একটি মৃত্যু কখনই জীবনের শেষ নয়, আরেকটি পথ চলার শুরু। না, আধ্যাত্মিক বিষয় নয়, বাস্তবে এমনই প্রমাণ রেখেছেন দুই বিপ্লবী। প্রথম জন মাস্টারদা সূর্য সেন, আর দ্বিতীয় জন তারকেশ্বর দস্তিদার।
আজকের দিনটা কেন বিশেষ জিজ্ঞাসা করলে শতকরা নিরানব্বই ভাগ ভারতীয় উত্তর দেবেন বিবেকানন্দের জন্মদিন ৷ কিন্তু বিশ্বাস করুন দু'একজন এমনও আছেন যাদের কাছে আজকের দিনটা অন্য কারণে বিশেষ ৷ আজ মাস্টারদা সূর্য সেনের মৃত্যু দিন ৷ পুরো নাম সূর্যকুমার সেন, ডাকনাম কালু। আজ তাকে ফাঁসি দিয়েছিলো তৎকালীন বৃটিশ সরকার ৷ বলা ভুল হলো বোধহয়, তাকে নয় তার মৃতদেহ কে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিলো আজ ৷ মৃত্যু তার আগেই হয়েছিলো জেলের ভিতর অকথ্য অত্যাচারে ৷ শুধু লোক দেখানো ফাঁসি দেওয়া হয়েছিলো তার প্রাণহীন দেহকে ৷ অনেকে অবশ্য বলেন তাকে অচেতন অবস্থায় ফাঁসি দেওয়া হয়েছিলো ৷ তার পর তার দেহ জাহাজে তুলে অথৈ সমুদ্রে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।
মৃত্যুর আগে কি করা হয়েছিলো তার সাথে ? পিটিয়ে শরীরের সমস্ত হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছিলো ৷ ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে ভেঙে দেওয়া হয়েছিলো তার সব কটা দাঁত ৷ উপড়ে ফেলা হয়েছিলো হাত ও পা এর সমস্ত নখ ৷ তৎকালীন বৃটিশ সরকার এমনই বর্বর আচরণ করেছিলো ৷ এমন কি মৃত্যুর পর তার দেহ তুলে দেওয়া হয়নি পরিজনদের হাতে, ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিলো সমুদ্রের বুকে।
চট্টগ্রাম সশস্ত্র বিপ্লবের এই নেতা যিনি আজীবন স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন ভারতের, যিনি প্রাণের মায়া না করে যুদ্ধ চালিয়েছিলেন অপরাজেয় বৃটিশদের সাথে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ৷ যিনি সাধারণ একজন স্কুল শিক্ষক হয়ে দেশ এর জন্য লড়াই করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন অগণিত ছাত্রদের, তিনি কোনোদিনই ধরা পড়তেন না হয়তো ! কিন্তু সবই অদৃষ্ট ! অর্থ, পুরস্কার, উপাধি এসবের লোভে তার বিশ্বাসভাজন অনুচর নেত্র সেন বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন ৷
সেই নেত্র সেন এর অবশ্য বেশীদিন আর ধরাধামে থাকা সম্ভব হয়নি এবং অর্থ, পুরস্কার কিছুই পাওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ মাস্টারদার অনুগামী এক বিপ্লবী, যার নাম আজও অজানা, তিনি নেত্র সেনকে খুন করেন কিছুদিন পরেই ৷ সেই বিপ্লবীর নাম জানতেন একমাত্র নেত্র সেন এর স্ত্রী, যিনি কোনোদিন সেই নাম প্রকাশ করেননি, কারণ শ্রীমতী সেনও মাস্টারদার আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন ৷ বিশ্বাস করতেন দেশ প্রেমের কাছে বাকি সব তুচ্ছ।
সূর্য সেনের অন্যতম সাথী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায় "কে জানতো যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপি অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ! কে জানতো সেই শীর্ন বাহু ও ততোধিক শীর্ন পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে - তার সমস্ত ক্ষমতাকে উপহাস করে বৎসরের পর বৎসর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেবে!
কিন্তু, আজ তারকেশ্বর দস্তিদারের কথা মনে করব কেন? কারণ, আজ তার জন্মদিন। ১৯১১ সালের ১২ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া এই বিপ্লবীর সাথেও সূর্য সেনের যোগ আছে। বিপ্লবী দলের সদস্য হিসেবে ১৮ এপ্রিল, ১৯৩০ সালে সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণের কার্যক্রমে তিনি অংশ নেন। সূর্য সেন ধরা পড়লে তারকেশ্বর নিজেই ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির নেতৃত্ব দিতে আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে বিপ্লব পরিচালনা করেন। ১৯ মে ১৯৩৩ তারিখে গহিড়ায় পূর্ণ তালুকদারের বাড়িতে পুলিসের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় গ্রেপ্তার হন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে।
তাই, আজ শুধুই বিবেকানন্দ নয়, আসুন তারকেশ্বর দস্তিদার আর সূর্য সেনকে গভীর মননে স্মরণ করি ।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন