কুম্ভকর্ণের কথা বলার পরে, স্বাভাবিকভাবেই কনিষ্ঠ ভ্রাতার নামটি আলোচনায় এসে যায়। কিন্তু পরাজিতদের গল্পে বিভীষণের কথা আসবে কেন? বিভীষণ তো লঙ্কার যুদ্ধে বিজয়ীপক্ষেরই অন্যতম নাম! একইসঙ্গে রাবণের মৃত্যুর পরে লঙ্কার সিংহাসনেও আসীন নামটিও তো বিভীষণ। কিছু-কিছু বর্ণনা অনুযায়ী, লঙ্কার সিংহাসন দখলের পরে রাবণের প্রধানা মহিষী মন্দোদরীকেও যিনি দখল করলেন! 'দখল' লিখলাম, কারণ, এক্ষেত্রে 'বিবাহ করলেন' লেখা কতটা সমীচীন হবে, বলা মুশকিল। এই 'বিবাহ'-তে মন্দোদরীর মানসিক সম্মতি ছিল না, একথা সহজবোধ্য। থাকার কথাও নয়, যেহেতু বিভীষণ যুদ্ধের সময়ে শুধুমাত্র শত্রুপক্ষে যোগ দিয়েছেন, তাই-ই নয়। রাবণ এবং জ্যেষ্ঠপুত্র মেঘনাদের হত্যার পিছনে বিভীষণের ভূমিকাও বিরাট। তাহলে অমন একটি 'বিবাহ' যদি ঘটেই থাকে, মন্দোদরী তাতে রাজি হলেন কেন? অসুর-সংস্কৃতি তো দেব-সংস্কৃতির মতো নয়! অসুরসমাজ অনেক লিবার্যাল, সেখানে কেউ কোনো মহিলার উপরে তার অপছন্দের বিবাহ চাপিয়ে দেবে না। সেখানে মেয়েরা বরাবরই নিজের বিবাহযোগ্য পাত্র নিজেই ঠিক করে নেওয়ার অধিকারী। আর এ তো হয়ে দাঁড়াচ্ছে একটি অস্বাভাবিক, অকল্পনীয় বিবাহ! এই বর্ণনার ব্যাখ্যাতারা (এঁদের মধ্যে কবিতা কানে অন্যতম) জানাচ্ছেন, রাবণের সিংহাসনের স্বাভাবিক উত্তরাধিকারী মেঘনাদ যেহেতু এই যুদ্ধে মৃত, অতএব মেঘনাদের প্রায়-সদ্যোজাত শিশুপুত্রই হলো লঙ্কার সিংহাসনের ভবিষ্যৎ। নিজের এই পৌত্রটির স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার্থেই মন্দোদরীর এমন সম্মতি। এখন কথা হলো, বিভীষণের তো কোনো ছেলে ছিল না! তাঁর একটিই মেয়ে, ত্রিজাতা (উচ্চারণভেদে, ত্রিজটা)। প্রয়াত কুম্ভকর্ণের ছেলেরাও যুদ্ধে নিহত। রাবণের অন্যান্য পুত্ররাও তাই। তাহলে তো এমনিতেই মেঘনাদের শিশুপুত্র লঙ্কার সিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী। তার অধিকার রক্ষার্থে মধ্যবয়সে (কোনো-কোনো বর্ণনা অনুযায়ী প্রৌঢ়বয়সে) মন্দোদরীকে অমন একটি অকল্পনীয় বিবাহে যেতে হবে কেন? এই প্রশ্নের কোনো যুক্তিসঙ্গত উত্তর কিন্তু এই ব্যাখ্যাতারা দিতে পারেননি! যদি তাঁরা বলতেন যে, ভবিষ্যতে বিভীষণের কন্যা ত্রিজাতার বিবাহের পরে লঙ্কার সিংহাসন বস্তুত তার স্বামীর হাতে চলে যাবে, এই আশঙ্কায় নিজেদের বংশের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য মন্দোদরীর এই অস্বাভাবিক সম্মতি, তাহলে উত্তরটি কিছুটা বিশ্বাসযোগ্য হতো। কিন্তু তাঁরা সরাসরি কখনোই সেই যুক্তি উচ্চারণ করেননি।
