অতনু জানা

অন্য-মানুষ
সেঁজু্তি বিছানায় শুয়ে শুয়েই জাস্ট চোখটা খুলল। সারা শরীর জুড়ে তীব্র ব্যাথা, শরীর নাড়ানোর মতো ও অবস্থা নেই। মানসিক-ভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছে যে, সে মন থেকে চায় কোন অবস্থাতেই যেন সুস্থ না হয়। মানসিক ভাবে বিন্দুমাত্র সুস্থ হওয়ার ইচ্ছাটুকুও তার নেই আর ! কি হবে সুস্থ হয়ে? কি হবে, এই মুখ নিয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার! সে আর পারবে না আবার বুক ফুলিয়ে রাস্তায় নেমে মিছিলে হাঁটতে,  মানুষের হাজার দাবী নিয়ে পথে নামতে। এমনকী তার দীর্ঘ দিনের পার্টিকর্মীরা ও পেছনে তাকে নিয়ে আলোচনা করবেই, সে এটাও জানে ভালোভাবে । এ সমাজ তাকেই নোংরার চোখে দেখবে। কোথায় বা যাবে সে? কিচ্ছু ভাবতে পারছে না-

কাল রাত থেকে তার হালকা-হালকা হুঁশ ফিরেছে যতবার, ঠিক ততবার চোখ জলে ভরে গেছে। যত সময় এগোচ্ছে চোখের জল কোনো মতেই বাগ মানছে না। মনে হয় ওখানেই মরে গেলে বেশ হত। কেন তাকে এই নার্সিংহোমে নিয়ে এসে- সুস্থ করে বাঁচিয়ে তুলে, তাকে সারা জীবনের মত মানসিক একটা পঙ্গুর জীবন দান করা হল! ভীষন রাগ হচ্ছে সবার ওপর, তার উপকার তো করলই না, বরং সারাটা জীবন তাকে একটা করুণ অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করার একটা পথ তৈরী করে দিল। মারা গেলে অন্তত মানসিক দিক দিয়ে শান্তি পেয়ে যেত হয়ত। এই পাপের শরীর নিয়ে সমাজের কাছে হাজার প্রশ্নের মোকাবিলা করার দায় অন্তত তার আর কোনোদিনো থাকত না। পারছে না, সে-জাস্ট পারছে না; এসব ভাবতে।

বালিশের উপর কাত হয়ে ঘাড়টা কোনোরকমে ঘোরাল, জানালা দিয়ে বহুদূর আকাশটা দেখা যাচ্ছে, সারা আকাশ সাদাটে মেঘে ঢাকা, সামনের আমগাছের মাথায় সকালের নরম-রোদ্দুর এসে পড়েছে, দুটো চড়াই ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে মনের আনন্দে খেলছিল। একটা হিংস্র কাক কর্কশ শব্দে "কা,- কা" করতে-করতে ক্ষিপ্র গতিতে তেড়ে এল, ওমনি চড়াই দুটো ভয়ে উধাও হয়ে গেল। সেঁজুতি ঘাড়টা সোজা করে নিল।

মাথার ওপর স্যালাইন স্ট্যান্ডে ডি-এন-এস ঝুলছে, অনবরত ফোঁটা ফোঁটা করে নিচে সরু একটা পাইপের ভিতর দিয়ে নামতে নামতে হাতে চ্যানেলের ভেতর দিয়ে শিরা উপশিরায় ক্রমাগত মিলিয়ে যাচ্ছে। বেডের পাশে মাথার দিকটায় অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখা।  ঠিক বেডের ধার ঘেঁষে মাস্কটা এখনো পড়ে- পাখাটা এক নাগাড়ে ঘুরেই যাচ্ছে , একবিন্দু-ও থেমে থাকার জোঁ নেই। অথচ তার জীবনটা তো থেমেই গেছে, সে আর কোনো দিন-ও এগোতে পারবে না।

ছিঃ একটা মানুষ! একটা পুরুষ মানুষ ! এদের মানুষ বলে কিনা ঠিক জানিনা ? পশুরাও বুঝি এদের দেখে লজ্জা পায়। মুখোশের আড়ালে কি ভদ্রই না সেজে ঘুরে বেড়াত ! মেঘ সেদিন যা বলেছিল, এখন স্পষ্ট বুঝতে পারি- ভুল কিছু বলেনি। আমিই চিনতে ওকে ভুল করেছিলাম। শুভ বন্ধু থেকে আরো ক্লোজ হয়ে পাশে এসে সাহায্য করার জন্য যে হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল, তার মধ্যে  এতটা নোংরা ইচ্ছা লুকিয়ে ছিল ! যেই শুনেছিল- মেঘের সাথে আমার বনি-বনা হচ্ছে না ওমনি সুযোগ বুঝে ভদ্রতার মুখোশ পরে, মেঘকে আমার জীবন থেকে হাঠানোর জন্য সমস্ত রকম ভাবে হাতটা বাড়িয়ে ফেলেছিল। আমি ও অবশ্য কম কিছু দায়ী ছিলাম না, কেমন একটা নেশার ঘোরে ভাল-মন্দ,ন্যায়-অন্যায় সব কিছু ভুলে গিয়ে শুভর মত একটা জানোয়ারের চক্রান্তে পা দিয়ে ফেলেছিলাম। আর মেঘ তখন এতটাই বাজে ভাবে সবকিছুতে রিয়্যাক্ট করা শুরু করেছিল, যে ওর সামনে দাঁড়ালেই পুড়ে যাব!  আসলে ওকে যেই মিথ্যে কথা গুলো বলেছিলাম, সে গুলো তো সত্যিই মিথ্যে ছিল। কিন্তু মিথ্যে কথা গুলোর কারন না খুঁজে ও যে ভাবে রিয়্যাক্ট করেছিল,সেটা সত্যিই আমি মেনে নিতে পারিনি।

মানুষটাকে তো এতদিন ধরে দেখে এসেছি, এত শান্ত-শিষ্ট মানুষ; এ ভাবে রিয়্যাক্ট করতে পারে, এমনটা কোনোদিন ও কল্পনা ও করতে পারিনি। আমার ভীষন রাগ হত, আমার এতদিনের সেই মেঘের সাথে তখনকার মেঘকে কোনোদিন ও মেলাতে পারিনি । সেদিন মেঘের ওপর এতটাই রেগে ছিলাম যে সমস্ত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। এমনকি বহুবার মেঘ চাইলেও আমি নিজেই ওর সাথে কথা বলার প্রয়োজনীয়তা টুকুও অনুভব করিনি। ও আরো ক্ষীপ্র ও হিংস্র হয়ে উঠেছিল, যেখানেই দেখা হত, সমস্ত জ্ঞান হারিয়ে স্থান- কাল-পাত্র বিবেচনা না করে আমায় জোর করে ওকে একলা করে দেওয়ার কারণ জিজ্ঞ্যেস করত ! শেষমেশ একদিন  বলেই ফেলেছিল - "এ ভারী অন্যায়, আমার বাক্- স্বাধীনতা পর্যন্ত সেঁজুতি তুমি কেড়ে নিয়েছ,আমি ও এর শেষ দেখেই ছাড়ব। সেদিন কে শোনে কার কথা !

