কাজী রুনালায়লা খানম

' ধর্মে ও রাজনীতিতে মৌলবাদ :- সভ্যতার সংকট'
"ধ্রীয়তে ধর্ম ইত্যাহুঃ স এব পরম প্রভূঃ। " ____ধারণ করে বলে সাধারণে তাকে ধর্ম বলে। পূণ্য -পাপ -ন্যায় -অন্যায় -ভালো -মন্দ -সুন্দর -অসুন্দর সমস্তই যা ধারণ করে তাইই ধর্ম। ধর্মই জগতের ধারক, ধর্মই সুখের আকর। মানুষের ধর্ম যেমন আছে তেমনই আছে ধর্মজ্ঞান। যা অন্য কোন জীবের নেই। আর এই ধর্মজ্ঞান আছে বলেই মানুষ শ্রেষ্ঠতম প্রাণী।

ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে বেপথুমান মানুষকে, উদ্ভ্রান্ত মানুষকে সুশৃঙ্খলিত করে একটা স্থিতিশীল, সাম্যাবস্থায় সমাজকে ধরে রাখার জন্য। যখনই এই পৃথিবীতে নেমে এসেছে ''আইয়ামে জাহেলিয়াত'', মানবিক গুণাবলি বিনষ্টির মুখে পড়েছে, পাশবপ্রবৃত্তি মাথা চাড়া দিয়েছে ঠিক তখনই কোন না কোন মহাপুরুষ আবির্ভুত হয়েছেন মানুষকে সঠিক দিশা দেখাতে। গীতায় আছে "যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত। অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।। পরিত্রানাং সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাং ধর্মস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।" কিন্তু সময়ান্তে দেখা গেছে এই ধর্মই বহিরঙ্গিক আচারসর্বস্বতার পাঁকে হারিয়ে ফেলেছে তার চলার গতি, সহজ স্বাচ্ছন্দ্য। সেখানেই ধর্ম মহিমা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে, হয়েছে প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন। যদিও সব ধর্মের মূল লক্ষ্য মোক্ষলাভ বা ঈশ্বরপ্রাপ্তি। তবু প্রতিটি ধর্মের অনুসরণকারীরা কখনোই সহমত হতে পারেন না, আর পারেন না বলেই পৃথিবীতে ধর্মের নামে এতো রক্তপাত। পৃথিবীতে প্রায় 1009 টি ধর্মের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায় এবং প্রতিটি ধর্মানুসরণকারী মানুষ নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের দাবীতে সোচ্চার। প্রত্যেকেই মনে করেন তাঁর ধর্মমতই অভ্রান্ত ও চরম। এ ব্যাপারে ঈশ্বরবাদী ও নিরীশ্বরবাদী উভয়ই সমান। ধর্মের ধ্বজাধারী যাজক -পুরোহিত -মোল্লা -গুরু সকলেই বিশ্বাস করেন এবং সদম্ভে প্রচার করেনএকমাত্র ধর্মীয় অনুশাসনই ইহজাগতিক ও পারলোকিক মুক্তি ও কল্যাণের একমাত্র পথ। তাঁরা যেহেতু মনে করেন তাঁদের ধর্মগ্রন্থগুলি ঐশী তাই তা অপরিবর্তনীয়। এর কোন সংশোধন বা পরিমার্জন করার এক্তিয়ার মানুষের নেই।

