নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

আমোদিনী পর্ব-প্রস্ফুটিতা
মোদিনী নূতন বিদ্যালয়ে আসিয়া বুঝিল এইস্থানে সকলে মিড ডে মিল খাইতে আসিতেছে না। ইহারা খাতায় মলাট দিয়া তাহার উপরে আপন আপন নাম লিখিয়া রাখে। যে বিদ্যালয় টি তে সে পূর্বে যাইত সেটি তাহার পল্লীস্থিত ।সেটিতে তাহার পুরাতন সহপাঠী ও সহপাঠিনীগণ মিড ডে মিল খাইবার জন্যে যাইত।মুরশেদ মাস্টারমহাশয় আর রেখা দিদিমনি তাহাদের যতটা পড়া শিখাইতেন তাহার অধিক সময় ব্যয় করিতেন ছাত্রছাত্রী দিগের দ্বিপ্রাহরিক আহারের ব্যাবস্থা পনা করিতে। তাহার মধ্যেই আমোদিনী একদিন মুরশেদ মাস্টারমহাশয় কে রবি ঠাকুরের ‘সাধ’ কবিতা টি নির্ভুল মুখস্ত শুনাইয়া দিতেছে। সেই দিন বিদ্যালয় ছুটি হইলে, মুরশেদ মাস্টারমহাশয় আমোদিনীর সহিত তাহার গৃহে আসিল। মা কে তিনি বহুকাল হইতে জানেন। আমোদিনীর পিতার মৃত্যুর পূর্বে একই রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলেন। মা তাঁহাকে দেখিয়া প্রমাদ গনিল। “আমোদ কি করেছে ঠাকুর পো? ওকে নিয়ে আমি কি করি?”বলিয়া হাঁ হাঁ চিৎকার করিতে শুরু করিয়া দিল। মুরশেদ মাস্টারমহাশয় এক মুখ হাসিয়া বলিল, “ অনেক দিন চা খাওয়ান নি ভালো করে আদা দিয়ে চা করেন তো।” মা বিব্রত আর আশ্বস্ত হইল। বাড়ির হাঁসের ডিম সরিষার তেলে ভাজিয়া চায়ের সহিত পরিবেশিত হইল। “ শুনেন এ মেয়ে কে তাড়াতাড়ি বিহা দিবেন না। ওর বাবার মতো বুদ্ধি ধরে। ৭ ঘরের নামতা একবার শুনে বুলতে পারে। আজ কেমুন সুন্দর রবি ঠাকুর বুল্ল। ” মুরশেদ মাস্টারমহাশয় তাঁর বড় বড় চোখ আরও প্রসারিত করিয়া আমোদিনীর মাকে বলিল। এই বিদ্যালয় টি আমোদিনীর জন্যে যথেষ্ট হইবে না তিনি মাকে বুঝাইয়া দিলেন। পাকা রাস্তার অপর পাড়ের নামী ইস্কুল টি তে আমোদিনীর নাম নথি ভুক্ত হইল। অভয় মামা নিত্য সাইকেলে করিয়া তাহাকে ইস্কুলের গেটে নামাইয়া দিল। ফিরবার সময় মা পাকা রাস্তার পার্শে দাঁড়াইয়া তাহার জন্যে অপেক্ষমাণ রহিত। 

আমোদিনী নূতন বিদ্যালয়ে নানান ব্যাপারে ধন্দে পড়িতে হইল। সে বুঝিল যে তাহার পুরাতন বিদ্যালয়টির সহিত এই বিদ্যালয়ের অনেক নিয়ম কানুনে , আচার আচরণে তফাৎ এবং সংঘাত রহিয়াছে। এই বিদ্যালয়ে কেহ তাহার বন্ধু হইল না।সহপাঠীরা তাহার তুলনায় পরিস্কার পরিছন্ন হইয়া থাকে। গ্রাম্য উচ্চারণে কথা কহিবার কারনে সকলের হাস্য উদ্রেক করে। আমোদিনীর মন খারাপ হইল।