■ সুশান্ত কুমার রায় / দাঁড়ায়ে জননী শরৎকালের প্রভাতে

সুশান্ত কুমার রায় /  দাঁড়ায়ে জননী শরৎকালের প্রভাতে


মা আসছেন।বাঙালির তেরো পার্বণের অন্যতম দুর্গাপুজা সমাগতপ্রায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় - আজি কি তোমার মধুর মুরতি / হেরিনু শারদ প্রভাতে! / হে মাত বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ / ঝলিছে অমল শোভাতে / পারে না বহিতে নদী জলধার / মাঠে মাঠে ধান ধরে নাকো আর / ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল / তোমার কানন সভাতে! / মাঝখানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী / শরৎকালের প্রভাতে...। শরতের সকাল দেখেই পূজোর আগমন বুঝা যায়। শিউলি ফুলের স্নিগ্ধ মিষ্টি সুবাসে চারপাশ ম-ম করে। দুর্বাঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দুগুলি শ্বেতশুভ্র সকালে সোনালী রোদে মুক্তোর মতো মনে হয়। শরতের নিজস্বতা, শুভ্রতা আর স্নিগ্ধতায় মিশে আছে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ জুড়ে সবুজের সমারোহ এবং নদীর কোল ঘেষে সাদা কাঁশফুলের অপরূপ সৌন্দর্য সেই সাথে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতেই শরৎকালীন প্রকৃতির অপরূপ কাব্য-সাহিত্য চিরন্তন মাত্রা পেয়েছে। আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরির খেলা / নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা / ওগো শেফালী বনের মনের কামনা / সকল বন আকুল করে শুভ্র শেফালিকা / আমরা বেঁধেছি কাঁশের গুচ্ছ / শিউলি সুরভিত রাতে বিকশিত জ্যোৎস্নাতে / শরৎ প্রাতের প্রথম শিশির প্রথম শিউলি ফুলে / হৃদয় কুঞ্জবনে মঞ্জুরিল মধুর শেফালিকা..। পরমা প্রকৃতি দেবীদূর্গা । তিনি আদ্যাশক্তি ও সৃষ্টির আদি কারণ। প্রতি বছর শরৎকালে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় অশুভ শক্তি বিনাশিনী বিশ্বমাতা দেবীদূর্গার আরাধনায় মেতে ওঠে শুভ-সুন্দরের প্রত্যাশায়। শারদীয় দূর্গোৎসব সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ এবং সর্ববৃহৎ  সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব। আর এই শারদ প্রভাতেই শরতের আগমনী বার্তা নিয়ে মর্ত্যলোকে পদার্পন করেন দূর্গতিনাশিনী মা দূর্গা। বছরে দুইবার দুর্গোৎসবের প্রথা রয়েছে  আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে শারদীয়া এবং চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে বাসন্তী দুর্গাপূজা। সম্ভবত খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলায় দুর্গোৎসব প্রবর্তিত হয়। ঋগ্বেদে দুর্গার বর্ণনা নেই, তবে ঋগ্বেদোক্ত দেবীসূক্তকে দেবী দুর্গার সূক্ত হিসাবেই মান্যতা দেওয়া হয়। দুর্গার বিশেষ আলোচনা ও পূজাবিধি তন্ত্র পুরাণেই প্রচলিত।প্রাচীন মার্কান্ডে পুরাণে স্পস্টভাবে মা দূর্গার মাহাত্ম্য বর্ণনা আছে।এছাড়াও মৎস্যপুরাণ, দেবীপুরাণ, কালিকাপুরাণ ও দেবী ভাগবতে দুর্গাকে নিয়ে আলোচনা আছে। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিন তথা ষষ্ঠী থেকে আরম্ভ করে দশমী পর্যন্ত হয়ে থাকে এই দুর্গোৎসব। এই পাঁচ দিন যথাক্রমে দুর্গা ষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। এই পক্ষটিকে দেবীপক্ষ বলা হয়। পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিন এই দেবীপক্ষের সূচনা হয়, একে মহালয়াও বলা হয়ে থাকে; আর পূর্ণিমার দিনটিকে লক্ষ্মী পূজার দিন হিসাবে গণ্য করা হয় । 

যিনি দুর্গতি বা সংকট থেকে রক্ষা করেন। দৈত্য বা অসুর বিনাশ, রোগ-শোক এবং পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা । দেবী দুর্গা পরমা প্রকৃতি ও সৃষ্টির আদি কারণ। দেবতাদের অনুরোধে দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেন তাই দুর্গা নামে অভিহিত হন । মহাশক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবী মাতা। আদ্যাশক্তি মহামায়া এবং নারীরূপে বিশ্বের পরম শক্তির প্রকাশ। আর এই মহাশক্তি জগত সৃষ্টির আদি কারণ এবং প্রধান শক্তি।

মহাশক্তিকেই ঈশ্বর মনে করা হয় এবং সনাতন ধর্মে দিব্য জননীর স্থান প্রদান করা হয় এবং সেই পরমেশ্বরকে নারীশক্তি রূপে কল্পনা করা হয়েছে, সেই পরম ঈশ্বরের নারীশক্তি রূপ হলো মা দূর্গা। এই মহাশক্তি কেবলমাত্র সৃষ্টির কারণই নন, তিনি জগতের সকল পরিবর্তনেরও মূল কারণ, যে মহাশক্তির আদি ও অন্ত নেই। 

শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বলা হয়েছে জগৎপ্রপঞ্চের অন্তরালে এক মহাশক্তি আছেন। যিনি মহামায়া। এই মহামায়াই জগৎসৃষ্টি করেন, পালন করেন আবার প্রলয়কালে সংহারও করেন।  বৈষ্ণব ও শৈবধর্মে  এই মহাশক্তি হলো পুরুষের নারীশক্তি প্রকৃতি । তাই শিবের প্রকৃতি হলেন নারীশক্তি পার্বতী । তিনি মাতৃরূপীনী, তিনি শক্তিরূপীনী, তিনি দূর্গতিনাশিনী সর্বভূতে বিরাজমান । তিনি ত্রিনয়না, কপালে তাঁর অর্ধচন্দ্র শোভিত। দেবীর হাতে বহু প্রকার অস্ত্র, গাত্রে সুশোভিত অলংকার ও গলায় মাল্য । তাঁর সোনার অঙ্গ সহস্র সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল। দেবী মহাশক্তির আধার, প্রতি রূপেই দেবী মাতৃরূপা, কল্যাণময়ী, অশুভ শক্তি বিনাশিনী দেবীর অনেক রূপের মাঝে নয়টি রূপ বিশেষভাবে, বিশেষ লগ্নে পুজিত হয়ে থাকে। শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুশমাণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী, সিদ্ধিদাত্রী- মহাশক্তি রূপে দেবী দুর্গা দেবকুল, সাধক ও  ভক্তকুলে পুজিত হয়ে থাকেন প্রতিবছর শরৎকালে। 


লেখক পরিচিতি

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* মন্তব্য করতে পেজটি রিফ্রেশ করুন .