নাসির ওয়াদেন

নাসির ওয়াদেন


■ শারদ সংখ্যা : অন্বেষা, অর্পণ, বাহিনী ও সাহিত্য বন্ধন
প্রসঙ্গে কিছু কথা 



লিটিল ম্যাগগুলো সাহিত্যের আতুর ঘর ।এ প্রসঙ্গে নানা মহিষী নানা রকম মন্তব্য পোষণ করেছেন । কিন্তু লিটিল ম্যাগের ক্ষমতাও যে অসাধারণ তা বারে বারে প্রমাণিত । শারদীয়ার সময়ে বেশি বেশি লিটিল ম্যাগ প্রকাশ হতে দেখি ।ইতিমধ্যে আমার ভাঁড়ারে অনেকগুলো লিটিল ম্যাগ জমা পড়েছে, যা সহিষ্ণু সম্পাদকগণ গাঁটের কড়ি খরচ করে ছাপছেন ও পাঠিয়েছেন । তাঁদের উদারনৈতিক চিন্তাকে মূল্য দিতে কিছু পত্রিকার আলোচনা করা হচ্ছে । ম্যাগগুলোতে গুণগত মান যাই হোক, ভূমিষ্ঠ শিশুর মধ্যেও বিশাল সম্ভাবনা থাকা অনাশ্চর্ষের নয়, সেই সম্ভাবনাকে খুঁচিয়ে তুলে ধরার ক্ষেত্রে লিটিল ম্যাগগুলোর ভূমিকা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ । 

" অন্বেষা" সাহিত্য পত্রিকার মধ্যে কিছু বিজ্ঞাপন আছে, যা পত্রিকার পক্ষে সহায়ক । সম্পাদক তার বক্তব্যে "অন্বেষার মধ্যে আমরা যে, সাহিত্য সম্ভাবনার বীজ বপন করছি একদিন সেটা ফুলে ফুলে বিকশিত হবে ।' তিনি স্বীকার করেছেন যে, আমাদের পত্রিকার ছোট পরিসরেও অনেক নতুনদের জায়গা করে দিই, কিন্তু যখন কোন সাহিত্য সভা আমি একডজন কবিতা লিখেছি, তখন অবাক হই । কবিতার ক্ষেত্রে ভাব আবেগ থাকে, কিন্তু কিছু কবিতা ছাপার যোগ্য না হলেও অনুরোধে ছাপতে হয় , আমার এখানেই আপত্তি । ভাল লেখা ছাপার জন্য কঠোর না হলে, দুর্বল কবিতা ছাপলে পত্রিকার মান নিম্নমুখী হবে এবং বিদ্বজ্জনের পাতে তুলে দিতে সঙ্কোচ বোধ জাগে , নবীনদের শিক্ষণীয় হয়ে ওঠে না ।

পত্রিকাগুলো বেশির ভাগই পত্র সাহিত্য থাকে, তবে কবিতার সংখ্যাও কম নেই ।গল্পের সংখ্যা বেশি, কিছু প্রবন্ধও আছে ।কবি তৈমুর খান এর ' নীরা, কালসীমাহীন অনন্তের প্রজ্ঞা ' ও রাজেনদার ' স্রষ্টা এবং সংগ্রামী মহাশ্বেতা দেবী ' ভাল লাগল । গল্পের মান খুব উন্নত না হলেও চলবে। সম্পাদককে বজ্র কঠোর হস্তে মসির স্খলন ঘটাতে হবে ।সর্বোপরি প্রচ্ছদ ও অলংকরণ যুতসই বলা চলে ।এজন্য সম্পাদককে ধন্যবাদ জানাতেই হচ্ছে ।