তাহার পুরাতন বিদ্যালয়ের সহপাঠী দিগের কথা মনে পরিলে মন টি হু হু করিয়া উঠিতে থাকে।কত আনন্দে কাল অতিবাহিত করিতেছিল সে। পুকুরের জলে সন্তরণ করা, ধুলামাটি ফুল পাতা লইয়া খেলা। এই বিদ্যালয়ে তাহার বড় বদ্ধ বোধ হয়। তবে শ্রেণী কক্ষে তাহাকে যাহা যাহা শিখানোর চেষ্টা করিয়া থাকে শিক্ষিকা গণ তাহা সে বুঝিবার চেষ্টা করে। কিন্তু হায় বহু চেষ্টা করিয়া ও তাহার ফলাফলের ঝুলিটি তেমন রূপে ভারী হইতেছে না। তাহার মন বড় খারাপ হইতেছে। ষাণ্মাসিক পরীক্ষার মুল্যায়নের কাগজ টি লইয়া সে বিরস বদনে ঘরে বসিয়া রহিল। পাড়ার সকল কচিকাঁচারা ছুটিয়া ছুটিয়া খেলিতেছে। সেখানে আমোদিনী নাই দেখিয়া আমোদিনীর মা কিঞ্চিৎ চিন্তিত হইলেন। তিনি ঘরে নিঃশব্দে ক্রন্দন রত আমোদিনী কে দেখিয়া উদ্বেল হইলেন। আজ তিনি চিৎকার করিলেন না। পাশে আসিয়া কন্যাকে স্পর্শ করিতে সে ভাঙ্গিয়া পড়িল। “অংকে আমি ফেল কর্যা ছি মা। আর তিন নাম্বার পেলি পাস হতাম। আর ইংরাজি তে পাঁচ পেইয়াছি। ”মা তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়া বসিলেন। পরের দিন মা আমোদিনীর হাত ধরিয়া যাইলেন মুরশেদ মাস্টারমহাশয়এর কাছে। মুরশেদ মাস্টারমহাশয় মিড ডে মিলের রেশনের হিসাব লিখিতে ছিলেন। তিনি মুল্যায়নের কাগজ টি হাতে লইয়া বেশ কিছু ক্ষণ দেখিলেন। “ একখান কাম করেন বউদি। একটা প্রাইভেট টিউটারের ব্যাবস্থা করেন।আমি রাখাল কে বুলে দিচ্ছি ।উ ছুঁড়া নিজে না হক আর কারু কে ঠিক ব্যাবুস্থা করে দিবে।”



“ একঠো দিদিমুনি হলে ভালো । ব্যাটাছেলা হলে আমার অসুবিদা ঠাকুর পো।” “ঠিক আছে একটা লেডী টিচার কে খুঁজে দিব” এক মুখ হাসি নিয়া মুরশেদ মাস্টারমহাশয় বলেন। 

একটি নয় আমোদিনীর শিক্ষার জন্যে দুই জন নিযুক্ত হইলেন। আমোদিনী বার্ষিক পরীক্ষা তে উন্নতি করিল। একটি দুটি সহপাঠিনীর সখীত্ব লাভ হইল। আর অভয় মামা তাহাকে সাইকেল চালাইতে শিখাইয়া দিল। মা তাহাকে গুড়রুটি টিফিনের লাগিয়া দিত। উহা লইয়া শহরের কিছু কন্যা যারপরনায় হাসিত। কাঁদিয়া ফেলিল একদিন। আমোদিনী বুঝিত কেহ তাহার কষ্ট বুঝিবে না। তার নিষ্প্রভ গাত্রবর্ণ, তেলমাখা চুল, গ্রাম্য কথন শৈলী ইহাদের নিকট হাস্যস্পদ। সে মনে মনে আরও শক্ত হইল। সব দুঃখের কথা বলিয়া আর মাকে কষ্ট দান করে না। সে ভালো করিয়া নিজের কাপড় জামা পরিস্কার করিয়া থাকে। খাতাপত্র গুছাইয়া লইয়া বিদ্যালয়ে যায়। এমনি করিয়া প্রস্ফুটিত হইতে লাগিল আমোদিনী। সে তাহার মায়ের গৃহকাজেও সাহায্য করিয়া থাকে। সকলে বলিতেছে বিবাহের কথা ।কিন্তু মা নিঃশব্দে এড়িয়ে চলিয়া যান। মুরশেদ মাস্টারমহাশয়ের শরীর নানান ব্যাধি গ্রস্ত। সাইকেল চালাইয়া বিদ্যালয়ে চলিয়া যাওয়া আমোদিনী কে হাত নাড়াইয়া স্নেহ জানাইয়া থাকেন। সেও বড় আনন্দ পায় তাঁহাকে দেখিয়া।

আমোদিনী তাহার গ্রাম্যকথন শৈলী টি নিজের পরিমণ্ডলে বলিয়া থাকিলেও বিদ্যালয়ে ব্যাবহার করে না। সে জীবন রহস্য আর নারী হবার বিপদ সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞাত হইয়াছে। কিন্তু বিদ্যালয় হইতে ফিরিবার কালে সেদিন দেখিল পল্লীর নানান স্থানে জটলা। কৌতূহল হইল। জানিয়া যারপরনাই বিস্মিত হইল। মুরশেদ মাস্টারমহাশয়ের যে ছেলেটি কলিকাতায় বাস করে তাঁহাকে খুঁজিতে আজ পুলিস আসিয়াছিল, কোন মহিলা ঘটিত অপরাধ।ঘরে আসিয়া দেখিল মা কিঞ্চিৎ বিষণ্ণ। আমোদিনীর খুড়া খুব দ্রুত পায়চারী করিতেছেন। অভয় মামা বলিল, “ আমোদ রে কি সমস্যা। যদি তোরে মুরশেদ মাস্টার কে লিয়ে পুলিশ জিগাই, তু কিন্তু বলবি ছুটো বেলায় মাস্টার ছিল।আর কিছু জানি না” প্রতিবেশী বৃদ্ধারা উঠানের চারিধারে বসিয়া নানান অজ্ঞাত কথা বলিতে লাগিল। মুরশেদ মাস্টারমহাশয়ের একই প্রকার দোষ আছিল যৌবন কালে। হিন্দুর বাড়ি গিয়া তাহাদের মেয়েদের সহিত নানান ঘটনা ঘটাইয়াছে। এমন কি এই বাড়িতেও কত কাণ্ড ঘটিয়াছে। আমোদিনীর মন টি টনটন করিয়া উঠিল। রাত বাড়িল মায়ের সহিত আমোদিনী একই শয্যায় ।“ মা এই বাড়িতে কি কাণ্ড হোয়া ছিল” আমোদিনী বহুকাল পড়ে মাকে কিছু প্রশ্ন করিল। মা নিরুত্তর রহিলেন। “ ওরা কি সব বুলছে? একটু বুলঅ” মাকে হাত দিয়ে নাড়ায় আমোদিনী। মা উঠে বসে। “ তুমার মুরশেদ মাস্টার ভালো মানুষ রে আমোদ” মা শান্ত হয়ে বলে। “ তুমার বাবা আর মুরশেদ মাস্টার তখুন পার্টি করত। জৈবন বয়স। কি তেজ। আমি নতুন বিহা হয়ে এসে শুধু চা করতাম। যে ঘরে তুমার অভয়মামা রাতে শোই। ওই ঘরে চলত মিটিং। কি সব গরুম গরুম কথা।”মায়ের চোখে অতীতের সুখস্মৃতির ছায়া। আমোদিনীর মার ওপর মায়া উদ্ভুত হয় সে মার আরও ঘনিষ্ঠ হইয়া আসে। “ আমি চা করে কাপে কাপে ঢেলে দিতাম আর সেটা তুমার ছোট পিসি লিয়ে যেত। কি সোন্দর যে ছিল। মাজা অবধি চুল। মোটা মোটা চোখ। তারও বিহা হয়াছে।”মা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া স্তব্ধ হইল। আমোদিনী বুঝিতে পারিতেছে সে একখানি খুব গুপ্তকথা কিছুক্ষণের মধ্যে জানিতে পারিবে। “ বল মা , তারপর”। ফোঁস করিয়া মা শ্বাস ত্যাগ করে। “ তুমার পিসির শউর বাড়ির লোক এল একদিন ,খুব ঝগড়া অরা তুমার পিসি কে আর ফিরিয়ে লিয়ে যাবে না। প্যাটে যে সন্তান ছিল উটা নাকি জামাইয়ের লয়।সারা দিন কান্নাকাটি। লোকে বুলতে লাগলো মুরশেদ সন্তান উটা।”চমকে উঠিয়া আমোদিনী মায়ের হাত টি চাপিয়া ধরে। “ সত্যি মা” । “ “না রে মা মুরশেদ কুন দিন উ কাম করেনি।রাজনীতি ।রাজনীতি। উ জামাই উন্য পার্টি করত। মুরশেদ মাস্টার কে সরিং দিলে তুমার বাবা লরুম হয়ে যাবে। পিসির গর্ভে ওই বাচ্চা জামাইয়ের।” “কি হল ওই বাচ্চা টোর?” “ ঝাঁটাখেগোর বাচ্চা ওই জামাই একদিন রেতে এলে।এসে বুল্লে উ বাচ্চা লস্ট করে তো ঘরে লিবে। সব্বাই একমত হলে।কিন্তু পিসি ওই ভরন্ত পোয়াতি বুল্লে আমি কুন দোষ করি নাই ।আমি ছেল্যা লস্ট করবো না। তুমি ঘরে না ল্যাও তো ভিক্ষা করে খাবো।খুব চিল্লালে জামাই।তোর বাবা বুনের পাশে দাঁড়ালে”। “ ওই বাচ্চার কি হল মা। পিসি তো কাশী তে আছে।”আমোদিনী আরও বিস্মিত হয়। “ মা করুণ হাসি হাসিয়া আমোদিনীর দিকে তাকাইল।“পুলিশ যদি বলে মুরশেদ মাস্টার কেমুন মানুষ তুমি বল্ব্যা দেব্‌তা। যে ছেলেটো কে পুলিশ খুঁজছে ওই ছুঁড়া সেই বাচ্চা মা। তুমার পিসি কে বাড়িতে জখুন সব্বাই খুব দুষছে। মুরশেদ মাস্টার এক ঘর মান্সের সামনে বুল্ল উ বাচ্চা আমি মানুষ করবো আমাকে দ্যান।তোর বাবাকে বুল্ল পিসির অন্য কুথাও বিহার ব্যাবস্থা করতে। মুরশেদ মাস্টার কুনোদিন পিসির দিকে তাকাইনি রে মা।”

আমোদিনী অতি প্রাতে উঠিয়া সাইকেল করিয়া মুরশেদ মাস্টারমহাশয়ের বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করিল। তাঁকে প্রনাম করিয়া পরীক্ষা দিতে যাইবে। পুলিশ যদি আসে তাহাদের সহিত কথা এখন হইতে সেই বলিবে বলিয়া দিল অভয় মামা কে। পলিপ্যাকে এক ডজন হাঁসের ডিম সিদ্ধ করিয়া লইয়াছে। দুই খানি মুরশেদ মাস্টারমহাশয়ের জন্যে অন্য দশ খানি সহপাঠীদের জন্যে। মুরশেদ মাস্টারমহাশয় তাহার আগমনের জন্যে বসিয়া রহিয়াছেন। একমুখ হাসিয়া ডিম রাখিয়া তাহার মনে পড়িল সে বিটনুন আনিতে ভুলিয়া গিয়াছে।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