অনিরুদ্ধ নীরাকে রান্নাতে হাতও দিতে দেয়নি। নিজে যত্ন করে সমস্তটাই করেছিলো। মণিপিসি জোগাড় করে দিয়েছিলেন সব। সেই যত্ন করে করা খাবার নীরা নিজে খাবার আগে প্রতিদিনের মতো বাবিনের ছবিকে খাওচ্ছিলো। ফেলছিলো চারিদিকে। অনিরুদ্ধ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো। দেখছিলো সব।
-বাবিন কবে আসবি সোনা? মামণিকে ভুলেই গেছিস না... কি বললি? আসবি? কবে বাবা? আর একটু কাজ আছে? আচ্ছা,খেয়ে নাও সকাল থেকে তো কিছুই খাওনি। বাপি রান্না করেছে। দেখো...
মণিপিসি অনিরুদ্ধকে চশমা খুলে চোখ মুছতে দেখলো।
-এটা রোজকার ঘটনা অনি
-এতদিন শুনেছি। আজ দেখছি। এতটাও জানাতে পারনি।
-এই করতে গিয়ে নিজে খাবে না। আমি বকে বকে খাওয়াতে গেলে অভিমান হবে।
মণিপিসি অভিভাবকের মতো। অনিরুদ্ধ,নীরাকে বকাঝকা করেন স্বাভাবিক দরকারে।
-তারপর সারাদুপুর ছবিটা হাতে নিয়ে বকবক,গল্প-চলবেই।
-আমি ফেরার সময় তো ঘুমোয় দেখি।
-হ্যাঁ,দুপুরের ওষুধের প্রভাব। পাঁচটা থেকে ঘুমিয়ে পড়ে। রাত দশটায় ঠেলেঠুলে তুলে খাওয়াতে হয়। তখনও আগে বাবিন। তারপর নিজে।
-রাতেরটা জানি। আমি আসি তো...
-হ্যাঁ। তুমি থাকো বলেই রাতে মাত্রাটা কম হয়। কিন্তু দুপুরে মাত্রা ছাড়া।
অনিরুদ্ধ গুম হয়ে গেল। তাহলে কী বন্ধুরাই ঠিক? কাকাও তো বলছিলেন অ্যাসাইল্যামে দিতে। ভালো কিছু হবে না এর থেকে। অনিরুদ্ধর অবাক লাগে। আগের রবিবারগুলোতে ও পাশের ঘরে বা স্টাডিতে থেকেও এই মাত্রাছাড়া ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। অনিরুদ্ধরও কী দোষ নেই তাহলে? নিজে চেষ্টা করে না দেখে হাল ছাড়তে চায় না অনিরুদ্ধ।
-নীরা,বাবিন খেয়ে নিয়েছে। চলো এবার তুমি খাবে চলো।
অনিরুদ্ধ নরম সুরে বলল।
-আরটু খাবে যে।
-আচ্ছা। বলছে তোমায়?
-হ্যাঁ। মুখটা দেখো,পেট ভরেনি।
-আরটুই কিন্তু। ব্যস। এবার চলো।
-এখানেই আনো না।
অনিরুদ্ধ বললো,
-বাবিন খেলো,ঘুমাবে না একটুও? ও রেস্ট করুক। আমরা খেয়ে আসি। না হলে বিরক্ত হবে।
এই কথাটা নীরার মনে ধরলো,
-চলো।
অনিরুদ্ধদের মূল ডাইনিং হল নীচতলায়। নীরাকে নীচে নামিয়ে নিয়ে আসার নাই অনিরুদ্ধ এই ট্রিকটা করলো,না হলে রোজই তো ঘরে খায়। নীরার এঁটো হাত ধুইয়ে নীচে যেতে বলতেই নীরা বলেছিলো,
-নীচে গেলে তো চেঞ্জ করতে হবে অনি। ঘরে পরার শাড়ি...
-করে নাও।
-শাড়ি?
-চলো,আমি খুঁজে দিচ্ছি।
অনিরুদ্ধ নীরার কাবার্ড খুলে শাড়ি,ব্লাউজ,সায়া খুঁজে দিয়েছিলো। এই শাড়ির আলমারি ভীষণ গোছানো থাকতো অথচ বছর দেড়েক কোন শাড়িতে হাত পড়েনি।
-নাও,পরে নাও।
-তুমি বাইরে যাও।
অনিরুদ্ধ হেসেছিলো,
-যাচ্ছি। কিন্তু কুঁচি ধরতে হলে?
-ডেকে নেবো। এখন যাও। কুঁচি ধরতে ডাক পড়েছিলো। অনিরুদ্ধ এটা বরাবরই করে দেয়। আজ কুঁচির সাথে সাথে চুলটাও আঁচড়ে বেঁধে দিলো নিজে হাতে।
-এটাও পারো?
-মায়ের করে দিতাম। আর সব কিছু শিখে রাখা ভালো।
নীরা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিলো।
-অত কী দেখছো? সাড়ে সাত বছরের পুরনো বর তোমার।
নীরা লজ্জা পেয়েছিলো,
-সিঁদুরের কৌটটা দাও।
-দাঁড়াও।
অনিরুদ্ধ নিজের হাতে সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছিলো। পরপর দুই বছর বাড়ির পুজোয় নীরা যায়নি। বরণ করেনি,সিঁদুর খেলেনি। অতীন অনুপমের স্ত্রীদের যখন ওরা নিজে হাতে সিঁদুর পরিয়েছে-অদ্ভুত একটা শূন্যতা ভিড় করেছিলো অনিরুদ্ধর বুকে। আজ যেনো কষ্টটা কমলো। নীরা নমস্কার করতে গেলে থামিয়ে দিলো অনিরুদ্ধ। এটা ও কোনদিনই পছন্দ করে না। বিয়ের সময় স্ত্রী আচারে বাড়ির সবার সামনে দুই একবার হয়তো নীরার প্রণাম নিয়ে ফেলেছে-কিন্তু একান্তে কখনোই নয়। নীরার কপালে চুমু খেলো অনিরুদ্ধ।
-নেকলেসটা পরিয়ে দাও।
নীরা আব্দার করলো। অনিরুদ্ধ খুশি হলো। নেকলেস পরিয়ে দিয়ে বললো
-দেখো,কী সুন্দর লাগছে তোমাকে।
নীরা দেখলো। আয়নায় বহুদিন দেখেনি ও নিজেকে।
-দুজনকে একসাথে কত ভালো লাগে,তাই না নীরা?
-আর বাবিন?
অনিরুদ্ধ মনের কষ্টটা মুখে আনলো না।
-তাহলে পরিপূর্ণতা আসে।
হঠাৎ পরীর গলায় জেঠুমণি ডাক শুনে চমকে তাকালো অনিরুদ্ধ। পরী এসেছে। মণিপিসির সাথে দোতলাতেও চলে এসেছে। ঢুকতে গিয়েও জেঠিমণিকে দেখে থমকে গেলো পরী। জেঠিমণি খুব রাগী আর চুপচাপ। মায়েরা বলে,ও তো তেমন করে দেখেইনি। পুজোতেও আসে না জেঠিমণি। অনিরুদ্ধ পরীকে দেখে ভীষণ খুশি হলো,
-পরী,আয় ওখান দাঁড়িয়ে কেন?
নীরা দেখালো পরীকে। অতীনের মেয়ে,বছর তিনেকের হয়ে গেছে। মনে হয় ওকে দেখে ভয় পাচ্ছে।
-তুমি গিয়ে কোলে করে নিয়ে এসো।
অনিরুদ্ধ তাই করলো
-কে দিয়ে গেলো?
মণিপিসি বললো,
-অতীন আর বৌমা। ওরা হাসপাতালে যাচ্ছে। অনুপমের ছেলে দেখতে। এত ছোট বাচ্চা তো...
-ও। বাহ খুব ভালো করেছে। কাকিমণিও ওখানে?
-হ্যাঁ,নীরাকে নিয়ে নীচে এসো অনি। খাবে তো।
অনিরুদ্ধ কোলে করে পরীকে নিয়ে নীরার কাছে এলো।
-জেঠিমণিকে চিনিস পরী?
-জেঠিমণি তো পুজোয় যায় না। দেখিনি।
নীরা হেসে ফেললো,
-খুব টরটরে তো?
-একদম। সারা পুজো আমার কোলে থাকে।
জেঠুমণি কী বলো তো পরী?
-বেস্ট।
অনিরুদ্ধ পরীর দু’গালে চুমু খেলো,
-জেঠিমণির কোলে যাবে? ইচ্ছা করেই বললো অনিরুদ্ধ। পরীর অমত ছিলো না। জেঠিমণিকে দেখে মোটেও রাগী মনে হচ্ছে না। খুব সুন্দর দেখতে।
নীরা হাত বাড়ালো,
-এসো।
পরী নীরার কোলে চলে গেল। নীরা বললো,
-কী মিষ্টি দেখতে হয়েছে। অনি,বাবিন রাগ করবে না তো?