" অর্পণ " দশ বছরের পুরনো সাতাশতম সংখ্যা, নেহাত অভিনন্দন যোগ্য ।যেখানে লিটিল ম্যাগগুলো বড় জোর ৩|৪ বছরের বেশি বাঁচে না , পথ চলতে গিয়ে 'মরুপথে হারিয়ে যাওয়া ধারার মতো হারিয়ে যায়নি ।প্রচ্ছদ, অলংকরণ সুশোভন । বিজ্ঞাপন থাকলেও যৎসামান্য, যা দিয়ে খরচ তোলা যাবে না ।সম্পাদক জানালেন যে, পা ফেলে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছে লক্ষ্যের পথে ।কিছু মণিষীর প্রাপ্তির সংবাদ ছাড়া পাওয়ার মতো কিছুকিছুই রাখলেন না ।আগামীতে সম্পাদকের ভাব-ভাবনার প্রতিফলন হতে দেখব, যাতে পত্রিকার মান ও কৌলীন্য বজায় থাকে ।' কবি রমেন্দ্র কুমার আচার্য চৌধুরীর কবিতার চিত্রকল্প রূপের অবতারনা করেছেন হেমন্ত গরাই, কিন্তু ব্যাখ্যাত পরিসরে স্বল্প ।ভাল লাগল। নতুন প্রজন্মের লেখকগণ সমৃদ্ধ কিছুটা হবে ও তাদের কাছে শিক্ষণীয় ও বটে ।'আমাকে আমার মতো থাকতে দাও ' বিষয় নির্ভর কবিতা, গল্প লেখার ফলে পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, তেমনি পত্রিকার বৈচিত্র্যে ধাক্কা খেয়েছে ।ইতিমধ্যে সম্পাদক মহাশয়কে পত্র দিয়ে পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করেছি , যাতে আগামীতে লেখকদের স্বাধীন চিন্তা নিয়ে 'বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য ' প্রতিধ্বনিত হয়ে থাকে ।কিছু গল্প ভাল লেগেছে, গল্প বলার সাবলীলতা লক্ষ্য করা গেছে ।সম্পাদক এক আলাপচারিতার সময় জানালেন যে, সঠিক উৎসাহী লোকের বড্ড আকাল। নতুনদের জায়গা দিতে গিয়ে দুর্বল লেখা ছাপতে হয়েছে ।তাঁর মধ্যে কোন ভনিতা বা চাতুর্য নেই ।

পুলিশ ও পাবলিকের সম্প্রীতির কাহিনী প্রচারের জন্য বাহিনী পত্রিকা, সম্পাদক ও সভাপতি দুজনেই প্রশাসনিক দক্ষতায় দৃঢ় ।তথাপি জনশাসন করতে করতে নির্মল চিত্তে সাহিত্য ভজনা করছেন দেখে ভাল লাগল ।পত্রিকাখানি অবয়বে ক্ষুদ্র হলেও সম্পাদকের সুদক্ষ হাতের ব্যবচ্ছেদের ফলে সবল ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে । পদ্য ছন্দে সম্পাদকের স্বল্প কথার মধ্যে ' শরতের মিস্টি মধুর আলোক ছটা 'মনের জ্বালা ঘোচাবে ।আনন্দমুখর হাওয়া ঝিকিমিকি রোদের বর্ণচ্ছটায় দশদিক উদ্ভাসিত হোক ।

কবিতা নির্বাচনে কিছুটা দক্ষতা লক্ষিত হচ্ছে । কবিতার ছড়াছড়ি, জড়াজড়ি, ফলে কাব্য সংকলন হয়ে গেছে । সম্পাদককে এ বিষয়ে পরামর্শ আগামীতে বিভিন্নতা যেন প্রকাশ পায় এবং সাহিত্য রস পিপাসুগণ যাতে একটু জলরস পান করার অভিলাষেই উৎসুক হয়ে থাকেন ।কবিকুলের তালিকাতে এপার ওপার বাংলার কয়েকজন বিশিষ্ট কবি আছেন, তেমনি অনামী নবীন কবিদের কবিতা ঠাঁই পেয়েছে ।কবি জীবনানন্দ দাশের কথায় -" সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি "-, লিখতে লিখতে একদিন কবি হয়ে যাওয়া আশ্চর্যের ব্যাপার নয়।কিন্তু কবিতা নির্মাণের ক্ষেত্রে ভাব, ভাবনা, আবেগ, অনুভূতিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে ।আজকাল আকছার গদ্য ছন্দে কবিতা লেখার বাতিক বেশি -তাল, লয়, ছন্দ, রূপ, কলা রীতি প্রকৌশল মানা হচ্ছে না, ফলে কবিতার শরীর কংকাল হয়ে থাকছে।তবে একেবারে যে, মানছে না তা নয়, কিছু কিছু কবিতার মধ্যে প্রচ্ছন্ন ভালবাসার সাথে হৃদয়ানুভূতির সুর ভেসে ওঠেছে ।

" মাটি যদি ফসল ফলায়, ফসল ফলবে /ঝরে পড়বে বৃষ্টির মনে পৃথিবীর নতুন রঙ ', 'দু'ফোঁটা জলের বদলে কেন দাও কর্তন •••', 'হলুদ দেখতে দেখতেই সন্ধ্যার কাছে /সূর্য হলো নত '।' আমার অক্ষরগুলি কোনদিন বীজ হবে ', 'বর্ণপরিচয়ের পাতায় পাতায় ছেঁড়া ছেঁড়া কথা ',' বিশ্বাসের বেড়া ভাঙে •••সোনালী স্বপ্নে ভেজা বৃষ্টিহীন বাতাসে ','আঁচলের হাওয়াতে ঘাসের সত্য পরিচয় 'ইত্যাদি পংক্তিতে মগ্ন চৈতন্যের ছোঁয়া লেপ্টে রয়েছে, এতে পত্রিকার গুণমানে কৌলীন্য বেড়েছে বলতে পারি ।