#

হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ হল, কে-এল আর কে-গেল, এখন বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তার। প্রিয়া, অন্বেষা, জয় ও দেবরাজ একসাথে ঢুকল ঘরের মধ্যে। সবার চোখে দেখতে পেল কান্নার স্পষ্ট ছাপ। প্রিয়া ঢুকেই আর পারলনা নিজেকে সামলে রাখতে সেঁজুতিদি বলে জড়িয়ে ধরল। কপালে কপাল রেখে মাথায় হাত বোলতে-বোলাতে কেঁদেই চলছে। মিনিট খানেক এভাবে চলতেই থাকল। হঠাৎ দেবরাজ প্রিয়া - কে ধরে নিয়ে জোর করে বাইরে বেরিয়ে গেল। দেবরাজ বাইরে এসে প্রিয়া কে বোঝাচ্ছে,"এ অবস্থায় দি ভাই কে এক্সসাইট করতে বারন করল না ডাক্তার বাবু।"

সেঁজুতি বিছানায় সেই এক-অবস্থায় আবার ফোঁপাচ্ছে । জয়দেব কপালে হাত রেখে আদর করতে করতে  সেঁজুতি কে  বলল, দি ভাই; বিশ্বাস কর কিচ্ছু হয়নি, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদেরকে তুমি ছাড়া কে ঠিক পথে নিয়ে আসবে বল !  তুমি ছাড়া কে আমাদের ভুল বুঝিয়ে দেবে?  তুমি একটু মন থেকে সুস্থ হওয়ার চেষ্টা কর,দেখবে তুমি সম্পূর্ন সুস্থ হয়ে উঠবে। জীবনের প্রত্যেকটা মুহূর্তে যে তোমাকেই চাই দিভাই। অন্তত আমাদের জন্য তো সুস্থ তোমাকে হতেই হবে, আর কারোর জন্য তোমায় কিচ্ছুটি করতে হবে না, অন্তত আমাদের এই চার জনের যে তোমায় ছাড়া চলবে না!

ডঃ গুপ্তের সাথে কথা বলে জয় বুঝেছে আপাতত সেঁজুতি-দি বিপদসীমার বাইরে, শারীরিক ভাবে সম্পূর্ন সুস্থ, তবে কয়েকটা দিন রেস্ট এর প্রয়োজন, আর মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙে পড়েছে, তাই মানসিক শক্তিটা বড্ড বেশী দরকার এই মুহূর্তে। নার্স এসে একটা ইঞ্জেকশান স্যালাইনের মধ্যে পুস করতে করতে জয়কে বললো বেশী কথা বলবেন না। যত কম কথা বলবেন ওনার মানসিক চাপটা কম আসবে,তাতে পুরনো চিন্তাভাবনা গুলো মাথার মধ্যে না আসাই শ্রেয়।

জয় বাইরে বেরিয়ে এল, সিস্টার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ঘুমিয়ে পড়ো সোনা বোনটি আমার। একেবারে মায়ের মত ছোঁয়া এই হাতে, এমন করে আদর অনেক দিন কেউ করেনি। অদ্ভুত ভাবে মায়ের হাতের গন্ধ পাচ্ছে সে, কতদিন মায়ের এমন আদর পায়নি , আবার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসছে তার। মা কি তার এমন দুরবস্থার কথা জানে?  নিশ্চিত না!  তা-নাহলে নিশ্চই একবার অন্তত দেখতে পেতো বাড়ির কাউকে । তবে কি বাড়ির কেউ জানে না? কালকে রাতে যখন প্রথমবার তার মিনিট পাঁচেকের জন্য হুঁশটা ফিরে এসেছিল, যত দূর মনে পড়ে হালকা আলোয় দরজার বাইরে যারা দাঁড়িয়েছিল, স্পষ্ট দেখেছে তাদের মধ্যে এই চারজন-ই ছিল, আর একজন কোনো ডাক্তার বা কেউ ছিল ঠিকমত দেখতে পায়নি।  দাদা তো অতটা স্লিম না! ওনাকে স্পষ্ট দেখতে পায়নি , হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে গিয়েছিল। তবে কি আর কেউ আসেনি এখানে ? এত মানুষ এত ভালবাসার লোকজন সবাই তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে? চরিত্রহীনা ভেবে বা ধর্ষিতা শুনে !  ক্রমশ শরীরটা শিথিল হয়ে আসছে, খুব ঘুম পাচ্ছে তার। সেঁজুতি আবার ঘুমের মধ্যে ঢলে পড়ল।



ডাক্তার গুপ্ত গাড়ি থেকে নেমেই সিস্টার রুমে ঢুকে গেল। ওমনি সিনিয়ার সিস্টার সমস্ত ফাইল নিয়ে এসে ডঃগুপ্তর দিকে এগিয়ে দিল-
-মেঘের ওই পেসেন্টের ফাইল টা দিন।
আর হ্যাঁ, ঘুমের ইঞ্জেকশানটা দিয়েছেন তো?

- হ্যাঁ এই যে মিনিট কুড়ি আগেই দিয়েছি,পেসেন্ট টা এখন ঘুমোচ্ছে।
 -হ্যাঁ খবর পেয়েছি, একটু আগেই মেঘ ফোন করেছিল।
ছেলেটা এত চিন্তা করছে যে, কি আর বলব ! ওকে বুঝিয়ে বলেছিলাম, এত চিন্তা করার কিচ্ছু নেই । কিচ্ছু হয়নি, পেসেন্টের, জাস্ট একটা ট্রমা, আর এত গুলো ঘুমের ওষুধের এফেক্ট। ভয়ের কিচ্ছু নেই, জানোয়ারটা সেঁজুতির তেমন কিছুই ক্ষতি করতে পারেনি। তবু ও চিন্তায় প্রতি ঘন্টায় -ঘন্টায় একবার করে খবর নিচ্ছে, আর এদিকের খবর নিয়ে আমায় জানাচ্ছে। কি করি একি প্রফেশনে কাজ করি, ছেলেটাকে বহুদিন ধরে চিনি, এমন ভাল সৎ ছেলে খুব কম দেখেছি, কি করে অ্যাভোয়েড করি বলুনতো! তাছাড়া ছেলেটাকে নিজের ছেলের মত আমিও স্নেহ করি। সেই কবে থেকে আলাপ, এই প্রফেশনে অনেক জুনিয়র ছেলে-পুলেদের সাথে কাটিয়েছি, মেঘ কিন্তু সম্পূর্ন তাদের থেকে আলাদা। যেমন কথাবার্তায় শালীনতা তেমনি কমিটেড। সব থেকে বড় ব্যাপার যেটা ভীষন হেল্প-ফুল,যা আজকালকার জেনারেশনে সচরাচর দেখা যায়না ।

চলুন ওর ফাইলটা নিয়ে, ডঃ গুপ্তার সাথে সাথে সিস্টাররা ও ফাইল নিয়ে সেজুতির কেবিনের দিকে এগোতে থাকল, সামনের বেঞ্চটাতে দেবরাজ-দের দেখতে পেয়ে ডঃ গুপ্তা হাসতে হাসতে বলল তোমাদের এত চিন্তা করার কিছুই নেই, পেশেন্ট পুরোপুরি আউট অফ ডেঞ্জার। তোমরা মেঘকে একটু বোঝাও আর সেজুতিকে মানষিক ভাবে শক্ত কর। ব্যাস,সব ঠিক হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ, মেঘকে বোঝাও- ছেলেটার বিরুদ্ধে লিগালি একটা স্টেপ নিতে। এ-ধরনের পশুকে ফাঁসি দেওয়াই উচিৎ ,শুনছেই না আমার কথা। এতবার করে বোঝালাম ওকে, শুধু বলছে ও নাকি সব সামলে নেবে,আপনি শুধু সুস্থ করে দিন। কি সামলে নেবে ওই জানে?

-আমরা ও তো তাই বোঝাচ্ছি ডাক্তার বাবু ; ও কিছুতেই শুনছে না আমাদের ও কথা। সেই হোটেল থেকে আমাদের নিয়ে গিয়ে দি-ভাইকে নিয়ে এল, আমাদের চার জনের বাইরে কাউকে জানাতে বারণ করল।এমনকি হোটেলের ম্যানেজারকেও বুঝিয়ে- সুঝিয়ে পয়সা খাইয়ে; থানায় জানাতে দেয়নি, বলে এসেছে এ খবর যেন কেউ না জানতে পারে কোনোদিনও। এমনকি সেঁজুতি-দির বাড়িতে ও কাউকে জানায়নি। ভগবান না করুক বাইচান্স দি-ভাইয়ের কিছু একটা হয়ে গেলে,তখন দায়-ভার কে নেবে? সব দোষ  তো ওরি ঘাড়ে পড়বে,  তখন তো আরো একবার ওর উপকার করতে গিয়ে নিজেই আবার পুলিশ-কেসে না ফাঁসে !

বলে কিনা-"ধর্ষকের ধর্ষনে যতটা না ক্ষতি হয়- ধর্ষিতার শরীরে , তার থেকে ও বেশী ক্ষতি হয়- ধর্ষিতার মনে ; ধর্ষিতার  মানষিক অবস্থার। যা সত্যিই পরবত্তী জীবনে ধর্ষিতাকে একাকেই একান্তেই বহন করে নিয়ে যেতে হয়, তখন আর কাউকে  পাওয়া যায় না।" দেখিস এমন প্রচুর লোক পাবি যারা  প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে মিছিল কাঁপিয়ে দিচ্ছে , সব কিছু মিটে যাওয়ার পর ওরাই আবার গোপনে ধর্ষিতার গল্প করছে। ধর্ষনের বর্ননা করে ধর্ষনের রসাত্মক মজা নিচ্ছে। কিছু দিন বাদে পাস দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে বন্ধুর কানে কানে বলবে- এই দেখ সেই মেয়েটা,যে কিনা ধর্ষন হয়েছিল, তারপর আড়চোখে ; নোংরা ভাবে ওরাই আবার তাকাবে !

এই তো আমাদের সমাজ। কটা বীরপুরুষ আছে, যারা মিছিল মিটিং করে বেড়াচ্ছে- হাজার প্রতিবাদ করেছে,অথচ নিজের ফিয়ন্সের ধর্ষনের খবর শোনার পর ও বিয়ে করার সাহস রাখে ? অথবা ধর্ষন-পরবর্ত্তী জীবনে ধর্ষিতা-ফিয়ন্সের পাশে দাঁড়িয়ে মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত রেখে আবার আগের মত মিশতে পারে, আবার সতীসাবিত্রীর নজরে দেখে বিয়ে করার সাহস রাখে ? সুতরাং ওর পরবর্ত্তীকালের মানষিক সুস্থতার জন্য সমাজের কাছে গোপন রাখাটাই বাঞ্চনীয়। এই সমাজ এবং এই প্রশাষন এখন ও ধর্ষিতাকে সম্পূর্ণ সুস্থ একটা জীবন দিয়ে সুরক্ষিত রাখতে শেখেনি।

ড: গুপ্তা কেবিনে ঢুকে দেখল সেঁজুতি ঘুমোচ্ছে, একটু আগেই জলপিডার্ম ইঞ্জেকশান দেওয়া হয়েছে। ভালো করে দেখে নিয়ে সিস্টারকে বলল- আর কোনো অসুবিধা নেই।তবে আজকে সারাদিনে ছ ঘন্টা গ্যাপে আর ও তিনটে ইঞ্জেকশান দিতে হবে। যেন বেশিরভাগ সময়টাই ঘুমিয়েই কাটায়। কালকের দিনটা দেখেই আশাকরছি পরশু সকালে ছুটি দিয়ে দিতে পারব। ডাক্তার গুপ্তর মুখে কথাটা শুনেই অন্বেসাদের মন খুশিতে ভরে গেল।

ডাক্তার গুপ্ত বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই ওরা চা খেতে বেরোল। শেষ ৪ টে দিন যে ভাবে কেটেছে ওদের ; একমাত্র ওরাই জানে !

#

সেই হোটেল থেকে ফোন পাওয়ার সাথে সাথেই অন্বেসা মেঘকে জানিয়েছিল, তারপর মেঘ দেবরাজ প্রিয়া ও জয়কে ডেকে নিতে বলে- সেই রাতেই গাড়িতে করে ওরা পৌছে গেছিল দীঘার সেই হোটেলে। পৌছে হোটেলের ঘরে ঢুকে সেঁজুতি কে যে অবস্থায় ওরা দেখেছিল ভীষন ভয় পেয়ে গেছিল প্রত্যেকেই।

হোটেলের ম্যানেজার বলল- ছেলেটা বিকেল থেকে বেপাত্তা , বহুবার ফোন করে ও পাওয়া যায়নি। সেঁজুতির মোবাইলটা ও নিয়ে পালিয়েছে যাতে কোনো ভাবে ট্রেস না করা যায় । ওর ঘরে ঢুকে ওই অবস্থায় দেখে ঘাবড়ে যাই , সাথে-সাথে এখানকার লোকাল ডাক্তার অর্নব বাবুকে নিয়ে এসে দেখালাম। উনি বললেন- প্রচুর পরিমানে মাদক ও ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তার শরীরের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে। কিন্তু শারীরিক ভাবে তেমন কিছু ক্ষতি হয়নি। ওই অবস্থার পর রেজিশটার খাতা বের করে দুটো নাম্বারেই ট্রাই করেই যাচ্ছিলাম,- পাচ্ছিলাম না। শেষমেশ সেঁজুতির পার্স হাতড়ে দেখার চেস্টা করি- যদি কোনো কার্ড বা নাম্বারের হদিস পাই। অবশেষে একটা সিম পেয়েছিলাম।ওই সিমটা আমার ফোনে লাগিয়ে গোটা তিনেক নম্বর পেয়েছিলাম। তার মধ্যে প্রথম নাম্বারটা ছিল অন্বেষার, ট্রাই করতেই দেখলাম রিংটোন বাজছে। যা কিছু দেখেছি- উনাকে সংক্ষেপে সবকিছু বলেছি, কিচ্ছু গোপন রাখিনি।

উনি কাঁদতে কাঁদতে আমার থেকে হোটেলের এড্রেসটা নিলেন।  তার মিনিট পাঁচেক বাদেই দেখলাম অন্য একটা নম্বর থেকে ফোন এল, মেঘের দিকে দেখিয়ে বললেন, সম্ভবত ইনিই ফোন করেছিলেন। আমায় উনি বললেন-আপনি দয়াকরে; আমি না যাওয়া পর্যন্ত কাউকে কিছু বলবেন না, ওখানকার লোকাল কোনো ডাক্তারকে এনে ট্রিটমেন্ট শুরু করুন। কোনো চিন্তা করবেন না, খরচ-পত্র বা অন্য কোনো সমস্যা নিয়ে। আমি ঘন্টা তিনেকের মধ্যেই আসছি। মাঝে অবশ্য উনি আরো কয়েকবার ফোন করে পেশেন্টের খবর নিয়েছিলেন। এক নিশ্বাঃসে বলে গেলেন।

কি মুশকিলে পড়লাম বলুনতো !
আমি সামান্য এক হোটেল চালাই-
কোথ থেকে এসব ঝুট ঝামেলা গুলো আমার ঘাড়ে এসে জুটল বলুন তো !
মেঘ শান্ত কন্ঠে বলেছিল-
আপনি চিন্তা করবেন না।
আপনি যেখানে যা সাইন করানোর করান-আর একান্তই যদি এই কেসটা নিয়ে বাজে কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে যান, আমার নম্বর আইডি-প্রুফ সব রাখুন। আমি আপনাকে সমস্ত রকম ভাবে সাহায্য করব। তবে একটাই রিকোয়েস্ট, দয়া করে কাউকে জানাবেন না।

সেই ওখান থেকে সেঁজুতিদি কে নিয়ে এসে, এই হসপিটালে অ্যডমিশান থেকে এখনও পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া, ঘুম কিচ্ছু ঠিকমত হয়নি। এখন অন্তত কিছুটা স্বস্তিতে সবাই।

#

রোজকার মত সেদিন ও দুপুরের দিকে মেঘ নার্সিংহোমে এল, বাইরে তখন প্রিয়া আর অন্বেশা গল্প করছিল, মেঘকে দেখা মাত্রই দৌড়ে গেল, খুব এক্সসাটেড হয়ে প্রিয়া বলল-
"জানো- তো মেঘ দা, সেঁজুতি দি-কে পরশু সকালে ছেড়ে দেবে।"
 -তাই?
ও কি করছে এখন?
- ঘুমোচ্ছে, ডাক্তার বাবু বলল আজ সারাক্ষন ওকে ঘুমিয়ে রাখতে। ঘুমের ইঞ্জেকশান দিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে- যাতে ভুলভাল মানসিক চিন্তা মাথায় না আসে। কালকের দিনটা দেখেই ছেড়ে দেবে বলল । তুমি যাবে না আজও ওকে দেখতে?
-না থাক। বরং চল তোরাও কিচ্ছু খাসনি, চল খেয়ে আসি।
-তুমি একটু দেখে আসতেই পারতে কিন্তু।
-আচ্ছা প্রিয়া, তুই বল- কি করব ওকে দেখে? শুনলাম তো সুস্থই আছে। ব্যাস,আর কি চাই বল আমার? তাছাড়া বাইচান্স যদি জানতে পারে,আমি এখানে আছি, কি রিয়াকসান হবে ভেবে দেখেছিস!
-তবে তুমি ওর জন্যে এতটা কষ্ট করো কেন? এত কিছু করছ কেন বলতে পার !
-জানিনা রে-কেন করছি!
তবে ওর ওই অবস্থা জানার পর এগুলো না করলে হয়ত আমি অনেক-অনেক কষ্ট পেতাম রে। মরে গিয়েও সেই কষ্ট আমাকে তাড়া করে বেড়াত !
- ডাক্তার বাবু ও বলছিলেন শুভর এগেনস্টে লিগাল স্টেপ নেওয়ার জন্য। এটা কিন্তু করার দরকার আছে মেঘ-দা। ওই শুয়োরটা তোমাদের মধ্যে এত কিছু ঘটিয়েছে। ওর জন্য দি -ভাই ও তোমায় ভুল বুঝেছে। তাছাড়া দেখলে তো সেঁজুতি দি,র কি হালত করেছে?
-প্লিজ ছাড় না। ও তো আগে সুস্থ হয়ে উঠুক !  যদি ওর মনে হয় ও লিগাল স্টেপ নেবে ওই নিক। এটা ওদের পার্সোনাল ব্যাপার।
-আর তুমি ওর পার্সোনাল নয় ? আমরা কি জানিনা,কে কার কতটা পার্সোনাল !
-না রে, তুই ভুল করছিস। ওরা এখন ওরাই। ওর কাছে আমার কোনো জায়গা নেই রে, আমি তো সেই কবে থেকেই থার্ড-পার্সন হয়ে গেছি।
আমি অনেক দিন আগেই সেই জায়গা হারিয়ে ফেলেছি। চল ওদেরকে ডাক, খেয়ে আসি।

অন্বেষা এতসময় চুপচাপ সব শুনছিল, এবার মুখ বেঁকিয়ে বলে উঠল-সত্যি তুমি মানুষ একটা! আর কত নিজে কষ্ট পেয়ে ওর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে বলত?
মেঘ হাসতে- হাসতে বলল, বড্ড খিধে পেয়েছে রে- চল আমরা খেয়ে আসি।
-হ্যাঁ এবার তো কথা ঘোরাবেই।
-চল্ চল্, ওদেরকে ডেকে নিয়ে আয়।
সেদিন সব্বাই একসাথে ক্যান্টিনে ঢুকে খেলো ওরা। মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন বাদে ওরা খাচ্ছে ! খেতে খেতে দেবরাজের মনে হচ্ছিল- সেই বছর দুয়েক আগে ওরা যে ভাবে শংকর পুর ঘুরতে গিয়ে সেঁজুতি-দি কে ছেড়ে রেখে খাচ্ছিল,সেই টেবিলেই বসে খাচ্ছে। সে বার সেঁজুতি দি আর মেঘদা  সক্কাল সক্কাল ওদেরকে না নিয়ে গিয়ে শুধু দুজনেই ঘুরতে বেরিয়ে গেছিল। আসলে তো ঘোরা না, সত্যি কথা বলতে কি প্রেম করতে বেরিয়েছিল। সেঁজুতি-দির থেকেই শোনা এসব। আগের দিন রাতে সব্বাই মিলে অনেক রাত পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া গান হই- চই হয়েছে,সবার ঘুমোতে ঘুমোতে অনেক রাত্রি হয়ে গেছিল। ভোরের বেলা সব্বাই যখন ঘুমোচ্ছিল, সেঁজুতি-দি জোর করে মেঘদা কে চড় মেরে ঘুম থেকে তুলে বলেছিল। এই বাচ্চা গুলোর সাথেই কাটাবে যদি, আমাকে নিয়ে এলে কেনো? আমরা তো প্রেম করতেই পারছি না গো! এখন আমাদের বাচ্চাগুলো ঘুমোচ্ছে, চলো এই ফাঁকে শুধু তুমি আর আমি ব্যাস,আর কেউ থাকবে না।
চলো বলছি -
মাত্র ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়েছে, চোখ পুরো লাল দুজনেরই। ওরা বেরিয়ে গেছিল সমুদ্রের শান্ত স্নিগ্ধ ভোরের বাতাসে প্রেম করতে।
অনেক বেলাতে ফিরে এল ওরা।
ফিরে এসে দেখল- দেবরাজ মোবাইলে গেম খেলছে, বাদ বাকি সব্বাই ঘুমোচ্ছে।
মেঘ আর সেঁজুতি সব্বাইকে ঘুম থেকে তুলে স্নান করতে পাঠিয়েছিল, স্নান সেরে ঘন্টা খানেক ঘুমিয়ে একসাথে সব্বাই খেতে যাবে বলে প্ল্যান করছিলো। প্রিয়ার স্নান সারতে দেরি দেখে সেঁজুতি ঘুমিয়ে পড়েছিল,সেই সুযোগে মেঘ বদমাইসি করে সব্বাইকে বলেছিল, তোদের দিভাই তোদের ছেড়ে অনেক আনন্দ করেছে সকালে আমার সাথেবেরিয়ে। সুতরাং ওর শাস্তি হওয়া দরকার! তাই সেঁজুতি দি যখন ঘুমোচ্ছে মেঘদা বাদবাকি সব্বাই কে নিয়ে গিয়ে একটা ফাটাফাটি লাঞ্চ গিফট করেছিল। সেদিন সব্বাই মিলে খুব মজা করেছিল ওরা। সেঁজুতি ঘুম থেকে উঠে সবার সামনে খুব চিৎকার করে বলেছিল এটা ঠিক করলি না তোরা। কিন্তু পরে মেঘকে বলেছিল। আমার বাচ্ছা গুলো-তো শান্তি পেল। আসলে সেঁজুতি আর মেঘ দুজনেই ওদের থেকে বয়সে অনেকটাই বড়, ওদের দুজনের প্রতি ওদের ভালবাসা, আব্দার, স্নেহ শ্রদ্ধা মিলে মিশে এমন একখানা সম্পর্ক হয়ে গেছে, মেঘকে মাঝে সাঝেই আদর করে সব্বাই বাব্বা আর সেঁজুতি -কে মা বলত।

আমি না হয় একটা দুপুর না খেয়ে থাকলাম, কি হয়েছে তাতে বল! বাচ্ছা গুলো না হয় মজা পেল, তা বলে তুমি ও ! তুমি পারলে?
মেঘ বলেছিল, বিশ্বাস কর, আমি ও আজ ওদের সাথে কিচ্ছু খাইনি। ওদেরকে  বলেছিলাম  আমি আর তোদের দি-ভাই দুজনে পেট ভরে ব্রেকফাস্ট করেছি, আর খেতে পারব না রে। সত্তিই সেদিন মেঘ ওদের সাথে কিচ্ছু খায়নি- কি করে খাই বলত ? তোমায় ছাড়া কি গলা দিয়ে কিছু নামবে আমার ! তুমি তো সেটা ভাল ভাবেই জানো।

তবু ও সত্যিটা  তো সত্যিই হয়। কি করে অস্বীকার করি ! সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই বদলে যায়। আজকাল এমন একখানা বাস্তবতার মুখোমুখি আমরা । মেঘদা আর সেঁজুতি দি হঠাৎ রাস্তায় মুখো মুখি হলে ও এমন ভাব দেখায় -যেন কেউ কাউকেই চেনেনা,জানেনা যেন সম্পূর্ণ অপরিচিত দুজন! ওরা অনেক চেষ্টা ও  করেছিল-তবুও কেমন যেন সব কিছু এলোমেলো হয়েগেছে। আর এই সব কিছুর জন্য দায়ী একমাত্র শুভ, সেটা সবাই স্বীকার করে।

#



সেদিন সারাটাক্ষন সেঁজুতি বিছানায় বসেই কাটাল। আজকে আর আগের মত শরীরে ব্যাথা নেই, বেশ কিছুটা সুস্থ লাগছে তার, দুপুরে  বেডে বসেই খেল প্রিয়াদের সাথে গল্প করতে -করতে। এর মধ্যে সেঁজুতি প্রিয়ার সাথে কথা বলে বুঝেছে, তার এখবর বাইরের কেউ জানেনা। এমনকি তার বাড়িতেও কেউ জানেনা। অন্তত আর যাই হোক, সেঁজুতিকে বাইরে বেরিয়ে আর সহস্র ধর্ষিতার মত নোংরা  সমাজের তাচ্ছিল্যটা তাকে অন্তত ফেস করতে হবে না- এটুকু নিশ্চিত। সে আবার গিয়ে রাস্তায় নামতে পারবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারবে। সমাজের বঞ্চিত মানুষদের নিয়ে আবার সে আন্দোলনে এগিয়ে যেতে পারবে। সেই মিছিলে বিদ্রুপ বা তাচ্ছিল্য কিছুই আসবে না, তার জীবনের ঘটে যাওয়া এই দুর্দিন নিয়ে।

হ্যাঁ এবার থেকে মুখের আড়ালে মুখোশ গুলো সে বেশ ভালভাবেই চিনতে পারবে। সব মুখোশ গুলোকে টেনে বের করবেই। হয়ত এমন মুখোশ গুলোর ভীড়ে পার্টির আদর্শ ন্যায়-নীতি সঠিক থাকা সত্বে- ও ওরা মানুষের সেই গভীর আবেগ স্পর্শ করতে পারছেনা। বা পার্টির সাফল্যতা আনতে পারছিনা। এ গুলোকে টেনে বের করে ছুঁড়ে ফেলবেই সে -এখন থেকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ । সেঁজুতি সেদিনের ঘটনাটা প্রিয়াকে বলতে চেয়েছিল-
প্রিয়া বলল- থাক না দি-ভাই, ওসব কথা।
তুমি সুস্থ হয়েগেছো ব্যাস, আমরা আর কিচ্ছু চাইনা। তুমি নিজেই তো বুঝতে পেরেছ ওই জানোয়ারটার চরিত্র। আমরা অনেক আগেই জানতাম ছেলেটা কেমন।
কেন,  মনে নেই! তোমার সাথে মেঘদার যখন বনিবনা হচ্ছিল না, ও তো তোমার খুব ভাল বন্ধু সেজে থাকত সে দিন, একবার ও তোমাদের মধ্যে সব ঠিক-ঠাক হয়ে যাক সেই চেষ্টা করেছে? তুমি বল তো ?  তা না করে নিজেই মেঘদার জায়গা নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। আর যাই হোক ছেলেটা-যে সৎ ছিলনা সেদিনই আমরা বুঝে গেছিলাম। কেন মেঘ-দা ও তো বহুবার ফোন করে ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিল, সৎসাহস থাকলে তো কথা বা দেখা করতেই পারত। সে সাহস ও ছিল না ছেলেটার। অসৎ-যে ছিল, আমরা আগেই জানতাম। আমরা অনেক ছোট্ট তোমাদের থেকে, তোমাকে আর মেঘদাকে দুজনকেই ভালবাসি ও শ্রদ্ধা করি। তাই তোমাদের মাঝে ঢুকে এসব না বলতে পারলে ও, তোমায় ইনডিরেক্টলি বহুবার বোঝানোর চেষ্টা ও করেছি। না বুঝলে আমরা কি করব ! প্রিয়া এক নিশ্বাসে বলল কথা গুলো-
যাক ছাড় ও সব কথা।
- বুঝলি প্রিয়া ,
 আমি স্পষ্ট এখন বুঝতে পারছি, সত্যি আমি খুব ভুল করেছিলাম রে, সেদিন ভুল বুঝে মেঘের সাথে যা অন্যায় করেছিলাম, ভগবান হয়ত তার যথাযথ শাস্তি-ই আমায় দিয়েছে। মেঘের কাছে গিয়ে ক্ষমা আমাকে চাইতেই হবে। জানি ও হয়ত ভাববে- এত কিছুর পর স্বার্থপরের মত আবার ওর কাছে ফিরে যেতে চাইছি। আসলে তা নয়, আমি আমার পাপ গুলো স্বীকার করে নিতে চাইছি। মেঘের সাথে কমিটেড ছিলাম যখন একদিন ও এরকম হয়নি , মেঘ আমাকে না বলে আমার গায়ে পর্যন্ত স্পর্শ করেছে।এমনকি আমাদের প্রথম চুমুটাও আমিই ওকে দিয়েছিলাম ,সেদিন ভীষন অপ্রস্তুতিতে পড়ে গেছিল মেঘ।

আর এদিকে এই পুরুষ-টাকে ও দেখলাম, ওর সাথে আমার বন্ধুত্বের বাইরে কোনো সম্পর্ক নেই অথচ- কোন অধিকারে আমার শরীরের প্রতি এমন পাশবিক ক্ষুধা ওর জন্মায় ! আমি জানি না- কি করে একটা মানুষ; এমন নোংরা একটা পথ ও বেছে নিতে পারে? এদের মানবিকতায় ও কি লাগে না। কেমন রুচি এসব মানুষের - এরাই আবার মিছিল জুড়ে বড় বড় স্লোগান দেয়, নারীবাদি আন্দোলন ও তো কম দেখিনি ওর কাছে। ওমন মেকি আন্দোলন দেখেই বলতে পারিস, আমি সেদিন ওর বন্ধুত্বে মজে গেছিলাম। মুখ আর মুখোশের মিছিলে মানুষ খুঁজে নেওয়াটা বড্ড বেশি শক্ত রে! আমি ও সেদিন মুখোশের ভীড়ে মুখ চিনতে ভুল করেছিলাম।

-  প্রিয়ারা সবাই সন্ধ্যের পর বাড়ি ফিরে গেছে। কাল সকালের দিকে ওরা সবাই ওদের দিভাই কে নিয়ে ফিরে যাবে। মেঘ ও এই কয়েকদিনের মত রাতের দিকে একবার রিসেপসানে এসে দেখা করে টাকাপয়সা সব মিটিয়ে দিয়েছে। যতটা বিল হয়েছে অনেকটাই কম চার্জ করেছে এখানে। ডঃগুপ্ত একদিনের ও ফিজ নেয়নি-এই হল এক সমস্যা, ব্রাহ্মণ পুজো করবেন, অথচ দক্ষিনা নেবেন-না, এ-ভীষন লজ্জা করে মেঘের। তবু ও তো উপায় ছিলনা। এমন ডঃ এর চিকিৎসা ছাড়া তো সেঁজুতি সুস্থই হতনা। ডঃ গুপ্তের প্রতি মেঘের ভীষন ভরসা।
মেঘ বাইরে অপেক্ষা করছিল ডঃ গুপ্তার জন্য। হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলে মিনিট তিনেক দূরেই হাইওয়ে। কাল সেঁজুতি- কে ছেড়ে দেবে, খানিক আগেই ডঃ গুপ্তের সাথে ফোনে কথা হয়েছে। উনি পপুলার নার্সিং হোমে  রাউণ্ড মেরেই এখানে আসবেন- আসতে প্রায় এখনো মিনিট কুড়ি মত সময় লাগবে বোধ হয়! পকেট থেকে সিগারেটটা বের করে, মুখে নিয়ে লাইটারটা দিয়ে ধরাল। একটানে যতটা সিগারেট টানা যায়,ঠিক ওমন একটা টান দিল- দুপুরের পর থেকে মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে আজ তার । সোজা  হাইওয়েতে পৌঁছে পেছন ফিরে নার্সিংহোমের দিকে তাকাল-অদ্ভুত একটা শ্রান্ত ভাব চারিদিকে- সামনে গেটে একটা টিম-টিম করে আলো জলছে, কেবিনের হালকা আলো জানালা চুঁয়ে পেছনের রাস্তায় এসে পড়েছে। শীতের রাত্রি হালকা কুয়াশায় ঢেকে আছে চারিদিক- স্পষ্ট কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। দূর থেকে লরির হেডলাইটের উজ্জ্বল আলো গুলো ও ভীষন ম্লান মনে হচ্ছে তার। এখানে দাঁড়িয়ে সেঁজুতির কেবিনের জানালাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।আম গাছটার ফাঁক দিয়ে, কুয়াশায়  পাতা-গুলো ভিজে গিয়ে আজ ভীষণ চকচক করছে। কত সময় ওদিকে তাকিয়ে ছিল খেয়েল নেই। ডঃ গুপ্তের ডাকে হুঁস ফিরল।
-কি হল!  এখানে দাঁড়িয়ে?
-এই যে আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি।
-তো রিসেপসানে গিয়ে বসতে পারতে তো। হিম পড়ছে খুব -মাথায় একটা ঢাকা তো নিতে পারতে!
-না ডাক্তারবাবু অভ্যেস আছে, তাছাড়া আপনি তো আছেনই,হাসতে হাসতে বলল মেঘ।
-ডঃ গুপ্ত হাসতে হাসতে বললেন,- অনেক হয়েছে, চল ভেতরে যাই। পেশেন্ট গুলো দেখে এসে বরং গল্প করা যাবে।

ডাক্তার গুপ্তা পেশেন্ট গুলো দেখা শেষ করে,  অফিসে বসে বসে সমস্ত প্রেস্ক্রিপকশান রেডি করে দিলেন। তারপর  মেঘকে বলল- চল এগোই, জান তো মেঘ- মাঝে মধ্যে মনে হয় পৃথিবীতে মানুষ আবার আদিম হিংস্রতার যুগে ফিরে যাচ্ছে। মানুষের রুচি-মুল্যবোধ, দয়া-মায়া, মানবিকতা,সব ফুরিয়ে যাচ্ছে,মানুষ আবার আদিম বর্বর যুগে ফিরে যাচ্ছে। আজকে আবার একটা বাচ্চা মেয়ে ধর্ষন হল। এই মাত্র ওখান থেকেই ফিরে আসছি। এই টুকু একটা চার বছরের বাচ্চা মেয়ে। ছিঃ মানুষ আর পশুর মধ্যে কোন ফারাক নেই আর !
-আচ্ছা মেঘ, একটা সত্যি কথা বলবে?
-বলুন ডাক্তারবাবু,
-আমার ঘুব জানতে ইচ্ছে করছে, তুমি কেন চাইছনা; ছেলেটা শাস্তি পাক!
কি হবে বলুনতো !
এই তো কয়েকদিন আগেই ধনঞ্জয়কে  ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, তাতে কি রেফ কমেছে?
আসলে - সমাজে সমস্ত ধরনের অন্যায়ের কারন হল মানুষের মূল্যবোধ। যা আজকাল বেশিরভাগ মানুষ  হারিয়ে ফেলেছে।  সবাই কেমন যেন নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিচ্ছু বোঝে না। তাতে কার কতটা ক্ষতি হল বা কার উপর কতটা অন্যায় করা হল, এসব নিয়ে কেউ আর ভাবেনা-
শুধু রেফ কেন ? সমাজে আর ও হাজার খানা কিছু চরম অন্যায় ঘটছে রোজ। তার কতটুকুই বা আমরা প্রতিবাদ করতে পারি! কটা নোংরা মানুষকে আমরা শাস্তি দিতে পারি! এই যে ধরুন সেঁজুতির সাথে যেটা ঘটেছে- সে তো বন্ধুত্বের প্রতিশ্রুতিতে নিরাপত্তায় ভরসা করে ঠকেছে। আপনি কি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারেন ! সেঁজুতি ও কোনোদিন কোনো ছেলেকে নিরাপত্তার আশ্রয় দেবে বলে, একদিন প্রতিজ্ঞ্যা করে ও প্রতিজ্ঞ্যাটুকু রাখতে পারেনি? তাকে হয়ত একদিন চরম কস্ট দিয়েছে, সেটা ও কি রেফের থেকে কিছু কম!

আপনি বলুন, সেই ছেলেটাকে-ও তো একান্তে একা-একা চরম হতাশা-কস্ট-আর ব্যক্তিত্বের অবমানাননা নিয়ে কাটাতে হয়। কই সেই আন্দোলন তো কেউ কোনোদিন করেনি! সমাজ এখন একটা ভয়ংকর  অসুখে ভুগছে। মনে হয় সমস্ত জন্তুজানোয়ার জঙ্গল ছেড়ে দাঁত-নোখ কেটে এই শহরের সভ্য মানুষের সাথে মিশে গেছে। আপনি এই এত সহস্র মানুষের ভিড়ে কজনকেই বা খুঁজে পাবেন? আর কজনকেই বা শাস্তি দিতে পারবেন, বলুনতো !

সুৎরাং, যতদিন মানুষ সামগ্রিক ভাবে মানুষের মুল্যবোধ নিয়ে ফিরে আসতে না পারবে, ততদিন আপনি আমি দু-একজনকে শাস্তি দিয়ে সমাজের অসুখ সারাতে পারবোই না। এই ধরুন একটা চার বছরের বাচ্ছা মেয়ের সাথে এমন একটা ঘটনা ঘটল। আপনার মনে হয়, এটা ধর্ষন? আমার তো মনে হয়-এটা একটা পাশবিকতা ছাড়া আর কিছুই না! মানুষ তো এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীব। তার চরিত্রগত দিক থেকে সে যে সম্পুর্ন পৃথক এবং সবশ্রেষ্ঠ, সেটা মানুষের নিজের চরিত্র -আচার -আচরন ব্যাবহার ইত্যাদি দিয়ে প্রত্যেক মুহুর্তে প্রমান করে। এবং নিজেকে বাদবাকী পশুদের থেকে পৃথক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছে। বাদ বাকী প্রানীদের থেকে তারা যে যথেষ্ট রুচিশীল। প্রত্যেকটা পদক্ষ্যেপে তা প্রমান করবেই। এটাই স্বাভাবিক, এমনকি যৌনতার ক্ষেত্রে ও এর ব্যাতিক্রম হয় না-

এই পৃথিবীর প্রত্যেকটা প্রানী,গাছ-পালা,পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ সবার মধ্যেই যৌনতা বিদ্যমান। এবং এই যৌন আকর্ষন বীপরিত লিঙ্গের প্রতি থাকবেই, এটাই স্বাভাবিক। এবং যা প্রত্যেকটা প্রানী-এবং জীবজগতের অতি প্রয়োজনীয় একটা কার্যকলাপ। মানুষ উচ্চ রুচি সম্পন্ন জীব। তাই তার উচ্চরুচির পরিচয়-স্বরুপ প্রত্যেক- কটা কার্যকলাপে জংগলের পশুদের থেকে নিজেকে পৃথক এবং উন্নত প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছে, শুধুমাত্র উচ্চ রুচি আচার আচরন আর তার চরিত্রগত ব্যাবহারের মাধ্যমে। যৌনতার ক্ষেত্রে ও মানুষ উচ্চরুচির পরিচয়-স্বরুপ প্রেম নামক একটা পবিত্র বস্তুর জন্ম দিয়েছে । দুটি ভিন্ন লিঙ্গের মানুষের মনের মধ্যে পবিত্র একটা প্রেমের জন্ম হয়।সেই প্রেম ক্রমশ মন থেকে আশ্রয় নেয় দেহে। তখন উভয়ে উভয়কে পূজার নৈবেদ্যর মত ঈস্বরের কাছে নিজেকে যে ভাবে উৎসর্গ করে,ঠিক একই রকম ভাবে দুটি মানুষ নিজেদের কাছে নিজেদের  সম্পূর্ণ  উৎসর্গ করে দেয়। মানুষের ক্ষেত্রে এমন উচ্চরুচিসম্পন্ন প্রেমের নাম হল যৌনতা। আর এমন যৌনতার দান হল মাতা মেরীর কোলে পুত্র যীশু।

কিছু মানুষের রুচি যখন পশুদের  আচার ব্যাবহারকেও স্পর্শ করে,সেক্ষেত্রে মানুষটি আর মানুষ থাকে না।
ডঃগুপ্তা  অনেক কিছুই জানেন, কিন্তু এরকম কথাবার্তা প্রথম কারোর কাছ থেকে শুনছেন আজ ,তাও আবার ছেলের বয়সী একটা যুবকের থেকে। সত্যি বয়স বাড়লেই যে মানুষের অভিজ্ঞতা বাড়ে, তা নয়। অনেক সময় কিছুকিছু মানুষ দৈনন্দিন ঘাত-প্রতিঘাতের সাথে লড়াই করতে- করতে অনেক বেশি অভিজ্ঞ হয়ে উঠে। মেঘ তার প্রকৃষ্ঠ উদাহরন হয়ত- হাঁটতে হাঁটতে ডঃগুপ্তার সাথে মেঘ হাইওয়ের পাশে এসে দাঁড়াল, ডঃগুপ্তার ড্রাইভার গাড়িটা নিয়ে চলে এসেছে ওদের পাশে। দরজাটা খুলতে খুলতে মেঘকে বলল-
একদিন রোববার দেখে বাড়িতে এস। তোমার বৌদি ও বলেছিল অনেকবার , অনেক গল্প হবে।ঠান্ডাটা ও আজ ভীষন বেড়েছে।  সাবধানে ফিরে যেও, বেশি- দেরি করনা।
গুডনাইট-
মেঘ ও প্রত্যুত্তরে গুডনাইট জানাল।

ক্রমশ ডঃ গুপ্তার গাড়িটা হাইওয়েতে ঘন কুয়াশায় মিলিয়ে যাচ্ছে- বড় একটা ট্রাক পাশদিয়ে হুস করে বেরিয়ে গেলো, ঠান্ডা হিমেল হাওয়া সারাগায়ে এখন ও লেগে আছে। ঘন কুয়াশায় আবছায়া চারিদিক, অন্ধকারে যত দূর চোখ যায় কোথাও আলো নেই -বড় একটা গাছের পাতা থেকে টুপ করে একঁফোটা হিম ঝরে পড়ল মেঘের কপালে, ভীষন ঠান্ডা সে- পরশ। ইচ্ছে করছে একটু খালিপায়ে ঘাসের ওপর হাঁটতে।কত দিন ভেজাঘাসের ওপর হাঁটা হয়নি তার। ছোটবেলার দিন গুলোর কথা ভীষন তার মনে পড়ছে এখন-গ্রামের বাড়ির উঠোনে শীতের সকাল, সবে হালকা একটু রোদ উঠেছে-পাশে পেপেগাছের পাতা থেকে ফোটা-ফোটা শিশির টুপ-টাপ আওয়াজ করে ঝরে পড়ছে।আর ঠিক পাশেই দাদু চাদরমুড়ি দিয়ে বর্নপরিচয় পড়াচ্ছেন।সেদিনের সেই ছোট্ট মেঘ একটু পড়ছে, আর উঠে গিয়েই ছোট্টছোট্ট পা নিয়ে ভিজছে, শিশিরে ভেজা ঘাসেদের দেশে। পেছন থেকে হঠাৎ একটা আলোচ্ছটা ঘাসে এসে পড়ল, মনে হল সেখানে বুঝি সহস্র  মুক্তো পড়ে আছে।আলোর উৎসর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে মেঘ দেখতে পেল- সেঁজুতির কেবিনের জানালা থেকেই আলোটা আসছে। আর ছায়ামূর্তির মত জানালার ধারে দাঁড়িয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে।হয়ত এই অন্ধকারেই সেঁজুতি আবার খুঁজছে জীবনের শেষটুকু আলো।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