আধুনিক জীবনজিজ্ঞাসা ও যুক্তিবিজ্ঞানের যতোই পরিপন্থী হোক, যতোই সঙ্গতিবিহীন হোক এই গ্রন্থগুলির অনুশাসনের মানদন্ডেই সমাজ পরিচালিত হবে। রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণেও এই গ্রন্থগুলি অন্যতম নিয়ামক শক্তি হিসেবে কার্যকর। আর ধর্মনীতির কঠোরতার জমিতেই জন্ম নেয় fundamentalism তথা ধর্মীয় মৌলবাদ। সুতরাং একথা অনস্বীকার্য যে ধর্মীয় অন্ধ বিশ্বাসই ধর্মীয় মৌলবাদের সূতিকাগার। মৌলবাদের সাথে সাম্প্রদায়িকতার সম্পর্কটিও অচ্ছেদ্য। ধর্মীয় মৌলবাদের মূলে রয়েছে মানুষের চিন্তার জঙ্গমতা। একটি বিশেষ অনুশাসনকে আঁকড়ে ধরে অন্য সবকিছু থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মৌলবাদ পক্ষান্তরে সংকীর্ণতারই জন্ম দেয়। ভারতবর্ষ মূলত: সনাতন হিন্দুধর্ম, খ্রীষ্টান, ইহুদী, ইসলাম, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের বাস। সনাতন হিন্দুধর্মাবলম্বীরা দাবী করেন সমসাময়িক চিন্তাচেতনার সাথে তাঁরা ধর্মীয় অনুশাসনগুলির সংস্কার করেছেন,, যেখানে ইসলাম ও খ্রীষ্টান ধর্মানুসারীরা মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণা থেকে একচুলও সরে আসতে পারেনি। এ কথার মধ্যে আংশিক সত্য স্বীকার করে নিয়েও বলা যায় কোন ধর্মই পরিবর্তিত চিন্তাচেতনা ও যুগমানসের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম নয়। 

তবে একথাও জোরালোভাবে উল্লেখের দাবী রাখে যে, মৌলবাদ কেবলমাত্র ধর্মকে কেন্দ্র করেই জন্ম নেয়নি। দেশে দেশে কালে কালে সমাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতিতেও মৌলবাদের পরিপুষ্টি ঘটেছে। বর্তমান সময়ে দেশজুড়ে রাজনৈতিক দলগুলির অসহিষ্ণুতার চরম প্রকাশ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে রাজনৈতিক মৌলবাদের কদর্য মুখ। আর সবচেয়ে মর্মান্তিক সত্যটা হলো সমাজের সাধারণ মানুষ যুগ যুগ ধরে এইসব মৌলবাদের যুপকাষ্ঠে বলিপ্রদত্ত্ব হয়ে আসছে।

প্রকৃতির রুদ্র শক্তির হাত থেকে পরিত্রাণ লাভের উদ্দেশ্যে মানুষ ধর্মের ছায়াতলে একতাবদ্ধ হলেও কালক্রমে এই ধর্মই মানুষকে সবচেয়ে বেশি বিভাজিত করেছে। ধর্ম আর রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের ওপর ক্ষমতা ও আধিপত্যবিস্তারের ক্ষেত্রে একে অপরের পরিপূরক হয়ে পরস্পরের হাতকে বলিষ্ঠ করেছে।

একটি বিষয় উল্লেখ না করলে আলোচনাটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তা হলো প্রতিটি ধর্মের অনুসরণকারীরা অন্য ধর্মাচরণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকায় অতি সহজেই অপর ধর্মকে হীন বলে নস্যাৎ করে। আর বিরোধের ক্ষেত্রটা এখানেই প্রস্তুত হয়। যা সভ্যতার স্বাভাবিক গতিকে শুধু পঙ্কিলই করেনা, শ্বাসরোধও করে দেয়। সীমিত জ্ঞান, অসহিষ্ণুতা, মৌলবাদের বিষবৃক্ষকে পুষ্ট করে যা সুস্থ যাপনের পথে অন্তরায়।

এখন প্রশ্ন হলো এই ধর্মীয় তথা রাজনৈতিক, তথা উগ্র প্রাদেশিকতা (এটাও একধরণের মৌলবাদ। অতি সম্প্রতি আসামে পাঁচ বাঙালি হত্যা, যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এ বিষয়ে সময়ান্তরে আলোচনা করবো।) সভ্যতার অগ্রগতির পথে অন্তরায় কেন? যেহেতু প্রতিটি ধর্মই নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিজেকে স্বয়ম্ভু মনে করে এবং ধর্মের বিধিবিধানের নিরিখেই সমাজ পরিচালনার পক্ষপাতি তাই তারা সমাজের সকল দিকনির্দেশ ধর্মীয় অনুশাসনেই করতে বদ্ধপরিকর। সাধরণভাবেই সকল ধর্মের মৌলবাদী অনুগামীরা প্রাণীজগৎ ও পৃথিবী সৃষ্টিরহস্য ( cosmology and anthropology) নিয়ে নিজস্ব ধর্মের ব্যাখ্যাকেই অভ্রান্ত বলে মনে করেন এবং এটা খুবই স্বাভাবিক যে প্রতিটি ধর্মের নিয়তনীতির কিছু পরস্পরবিরোধিতা আছে। আর অনিবার্যভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মীয় অনুশাসন অনুসৃত হলে বিজ্ঞান ও যুক্তিনির্ভর রাষ্ট্রনীতি ব্রাত্য হয়ে পড়ে। এই কারণে ইসলামী রাষ্ট্রগুলিতে (ইরাক ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান) ইসলামী মৌলবাদ আবার খ্রীষ্টান দেশগুলিতে খ্রীষ্টান মৌলবাদ (আমেরিকার মতো দেশও আছে এই তালিকায়)। যদিও অনেক ধর্মবেত্তাগণ বর্তমানে উদারনৈতিক শিক্ষার আলোকে শিক্ষিত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি নির্ধারণে সচেষ্ট হয়েছেন। তবু একথা অনস্বীকার্য যে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র কখনোই গণতান্ত্রিক রাষ্ট হতে পারেনা। আবার জোট রাষ্ট্রগুলিও স্ববিরোধিতায় আক্রান্ত। যুগ যুগ ধরে ধর্ম আর রাষ্ট্র সুচতুর ভাবে পরস্পরের হাতকে শক্ত করেছে সাধারণ মানুষকে শাসন, শোষণ আর অবদমন করার লক্ষ্যে।

সভ্যতা একটি প্রবহমান ধারা। সৃষ্টিলগ্ন থেকে সভ্যতার এই ধারাটিকে পুষ্ট করেছে সাধারণ মানুষ তাদের বুদ্ধি দিয়ে, মেধা দিয়ে, শ্রম দিয়ে সাধনা দিয়ে। বিজ্ঞানী তার বিজ্ঞানসাধনার দ্বারা আবিষ্কার করেছেন জাগতিক বিষয়সমূহের যুক্তিসিদ্ধ কার্যকারণের ব্যাখ্যা। চিত্রকর, ভাস্কর তাঁর শিল্পকর্মের সৌকর্যে ফুটিয়েছেন নান্দনিকতা। মানুষের মানবিক সুকুমার বৃত্তির বিকাশ সাধনে সঙ্গীত, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, এবং শিল্পের অন্যান্য শাখা সমাজপ্রবাহে এনেছে নতুন জোয়ার। চিন্তাচেতনার বিস্তারে, মননের চর্চায়। দার্শনিক তার দর্শনত্ত্বের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর সমাজের মানুষের কল্যাণের পথের হদিশ দেন। তারই ওপর ভিত্তি করে কল্যাণকর রাষ্ট্রব্যাবস্থার ইঙ্গিত দেন। এভাবেই সভ্যতার ধারাটি এগিয়ে চলে উৎকর্ষতার অভিমুখে।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এতদ্সত্ত্বেও কেন রাষ্ট্র তথা সমাজবিকাশের পথে এতো অন্তরায়? সমাজ কি কেবল ক্ষমতার অলিন্দে থাকা মুষ্টিমেয় মানুষের স্বেচ্ছাবিচরণক্ষেত্র নাকি বৃহত্তর সাধারণ জনগোষ্ঠীর সুস্থ জীবনযাপনের ক্ষেত্রভূমি? 'গ্লোবাল ভিলেজ' কনসেপ্টকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আমরা এখন নির্লজ্জভাবে মৌলবাদের চর্চা করছি, কি ধর্ম, কি রাজনীতি, কি প্রাদেশিকতা __সবক্ষেত্রেই। আমাদের দেশও একই অন্ধকারে হাঁটছে। বহুর মাঝে ঐক্যের সংস্কৃতিচর্চার পীঠস্থানে আজ প্রাচীন ঐতিহ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে হাতে তুলে নিয়েছি কেউ ত্রিশূল তো কেউ তলোয়ার, কেউ গায়ে জড়িয়েছি গেরুয়া তো কেউ আলখাল্লা। আর আমরা একে অন্যের দিকে তাক করছি মারণাস্ত্র। যাতে শান দিচ্ছে ভন্ড ধার্মিক আর চতুর রাজনীতিক।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যখন সর্বাধিক মানুষের আর্থসামাজিক সাংস্কৃতিক উৎকর্ষবিধানই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। তখন রাষ্ট্র নিজেই সাধারণকে লড়িয়ে দিয়ে আখের গোছানোর খেলায় মেতে উঠতে চাইছে। সাধারণের কাছে সাংবিধানিক অধিকার অর্জন 'সোনারপাথর বাটি' হয়েই থেকে যাবে এতে আর আশ্চর্য কি! বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকারগুলি অন্ন -বস্ত্র -বাসস্থান -শিক্ষা -স্বাস্থ্য কে সুনিশ্চিত করা, কর্মক্ষম প্রতিটি নাগরিকের জন্য যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা আধুনিক রাষ্ট্রের অন্যতম কর্তব্য কিন্তু একটু সচেতন হলেই বোঝা যাবে আমাদের দেশের কর্ণধারগণ সুচতুরভাবে নিজ দায়িত্ব এড়িয়ে ধর্মের বিষবৃক্ষ রোপণ করে মানুষের মগজধোলাই করে যাচ্ছে। 'ধর্মনিরপেক্ষ' ভারত আজ ধর্মীয় মৌলবাদের শিকার। মৌলবাদীরা অতিসক্রিয় হয়ে উঠেছে আর গোপনে রাষ্ট্র তাদের মদত জুগিয়ে চলেছে। দলিতদের ওপর আক্রমণ, মুসলিম হত্যা, ষড়যন্ত্র, ভারতীয় সংস্কৃতির আহবমান স্রোতধারাকে কেবল কলুষিতই করেনি ভবিষ্যৎকেও দাঁড় করিয়েছে ভয়ঙ্কর সংকটের মুখে। কয়েকবছরে চিত্রটা আরোও ভয়াবহ আকার নিয়েছে।স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষের বুকে এমন কালবেলা আর আসেনি কখনো। মৌলবাদকে দমন না করে বরং মানুষের প্রতিবাদের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিয়ে শূন্যে তলোয়ার চালানোর এই খেলা যত তাড়াতাড়ি মানুষ বুঝবে ততোই মঙ্গল।

বিজ্ঞানের জয়যাত্রা যখন মঙ্গল গ্রহ অতিক্রম করে সূর্যের রহস্যকে ছুঁয়ে ফেলার দুঃসাহস দেখাচ্ছে তখন ধর্মের জিকির তুলে বিশ্বকে পশ্চাৎগামীতার দিকেই ঠেলে দিচ্ছে মৌলবাদ। আফগানিস্তান, ইরাক, ইরান, সৌদী আরবে এখন মৌলবাদ দুরারোগ্য ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। অতি সম্প্রতি মায়ানমারে দেখালো তার কদর্য রূপ। এমন পৈশাচিক হত্যালীলা আধুনিক বিশ্ব আর দেখেনি কখনো।

তবে সুখের কথা, বিজ্ঞান চেতনায় মানুষ ঋদ্ধ হচ্ছে, ধীরে হলেও। যুক্তিবিজ্ঞানের হাত ধরে যেদিন মানুষ সমবেত হবে বিজ্ঞাননির্ভর যাপনছায়ায়। শুধুমাত্র মানুষ পরিচয়ে পরিচিত করবে নিজেকে। মৌলবাদের নিষ্ফলা, ক্ষতিকর, গণবিমুখ, অসাড় অপ্রাসঙ্গিক অস্তিত্বকে নস্যাৎ করে দিতে পারবে সেদিন ঘটবে প্রকৃত উত্তরণ। একটা সহজ সাবলীল সমাজের লক্ষ্যে মানুষের মনে রাজনৈতিক চেতনাবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি করে বিজ্ঞানমনস্ক ,উন্নত আধুনিক সমাজকাঠামোর ওপর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বনিয়াদকে নিশ্চিত করতে হবে। পরমত সহিষ্ণু ও পরমত গ্রহীষ্ণু চিন্তাচেতনার মসৃণ পথেই আগামী সভ্যতা মুছে দেবে সকল আঁধার। আশার কথা, মানুষ জাগছে। পিছু হটছে ধর্মের কারবারীরা। আগামী সভ্যতা বিজ্ঞানের আলোয় ধর্মের পাপস্খালন করে শুচিস্নানের আয়োজন করছে। সময় সমাগত।



anishakrk333@gmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