সুশান্ত কুমার রায়

সুশান্ত কুমার রায়
- এক

ভাওয়াইয়া শিল্পী কছিম উদ্দিন। রক্তে যাঁর ভাওয়াইয়া গান। ভাওয়াইয়া গানে একটি অতি পরিচিত নাম। উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীত ভাওয়াইয়ায় কছিম উদ্দিন সুবিদিত। ভাওয়াইয়ার মনোমুগ্ধকর বিচিত্র সুরের মাদকতায় এবং ভাবের বৈভবে মগ্ন হয়ে তিনি কয়েক হাজার ভাওয়াইয়া গান লিখেছেন, সুরারোপ করেছেন এবং গেয়ে দর্শক শ্রোতাদের মাতিয়ে তুলতেন। বিষয় বৈচিত্র্যে ভরপুর কছিম উদ্দিনের গান। তাঁর অধিকাংশ গানই শ্রোতা নন্দিত ও বহূল গীত। ছোটবেলা থেকে দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত থেকেও নিজ প্রতিভাগুণে প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই রচনা করেছেন মন মাতানো কথামালার ব্যাঞ্জনায় সুরের স্বর্গীয় সুধা। কছিম উদ্দিন প্রতিটি অনুষ্ঠানকে মাতোয়ারা করে মানুষের মাঝে অকাতরে বিলিয়েছেন তাঁর সুর-ঐশ্বর্য ও প্রেম। ১৯৩৪ সালে ২ ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রাম জেলার হিংগলরায় গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা মৃত ছমির উদ্দিন ও মাতা কছিরন বেওয়া। ১৯৫২ সালে বেতারের শিল্পী হিসেবে এবং ১৯৬৫ সালে টেলিভিশনের শিল্পী হিসেবে তালিকাভূক্ত হন। আব্বাস উদ্দিন পরবর্তী এদেশের সমসাময়িক ভাওয়াইয়া শিল্পী, মহেশ চন্দ্র রায়, হরলাল রায়, কে. এস. এম আশরাফুজ্জামান সাজু, মকবুল আলী, সিরাজ উদ্দিন, শমসের আলী প্রধান প্রমুখ শিল্পীদের মধ্যে কছিম উদ্দিন অন্যতম। কছিম উদ্দিন সৃষ্টির আনন্দে মশগুল থেকে একের পর এক রচনা করেন ভাওয়াইয়া গান যা ভাওয়াইয়া সংগীত ভূবনে অনন্য । কছিম উদ্দিনের ভাওয়াইয়ার কথা ও সুর বৈচিত্র্যে একদিকে যেমন চিরায়ত গ্রাম বাংলার ছবি অবলীলায় অকপটে ফুটে উঠেছে তেমনিভাবে অন্যায়-অত্যাচার ও শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বরাবরই তিনি আপোষহীন ও সোচ্ছার ছিলেন। কছিম উদ্দিনের এই বিখ্যাত গানটির কথায় তীব্র প্রতিবাদী সুর উঠে এসেছে-

“মাটি চিরে যাঁরা ফলায় সোনা রতন কাঞ্চন
তাঁদের তরে রইলো আমার গানের আমন্ত্রণ
যাঁরা শহর বাসীর মুখের হাসি, পল্লী বাসীর প্রাণ
তারাই আমার গানের কথা, তাঁরাই আমার গান
যাঁদের ধনে গড়া রে ভাই দশতলা দালান”...।

কৃষি নির্ভর আমাদের অর্থনীতি । কৃষিই আমাদের অর্থনীতির প্রাণ ও কেন্দ্রবিন্দু। কৃষিকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশের অধিকাংশ লোক কৃষি কাজের সাথে জড়িত। ধান আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য। গানটিতে স্ত্রীর সাথে একমত পোষণ করে স্বামীর আক্ষেপ ও প্রতিবাদের সুর তুলে ধরেছেন এভাবে-


“ক্যানে বউ ঝগড়া করিস
যাইসনে ক্যানে আন্দোন ঘরে
ক্যানে বউ ঝগড়া করিস।
ইরি গারমো সারি সারি
ফলন হইবে বেশি
এক বিঘাতে দুই বিঘার ধান
মাপিয়া নিবু কষি”...।

কছিম উদ্দিন গভীরভাবে ভালো বেসেছিলেন এদেশ-মাটি ও মানুষকে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই সোনার দেশ থেকে তিনি পেয়েছিলেন তাঁর ভাওয়াইয়া গানের সুর। তাঁর অবিনাশী সুরেলা কন্ঠের অবিনাশী গান আজও অন্তরে দোলা দেয় অমর ঐতিহ্যে। এই মহান ভাওয়াইয়া শিল্পী ১৯৯২ সালের ২২ আগস্ট ছেলে-মেয়ে এবং অসংখ্য ভক্ত-শিষ্য ও গুণগ্রাহী রেখে চলে যান অসীম অনন্তলোকে।


দুই

১৯৭১ সালে সংঘটিত হয় মুক্তিযুদ্ধ । একটি অবিস্মরণীয় ইতিহাস। আমাদের এই মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশ রক্ষার তাগিদে ছাত্র-শিক্ষক-জনতা ও আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা শক্তি, সাহস ও শৌর্য বীর্যের পরিচয় দিয়েছে। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আর লাখো মা-বোনের সম্ভ্রমহানির মাধ্যমে আমাদের যে অর্জিত স্বাধীনতা তা একদিনে করায়ত্ত হয়নি। ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিকামী স্বাধীনতার চেতনায় একটি ধারাবাহিক ইতিহাসের মধ্য দিয়ে যে লাল টুকটুকে সূর্য আর বাংলাদেশ নামের সবুজ শ্যামল স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যূদয় ঘটে তা আমাদের বাঙালি জাতির গৌরব আর অহংকারের ইতিহাস। পাকিস্তানী দুঃশাসন আর প্রতারণায় বিপর্যস্ত এদেশের মানুষ নিজেদের মুখোমুখি দাড়িয়ে হাড়ে হাড়ে অনুধাবন করতে পেরেছিল নিজেদের সংকটাপন্ন অস্তিত্বকে। তখনি আত্ম-পরিচয় উদ্ধারের অর্ন্তগত তাড়নায় ক্রমে ক্রমে সাগরের উত্তাল তরঙ্গমালার ন্যায় ফুসে ওঠে। বিক্ষুদ্ধ হয়ে গর্জে ওঠে পাকিস্তানী দুঃশাসনকে প্রতিহত করতে- জাতিসত্তার বিকাশে মুক্তি কামনায়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। আর এই মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে যাঁরা জাগরণ বা চেতনার গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দৃঢ় মনোবল, শক্তি, সাহস সঞ্চার করেছিলেন তাঁরা শব্দ সৈনিক হিসেবে পরিচিত।


কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের পাশাপাশি, বিভিন্ন ক্যাম্প, শরনার্থী শিবির, যুদ্ধে অংশগ্রহনের নিমিত্তে যুদ্ধ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে দেশ মাতৃকার ডাকে চেতনার গান গেয়ে উৎসাহ ও সাহস যোগাতেন। বিদ্রোহী কবি নজরুলের “কারার ঐ লৌহ কপাট / ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট”..। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আমার সোনার বাংলা / আমি তোমায় ভালবাসি”...। আব্দুল গাফফার চৌধূরীর “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি / আমি কি ভুলিতে পারি”...। “শতস্বপ্নে আঁকা জন্মভূমি / তোমায় নিয়ে কত যে ছবি আঁকি”...। “জয়বাংলা জয়বাংলা বইলারে”...। “ ও প্রাণের বাংলা ভাষা রে / এইনা ভাষার তরে / ভাইয়েরা মোর রক্ত দিলা রাজপন্থে পরে রে”...। “একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি / মোরা একটি মুখের হাসির জন্য যুদ্ধ করি”...। আর এই মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশ মাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে কুড়িগ্রামের দরদী ভাওয়াইয়া কন্ঠশিল্পী শব্দ সৈনিক হিসেবে অন্যান্য সহযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন। সংগীত পরিচালক সমর দাশের তত্ত্বাবধানে এবং এম.পি. শাহ আব্দুর রাজ্জাক এর পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতের কোচবিহারে “সাংস্কৃতিক মুক্তি পরিষদ” গঠিত হয়। সেই সময়ে কৃষ্ণ চন্দ্র সরখেল, বুলবুল বকসী, অরুণ কুমার মুখার্জী, নমর উদ্দিন ( দোতরা বাদক), শাহানা চৌধুরী, চায়না নিয়োগী, বলাই পাল, জিন্নাহ, নাসরিন আহমেদ, নিকুঞ্জ বিহারী, বিনয় কুমার বণিক, কবিতা দাস, এসরাউল হক, ইতি বিশ্বাস, রামকৃষ্ণ সোমানী, মেসবাউল আযম, শহিদুল ইসলাম প্রমুখ ব্যক্তিত্ব ছাড়াও আরো অনেকে সাংস্কৃতিক মুক্তিপরিষদে যোগদান করে চেতনার গান বা জাগরণী সংগীত পরিবেশন করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধার কিছু অংশ ও বুড়িমারী-পাটগ্রাম মুক্ত ছিল এবং এসব মুক্তাঞ্চলে শব্দ সৈনিকেরা তৎকালীন আবেদ আলী এম. পি. এর সহযোগিতায় উইং কমান্ডার এম. কে. বাশার এর উৎসাহে গঠিত হয় “বিপ্লবী সাংস্কৃতিক পরিষদ” এবং মুক্তিযুদ্ধ ফ্রন্ট দল নিয়ে শব্দ সৈনিকেরা সংগীত পরিবেশন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও মনোবল জাগ্রত করে তুলতেন।

তিন

মুক্তিযুদ্ধের সময় কছিম উদ্দিন যখন শব্দ সৈনিক হিসেবে কোচবিহারে যান তখন উল্লেখযোগ্য এবং স্মরণীয় ঘটনা হলো “দি গ্রামোফোন কোম্পানী অব ইন্ডিয়া”তে রেকর্ডে তাঁর নিজ গলায় গীত ভাওয়াইয়া গান। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পাওয়া শংসাপত্র ও বেতারের অর্ন্তভুক্তি হিসেবে দালিলিক কাগজপত্রগুলি নিয়ে কলকাতার বিভিন্ন রেকর্ড কোম্পানীতে যান। তাঁর উদ্দেশ্য হলো শিল্পী হিসেবে তাঁর গান রেকর্ডে বাজুক। নিজের লেখা গান “গ্রামোফোন কোম্পানী”তে রেকর্ড বিশাল সম্মান ও গৌরবের বিষয়। দেশের বাইরে তখনকার দিনে কলকাতায় গিয়ে গান রেকর্ড করা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। কিন্তু সেই কাজটিকে একটি বাস্তব রূপ দিতে কলকাতার বিভিন্ন রেকর্ড কোম্পানী “দি গ্রামোফোন কোম্পানী অব ইন্ডিয়া”, এইচ. এম. ভি ( হিজ মাস্টারস ভয়েস), ওডিয়ন, পাইয়োনিয়ার মতো বিভিন্ন জায়গা থেকে ভাওয়াইয়া শিল্পী কছিম উদ্দিন প্রত্যাখ্যাত হন। তবে একটি মাত্র কোম্পানী “দি গ্রামোফোন কোম্পানী অব ইন্ডিয়া” তাঁর অনেক অনুরোধ অনুনয়নের পর তাঁকে আশ্বস্ত করেন শর্ত জুড়ে দিয়ে। তাঁর গান রেকর্ড করা হবে যদি তিনি সেই শর্ত পূরণ করে নিয়ে আসেন। নিজের গান ও গলা বিষয়ে যেহেতু কছিম উদ্দিন এর আত্মবিশ্বাস ছিল সেই শর্ত পূরণে “দি গ্রামোফোন কোম্পানী অব ইন্ডিয়া”র কাছে রাজি হয়ে গেলেন। “দি গ্রামোফোন কোম্পানী অব ইন্ডিয়া” যে শর্ত ভাওয়াইয়া শিল্পী কছিম উদ্দিনকে দিলেন গান রেকর্ড করার ব্যাপারে, তাহলো কোচবিহারের হরিশ্চন্দ্র পাল মহাশয় যদি তাঁর গলা সম্পর্কে সুপারিশপত্র দেন তাহলেই তাঁর গান রেকর্ড করার ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করবে “দি গ্রামোফোন কোম্পানী অব ইন্ডিয়া”। তখন হরিশ্চন্দ্র পাল উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতির একজন পুরোধা। লোকসংস্কৃতির ইতিহাসে স্মরনীয় নাম হরিশ্চন্দ্র পাল। শিল্পী, সংগ্রাহক, পৃষ্ঠপোষক, নাট্যাভিনেতা, নাট্যকার ও পরিচালক হরিশ্চন্দ্র পাল। উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া ও চটকা গানের সর্বপ্রথম সংগ্রাহক। উত্তরবঙ্গের পল্লীগীতি “ভাওয়াইয়া খন্ড” ও উত্তরবঙ্গের “পল্লীগীতি চটকাখন্ড” তাঁর অমরকীর্তি। স্বাভাবিক কারণেই “দি গ্রামোফোন কোম্পানী অব ইন্ডিয়া”র শিল্পী কছিম উদ্দিনের গান রেকর্ডের বিষয়টি হরিশ্চন্দ্র পাল মহাশয়ের উপর ন্যস্ত করেছিলেন। কছিম উদ্দিন সুপারিশপত্রের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন। জাদুকরী সুরেলা কন্ঠের অধিকারী কছিম উদ্দিন আর দেরি না করে চলে গেলেন কোচবিহারে। খুঁজে বের করলেন হরিশ্চন্দ্র পাল মহাশয়ের বাড়ি। কিন্তু মনে শঙ্কা, আমাকে আমার গান শুনে গলা সম্পর্কে সুপারিশপত্র দেবেন কিনা। তিনি হরিশ্চন্দ্র পাল মহাশয়ের কাছে নিজের লেখা গান ও কন্ঠ সম্পর্কে এবং “দি গ্রামোফোন কোম্পানী অব ইন্ডিয়াতে” নিজের গান রেকর্ড করার বিষয়ে তাঁর সুপারিশ পত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা অবহিত করলেন নিজের পরিচয় দিয়ে। হরিশ্চন্দ্র পাল মনোযোগ সহকারে সবকিছু শুনলেন। অতিথি আপ্যায়নের আয়োজন করলেন এবং আপ্যায়ন শেষে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে পড়লেন। কছিম উদ্দিন বেশ কয়েকটি গান গাইলেন। মুগ্ধ ও বিস্মিত হলেন কছিম উদ্দিনের দরদী কন্ঠ শুনে। সুপারিশ পত্র দিলেন। সেই সুপারিশ পত্রের সাহায্যে“দি গ্রামোফোন কোম্পানী অব ইন্ডিয়া’ চারটি গানের একটি ৪৫ আর. পি. এম. ( রেভ্যুলোশন পার মিনিট) রেকর্ড প্রকাশ করেন। জানা যায় পরবর্তীতে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠিত হবার পর শিল্পী কছিম উদ্দিন তাঁর অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসেন হরিশ্চন্দ্র পাল মহাশয়কে। “বাবু তোমরা না থাকিলে মোর রেকর্ড না হইল হয়” শিল্পীর চোখে জল । কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে ধরলা-তিস্তা পাড়ের চিরচেনা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত পরিবেশে তাঁর কয়েক সহস্রাধিক গান রচিত হলো, আজ তা কোথায়, কিভাবে আছে তা অনেকেরই অজানা। তাঁর রচিত মোট গানের সংখ্যা, স্বরলিপি সহযোগে কতটি প্রকাশিত এবং বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন আর্কাভে কতগুলো গান সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং সংরক্ষণ না হয়ে থাকলে তাঁর গানগুলো স্বরলিপি সহযোগে সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গৃহিত হোক এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* মন্তব্য করতে পেজটি রিফ্রেশ করুন .