যাইহোক, বিজয়ীদের অন্যতম হয়েও বিভীষণ কেন পরাজিতদের গল্পের একজন, সেকথায় দ্রুত আসা দরকার। আমরা তো জানিই যে, সীতাহরণ ও তার পরের ঘটনাক্রম বিভীষণকে রাবণ তথা রাক্ষসপক্ষ ত্যাগ করে শত্রুশিবিরে যোগ দিতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু সেটাই একমাত্র বিষয় নয়। আগের পর্বগুলিতে যতবার বিভীষণের কথা আলোচনায় এসেছে, তার থেকেই বোঝা সহজ যে, রাবণের সঙ্গে তাঁর বিরোধের জায়গাটা একদম মৌলিক। আরও বৃহৎ প্রেক্ষায় বললে, অসুর-সংস্কৃতির সঙ্গেই বিভীষণের বিরোধ, এবং তা হঠাৎ করে তৈরি হওয়া কিছু নয়। রাবণ অবশ্যই তাঁর দেব-পিতৃকুল ও অসুর-মাতৃকুলের যথার্থ সম্মিলন ছিলেন। যে-কারণে বেদ ও যুদ্ধে তিনি সমান পারঙ্গম। সঙ্গীত, চিকিৎসা ও জ্যোতির্বিদ্যায় তাঁর সমান পটুত্ব। শাস্ত্র ও শস্ত্রে তাঁর সমান দক্ষতা। কিন্তু নিজের উপর মাতৃকুলের ব্যাপক প্রভাবের কারণে তিনি বাবার মতো ঋষির জীবন না-বেছে, নিজের জন্য যোদ্ধার জীবন বেছে নিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে ক্রমশ হয়ে উঠলেন দুর্দমনীয়। মা কৈকেশী ও মাতৃকুলের অন্যদের কাছে তিনিই অসুর-সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার ও বিস্তারের পক্ষে একমাত্র আশা। মূলত সেই কাজে রাবণকে সাহায্য করার জন্যই কৈকেশী আরও তিনটি সন্তানের জন্ম দেন। তাঁদের কারও মধ্যেই যে রাবণের মতো দেব-অসুরের পারফেক্ট ব্লেন্ডিং ঘটলো না, সেকথা আলাদা। কুম্ভকর্ণ মূলত আসুরিক, শূর্পনখাও তাই। যদিও চারিত্রিকভাবে এই দু'জনের পার্থক্যও অনেক। কিন্তু বিভীষণ তাঁদের থেকে ঠিক বিপরীত। চেহারা ও স্বভাবে তিনি যেন পিতা বিশ্রবার প্রায় ফটোকপি! শাস্ত্রচর্চায় তাঁর যত আগ্রহ, শস্ত্রচালনায় তার কিছুই নয়। আত্মরক্ষার্থে যেটুকু অস্ত্রশিক্ষা করতে হয়, ততটুকুই তাঁর দক্ষতা। অসুরকুলের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী দীর্ঘকায় ও পেশীবহুল না-হয়ে তিনি বিশ্রবার মতোই তুলনায় খর্বকায় ও ক্ষীণ। ধর্মাচরণেও তিনি দেব-সংস্কৃতির অনুগামী। আরও মারাত্মক ব্যাপার হলো, অসুর-সংস্কৃতিতে সর্বত্রগ্রাহ্য একমাত্র দেবতা শিব তাঁর আরাধ্য নন, তিনি বিষ্ণুর উপাসক---অসুরদের সঙ্গে যে-দেবতার বৈরী চিরকালীন! অতএব, এমন কনিষ্ঠের সঙ্গে রাবণের সম্পর্ক যে সুগম থাকবে না, সে তো স্বাভাবিক! ঠিক যেমন, বিদগ্ধ পিতার জ্ঞানের প্রতি ব্যাপক সম্মান থাকলেও তাঁর সঙ্গে রাবণের সম্পর্ক সহজ ছিল না। কুবেরকে অপসারিত করে লঙ্কায় অসুররাজ্য পুনর্প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে, বিশ্রবার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আক্ষরিক অর্থেই শেষ হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে, বিশ্রবাই রাবণকে