পরীর মুখের অবাক ভাব দেখে অনিরুদ্ধ সামলালো,
-বাবিনের বোন তো। রাগ করবে কেন?
পরীর মায়ের কাছ থেকে শোনা যে জেঠুমণির ছেলের নাম বাবিন,যে নাকি নেই। জেঠুমণি ঐ দাদাটার কথাটাই বলছে?
-তাও। জানোই তো কী হিংসুটে। মামণির কোলে আর কেউ ...
-ওসব ভেবো না। বাবিনকে আমি বুঝিয়ে দেবো। তোমার আদর করতে ইচ্ছা হচ্ছে খুব বুঝেছি,করো।
জেঠিমণি এবার সত্যিই আদর করল পরীকে। অনেক করে। কিন্তু যে নেই তাকে জেঠুমণি বোঝাবে কী করে? কথাটা জেঠুমণিকেই জিজ্ঞাসা করবে পরী,পরে।
-পরী,এবার দেখলি তো জেঠিমণি রাগী না একটুও।
অনিরুদ্ধ নীরার কোলে পরীকে দেখে খুব খুশি ছিল মনে মনে। পরী এভাবে এলে ভালোই হয়। নীরার সাথে থাকলে নীরার একাকীত্ব কমবে।
-পরীকে মাঝে মাঝে আনতে পারো তো এখানে।
নীরা নিজেই কথাটা তুললো।
-আচ্ছা,কাকিমণিকে বলে আনাবো।
নীরার বেশ মনে ধরেছিল ফুটফুটে মেয়েটাকে।
-আমি একাই আদর করবো। পরী আমাকে আদর করবে না?
নীরা পরীর চোখে চোখ রেখে বললো। পরী অনিরুদ্ধর দিকে তাকালো। অনিরুদ্ধ বললো,
-হামি চাইছে জেঠিমণি।
পরী জেঠিমণিকে আদর করলো। তারপর জেঠুমণিকেও। নীরা হেসে ফেললো,
-দেখেছো-দুজনকেই আদর করে। বুদ্ধি আছে পরীর।
অনিরুদ্ধ পরীকে কোলে নিলো এবার।
-চলো,নীচে যাই-খাবে তো।
নীরা বললো,
-পরী খেয়ে এসেছে?
-খেয়েছি।
-আবার খাবি চল।
অনিরুদ্ধ বললো,
-আবার? মা তো নেই? খাওয়াবে কে?
নীরা বললো,
-চলো,আমি খাওয়াচ্ছি। বাবিনদাদাকেও তো আমিই খাওয়াই। তাই না অনি?
-একদম। চলো।
পর্ব-সাত
রাতে ঠাম্মার কাছে শুয়েছিলো পরী। ঠাকুরদাদা একই ঘরে অন্য খাটে ঘুমোয়। পরী বেশীরভাগই ঠাম্মার কাছে থাকে। ঠাম্মা পরীকে নানারকমের গল্প বলে। ও ঘরে মা,বাবা,দাদা-ওরা তেমন গল্প বলতেই চায় না। দুপুর থেকে ঠাম্মাকে একটা কথা বলবে বলে উসখুস করছিলো পরী। সুহাসিনী শুতে এলেই বললো,
-ঠাম্মা জানো,আজ জেঠিমণির কাছে ছিলাম ক-তক্ষণ।
-তাই? জেঠিমণি ভালো?
-খু...উ...ব।
-বাহ।
-জেঠুমণি,জেঠিমণি দুজনেই খুব ভালো। দারুন দারুন গল্প বলে। জেঠুমণি খেলেওছে আমার সাথে। জেঠিমণি বসে দেখেছে আর হেসেছে।
সুহাসিনী বুঝলেন পরীকে অনির হাতে সঁপার জন্য অচুতের চালটা নীরার সুস্থতার জন্যও মন্দ কাজ করছে না। নীরা খুব ভালো মেয়ে। বিয়ে হয়ে এসে থেকে শাশুড়ির সবটুকু সম্মান সুহাসিনীকে দিয়েছে। কাকিশাশুড়ি যে-বুঝতে দেয়নি।
-জেঠিমণি তাহলে রাগী না। দেখলি তো?
-একটুও না। তবে খালি বাবিনদাদার কথা বলে।
-সুহাসিনী বুঝলেন যে রটনাগুলো ঘটনা। বাবিনের শোক এখনও অতিক্রম করতে পারেনি নীরা।
-বলবেই তো। বাবিনদা জেঠিমণির ছেলে ছিলো যে,
-কোথায় চলে গেছে, ঠাম্মা?
-অনেকদূরে,যেখান থেকে কেউ ফেরেনা।
-কিন্তু জেঠিমণি যে বললো বাবিনদাদাকে খাওয়ায়...
-পরী তুমি আমার ভালো দিদিভাই তো?
-হ্যাঁ,ঠাম্মা। তাহলে জেঠিমণিকে বাবিনদাদা নিয়ে কিচ্ছু বলো না কেমন?
-আচ্ছা। ঠাম্মা-ভাইটা কেমন হয়েছে গো?
-সুন্দর হয়েছে।
-আমার চেয়েও?
সুহাসিনী হেসে ফেললেন,
-তা হয়? আমার দিদিভাই সবচেয়ে সুন্দর।
-শুধু তুমিই বলো। মা,বাবা,ঠাকুরদাদা,কাকা সব্বাই দাদাভাইকে বেশি ভালোবাসে।
সুহাসিনী বুঝলেন এইটুকু বাচ্চার নজরে কিছু এড়ায় না।
-ঠাম্মা কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে?
পরী ঠাম্মার গলা জড়িয়ে ধরে,
-পরীকে।
-কেন?
-ঠাম্মার যে আমি একমাত্র দিদিভাই,তাই।
সুহাসিনী নাতনির কপালে আদর করে দেন।
-ঠিক। আর পরী একদম আমার মতো,তা-ও।
-দেখতে তো? সব্বাই বলে।
সুহাসিনী হাসল,
-বলবেই,আমার পরী আমার ছাড়া কার মতো হবে?
-মা?
বড় বৌমার গলা পেয়ে তাকালেন সুহাসিনী।
-পরী ঘুমোয়নি?
-না-এই ঘুমোবে।
-এখনো গল্প? কত রাত হলো? কাল স্কুল আছে।
পরী প্রাণপণে চোখে বন্ধ করেছিলো। সে একটা প্লে স্কুলে যায়,তা নিয়েই মা-বাবার চিন্তার অন্ত নেই।
-ঘুমোবে,তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। স্কুলে ঠিক পৌঁছবে। চিন্তা নেই। সুহাসিনীর গলার ভারী ভাব পরীর মা’কে ঘর থেকে চলে যেতে বাধ্য করলো। সুহাসিনী দাপুটে শাশুড়ি। বৌমারা কথা বলার সাহস পায় না। পরীর মা চলে গেলে সুহাসিনী বললেন,
-চোখ খোলো দিদিভাই। চলে গেছে।
পরী ফিক করে হাসলো।
-যাবে না! কী বকাটাই না খেলো আমাকে বকতে এসে।
-এমন বলে,পাকা বুড়ি? মা হয় যে।
পরী ঠাম্মাকে আঁকড়ে ধরে। বুকে মুখ গুঁজে দেয়। বলতে চায় ঠাম্মা থাকতে ও কাউকে চায় না। সুহাসিনী জানে কথাটা। সত্যি পরীটাকে হাতে করে সুহাসিনীই মানুষ করেছেন। অতীনের বৌ জিনা ছেলে নিয়েই ব্যস্ত। ছেলে আর বর। মেয়েটাকে তাই শাশুড়ির জিম্মায় দিয়ে নিশ্চিন্ত। সুহাসিনীরও মন্দ লাগে না। পরীটাকে ছেড়ে একমুহূর্ত ভালোও লাগে না ওনার। অনেকদিন বাঁচতে চান এখন। পরীটাকে মানুষ না করা অবধি মুক্তি নেই।
পর্ব-আট
-সময় নেই বললেই হবে? সময় বার করতে হবে।
শাঁওলির কথা শুনে অনিরুদ্ধ বেশ মজা পায়। ছোট মুখে বড় কথা বলে ধমক দিতে চাইলেও,পারে না। হেসে ফেলে।
-কিসের সময় শুনি?
-বেরোবার।
-কোথায়?
-কোথাও।
-আর অফিস?
-দেখো,সেদিন একে মিথ্যা বলেছো...
-মিথ্যা?
-হ্যাঁ। তুমি বললে তুমি অফিসে কাজ করো। অথচ তুমি ঐ পেল্লায় দোকানটার মালিক। এরকম নাকি আরো কুড়ি-বাইশটা আছে।
অনিরুদ্ধ হেসে ফেলল।
-কে বললো? প্রতীক?
-হ্যাঁ। মিথ্যা বলা মহাপাপ। জানো না।
-জানি তো। সরি।
-কমপেনসেট করো আগে।
-বেড়িয়ে?
