সুশান্ত কুমার রায়

সুশান্ত কুমার রায়









বিশুদ্ধতা, সৌন্দর্য ও পবিত্রতার প্রতীক প্রথমে পদ্মফুল। এক সময়ে আমাদের দেশে বর্ষা ও শরৎকালে বিলে-ঝিলে শোভাবর্ধন করে ফুটে থাকতো মনোহারি পদ্মফুল। কিন্তু প্রকৃতি বৈরিতায় আগের মতো বিল-ঝিলের জৌলুষ হারিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি পদ্মফুলসহ আরও অনেক জলজ উদ্ভিদ আজ প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে। পদ্মফুলের বৈজ্ঞানিক নাম- Nelumbo nucifera । আর ইংরেজিতে যাকে Lotus বলা হয়ে থাকে। সাধারণত ইহা sacred lotus বা Indian lotus হিসেবে পরিচিত। এটি ভারতের জাতীয় ফুল। পদ্ম Nelumbonaceae পরিবারের অর্ন্তভুক্ত Proteales বর্গের অর্ন্তগত এক প্রকার হার্ব জাতীয় জলজ উদ্ভিদ। এটি উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলে জন্মে থাকে। ইরান, চীন, জাপান, নিউ গায়েনা, বাংলাদেশ, ভারত ও অষ্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে পদ্ম জন্মে । আমাদের দেশে পুকুর, ডোবা, হ্রদ, নদ-নদী, জলাশয় ও খাল-বিলে এক সময় প্রচুর পরিমাণে পদ্ম পাওয়া যেত। বর্তমানে পদ্ম তেমন একটা চোখে পড়ে না সেইভাবে। হয়তো আর কিছুদিন পড়ে নতুন প্রজন্মকে পদ্মফুল দেখাতে হয় যেতে হবে জাদুঘরে নতুবা কম্পিউটারে। পদ্ম সৌন্দর্য, বিশুদ্ধতা ও পবিত্রতার প্রতীক। বিশুদ্ধতা, সৌন্দর্য ও পবিত্রতার প্রতীক হওয়ায় নিচু বংশকূলে জন্ম গ্রহন করে বিখ্যাত বা উচ্চ পর্যায়ে অধিষ্ঠিত হলে তখন সেই ব্যক্তিটি ‘গোবরে পদ্মফুল’ নামক বাগধারায় পরিণত হয় এই পদ্মের কারণে। এতেই অনুমেয় হয় যে পদ্মের রূপ-সৌন্দর্য ও বাহার কত গুরুত্বপূর্ণ । প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন ধমীর্য় আচার অনুষ্ঠানে অনেক উদ্ভিদ ব্যবহৃত হয়ে আসছে, এসব উদ্ভিদকে বলা হয় ÔSecred PlantÕ বা ‘পবিত্র গাছ’। যেমন- বড়ই গাছ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের নিকট পবিত্র গাছ হিসাবে সুপরিচিত । তুলসী, বট, পাইকর, কলাগাছ ও পদ্ম সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিকট পবিত্র গাছ হিসাবে পুজা-পাবর্ণাদিতে ব্যবহার হয়ে আসছে সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই । সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপুজায় পদ্মফুলের প্রয়োজন হয় অবশ্যাম্ভাবী । তবে শাপলা ও পদ্ম বলা যায় একই সূত্রে গাঁথা কাছাকাছি প্রজাতির দুটি জলজ উদ্ভিদ। নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, ডোবা ও জলাশয়ে এক সময় শাপলা ও পদ্মের অবাধ বিচরণ ছিল মনোহরণ ও চোখে পড়ার মতো। পদ্ম, শাপলা, শালুক, কলমি, হেলেঞ্চা, ঘেচু প্রভৃতি উদ্ভিদ প্রতিবেশি হিসাবে একে অন্যকে জড়িয়ে জলাশয়ে উপস্থিত থেকে নিজেরা প্রস্ফুটিত হয়ে রূপ-সৌন্দর্য সুধা প্রকৃতির মাঝে অকাতরে বিলিয়ে দিতো স্বমহিমায়। ‘পদ্ম’ শুধু যে বিশুদ্ধতা, সৌন্দর্য ও পবিত্রতার প্রতীক হিসাবে মানুষের মনোহরণই করে তা নয়, পদ্মফুল প্রস্ফুটিত ও পরিপক্ক হয়ে যখন পদ্মখোঁচায় রূপ নেয় তখন আর এক অন্য রকম স্বাদ বা অনুভুতি। পদ্মকাঁটাকে অগ্রাহ্য করে যারা পদ্মখোঁচা খেয়েছেন তাঁরা হয়তো আজও তার রসদ অনুভব করতে পারবেন। এ প্রসঙ্গে কবিতার পঙক্তিমালা কে না উচ্চারণ করে- “কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে / দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহিতে ? ”... । শুধু কাঁটাকে অতিক্রম করার মধ্যে যে ভীতি সঞ্চারবোধ তা কিন্তু নয়, পদ্মফুল ও পদ্মখোঁচাকে পেতে অনেক সময় বিষধর সাপের বিপত্তিও কম বড় ছিল না। বড় বড় পদ্ম পাতার আবরণে লুকিয়ে থাকতো বিষধর সাপ। আর এই প্রতিকূলতাকে জয় করে পদ্মফুল ছিনিয়ে আনার মধ্যে যে তৃপ্তি ও আনন্দ তার মজাই আলাদা । পদ্মফুল আর পদ্মখোঁচার সাথে ‘শাপলাফুল’ আর ‘ভ্যাট’ আহরণ ছিল অন্য আর এক রস আস্বাদন। শাপলার ভ্যাট থেকে তৈরি হতো খৈ ও মোয়া। 