ত্যাগ করেন। এর কারণ হিসেবে যদিও তিনি বলেন যে, তিনি একজন ঋষি এবং রাজসভায় তাঁর কোনো কাজ নেই, বরং আশ্রমই তাঁর জীবনযাপন ও সাধনার স্বাভাবিক স্থান হওয়া উচিত; কিন্তু আসলে যে প্রথমপক্ষের সন্তানকে ক্ষমতাচ্যুত করে দ্বিতীয়পক্ষের সন্তানের ক্ষমতা দখলের ঘটনাটি তিনি মেনে নিতে পারেননি, তা স্পষ্ট বোঝা যায়। আরও বড়ো কথা হলো, দেব-সংস্কৃতির অন্যতম প্রতিভূ বিশ্রবার পক্ষে অসুর-সংস্কৃতির এমন জয়জয়কার মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। রাবণও যে তাঁকে খুব একটা আটকাতে চেয়েছিলেন, তা নয়। তবে দ্বিতীয়পক্ষের জ্যেষ্ঠপুত্রটির ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলচিন্তাও তাঁর ছিল। তাই দ্বিতীয়পক্ষের পরিবার ত্যাগ করে বিশ্রবা যখন প্রথম স্ত্রী ইলাবিদাকে নিয়ে আশ্রমে ফিরে যাচ্ছেন এবং বিভীষণ তাঁর সঙ্গী হতে চাইছেন, তখন বিশ্রবা বিভীষণকে লঙ্কায় থেকে যাওয়ার পরামর্শই দেন; যাতে বিভীষণ রাবণের রাজকার্যে সহায়তা করতে ও তাঁকে 'ধর্মপথে' থাকতে সহায়তা করতে পারেন। হয়তো বিশ্রবার দেব-সংস্কৃতির বিশ্বাস অনুযায়ী, বিভীষণই রাবণকে তাঁর ভিতরের অসুরটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করতে পারবেন বলে বিশ্রবার মনে হয়েছিল।
তবে নিজের দুর্বল ব্যক্তিত্বের কারণে বিভীষণ কিন্তু কোনোদিনই তাঁর প্রবলপ্রতাপ ব্যক্তিত্বময় অগ্রজটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হননি। মধ্যম অগ্রজ কুম্ভকর্ণ, এমনকি অনুজা শূর্পনখাও অসুরোচিত স্বভাবের অনুপস্থিতির কারণে তাঁকে কিঞ্চিৎ অনুকম্পার চোখেই দেখতেন। এঁরা সকলেই অবশ্য বিভীষণের শাস্ত্রজ্ঞান সম্পর্কে আস্থাবান ছিলেন। আনন্দ নীলকণ্ঠন, কবিতা কানে-সহ প্রায় প্রত্যেক আধুনিক ব্যাখ্যাতাই দেখিয়েছেন, বিভীষণ রাবণের রাজসভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীও ছিলেন। রাজত্বের নীতি-নির্ধারণে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত স্বয়ং রাবণের হলেও, মাল্যবান-প্রহস্ত-মারীচ ত্রয়ীর মতোই বিভীষণের পরামর্শ তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভাই হিসেবে অবশ্যই কুম্ভকর্ণ রাবণের প্রিয়তর ও ভরসাযোগ্য (কেন, তা আগের পর্বেই আলোচিত হয়েছে); কিন্তু মধ্যম ভ্রাতাটি অধিকাংশ সময়েই নেশাচ্ছন্ন থাকায়, রাবণকে কনিষ্ঠের সহায়তা নিতেই হতো। তবুও যে বিভীষণ রাবণকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চাওয়ার সাহস করেননি, তার কারণ তাঁর দুর্বল ব্যক্তিত্ব। বরং তিনি নিজেই তাঁর স্ত্রী সরমার দ্বারা পরিচালিত হতেন। কবিতা কানের বর্ণনায় এই কারণে বিভীষণকে নিয়ে কৈকেশী ও শূর্পনখার হাসিঠাট্টা, এবং কিছু-কিছু ক্ষেত্রে তাতে মন্দোদরী ও কুম্ভকর্ণ-পত্নী বজ্রমালার সহাস্য সম্মতির উল্লেখ আছে। এখন এই প্রসঙ্গে বিভীষণ-পত্নী সরমা ও কন্যা ত্রিজাতার কথা একটু বলে নেওয়া যাক।