-নিজের জন্য। আমার জন্য থোড়ি? বৌদিকে নিয়ে গেলেও হবে। কিন্তু ঐ অফিস,মিটিং থেকে বেরোতে হবে তোমাকে।
-বেশ, বেরবো।
-প্রমিস কিন্তু।
-প্রমিস। তোর স্কুলেই যাবো আগে।
-এমা না,না।
-কেন রে? এই তো সেদিনই বললি আসতে।
-তখন আমি থোড়ি জানতাম তুমি দি অনিরুদ্ধ মুখার্জ্জী? তোমার মত নামী লোক এলে হ্যাপা অনেক।
-নামী কেন তোর দাদা হয়েই আসবো তো?
-আমার দাদা আছে।
অনিরুদ্ধ হেসে ফেলে,
-দাদা করবি না তাহলে?
-আসবো। দাঁড়া ফোন আসছে একটা।
-ওকে টা টা।
অনিরুদ্ধ ফোনটা কাটলো। ডাক্তারকাকার ফোন। ধরলো।
-হ্যাঁ ডাক্তারকাকা।
-অনি নীরাকে সময় দিয়ে রেজাল্ট?
-ভালো। তবে...
-তবে,বাবিনের ব্যাপারটায় কোন উন্নতি নেই। দুপুরে বাবিনের সাথে কথা বলা,খাওয়ানো,কান্না...
-বুঝি...। আর তোমাদের...ইউ নো
-না সেসবের ইচ্ছে নেই। আমিও জোর করিনি।
-সন্তান নেবার প্রস্তাব?
-দিয়েছি। কিন্তু তার উত্তর হলো-বাবিনকে এনে দিতে হবে,আগে।
-জটিল ব্যাপার। যাকগে ডাক্তার চক্রবর্তী একবার ডেকেছেন তোমায়। নীরার কেসটা নিয়ে আমেরিকান মেন্টাল হেলথ অ্যাসোসিয়েশনে আলোচনা হয়েছে। সিমিলার কেস হিস্ট্রি পাওয়া গেছে। ঐ নিয়েই কথা বলতে চান।
-বেশ,কখন?
-সন্ধ্যা ছ’টায়।
-আসবো।
-রাখছি?
-রাখো।
সিমিলার কেস হিস্ট্রি! সলিউশন কী পাওয়া যাবে? অনিরুদ্ধ জানে না। জানতে চায় তবে।
-সলিউশন আছে। ব্রাউনি দম্পতি এটা একিসকিউটও করেছেন সাকসেসফুলি।
ডক্টর চক্রবর্ত্তীর কথা শুনে কৌতুহলী হলো অনিরুদ্ধ।
-ব্রাউনি দম্পতি?
-হ্যাঁ-ঐ সিমিলার কেস,বললাম না?
-ওদেরও কি ফার্স্ট চাইল্ড বাবিনের মতো...
-একস্যাক্টলি। সিডিতে এটাই আছে। আমি আপনাকে দেবো। বাড়িতে গিয়ে দেখবেন। তাও জিস্টটা বলছি। নীরার মতোই অবস্থা হয়েছিলো মিসেস ব্রাউনির। ওদের সাইক্রিয়াট্রিস্ট ডক্টর থমসন অ্যাসাইলামে দেওয়ারআগে একটা জুয়া খেলেন,অ্যান্ড দ্যাট পেইড অফ।
-জুয়া?
ডাক্তারকাকা অবাক হন।
-হ্যাঁ,জুয়াই। আ বিগ গ্যাম্বেল। মি.ব্রাউনিকে বোঝান যে তার ওয়াইফের নতুন সন্তানের প্রয়োজন নেই। আগের সন্তানটিকেই প্রয়োজন। তাই যদি তার মতো কাউকে...
-তার মতো? কি করে? লুক ওয়াইজ সিমিলার।
-পাওয়া যায়?
-খুঁজলে বাঘের দুধ মেলে ডক্টর ব্যানার্জ্জী। তবে বয়সটাও কাছাকাছি হতে হবে। মানে বাবিনের রিপ্লেসমেন্ট যদি আমরা খুঁজি তবে সাড়ে চার প্লাস দের...ছয়ের আশপাশে খুঁজবো।
অনিরুদ্ধ আকাশ থেকে পড়লো।
-বাবিনের রিপ্লেসমেন্ট খুঁজবো? কোথায়?
-কোন অরফ্যানেজে
-খুঁজে? তাকে বাবিন বলে নিয়ে যেতে হবে নীরার কাছে?
ডক্টর চক্রবর্ত্তী হাসলেন,
-একস্যাকটলি।
-এতো মিথ্যা!
-তাই তো জুয়ো। তবে মিথ্যাটাকে সত্যি বলে প্রকাশ করতে হবে। আর মানতেও হবে।
ডাক্তারকাকা বললেন।
-খুব শক্ত কাজ। অনি,পারবি তুই?
অনিরুদ্ধর জন্মকালের সংস্কার ওকে দিয়ে বলিয়ে নিলো।
-না,না-তা হয় নাকি। অরফ্যানেজের কার না কার বাচ্চা...তাকে বাবিন বলে মেনে,নীরার কাছে নিয়ে যাওয়া...অসম্ভব।
ডক্টর চক্রবর্ত্তী হাসলেন,
-জানতাম,আপনি অর্থোডক্স ফ্যামিলিতে মানুষ। কৌলীন্যবাদী। এমন চিন্তাভাবনা থাকবেই। তাহলে আর কি-নীরাকে আর একটু বেশি ওষুধ দিই-আর অপেক্ষা করি কবে অ্যাসাইলামে যাওয়ার মতো ডিটোরিয়েট করে। কারণ আমেরিকার সাইক্রিয়াট্রিস্টদেরও সেকেন্ড অপিনিয়ন এটাই।
অনিরুদ্ধ প্রথমে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলো। নিজের ব্যবসায়ীক বুদ্ধি দিয়ে নিজেকে শান্ত করলো,
-আমাকে একটু ভাবতে সময় দিন।
-ভাবুন। আপনি প্রস্তুত না থাকলে এই নাটকের অবতারণা করাই যাবে না।
-মিসেস ব্রাউনি এখন সুস্থ?
-সম্পূর্ণ। সিডিতে দেখবেন। যাকে এডপ্ট করে এনেছিলো সে তো খুশি বটেই,পরে আবার সন্তান হয়েছিল।
-আমি পরের ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত নই ডাক্তারবাবু। যাকে আনবেন-তাকে আমার জেনে,মেনে,বুঝে দায়িত্ব নিতে পারলে তবেই আনবো। নীরাকে সুস্থ করতে একটা জীবনকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করতে হবে। আমার অর্থোডক্স মেন্টালিটি এই টোপ দেওয়া ব্যাপারটাকেও ঠিক মানতে পারছে না।
ডক্টর চক্রবর্ত্তী বললেন,
-আগে আপনাকে তাকে সন্তান হিসাবেমানতে হবে মিস্টার মুখার্জী। এডপ্ট করতে হবে। বাকি ব্যাপার পরে হবে।
-ঠিক আছে। কয়েকটা দিন সময় দিন আমাকে। সিডিটা দেখি। মনকে কয়েকটা প্রশ্ন করি,জানাবো।
-নীরাকে কিন্তু এসব কিছুই বলবেন না।
-নিশ্চিন্ত থাকুন আপনার রুগী কিছু জানবে না এসবের।
অনিরুদ্ধ উঠে দাঁড়ালো।
-চলি,
ডক্টর চক্রবর্ত্তী ঘাড় নাড়লেন,
-আসুন।
পর্ব-নয়
প্রস্তাবটার বাস্তবতা নিয়ে সন্দেহ ধীরে ধীরে কাটছিলো অনিরুদ্ধর। সিডিটা ভালো করে দেখলও। যা দেখাচ্ছে- তাতে পরিবারটা সুখেই আছে বেশ। একইরকম দেখতে বাচ্চা পাওয়া যাবে কী? পেলেও যেটা মূল সমস্যা তা হলো পরিবারকে মানানো। নীরার মা-বাবা মানলেও কাকিমণিরা... নাহ,কাকিমণি মানলেও বাকি কেউ মানবে বলে মনে হয় না। জাত,কুল,ধর্ম ইত্যাদি নানা অজুহাত তুলবে। যৌথ পুজো,পরীর আসা-যাওয়া-সবই বন্ধ হবে। অথচ এই জুয়োটা সফল হলে আবারো সব ঠিক হয়ে যাবে।
-কী এত ভাবছো? নীরার গলা পেয়ে তাকালো অনিরুদ্ধ। নীরার ঘরেই শুয়েছিলো ও। ঘুম আসছিলো না।
-কিছু না। তুমি ঘুমাও।
-ব্যবসার চিন্তা?
অনিরুদ্ধ ঘুরলো নীরার দিকে,
-না তো
-তবে?
-এমনি। পরী এসেছিল আজ?
কথা খুঁজে না পেয়ে বললো অনিরুদ্ধ।
-হ্যাঁ,দুপুরে ছিল।
-একা?