' সাহিত্য বন্ধন 'পত্রিকার প্রচ্ছদ ভাবনা স্বতন্ত্রতার দাবি করে ।সম্পাদক চরম সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে জাতির জীবনে হাজার হাজার বছরের সম্প্রীতি যাতে বিনষ্ট না হয়ে যায়, তার প্রতি সতর্ক থাকতে অনুরোধ জানিয়েছেন ।ঈদ ও মাতৃ পূজার মধ্যে যে মিলন ঐক্য পরম্পরাগত সম্প্রীতির আবহকাল আবহমান সুরে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে আসছে, কূট কৌশল ঝড়ে ছেদ না ঘটার আকুতি ছত্রে ছত্রে পরিলক্ষিত ।পত্রিকা সংবন্ধনে উন্নত চিন্তা ও মননবোধের কবিতার সাথে সাথে প্রবন্ধে ও গল্পে উন্নত ভাবনার প্রয়াস অব্যাহত। ডঃ মোহন শ্যাম ভাস্করের 'টেরাকোটা শিল্প ও বাঙালি সমাজ জীবনে তার প্রভাব 'উপস্থাপনা করেছেন । সাহিত্যিক আব্দুর রাকিবের ' লোক সংস্কৃতি : পরাজিত পরম্পরা '-উৎকৃষ্ট লেখনী, যার মধ্যে দীর্ঘ ঐতিহ্যকে নতুন স্বাদে পরিবেশন করেছেন ।সাধন রক্ষিত-এর 'মহাস্রোতা -দেবী মহাশ্বেতা 'স্মরণ সমৃদ্ধ বুননে আকীর্ণ ।প্রাবন্ধিকগণ দীর্ঘ দিন ধরে সাহিত্য চর্চা করে আসছেন ।

কবিতার পর্বে চোখ নিরীক্ষণ করে দেখতে গিয়ে কিছু পংক্তি তুলে ধরছি, যা দক্ষ সম্পাদকের যাদুদণ্ডের স্পর্শে মৃন্ময়ী রূপ চিন্ময়ী চেতনার মননে রূপ নিয়েছে ।' এখানেই বেশ আছি / গভীর দুঃখের ভেতর '-জীবনের যন্ত্রণা মলিন দিন যাপনের চিত্রকে স্ফুরিত করে ।'হিম শীতলে মায়ার বাঁধন তীরের কণা/বিঁধলো বুকে মনের স্বপন, ছিঁড়লো ডানা ',-ডানা ভাঙা পাখির মতো অসহায় জীবনের প্রতিবিম্ব হয়ে" আলোর দিশা পায় '।' সন্ধ্যা দেখি আলোতে আর আঁধারে মাখামাখি 'তখনই 'ছায়াকে আজকাল বড্ড ভয় হয়/কেন জানিনা ।'তবুও আমরা পরমুহূর্তেই দেখি 'জননীর মুখে জননীর ছবি '।অনান্য প্রবন্ধ ও স্বচ্ছন্দে, সাবলীল গতিতে চলমান পত্রিকার মান সুদৃঢ় রাখতে একটু কঠোর তো হতেই হবে ।

পরিশেষে, পত্রিকাগুলোর বিশদ আলোচনা করার অবকাশ না থাকলেও পড়ে, বুঝে যা মনে হয়েছে অকপটে তা তুলে ধরে আগাম প্রজন্মের লেখকদের কাছে উৎসাহ দেওয়া, মনের আনন্দে শুধু নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতা মনে রেখে বহু সম্প্রদায় বিশিষ্ট সমাজকে ঐক্যবদ্ধনের দ্বারা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য নবীন প্রবীণ লেখকদের মসি চালনা করতেই হবে ।শেষে বলি -" নদীর কাছে এলে পাখি মাছ হয়ে যায় ",হিংস্রতা নির্মূল হয়ে ভালবাসার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ুক অন্ধকিরাচ্ছন্ন সমাজের ভেতর, জাতির প্রজ্ঞা জ্বলুক প্রদীপগুচ্ছে জীবন্ত রূপে ।আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসা রইল সৃজনশীল ব্যক্তির প্রতি মহিমার বর্ণচ্ছটার উজ্জ্বল কিরণে ।।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