পদ্মের ব্যবহার শুধু এই গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা কিন্তু নয়। খাদ্য ও ওষুধি গুণ হিসাবে পদ্ম আজ সারা বিশ্বে সমাদৃত। ‘সুগন্ধি’ বা ‘অ্যারোমা’ হিসাবে প্রসাধনী শিল্পে পদ্ম ব্যবহৃত হচ্ছে। গবেষকরা প্রমাণ করেছেন, পদ্মের এন্টি অবেসোজেনিক ও এন্টি ডায়াবেটিক ঔষুধি গুণ আছে । এছাড়াও রয়েছে ন্যুসিফেরিন, অ্যাপোরফিন ও আরমেপ্যাভিন জাতীয় অ্যালকালয়েড। ছোটবেলার সেই শৈশব ও স্মৃতি কার না মনে পড়ে ! তখনকার দিনে গ্রামাঞ্চলের হাট বাজারে পদ্মপাতার ব্যবহার ছিল আর এক অনন্য শিল্পকর্ম। আর পাতার প্রথম ব্যবহার যিনি শুরু করেছিলেন তাঁকে আমরা ‘শিল্পী’ অভিধ্যায় অভিসিক্ত করতে পারি। কারণ তখনকার দিনে হাট-বাজারে লবণ ও অন্যান্য জিনিসপত্র বাঁধার কাজে এবং মেলায় গুড়, চিনি, বাতাসা, নারু, মোয়া, মুড়ি, মুড়কি পদ্মপাতায় সুন্দরভাবে টোপলায় বেঁধে বিক্রি করতো দোকানদারেরা। সহজলভ্য ও পরিবেশ বান্ধব হওয়ায় এটির ব্যবহার ছিল অতুলনীয়। যদিও পরিবেশ বান্ধব কথাটি তখনকার দিনে সেইভাবে কেউ হয়তো ভাবেনি। তবে বর্তমান প্রযুক্তির যুগে এটি বিষাক্ত ও অবিনশ্বর পলিথিনের চেয়ে হাজার গুণে ভাল ছিল একথা আজ সর্বজন স্বীকৃত। শুধু পদ্মই নয় শাপলা, শালুক, কলমি, হেলেঞ্চাসহ অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ সংরক্ষণে প্রকৃতিবিদ, পরিবেশ বিজ্ঞানী ও উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের ভাবতে হবে এখনই। রয়েল বোটানিক্যাল গার্ডেন, কিউ, যুক্তরাজ্যে বিলুপ্তপ্রায় বা প্রতিকূল পরিবেশে হুমকীর সম্মুখীন এমন উদ্ভিদ গুলোকে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সারা বিশ্বে প্রায় ষোলশত বোটানিক্যাল গার্ডেন আছে। যেখানে দুর্লভ প্রজাতি, অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি এবং ট্যাক্সোনোমিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতির গাছ লাগানো হয়। উদ্ভিদ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং সেগুলোকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ÔInternational Union for Conservation of Nature and Natural ResourcesÕ (IUCN) নামক একটি বেসরকারি সংস্থা ১৯৪৮ সালের ৫ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয় ইউনেস্কো ও ফ্রান্স সরকারের যৌথ উদ্যোগে। IUCN এর মাধ্যমে ‘সারভাইভাল সার্ভিস কমিশনে’র অধীনে বিশ্বের বিপদ জনক, বিলুপ্ত বা বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতি সমূহের প্রকাশিত ও তথ্য সম্বলিত একটি পুস্তক হচ্ছে ÔRed Data BookÕ । ফ্লোরা (Flora) এবং ফনা (Fauna) উভয়ের জন্য বিপদ জনক, বিলুপ্ত ও বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির অবস্থানিক মান বা পর্যায় প্রকাশের জন্য ÔRed Data BookÕ এ কতকগুলো শ্রেণি বা ক্যাটাগরী ব্যবহার করা হয়। দিন দিন আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পদ্ম। তাই বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি বিশ্বের সকল দেশের সরকারকে প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ না করে এগিয়ে আসতে হবে । তবেই বাঁচবে বিশ্ব, আমরা ও আমাদের মতো হাজারো উপকারভোগী জীবকূল। পরিশেষে বলতে চাই, প্রিয়জনকে উপহার হিসাবে পদ্মফুলের চেয়ে অন্য ভাল কিছু আর কি হতে পারে ? আর পদ্মের যদি সৌন্দর্য বা বাহার বৈচিত্র্যই যদি মানুষকে আকৃষ্ট না করতো তাহলে “কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন” প্রবাদটিই বা এলো কোথা থেকে ?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* মন্তব্য করতে পেজটি রিফ্রেশ করুন .