রামায়ণের সব বর্ণনাতেই সরমা গন্ধর্বকন্যা বলে চিহ্নিত। মিথ অনুযায়ী, গন্ধর্বরা হলো দেবতাদের রাজসভার সঙ্গীতশিল্পী। স্বাভাবিকভাবেই অসুরদের তুলনায় দেবতাদের সঙ্গেই তাদের ঘনিষ্ঠতা। তাহলে হঠাৎ পরাক্রান্ত অসুররাজের ভাইয়ের সঙ্গে বিবাহ কেন? এই প্রশ্নেরও কোনো যুক্তিসঙ্গত উত্তর রামায়ণের মূলানুগ ব্যাখ্যাতাদের কাছে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে বাস্তববাদী ব্যাখ্যাকার নীলকণ্ঠন অবশ্য যাবতীয় মিথকে উড়িয়ে দিয়ে গন্ধর্বদের পরিচিতি দিচ্ছেন এই ভাষায়---'they are just another aborigine tribe, living on the fringes of the clashing Asura and Deva empires', এবং একমাত্র এই ব্যাখ্যা থেকেই এরকম একটি বৈবাহিক সম্বন্ধ যুক্তিসঙ্গত মনে হতে পারে। যাইহোক, রামায়ণের প্রায় সব বর্ণনাতেই সরমাকে লঙ্কায় বন্দিনী সীতার প্রতি সহানুভূতিশীল দেখানো হয়েছে। আর সেটা স্বাভাবিকও, কারণ বিভীষণও সীতাহরণের প্রতিবাদ করেছেন এবং লঙ্কাত্যাগ করেছেন। আমাদের বাংলা কৃত্তিবাসী রামায়ণে তো সরমা সীতাকে নিয়ে এতটাই আন্তরিক যে তিনি সীতার প্রিয় সখীতে পরিণত হয়েছেন! কিন্তু যেটা কিঞ্চিৎ অস্বাভাবিক, তা হলো, নিজে শত্রুশিবিরে যুক্ত হলেও বিভীষণ কিন্তু স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে পালাননি; লঙ্কার রাজপ্রাসাদেই রেখে গিয়েছিলেন। ধরেই নেওয়া যায়, তাঁর বিপক্ষে যোগ দেওয়ার ঘটনা সত্ত্বেও রাবণ সরমা ও ত্রিজাতার কোনো ক্ষতি করবেন না, এই বিশ্বাস বিভীষণের ছিল। রাবণ শুধু যে কোনো ক্ষতি করেননি তাই নয়, অশোকবনে সীতার দেখাশোনার দায়িত্বও মূলত ত্রিজাতা ও সরমার উপরেই ন্যাস্ত করলেন। এখানে রাবণের অসীম উদারতা এবং পারিবারিক ভাঙন সত্ত্বেও পরিবারের সদস্যদের প্রতি তাঁর অটুট আস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। তবে কোনো-কোনো বর্ণনায় দেখা যায়, বিভীষণের মতো সরাসরি না-হলেও, সরমাও রাবণের বিরুদ্ধাচারণ করছেন এবং শত্রুদের সুবিধা হয় এমন কাজ করছেন। রঙ্গনাথা রামায়ণ ও তত্ত্বসংগ্রহ রামায়ণে তেমন ইঙ্গিত আছে। সেখানে দেখানো হয়েছে যে, সরমা রামের বানরসৈন্যদের সেই যজ্ঞস্থলটি দেখিয়ে দিচ্ছেন, যেখানে যজ্ঞ করতে পারলে রাবণ অপরাজেয় হয়ে যাবেন। বানরেরা তখন সেই যজ্ঞস্থল নষ্ট করে দেয়। তেলুগু ভাষায় রচিত 'সীতা পুরাণামু'-তে ত্রিপুরাণেনী রামস্বামী আবার এক্ষেত্রে