-হ্যাঁ। আমার কাছেই ছিলো।
-ঘুম?
-এখানেই,দুজনকে দুপাশে নিয়ে ঘুমোচ্ছিলাম।
অনিরুদ্ধ খুশি হলো।
-পরী যদি আমাদের মেয়ে হতো ভালো হতো না?
-তোমার মেয়ের খুব শখ তাই না?
-হ্যাঁ,পরীর মতো মেয়ে,ভালোই তো।
-বাবিন আসুক।
-তারপর মেয়ে দেবে একটা?
অনিরুদ্ধ হেসে বললো,
-পরীকে রেখে দেবো না হয়,হবে?
অনিরুদ্ধ যে মনে মনে তা চায় না তা নয়। কিন্তু ও বাড়ি থেকে ছাড়বে না।
-এ ক’দিনেই বেশ মায়ায় জড়িয়েছে তোমায় বুঝতে পারছি।
-ভারী মিষ্টি।
-তোমার না মেয়ে পছন্দ নয়?
-পরীকে দেখে মনে হচ্ছে-এমন একটা মেয়ে থাকলে ভালো হয়। অবশ্য বাবিন না চাইলে...
অনিরুদ্ধ সায় দিলো,
-সেটাও কথা। আজ কথা হয়েছে দুষ্টুটার সাথে?
-হ্যাঁ...বলছিলো বাপি যে এখন এ ঘরে আসে সবাই এক খাটে ঘুমোয়-এটা ওর ভালো লাগে।
অনিরুদ্ধ বুঝলো নিজের মনের ভাবনা বাবিনকে দিয়ে বলায় নীরা।
-বাপিকে তো ভয় পায় বেশ।
-হ্যাঁ-তুমি শাসন করো যে।
-অনিরুদ্ধ হাসলো,
-ওকে বলে দিও তো এলে আর শাসন করবো না।
-বলবো?
-একদম।
-তুমি ঠিক করে খুঁজছো তো অনি?
অনিরুদ্ধ বুঝলো নীরার মন খুব ভালো এখন। নাহলে সচরাচর নাম ধরে না।
-সবরকম ভাবে খুঁজছি।
-তাহলে এই যে আগে বলতে ফিরবে না?
-ভুল ছিল সেসব নীরা বললাম তো।
-খুঁজে পাবে?
-মনে হচ্ছে। পেলে তুমি নেবে তো নীরা?
নীরা অবাক হয়,
-নেব না! আমার বাবিনকে নেবো না কেন?
-না, কোথায় না কোথায় ছিলো-বড় হয়ে গেছে-হয়তো দেখতেও একটু বদলেছে...এই সময় মুখের পরিবর্তন হয় তো।
ডক্টর চক্রবর্ত্তীর প্ল্যানের পথ পরিষ্কার করে অনিরুদ্ধ।
-হোক না। আমি তো মা,ঠিক চিনে নেবো।
ওটাই তো ভয়। মনে মনে বললো অনিরুদ্ধ।
পর্ব-দশ,
-পরীকে দাদাভাই-এর বাড়ি ইমপ্ল্যান্ট করার প্ল্যানটা তো ভালোই চালাচ্ছো।
অনুপমের মুখে এমন কথায় অচ্যুত,অতীন দুজনেই থমকে গেলো। অনুপম এমনই। নিজের মরজির মালিক। ব্যবসায় মন নেই। মা’কে ভয় পায় কেবল। সুহাসিনী ছোট ছেলের লাগাম ধরলেন,
-বাবার সাথে কথা বলছো,খেয়াল আছে।
-আছে মা। বাবার শুধুই বড় ছেলে। আর দাদারও সবসময় ধান্দাবাজি
অতীন রাগ দেখলো,
-বাবা দেখেছো। কী ভাষা তোমার ছোট ছেলের।
-ভাষা থেকে কি ভালো হবে। পরীর জন্য যেটা ভাবছো সেটা আমার ছোট ছেলেটার জন্যও তো ভাবা যেত। সদ্য হয়েছে। বৌদিমণি নিজে হাতে গড়ে নিতে পারতো। বাবিন ভেবেই গড়ে নিতো।
অচ্যুত বললেন,
-কী বলছিস ছোট খোকা। বাড়ির ছেলে দেওয়া যায় নাকি? পরী নেহাত...
-মেয়ে তাই তো?
সুহাসিনী বললেন।
-তা পরীকেও যে তার ঠাম্মা কাউকে দিতে দেবে ভাবলে কী করে?
অতীন বুঝলো এবার থামাতে হবে।
-আঃ মা,বাবা। এত গাছে কাঁঠাল,গোঁফে তেল দিয়ে লাভ নেই। বৌদিমণি সুস্থই নয়।যদি সুস্থই না থাকে তাহলে কাউকে নেবেই বা কী করে।
-সুস্থ হলে তো নিজেরটাই নিয়ে নেবে। গাধা।
অচ্যুত ধমকে বললেন।
-যা করার এর মধ্যেই করতে হবে।
-তুমি কি পরীকে পাকাপাকি ভাবে দিতে চাইছো নাকি?
সুহাসিনী বললেন।
-অনি নিতে চাইলে ক্ষতি কী? আর পরীও তো এখন জেঠিমণির সাথে ভালো মিশে গেছে।
ওসব চিন্তা মনেও এনো না। ঘুরতে দেওয়া আর একেবারে দেওয়ার ফারাক আছে।
-আহ! সবেতে নাক গলাও কেন বলো তো? যদি বড় খোকার আর বৌমার সমস্যা না থাকে তাহলে...?
সুহাসিনী খাবার রেখে উঠে চলে গেলেন। অনুপম ডাকলো,
-মা...
-যেতে দে। তেজ কমলে নিজেই খাবে।
অচ্যুত খাওয়ায় মনোনিবেশ করলেন।
সুহাসিনী রাতে শুয়ে নাতনিকে কোলের মধ্যে টেনে নিলেন।
-ঠাম্মা...
-পরী জেগে এখনো?
-হ্যাঁ তুমি কেঁদো না। আমি তোমায় ছেড়ে কোথাও যাবো না।
সুহাসিনী চোখের জল মুছলেন।
-কে বললো তোকে?
-দাদাভাই। মা বাবা এসব বলেছে,ও শুনেছে।
সুহাসিনী নিজের অবোধ নাতনিটাকে অনেক আদর করে দিলেন। মা বাবার কাছে ও কত অবাঞ্ছিত-এখন বুঝলেও পরে বড় হয়ে বুঝতে পারবে।
-জেঠুমণি,জেঠিমণি খুব ভালো ঠাম্মা।
-জানি তো।
আমাকে জেঠিমণিও সারক্ষণ যত্ন করে। মাটিতে পাই ফেলতে দেয়। আমি ওখানে যাই তো। কিন্তু ওরা যদি তোমাকেও নিয়ে যায়-তাহলেই পুরোপুরি যাবো। সুহাসিনী হেসে ফেললেন,
-কেন রে?
-ওদের তো মা-ও নেই সুহাসিনী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অনির মতো ছেলের মা হবার কপাল ওনার নেই। অথচ সবাই বলে যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা অনি স্বভাবটা সুহাসিনীর মতোই পেয়েছে। শান্ত,ভদ্র-অথচ দৃঢ়। সুহাসিনী যখন বিয়ে করে এলেন অনি তখন বছরখানেক। দিদিভাই মানে অনির মা খুব সুন্দরী ছিলেন। নিজের সাজগোজ,ঘোরাফেরা,কিটিপার্টির ব্যস্ততা ওনার সবসময় থাকতো। তাছাড়া,প্রথম সন্তান মারা যাওয়ার পর সংসারের প্রতি আরো উদাসীন হয়ে যান দিদিভাই। প্রথম সন্তানও ছেলে ছিলো। অনির দাদা। সুহাসিনীর বিয়ের মাস দুয়েক আগে মারা যায়। তাই শ্বশুর-শাশুড়ি তড়িঘড়ি ছোট ছেলের বিয়ে দেন। অনিকে সামলানোর জন্যই বেশি করে। অনিকে সেই অর্থে সুহাসিনীই মানুষ করেছেন। অথচ সুহাসিনীর সে স্বীকৃতি কোথায়।
-আমি তো বড়,আমাকে নেবে কী করে?
-তুমি যাবে? জেঠুমণিকে বললেই নিয়ে যাবে।
সে কথা সুহাসিনীও জানেন। দুর্গাপুজোতে যে অনি এখনও আসে কাকিমণিকে দেখতে পাবে বলেই। কাকিমণির ইচ্ছা আছে বলেই।
-বেশ,তোর সাথে যাবো।
-সত্যি?
-কাল যাবো। ও বাড়ি। তোকে নিয়ে।
পরী খুশি হলো খুব। ঠাম্মার সাথে ও বাড়ি বেড়াতে যাবে কাল। কী মজা! জেঠুমণি,জেঠিমণি,ঠাম্মা-তিনজনই খুব ভালো। পরীর তিনজনকেই চাই।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন