আচ্ছা পদবীটা কি দত্ত না হয়ে অন্য কিছু হলে আমার একটু কম মন খারাপ হতো? জানি না, শুধু ভাবছি যে মানুষটাকে কখনো চোখেই দেখি নি, তাঁর মৃত্যুর সংবাদ যে এতোটা বিষণ্ণ করে তুলবে তা কি তাঁর জীবিত অবস্থায় কখনো বুঝেছি? না, বুঝিনি। তিনি ফেসবুকে আমার কয়েক হাজার বন্ধুর একজন ছিলেন যিনি কখনো আমার কোনো পোস্টে লাইক দিয়েছেন বলেও মনে পড়ে না। অথচ, অন্য অনেকের থেকেই তাঁকে আমার বেশি বন্ধু মনে হতো। তিনি আমার বন্ধুই ছিলেন। আমি হয়তো তাঁর বন্ধু ছিলাম না। হয়তো কেন, নিশ্চিত ভাবেই ছিলাম না।
কবি ও শূন্যকাল পত্রিকার সম্পাদক দীপংকর দত্ত-র কথা বলছি, আজ সকাল থেকেই যাঁর বেঁচে থাকার জন্য আর এই পৃথিবীর জল-বায়ুর প্রয়োজন হচ্ছে না।
মনে আছে, বছর তিনেক আগে একটি বহির্বঙ্গের বাঙালি কবিদের কবিতা সংকলন সম্পাদনা করার সময় শ্রী অরুণ চক্রবর্তীকে অনুরোধ করেছিলাম দিল্লির কবিদের নাম ও ফোন নম্বরের একটি তালিকা দিতে। উনি দিয়েওছিলেন। কী কারণে এখন আর ঠিক মনে নেই, সেই তালিকার প্রায় সব কবির কাছ থেকেই কবিতা সংগ্রহ করলেও শুধু দীপঙ্কর দত্ত বাদ পড়েছিলেন। তাছাড়া আজ স্বীকার করতেও কোনো লজ্জা নেই, তখন পশ্চিমবঙ্গ থেকে বৎসরান্তে সংগ্রহ করে আনা মূলস্রোতের প্রিন্ট মিডিয়ার বাইরে এত সব ওয়েব-টোয়েব পড়ার অভ্যাস না থাকাতে পঁচিশ বছর ধরে দেশের পশ্চিমপ্রান্তবাসী আমার কোনো ধারণাই ছিল না দেশের উত্তরপ্রান্তে বসে কে বা কারা কী ও কেমন লিখছেন। দীপঙ্কর দত্তের নামের সাথেই আমার কোনো পরিচয় ছিল না তার লেখা তো দূরের কথা। তা সেই সংকলন প্রেসে চলে যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন দীপঙ্করের সঙ্গে যোগাযোগ না করার জন্য অরুণদার মারাত্মক ধমক খেয়ে ওকে ফোন করেছিলাম, স্বাভাবিক ভাবেই মনের ভেতর ওর প্রতি একরাশ বিরাগ নিয়ে। আমার মনে হয়েছিল ওই বুঝি অরুণদাকে দিয়ে বলিয়ে আমাকে কবিতা নিতে বাধ্য করছে। কিন্তু ফোন করে ওর সঙ্গে কথা বলে বুঝেছিলাম দীপঙ্কর শুধু নিরহংকারী ও মিশুকেই নয়, আমার ঐ সংকলনে কবিতা থাকা না থাকা নিয়ে ওঁর নিজের কোনো মাথাব্যথাই ছিল না। পরে মনে হয়েছিল অরুণদা নিজে থেকেই ফোনটা করে ধমকে আমার যে কী উপকারই করেছিলেন! দীপঙ্করের কবিতা আসলে ঐ সংকলনকেই ধনী করেছিল।
তাড়াতাড়ি করে আমার নিজের ও অন্য কারো একটা করে কবিতা কমিয়ে দীপংকরের কবিতা তো শেষ মুহূর্তে প্রেসে পাঠালাম কিন্তু সৌজন্য সংখ্যা পাওয়ার পর দিল্লি থেকে হঠাৎ পীযূষ বিশ্বাসের ফোন, ওর প্রিয় দীপঙ্করদার একটা কবিতার নাকি অর্ধেক ছাপা হয়েছে। পরের দিন অত্যন্ত সঙ্কোচের সাথে ফোন করেছিলাম দীপঙ্করকে, ততদিনে আমি জেনে গেছি যে ও প্রায় পঁচিশ বছর ধরে কবিতা লিখছে, ওর একাধিক বই প্রকাশিত এবং ও শূন্যকাল পত্রিকার সম্পাদক। আমি যখন মনে মনে অজুহাত হাতড়াচ্ছি, ও খুব স্বাভাবিক স্বরেই ফোনে বলেছিল, এখনও মনে আছে, "আরে এমন তো হতেই পারে। আমার কবিতা অত দেরি করে পেয়েছো।প্রুফ দেখারও নিশ্চয়ই সুযোগ পাও নি। পরে যদি কোনো সংস্করণ হয়, পারলে ঠিক করে নিও।" পরে সংস্করণ হয়েছিল, আমিও সংশোধন করে কপিও পাঠিয়েছিলাম এবং ও খুব খুশি হয়েছিল। আজকের এই কথায় কথায় অন্যকে দোষারোপ করার যুগে সেদিনই বুঝেছিলাম ওর হৃদয় কতটা প্রশস্ত ছিল। ও চাইলেই আমার সেদিনের ত্রুটিটাকে ইচ্ছাকৃত বলে অভিযোগ করতে পারতো। অন্য অনেকেই হয়তো তাই করতো।
তারপর থেকে ওর সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে অনেকবার। আমিই ফোন করেছি নানান প্রয়োজনে। কথা হয়েছে ওর লেখায় অন্য ভাষার শব্দ ব্যবহার প্রসঙ্গে। ওর কবিতা দুর্বোধ্য আমার এই অভিযোগে ধৈর্য সহকারে ফোনে আমার সঙ্গে আলোচনা করেছে। কখনো উপেক্ষা করেনি।
গত বছর দিল্লি গিয়েছিলাম বইমেলায় আমন্ত্রিত হয়ে। মুম্বাই থেকেই কথা হয়েছিল পীযূষ আর দীপঙ্করের সাথে আড্ডা হবে মেলার অনুষ্ঠানের পরে। হয়েওছিল, অন্য কবি বন্ধুদের সঙ্গে তুমুল এক আড্ডা। কিন্তু, সেদিন দীপঙ্কর সেই আড্ডায় যোগ দিতে পারেনি কোনো কারণে। আপশোস থেকে গেল ওর সঙ্গে আড্ডার সেই সুযোগটা এখানে আর হলো না।
তবে, হবে নিশ্চয়ই একদিন, অন্য কোথাও, অন্য কোনো ঠেকে।
1 মন্তব্যসমূহ
এক একজন মানুষ থাকেন যাঁদের তুলনা করার মতো উপমা খুঁজে পাওয়া যায় না।
উত্তরমুছুনসুচিন্তিত মতামত দিন