আর্য-দ্রাবিড় দ্বন্দ্ব টেনে এনেছেন। তাঁর মতে, সরমা আর্য (যেহেতু গন্ধর্ব) বলেই তাঁর দ্রাবিড় স্বামী বিভীষণকে আর্য রামের পক্ষে তথা দ্রাবিড় রাবণের বিপক্ষে যেতে প্ররোচিত করেন। যদিও আমরা এই ধারাবাহিকের শুরুর দিকে, দ্বিতীয় পর্বেই, আলোচনা করেছি যে, রাবণ ও তাঁর পরিবারকে ওইভাবে দ্রাবিড় বলা যায় না; বরং যে-যে কারণে তাঁদেরও আর্য বলা যায়, সেইসব যুক্তি দ্রাবিড় বলার কারণের থেকে অনেক বেশি জোরালো।
ত্রিজাতা বা ত্রিজটা মূলানুগ ও প্রাচীন বর্ণনায় একজন বয়স্কা রাক্ষসী, লঙ্কার রাজপ্রাসাদের পরিচারিকা। তবে সীতাহরণের পরে প্রকাশ্যে সে শাসকের অনুগত হলেও, মনে-মনে রামের জয় ও রাবণের পরাজয় চায়। যুদ্ধক্ষেত্রের সব খবর সে সীতাকে দেয়, তাঁকে সাহস জোগায় ও রামই জিতবেন বলে আশ্বস্ত করে। রামায়ণের অধিকাংশ পরবর্তী বর্ণনায় ত্রিজাতা বিভীষণের মেয়ে। যেমন, তামিল কম্ব রামায়ণ ও ওড়িয়া বলরামদাসা রামায়ণ। এছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাভানিজ ভাষায় প্রচলিত 'কাকাউইন রামায়াণা', মালয় ভাষায় প্রচলিত 'সেরি রামা', থাই ভাষার 'রামাকিয়েন'-এও ত্রিজাতা বিভীষণ-কন্যা। সে বন্দিনী সীতার দেখাশোনা করে, সীতাকে সঙ্গ দেয়। যুদ্ধজয়ের পরে তার অবদানের জন্য রাম তাকে বিপুলভাবে সম্মানিত ও পুরস্কৃত করেন। তবে ত্রিজাতাকে নিয়ে বর্ণনায় অল্পসংখ্যক ব্যতিক্রমও আছে। মারাঠি ভাবার্থ রামায়ণে ত্রিজাতা বিভীষণের বোন। যদিও কৈকেশীর সন্তানেরা চার ভাই-বোন, এটাই সর্বত্র স্বীকৃত। তাদের অনেক তুতো ভাইবোনের উল্লেখ আছে, কিন্তু আরও একটি সহোদরার উল্লেখ নেই। প্রাচীন জৈন রূপান্তর 'পৌমাচারিয়ম'-এ আবার ত্রিজটা রাবণের কাছে কর্মরত অন্যতম দূতী। এরই প্রভাবে বোধহয় বাংলার কৃত্তিবাসী রামায়ণে দেখা যায়, সে সীতাকে অনুরোধ করছে যাতে তিনি রামের কথা ভুলে গিয়ে রাবণকে বিবাহ করেন। কৌতূহলজনক ব্যাপার হলো, থাই ভাষার 'রামাকিয়েন'-এ যুদ্ধের পরে ত্রিজাতার সঙ্গে হনুমানের বিবাহ দেখানো হয়েছে। তাদের এক পুত্র হয়, যার নাম অসুরাপদা। মালয় রামায়ণেও বিভীষণের অনুরোধে হনুমান ত্রিজাতাকে বিয়ে করেন। তবে তাঁর শর্ত ছিল, মাত্র একমাস তিনি স্ত্রীর সঙ্গে থাকবেন, তারপরে রামের সেবা করতে অযোধ্যা চলে যাবেন। ওই একমাসের যৌথজীবনের ফলে ত্রিজাতার একটি পুত্র হয়, যার নাম তেগাঙ্গা তথা অসুরাপদা। অতএব বোঝাই যাচ্ছে, আমাদের দেশের লোকেরা পবনপুত্র বজরঙ্গবলীকে চিরকুমার দেখতে ভালোবাসলেও দূরপ্রাচ্যের লোকেরা তাঁকে নারী-সংসর্গ করা পুরুষ হিসেবে দেখতেই পছন্দ করেন। তবে অধিকাংশ বর্ণনায় ত্রিজাতা যেহেতু বিভীষণের মেয়ে, তাই আমরা সেটা ধরেই আলোচনা করবো। তাছাড়া, ত্রিজাতা বা ত্রিজটা তো একইসঙ্গে একাধিক নারীর নামও হতে পারে! সুতরাং, কয়েকটি অন্য বর্ণনা দেখে ত্রিজাতাকে বিভীষণের মেয়ে না-ভাবার কিছু নেই।
এবার বিভীষণের কথায় ফিরে আসা যাক। আগেই আমরা দেখেছি অসুর-সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য একদম গোড়ার জায়গায়। জীবনদর্শন থেকে ধর্মবোধ, সবেতেই সেই বিরোধ প্রকট। নীলকন্ঠন দেখিয়েছেন, রাবণের অপছন্দ জেনেও বিভীষণ একের পর এক উত্তর ভারতীয় বৈদিক ব্রাহ্মণদের লঙ্কায় নিয়ে গিয়ে বসাচ্ছেন। এই ব্রাহ্মণেরাই দেব-সংস্কৃতির মুখ্য প্রচারক। একইভাবে বিভীষণ আড়ালে বিষ্ণু-উপাসনার প্রচলন বাড়াচ্ছেন, নিজের ধর্মাচরণের এমন অনুগামী তৈরি করার চেষ্টা করছেন, যারা অসুর-সংস্কৃতিতে একেবারেই বেমানান। গুপ্তচরদের মাধ্যমে হোক বা অন্যান্য আস্থাভাজনদের সূত্রে রাবণ আগেই এইসব কাজকর্মের খবর পেলেও, কিছুটা ভ্রাতৃস্নেহে আর কিছুটা নিজের ক্ষমতার উপরে অটল বিশ্বাসে তা নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা করেননি। তিনি বিশ্বাসই করতে পারেননি যে, ভীরুস্বভাবী এই ভাইটি কোনোদিনও তাঁর বিরুদ্ধে কোনোরকম ষড়যন্ত্রে যুক্ত হতে পারে। সীতাহরণের পরে বিভীষণ রাজসভায় সর্বসমক্ষে এর প্রতিবাদ জানালেন, সীতাকে রামের কাছে সসম্মানে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বললেন এবং রাবণের কাছে অপমানিত হলেন। কোনো-কোনো বর্ণনা অনুযায়ী তিনি এরপরে নিজেই লঙ্কা ত্যাগ করেন, আবার কোনো-কোনো বর্ণনায় আছে যে রাবণ তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কারণে বহিষ্কার করেন। কেউ বলেছেন, এরপরে তিনি নিজেই রামের শরণে যান, যেহেতু তিনি বিষ্ণুর একনিষ্ঠ উপাসক এবং রাম ততদিনে বিষ্ণুর সপ্তম অবতার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আবার কারও-কারও মতে, স্ত্রী সরমা তাঁকে রামের পক্ষে যোগ দিতে উৎসাহ দেন। কবিতা কানে আবার লিখেছেন, এতে মা কৈকেশীরও মত ছিল। কনিষ্ঠ পুত্রকে শত্রুশিবিরে পাঠিয়ে তিনি হয়তো ইতিমধ্যে শুরু হয়ে যাওয়া ভয়ানক প্রাণঘাতী যুদ্ধের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি কিছু কম করতে চেয়েছিলেন। বিভীষণের রামের পক্ষে যাওয়া যেভাবেই সম্ভব হয়ে থাক না-কেন, একথা ঠিক যে মূলত সেই কারণেই তিনি যুগে-যুগে দেশে-দেশে বিশ্বাসঘাতক বা বিশ্বাসহন্তা বলে চিহ্নিত হলেন। তাঁর নামেই 'ঘরশত্রু বিভীষণ'-এর মতো নিন্দাসূচক শব্দবন্ধের জন্ম হলো। বস্তুত বাংলার ইতিহাসে মিরজাফর নামে এক সেনাপতির আবির্ভাব না-হলে আমরা বাঙালিরা বিশ্বাসহন্তা হিসেবে মহাকাব্যে পড়া বিভীষণের তুল্য আর কাউকে জানতেই পারতাম না! অবশ্য বিকল্প চিন্তাধারার ঐতিহাসিকরা বলেন, বহুবার বহুভাবে বয়সে অনেক ছোটো নবাবের কাছে অপমানিত হতে-হতে নাকি মিরজাফর সিরাজ-উদ-দৌল্লার সঙ্গে বেইমানি করার সিদ্ধান্ত নেন। সেদিক থেকেও বিভীষণের মতো চরিত্রের সঙ্গে তাঁর অনেক মিল। কিন্তু বিভীষণ সম্ভবত আরও বেশি ঘৃণিত এই কারণে যে, তিনি রক্তের সম্পর্কের বিরুদ্ধে, পিতৃপ্রতিম অগ্রজের বিরুদ্ধে, অসুর জাতির বিরুদ্ধে গেলেন। শুধু গেলেনই না, একেবারে শত্রুশিবিরে যোগদান করলেন! সীতাহরণের বিরুদ্ধে তো কুম্ভকর্ণও ছিলেন। কিন্তু নবম পর্বে আমরা দেখেছি, কী অপরিসীম প্রাজ্ঞতায় তিনি রাবণের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে, রাবণের কাছে ভর্ৎসিত হয়েও, রাবণ তথা অসুর সাম্রাজ্যের পক্ষে যুদ্ধে গেলেন। তিনি নিজের মতের উপরে সম্পর্ক ও জাতিকে স্থান দিলেন, আর বিভীষণ একই পরিস্থিতিতে যোগ দিলেন শত্রুপক্ষে! তৃতীয় পর্বে উল্লেখ করেছিলাম, শ্রীলঙ্কার উত্তর কালুতারা নামে একটি স্থান আজও 'দেশাশত্রু' নামে পরিচিত শুধু এই কারণে যে, সেখানে নাকি বিভীষণ বসবাস করতেন! অথচ বিভীষণ তো তথাকথিত ন্যায়ের পক্ষে গেলেন! তাহলে তাঁর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হওয়ার বদলে কালিমালিপ্ত হলো কেন?
এই প্রসঙ্গের ব্যাখ্যায় সর্বোত্তম সাহিত্যসৃষ্টির কাছে আসার জন্য আমরা আবার ফিরে আসতে পারি আমাদের বাংলা ভাষায়। যশোরের সাগরদাঁড়ি গ্রামের ভূমিপুত্র মাইকেল মধুসূদন দত্ত নামক এক মহাকবি শুধু যে-সৃষ্টির জন্য বিশ্বসাহিত্যে অমর হয়ে থাকলেন, সেই 'মেঘনাদবধ কাব্য' যে-ভয়াবহ, ন্যক্কারজনক ও ঘৃণ্য ঘটনাটিকে ঘিরে রচিত, তার নেপথ্যে তো ছিলেন বিভীষণই। নিকুম্ভিলা যজ্ঞগৃহে আরাধনারত নিরস্ত্র ভ্রাতুষ্পুত্র মেঘনাদকে হত্যা করার জন্য তিনিই তো লক্ষ্মণকে গোপন পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন! কাপুরুষোচিত সবরকম নিদর্শন রেখে লক্ষ্মণ সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন। কারণ, ইতিমধ্যেই তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে মেঘনাদের হাতে একাধিকবার পর্যদুস্ত, এবং একবার মেঘনাদের প্রাণঘাতী আক্রমণে মৃত্যুর মুখ থেকে কোনোরকমে ফিরেছেন। অতএব, নিরস্ত্র মেঘনাদই তাঁর জন্য একমাত্র বিজয়ের উপায়! মাইকেল 'মেঘনাদবধ কাব্য'-এর ষষ্ঠ সর্গটিতে চূড়ান্ত কবিকৃতির বর্ণচ্ছটায় এই নৃশংস ঘটনাটি দেখিয়েছেন, তা আমাদের সবার পড়া। কিন্তু বিশেষ করে মেঘনাদ যেখানে অনুভব করছেন যে, বিভীষণই এই অনৈতিক আক্রমণের নেপথ্য-যন্ত্রী; সেই জায়গাটি আবার ফিরে পড়ার ইচ্ছা সংবরণ করতে পারছি না!
'সচকিতে বীরবর দেখিলা সম্মুখে
ভীমতম শূল হস্তে, ধূমকেতুসম
খুল্লতাত বিভীষণে----বিভীষণ রণে!
"এত ক্ষণে"----অরিন্দম কহিলা বিষাদে----
" জানিনু কেমনে আসি লক্ষ্মণ পশিল
রক্ষঃপুরে। হায়, তাত, উচিত কি তব
এ কাজ, নিকষা সতী তোমার জননী,
সহোদর রক্ষঃশ্রেষ্ঠ? শূলীশম্ভুনিভ
কুম্ভকর্ণ? ভ্রাতৃপুত্র বাসববিজয়ী?
নিজ গৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে?
চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে?
কিন্তু নাহি গঞ্জি তোমা, গুরুজন তুমি
পিতৃতুল্য। ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে,
পাঠাইব রামানুজে শমন-ভবনে,
লঙ্কার কলঙ্ক আজি ভুঞ্জিব আহবে।"
বলাবাহুল্য, বিভীষণ এই অনুরোধ রাখলেন না। ইন্দ্রজয়ী মেঘনাদকে বিনাযুদ্ধে মরতে হলো। পরাজিতদের গল্পে তিনি নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠতম বিষাদচরিত্র। তাঁর কথায় আবার আমাদের ফিরে আসতে হবে পরবর্তী কোনো পর্বে। কিন্তু এমন কাজের জন্য বিভীষণ মহাকাব্যের ঘৃণ্যতম চরিত্র হয়ে থেকে গেলেন, নেহাতই শত্রুপক্ষের সঙ্গে হাত মেলানোর মতো কাজের থেকে যে-অপরাধ অনেক বেশি ভয়ানক। এখানেই শেষ নয়! যুদ্ধের চূড়ান্ত লগ্নে সম্মুখ-লড়াইয়ে রাম যখন শতচেষ্টাতেও রাবণকে হত্যা করতে পারছেন না, তখন রাবণের শরীরের ঠিক কোনখানে আঘাত করলে তাঁর অমরত্বের বর আর কাজ করবে না, সেই গোপন কথাটি রামকে জানিয়ে দেওয়ার কাজটিও বিভীষণই করলেন!
অতএব ঘরশত্রু বা দেশশত্রু হিসেবে পরিচিত হওয়া বিভীষণের জন্য স্বাভাবিক পরিণতিই ছিল। আর, এই পরিণতির জন্যই বিজয়ীপক্ষে থেকেও তিনি আসলে থেকে গেলেন পরাজিতদের দলে। তবুও, শুনতে আশ্চর্য লাগলেও সত্যি, বিভীষণই লঙ্কার একমাত্র বিশ্বাসঘাতক নন; সবচেয়ে বড়ো বিশ্বাসঘাতকও নন! মহাকাব্যটির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এর স্তরে-স্তরে পুঞ্জীভূত বহু অকথিত বা চাপা-পড়া কাহিনি আধুনিক ব্যাখ্যাতারা তুলে আনছেন। রামায়ণকে নতুন আলোয় পড়তে গেলে আমাদের সেইসব দিকের প্রতি সন্ধানী দৃষ্টি দিয়েই পরাজিতদের গল্পের শেষ পর্যন্ত যেতে হবে।
(ক্রমশ) নবম পর্ব পড়ুন
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন