ধানের শীষ। আপন মনে হেলছে, দুলছে ফিঙ্গে পাখি। নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে কার না ভরে মন? সোনালী ফসলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে স্বপ্ন বুনে কৃষক। সোনালী আমন ধান কাটার আনন্দ উৎসবে মেঠে ওঠে কৃষক। অগ্রহায়ণ এলেই দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ জুড়ে কৃষাণ-কৃষাণীর ধান কাটার মহাধুম পড়ে যায়। 

লোককবির ভাষায়- “আইলো অঘ্রাণ খুশীতে নাচে প্রাণ / চাষি কাঁচিতে দিলো শান / কাঁচি হাতে কচ কচা কচ কাটে পাকা ধান”...॥ অতীতের সেই সময়ে কৃষকের ঘরে ঘরে ছিল গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ আর বরজ ভরা পান। ‘দুধে-ভাতে বাঙালি’ কথাটি যেমনি বাঙালির আত্মপরিচয়ের সাক্ষ্য বহন করে তেমনি বাঙালি খাদ্যাভ্যাসেরও। ‘দুধে-ভাতে বাঙালি’ আমরা। দুধ-ভাত খাইয়ে তাঁর সন্তানকে পিতা-মাতারা আর্শীবাদ করতো। আজও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের অজো পাড়াগাঁয়ের বয়োবৃদ্ধ লোকমুখে-‘পিতামাতার আর্শীবাদ খা-বাচা দুধ-ভাত’ খনার বচনটি শুনতে পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে একটি উপমা প্রচলিত আছে- “দুধও মিঠা দইও মিঠা আরও মিঠা ননী / তাহার চেয়ে অধিক মিঠা মা বাপ ও জননী”...। তাই আজও আবহমান গ্রামবাংলার মানুষের মুখে প্রবাদটি কালের সাক্ষী হয়ে আছে। এক্ষেত্রে ঈশ্বরী পাটনীর ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ উদ্ধৃটি প্রণিধানযোগ্য । বৃটিশ শাসনাধীন তৎকালীন ভারতবর্ষে অর্থাৎ দেশ বিভক্তির অনেক পূর্বে ‘দুধে-ভাতে বাঙালি’ কথাটির প্রচলন শুরু হয়।  নতুন ধানে ভরে ওঠতো কৃষকের আঙ্গিনা। হেমন্তে কৃষাণ-কৃষাণী ধান কাটা ও ধান মারাইয়ের কাজে তখন থাকে মহাব্যস্ত। কৃষকের গোলা ভরে ওঠে নতুন ধানে। ধান ভাঙ্গার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে বাতাসে। ঢেঁকির ধান ভানার শব্দে মুখরিত হতো বাড়ির আঙ্গিনা। নতুন চালের ভাত আর নানা ধরনের ব্যঞ্জনে খাবার পরিবেশন হতো আনন্দঘন পরিবেশে। পঞ্জিকার ধারাবাহিকতায় মাঠ-ঘাট, গ্রাম-গঞ্জ ছেড়ে নবান্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে নানা রকমের পিঠা-পায়েস উৎসবে মুখরিত হয়ে শহরেও বয়ে যায় সেই ঢেউ। “ধন্য অগ্রহায়ণ মাস / ধন্য অগ্রহায়ণ মাস / বিফল জনম তাঁর / নাহি যাঁর চাষ..- মধ্যযুগীয় কবি মুকুন্দরাম প্রায় পাঁচ শতাব্দী আগে “চন্ডীমঙ্গল” কাব্যে এভাবেই অগ্রহায়ণের গুণকীর্তন করেছেন। সম্রাট আকবরের আমলে অগ্রহায়ণ মাস থেকে বাংলা বছর গণনা করা হতো। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দের ভাষায়- “আমি অঘ্রাণেরে ভালোবাসি বিকেলে এই রঙ! / রক্তের শূন্যতা রোদের নরম রোম-ঢালু মাঠ / বিবর্ণ বাদামী হলুদ বিচালী”..॥ ‘অগ্রহায়ণ’ আর ‘নবান্ন’ একই সূত্রে গাঁথা। বাংলার কৃষীজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন তাঁর মধ্যে অন্যতম। ‘নবান্ন’ শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’ । নবান্ন উৎসব হলো নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান কাটার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয় বাঙালির ঘরে ঘরে। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* মন্তব্য করতে পেজটি রিফ্রেশ করুন .