মৌ দাশগুপ্ত























ঘন নিকষ জঙ্গল। বাইরে কাল ঠান্ডা। ফোঁটায় ফোটাঁয় শিশির ঝরার টুপটাপ শব্দটা সুর তুলেছে সারাদিন ধরে এলোমেলো হাওয়ায় ঝরে পড়া শুকনো পাতাতেও। মাদল ধামসা বাজিয়ে দ্রুতলয়ের লোকগীতির হালকা সুর ভেসে আসছে।  ঘড়িতে সবে সন্ধ্যা আটটা। এমন কিছু রাত বলা যায়না। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ , রুমহীটার চলছে। সামনের খোলা বারান্দায় গিয়ে এক-দু’বার যে দাঁড়াইনি তা নয়, বাইরে তাকালে মনে হচ্ছে কতইনা গভীর রাত।এই ভরা শীতকালে যতদুর চোখ যায় গাছের পর গাছ। বাঁশ আর বেতের ঝোপ। সকালের রোদে দেখা কেয়ারি করা গাছ আর সযত্নে বানানো ঝোপঝাড়গুলোও কেমন অচেনা লাগছে। প্রতিটা গাছ, তাদের প্রত্যেকটা পাতা— হাওয়া দুলছে শিশিরের স্পর্শে কেঁপে কেঁপে উঠছে। দুরে নেহাত মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিস্ট লজের ভেপার ল্যাম্পগুলোর ঝকঝকে হলুদ আলো জমাট বাঁধা ঝুপসি গাছপালার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে বলে বুঝছি জঙ্গলে নয় বসে আছি ট্যুরিস্ট লজের নিরাপদ আশ্রয়ে। 

আজ সকালেই সপরিবারে এসে পৌঁছেছি বান্ধবগড় রিজার্ভ ফরেস্টে। থাকি কাটনিতে। হঠাৎই শনিবার ঠিক হল নিউ ইয়ার্সের ছুটিতে ঘরে না বসে থেকে ঘুরে আসা যাক কাছে পিঠে কোথাও। আমার ভোট ছিল পাঁচমারী, জনশ্রুতি অল্পস্বল্প বরফকণা পড়ছে বৃষ্টির মত।কিন্তু দুইমেয়ের ভোট বান্ধবগড়ের দিকে। সাথে কাকুও। কর্তা ভোট গণণাকারী। ভোটাধিকার নেই। অতএব তিন এক ভোটে জিতে বান্ধবগড় যাওয়াই ঠিক হল।সকাল সাতটার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের অনেক সফরসঙ্গী মেরুন ফিয়াটটি নিয়ে। মোবাইলে পথ নির্দেশ চলছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে সরি ব্যাকসীটে দুইবোনের অকারণে হাহা হিহি, খুচখাচ খুনসুটি,সাউন্ডসিস্টেমে রবীন্দ্রসঙ্গীত। সামনে খোলা কাটনি বারহি উমরিয়া ১০নম্বর স্টেট হাইওয়ে।দুপাশে চেনাঅচেনা গাছ, সরষে ,আখ, ভুট্টা,ছোলা,মটর, বাজরার ক্ষেত। তরিতরকারির ক্ষেতও নজরে এলো। ছোটছোট ছবির মত গ্রাম, বাজার হাট। ঝকঝকে ঝিলগুলো সুর্যে্র আলোয় ঝিকিয়ে উঠেই মিলিয়ে যাচ্ছে গাছের আড়ালে। পথের ওপর চট মেলে রোদে শুকাচ্ছে সবুজ মেথিশাক, সোনালী গেঁহু, সবুজ ছোলা, ভুট্টার দানা। কাঁচা বাঁশ কেটে ডাঁই করে রাখা হয়েছে, ছোটছোট বাচ্চাগুলো মহানন্দে চড়ছে নামছে। ডালাভরে বিক্রি হচ্ছে হলুদ সবুজ বিহি (পেয়ারা),আঁওলা (আমলকি),কলা, বরোই (কুল), নরম ছোলাশুদ্ধ “চানাশাগ”, মটরশুঁটি,ফুলকপি, আচারের মোটা লাল লঙ্কা। ঠেলা গাড়ীতে বিক্রি হচ্ছে মুড়ীর মোয়া, চিঁড়ের মোড়া, তিলের নাড়ু তিলের তক্তি,গুড়ের তক্তি, মোরব্বা, মেওয়া, অদ্ভুত ভালোলাগার মুহুর্তগুলো কেমন যেন জড়িয়ে নিচ্ছিল শীতের হাওয়ার মতই। এইভাবে পৌঁছানো গেল বরহি।টি ব্রেক। কাছাকাছি কোথাও পশুবিক্রির হাট বসেছে মনে হল।

রাস্তাজুড়ে গরু, মোষ, অথবা ছাগলের পাল তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে বিভিন্ন বয়সের রাখাল রাখালনীর দল। রাখালিনীদের সংখ্যাই বেশী। না তারা গড়ীর হর্ন শোনে না রাস্তা ছাড়ে।কথা বলে আর হেসে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে। ক্যামেরা বার করলে আড়চোখে দেখে নিয়ে শাড়ীর আঁচল কি ওড়নাটুকু টেনে গম্ভীর হয়ে হাতের ছোট পাঁচনবাড়ি দিয়ে সামনে যে পোষ্যটিকে পায় তাকে এটি খোঁচা মেরে বলে ওঠে “হাই রে ওহ টিকটিকটিক...হরররররর ছুটছুটছুট... হরররর হ্যাটহ্যাটহ্যাট”।বলে আবার যেই কে সেই গদাইলস্করি চালে চলতে থাকে। তাদের পিছনপিছন চলছি গড়িয়ে গড়িয়ে শম্বুকগতিতে। হঠাৎ বিপত্তি। থেমে থেমে চলতে চলতে বোধহয় ঘুমই পেয়ে গেছিল তাই বুজবুজি গ্রাম পঞ্চায়েতের গেট পার হয়ে একটু যেতে না যেতেই হিক্কা তুলে গাড়ীবাবু ন যযৌ ন তিস্থৌ।পিছনে বাজার পেট্রোলপাম্প ছেড়ে এসেছি একটু আগেই। লোকজন বিশেষ দেখা যাচ্ছে না।কর্তামশাই গম্ভীরমুখে জাননা দিলেন “ব্যাটারীর প্রবলেম”। জিনস টিশার্ট পড়া সদ্যকলেজ পড়ুয়া বিবি তিড়িং করে নেমে আসলো। কানে হেডফোন গোঁজা, পকেটে অরিজিৎ সিং এর গান গেয়ে চলা মোবাইল। সাথে সত্তর বছরের যুবক কাকু। গাড়ী ঠেলা হচ্ছে। আমি আর আমার আদুরী গোলগাল ছোটকন্যা হাসিতে কুটোপাটি কন্ডিশনে সবার ধমক খেতে খেতে একান্ত বেমানান ভাবে হাঁটছি এই বিচিত্র প্রশেসনের লেজ হয়ে ।রাস্তা দিয়ে ভটভট শব্দে আসছিল দুই বাইক আরোহী। তারা বিনা আমন্ত্রণে বিনা প্রশ্নে অযাচিতভাবে গাড়ী ঠেলতে লাগলো। ঠেলাঠেলিতে বিরক্তি সহকারে কাঁচাঘুম ভেঙে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দৌড় শুরু করলেন গাডীবাবু। আমাদেরও যাত্রা হল শুরু।

পর্ব ২

বারহি থেকে বান্ধবগড় ৩২ কিলোমিটার। অন্তত রাস্তার ধারের মাইলস্টোনগুলো তাই বলছে।টানা চওড়া রাস্তা। বরহি বর্ধিষ্ণু শহর।কিন্তু বরহি বাজার পার হতেই আচমকা দৃশ্যপট বদলে গেল।দুপাশে ঘন বন। মাঝখান দিয়ে লাল হলদেটে ধুলোমোড়া পিচ রাস্তা। রাস্তার পাশে ঘন ঝোপঝাড়ের অগ্রগতি রুখতে কাটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। মাঝে সাঝে বেড়ার সামনে ছোটখাটো পানের বা চায়ের দোকান।যেখানে অল্পস্বল্প্ ফাঁকফোকর আসছে চলন্ত গাড়ী থেকে নজরে পড়ছে উঁচু উঁচু গাছের আড়ালে সবুজ ক্ষেত, ঘরবাড়ী।জঙ্গলের কোলে লুকানো ঘরবাড়ী,লোকালয়,ছোটছোট গ্রাম।এভাবেই চলে এল পনপথ।রাস্তা চওড়া কিন্তু একদিক ব্লক করে বোল্ডার ফেলে রাস্তা যুগপৎ উঁচু আর চওড়া করা হচ্ছে।ফলে বারহি থেকে উমারিয়া (ভায়া বান্ধবগড়) মুখী যাবতীয় গাড়ী আর উমারিয়া থেকে বান্ধবগড়মুখী যাবতীয় গাড়ীর বিশাল লাইন। আমাদের মত ট্যুরিস্ট গাড়ি যেমন আছে তেমনি আছে লোকাল স্টেটবাস, বিশাল ভলভোবাস, বড় বড় ট্রাক, লরি,ম্যাটাডোর এমনকি হাতেটানা ট্রলিও।ট্রাফিক পুলিশ নেই। নির্বিকার মুখে পনপথ টোলের বনরক্ষীরা গাড়ীর জট দেখছেন।এখানে নেমে গাড়ীর নম্বর মালিকের নাম, কোথা থেকে আসছি, কোথায় যাবো,কদিন থাকবো ইত্যাদি নথিভুক্ত করাতে হল।বনরক্ষী দুজনের মধ্যে একজন নামধাম লিখছিলেন আরেকজন উদাস চোখে বসেছিলেন।হঠাৎই উদাসবাবু লাফ দিয়ে উঠে বললেন

- ওডিশারু আসিছন্তি আইজ্ঞা? আপ্পনমানে কেব্বে সিমলিপাল যাই ন থাহন্তি? আউ সাতকোশিয়া? বহত বঢ়িয়া জগাহ দুইটা, আপ্পনমানে কোঠি রহুছন ম্যাডম?

আমাদের গাড়ীর রেজিস্ট্রেশন নম্বর ওড়িশারই আছে, সবে তো কয়েকমাস হল মধ্যপ্রদেশে এসেছি, উদাসবাবুর আনঅফিসিয়াল প্রশ্নাবলীর জবাব দিয়ে রাস্তায় এসে দেখি তখনও জ্যামজট লেগেই রয়েছে। তবে মজার ব্যাপার হল ট্যুরিস্ট গাড়ীগুলোকে আগে সাইড দিয়ে দেওয়া হল। কখনো বামদিকে বারো পনেরো ফুটের ঝোপঝাড়ে ঢাকা বা ন্যাড়া কর্দমাক্ত খাদ, স্বচ্ছ অসচ্ছ তালাও (পুকুর), কখনো ডানদিকে।অন্যসাইডে রাস্তা তৈরীর বড় বড় সিমেন্টের বোল্ডার। বেশ খানিকটা রাস্তা এভাবে আসতে আসতে দেখি মাটি আর আকাশ দুটোর রঙই কেমন পালটে গেছে। আকাশের নীল চোখেই পড়ছে না শুধু সবুজ আর সবুজ। কত তার শেড।মাটি কখনো হলুদ কখনো গেরুয়া কখনো লাল । হঠাৎ পিছনের সীট থেকে দুইকন্যার যুগপৎ চিৎকার  ... 
- বাবা, গাড়ী থামাও ,গাড়ী থামাও, ঐ যে ময়ুর! ময়ুর।

মেন রাস্তার ওপরেই চরে বেড়াচ্ছে তিনটি ময়ুর ময়ূরী। গাড়ীটাড়ীতে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই।গাছের ফাঁকে দেখা যাচ্ছে আরো কয়েকটি। গাছের ডালেও বসা দেখতে পেলাম। ক্ষুদে ক্ষুদে লালচে মুখের বানরগুলো বসে আছে রাস্তার ওপর, যেন রোদ পোয়াচ্ছে।কয়েকটার আবার কাঁখেপিঠে বাচ্চাও রয়েছে। বিবি কায়দা করে নেমে ময়ূরের ছবি তুলছিল। বানরগুলোও ভালো পোজ দিচ্ছিল। তারপর মডেলিংএর পারিশ্রমিক নিতে দল বেঁধে এসে ঘিরে ধরতেই ফটোগ্রাফারের সাহস ফুট্টুস।বেগম হাতের সদ্যখোলা পটাটো চিপসের প্যাকেটটা একটু দুরে ছুঁড়ে ফেলতেই সবকটা দৌড়ে গেল ওদিকে। বিবিও হাঁফ ছেড়ে উল্টোদিকে একদৌড়ে গাড়ীতে।আবার একটু যেতে না যেতেই পুরো রাস্তা জুড়ে দেখি সার বেঁধে বসে আছে কালো মুখ লম্বা লেজের হনুমান আর একটু আগে দেখা লালমুখ খাটো লেজের বানরের দল।জনসভা নাকি? তবে গাড়ী কাছে যেতেই কেউ বিরক্তমুখে সরে বসল , কেউ লাফ দিয়ে কাছের গাছটায় চড়ে বসল।কেউ দুদ্দাড় পালালো।কয়েকটা আবার খানিকটা তাড়া করে এল গাড়ীর পিছন-পিছন। পনপথ থেকে বান্ধবগড় আট- নয় কিলোমিটার। রাস্তায় চলতে চলতেই একাধিক বার নজরে এল চিতল হরিণ, ময়ূর বানর হনুমান আর রং বেরং এর পাখী প্রজাপতি তো ছিলই। পুরো পথটাই বান্ধবগড় ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্পের অরণ্যের ভিতর দিয়ে। পর্যটক,বনরক্ষীদের গাড়ি তো আছেই, উমারিয়া বারহি রুটের পাবলিক বাস তো ঘণ্টায় ঘণ্টায় দেখেছি। অভয়ারণ্যের ভিতর দিয়ে কী ভাবে যে গাড়িঘোড়া এরকম ভয়ানক হর্ন বাজিয়ে যায়, অবিশ্বাস্য! যদিও পথের দুধারে বনজ প্রাণী সংক্রান্ত সতর্কবার্তা যেমন আছে তেমনিই ঘন্টায় ২০ কিমি র বেশি বেগে গাড়ী না চালানোর ও হর্ন না বাজানোর নিষেধাজ্ঞাও ঘনঘন চোখে পড়েছে আমাদের।

পর্ব৩

পথ যে কখন শেষ হল বুঝতেই পারিনি। বান্ধবগড় গ্রামই তবে ট্যুরিস্টদের সুবিধাযোগ্য অনেককিছুই আছে এখানে। আমাদের গন্তব্য মধ্যপ্রদেশ সরকারে ট্যুরিস্ট লজ। একেতাকে জিজ্ঞাসা করে যখন লজে ঢুকছে তখন বেলা আন্দাজ সাড়ে এগারোটা। সাজানো বাগান ফোয়ারা মরশুমী কেয়ারীর পাশেই বিশাল শাল সেগুন অর্জুন মেহগনী গাছ। ঝুপসি বেঁটেখাটো চেহারার আম পেয়ারা আতা কল্কে চাঁপা গাছও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। গাড়ী রাখার জায়গাটা অনেক চওড়া। কুঁচ পলাশ সেগুনের ছায়ায় এই শীতেও রোদ্দুরের ছোঁয়াটুকু না পেয়ে ঠান্ডায় কনকন করছে। নাম না জানা বনজ লতান গাছে ফুলে ফুলে আলো হয়ে আছে কারস্ট্যান্ডের পিছনের কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আলাদা করে রাখা জঙ্গলাকীর্ণ জায়গাটুকু।অতঃপর কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে রিশেপসন।সেটা পেরিয়েই বিরাট হলঘর। ডাইনিংরুম। আরামদায়ক সোফা চেয়ারে সাজানো। গোল প্যাগোডা ধাঁচের বিরাট হলঘর দেওয়াল জোড়া বড় বড় কাঁচের জানলা।ব্রেকফাস্ট পর্ব চলছে। কেননা সকালের সাফারি সেরে ফিরতে ফিরতেই তো সাড়ে দশটা এগারোটা হয়ে যায়। হলঘর পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতেই সামনে ছড়ানো ছিটানো বাংলো। কাঠেরগুলো মাটি থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে মাচার ওপর। কাঠের পাটাতনের মত ব্রীজ দিয়ে হেঁটে এসে রিসেপপন ডেস্কের ডানদিক এবং বামদিকে নেমে আসতে হয়।সেগুলো পেরিয়ে ডানদিকে স্যুইমিংপুল বামদিকে সযত্নে বোনা লতাপাতা ছাওয়া একতলা ঘরগুলো।মাটি থেকে দু আড়াইফুট ওপরে।এক একটা ভাগে দুটি করে ঘর।এগুলো সিমেন্টের। আধুনিক ও আরামদায়ক। ওপরর ছাদটা খোলা,সবুজ ফাইবারে ঢাকা। ওখানে বসে জঙ্গলের ভিতরে অনেকটাদুর অবধি দেখা যায়।সামনে গোলমত অনেক জায়গায় আসল বনের রেপ্লিকা করে রাখা। ঝোপঝাড়, বাঁশবন।লোকে দাঁড়িয়ে ফটোও তুলছে। রিসেপশনেই শুনেছিলাম দিনে দুটো সাফারি করা যায় একটা সাড়ে ছটা থেকে সাড়ে দশটা বা এগারোটা অবধি আরেকটা বেলা সাড়ে তিনটে থেকে পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা অবধি। এটা শীতকালের হিসাব।কথা যখন বলছিলাম তখন এক বাঙালী পর্যটক খবর দিলেন কোর এরিয়া দুই আর তিনে বাঘ দেখা যাবে। আমরা আগে থেকে অনলাইন বুকিং করে আসিনি। ফলে বিকালে বাফার জোন১ এ যাবার পারমিটই শুধু পেলাম। এই শীতের ছুটিতে ভীড় যথেষ্ট আর এই ভীড়ের ৭০ শতাংশই দেখলাম বাঙালি, তবে পিকটাইম হল এপ্রিল থেকে জুন। তবে একটা কথা বলে দেওয়া ভালো, বর্ষার সময়ে জঙ্গল বন্ধ থাকে ১৫ জুন থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর। পয়লা অক্টোবর খোলে। 

ফেরত আসি আগের প্রসঙ্গে, তিনটে বাজতে না বাজতেই আমাদের পল্টন রেডি। সোয়া তিনটায় আসলো সাফারি গাড়ী। খোলা জিপ।ড্রাইভার কেবিনটা শুধু কাঁচে ঘেরা। তাও খোলাছাদ।সিকিউরিটি বলে কিছুই নেই। গাড়ীতে ড্রাইভারের পাশে একজন,তার পিছনের সীটে তিনজন, তার পিছনে আরো তিনজন বসতে পারে।লাস্ট তিনটে সীটের একদম লেফ্ট কর্ণারের সীটের পিছনে লেখা “গাইড”।শিমলিপাল বা সাতকোশিয়া তো ছেড়েই দিলাম নন্দনকানন অভয়ারণ্যে বাঘ দেখতে গেছি লোহার জাল দেওয়া বা কাঁচ ঘেরা গাড়ীতে। তাই এরকম আলগা সিকিউরিটি দেখে মনে হচ্ছিল আমরা বাঘ দেখতে যাচ্ছি নাকি বাঘের টোপ হতে যাচ্ছি? ড্রাইভার ধর্মেশকে জিজ্ঞাসা করতে পরম বিজ্ঞ জবাব পেলাম এখানকার বাঘেরা আশেপাশের গ্রামে হামলা করে লোকজন মারলেও কোনদিন কোন ট্যুরিস্ট মারেনি! লাও ঠেলা সামলাও।মনে মনে ইষ্টনাম জপ করতে করতে উঠে পড়লাম জীপে।লজ থেকে বেরিয়ে সেই উমারিয়া রোড ধরেই চললাম।দু আড়াই কিলোমিটার দুরে বামদিকে মাটির চওড়া রাস্তা ধরে এগোতেই নজরে এলো বিট নাম্বার ১এর গেট।বনরক্ষী বাহিনীর লেভেল ক্রশিং গোছের গেট। ড্রাইভার নেমে পারমিটে সাইন করিয়ে ফিরে এল একটা বছর আঠারোর হাসিহাসি মুখের ছেলেকে নিয়ে।এ নাকি আমাদের গাইড।নাম রাকেশ কুমার।

গাড়ী চলতে লাগলো সাথে শ্রীমান রাকেশের বকবকানি।জন্তুজানোয়ার থেকেও বেশী চেনাতে লাগলো গাছপালা, তা নিয়েই আলোচনার বিষয় হয়ে উঠল, কেবলই, জঙ্গল আর জঙ্গল। কী কী গাছ আছে এখানে, ঋতুভেদে সে সব গাছেদের চেহারা কেমন হয়, কোনগাছে কিরকম ফুল বা ফল হয়, গরমের এইসবুজ জঙ্গল কেমন লালে লাল হয়ে ওঠে পলাশ, শিমুল, কৃষ্ণচূড়ায়, বর্ষায় কেমন করেই বা নতুন কচিপাতায় আরও সবুজ হয়ে ওঠে বান্ধবগড়। - এ সবই। তারপরেও শুনলাম, কোনগাছে পাখিরা বাসা বাঁধে, কেন বাঁধে. বানর কিভাবে গাছে বাস করে। কেমন করে বানররা গাছের ফল বা কচিপাতা খেয়ে পাতা ছিঁড়ে ফেলতে ফেলতে একগাছ থেকে আরেক গাছে যায় আর হরিণরা সেই পাতা খায়।এমনকি বাঘ দেখলে জোরে চেঁচিয়ে হরিণদের সতর্কও করে দেয়। বদলে মাটিতে নেমে আসা বানরদের বিপদের সতর্কবার্তা দেয় হরিণের দল।
তারমাঝেই চোখে পড়তে লাগলো চিতল হরিণ, সম্বর, একবার বার্কিং ডিয়ারের ছোট একটা দলও দেখতে পেলাম। রাকেশ নয় ধর্মেশই দেখিয়ে দিচ্ছিল। আরো দেখলাম জংলী শিয়াল, সজারু, দুতিন রকমের বানর।রং বেরংয়ের পাখি। বাফার জোন তাই ছোট ছড়ানো ছিটানো আদিবাসী গ্রাম আর ঘরে পোষা গরুবাছুর মোষও চরতে দেখলাম। খয়ের, শাল, শিমুল, মহুয়া পলাশ আর খাটোখাটো বাঁশঝোপের ছায়া মাখা নিরুপদ্রব ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম পেরোতে না পেরোতেই আবার জঙ্গলের শুরু। পথের চিহ্নমাত্র নেই তবু কিভাবে যেন মানুষসমান ঘাসের ওপরদিয়ে অনায়াসে গাড়ী চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ধর্মেশ , ভাবছিলাম এই বুঝি তিনি এলেন কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা।কিছুই দেখা গেলনা। ঘাসজমির শেষে একজায়গায় এবড়োখেবড়ো লাল রুক্ষ মাটির জায়গায় জায়গায় পাথর বেরিয়ে আছে, সেখানেই সুড়ঙ্গ মত নীচুজমির খোঁদল দেখিয়ে রাকেশ বলল এটা নাকি গরমকালে বাঘের আস্তানা হয় কারন পাশ দিয়েই একটা টলটলে জলে ভরা ঝোরা বয়ে যাচ্ছে, যেটা নাকি প্রচন্ড গরমেও শুকায়না। শীতের সন্ধ্যা, গাছের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতেই টহলরত বনরক্ষী বাহিনীর জিপ থেকে সতর্কবাণী শুরু হল। অনেকটা ভেতরে চলে এসেছিলাম। আশেপশে অন্য গাড়ীটাড়ি নজরেও পড়ছেনা। ধর্মেশও দেখলাম নিষেধ না মেনে প্রায় ৩০-৩৫ কিলোমিটার বেগে গাড়ি ছোটাচ্ছে। আমরা মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। একে তো ডিসেম্বরের ঠাণ্ডা, তার ওপর অত জোরে গাড়ি ছোটানোয় গায়ের মধ্যে হাওয়া কেটে বসছে। থেকে থেকেই মুখে বাশঝাড়ের ঝাপটা লাগছে। সাধারণত এমন হয় না। অন্ধকারও নেমে আসছে, তা ছাড়া অত জোরে গাড়ি চালালে জন্তু জানোয়ার দেখব কী করে। একটু পরেই পৌঁছে গেলাম চওড়া মেঠো রাস্তায়, অন্যান্য ট্যুরিস্ট জিপগুলোও দেখলাম পরপর বন জঙ্গল ঠেলে উঠে এল মেন রাস্তায়। উল্টোপথে আবার দল বেঁধে ফেরত যাওয়া। নজরে পড়লো বান্ধবগড়ের জঙ্গলে মহুয়া পলাশ জারুল সেগুনের সাথে অর্জুন কিংবা খয়ের গাছও জায়গা করে নিয়েছে আর আছে বিভিন্ন ধরনের বাঁশগাছ। ফেরার পথেও রাকেশের বকবকানির অন্ত নেই। সে তখন পরম উৎসাহে আমাদের খয়ের গাছ থেকে কী ভাবে খয়ের তৈরি হয় বলছিল— প্রথমে খয়ের গাছের ওপরের শক্ত ছালটা ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। তার ঠিক নীচে যে সাদাটে অংশ থাকে, সেটাও ধারালো ছুরি দিয়ে তুলে ফেলা হয়। তখন দগদগে ঘায়ের মতো গাছের লাল দেহ বেরিয়ে পড়ে। সেখানে আঠার মতো আস্তরণ জমতে শুরু করে। আঠা জমে শক্ত হয়ে আসলে সেই পোর্শনটা চেঁছে তুলে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে জলে ফোটানো হয়। এতে ঘন কালচে মেরুণ একটা ক্বাথ তৈরি হয়। সেটাকে ঠান্ডা করে ওর গাঁদ আংশটা বাদ দিয়ে বাকি সান্দ্র অংশটা অন্য পাত্রে ঢেলে আবার উনুনে চাপানো হয়। ঘন হয়ে এলে সেটাকে থিতোতে দেওয়া হয় এর পর। পরের দিন ঘন পদার্থটা বড় ঝুড়িতে ঢালা হয় ছাঁকবার জন্য। ঝুড়িতে যেটা জমা হবে, সেটা দিয়ে দামী খয়ের আর ঝুড়ির বাইরে যেটা জমা হবে সেটা দিয়ে কমদামী খয়ের তৈরি হয়। অনেক জ্ঞান পেলাম। ওদিকে কিন্তু অন্ধকার হবার আগেই ঢুকে পড়তে হল লজে। ডাইনিং স্পেসে চা পর্ব চুকিয়ে যখন বাংলোসাইডে পা বাড়ালাম, বাইরে ঘন অন্ধকার , হিম পড়ছে, ঠান্ডা বাড়ছে। ভেজা ভেজা বাতাস আরো ঠান্ডার অনুভূতি বাড়াচ্ছে। ডাইনিং স্পেস আর বাংলোর মাঝের খোলা চাতালে বনফায়ারের আয়োজন চলছে। পাশে বারবি কিউয়ের আয়োজন। সুন্দর লোভনীয় গন্ধ ভেসে আসছে। রঙীন পানীয় প্রকাশ্যে পান করা লজে নিষেধ তবে কয়েকজনকে দেখে বোঝা গেল তারা অলরেডি চারদেওয়ালের আড়াল থেকে টইটুম্বুর হয়েই এসেছেন। মেয়েদের আজকের তোলা ছবিগুলোর ময়নাতদন্তের প্রবল ইচ্ছা, কর্তামশাইয়ের মন পড়ে আছে অফিসিয়াল মেলের দিকে। কালকের সাফারির অনলাইন বুকিংও করতে হবে। আমি তখন পিঠ-টান করে শুতে পারলে বাঁচি, তাই আগুনোৎসবকে পাশ কাটিয়ে সপরিবারে রুমের দিকে পা বাড়ালাম।

পর্ব৪

অতঃপর সাড়ে আটটা নাগাদ গরমাগরম ভীষণ সুস্বাদু ডিনার শেষে টুপটাপ হিমপড়ার আওয়াজ শুনতে শুনতে জঙ্গলের অদ্ভুত সব কাহিনী ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম পরের দিন ভোরে। সাড়ে ছয়টা। বাইরে কুয়াশা। আলো ফোটেনি ঠিকমত। আবছা আকাশ। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। চুলের খোলা অংশে জলের ছোটছোট ফোঁটা জমছে। ভেজা হাওয়ায় শিউরে উঠছে মুখ আর হাতের খোলা অংশ। মাথা মুখ ঢেকে গতকালের মত খোলা জীপে সাফারি অভিযান শুরু হল গতকালের মতই। আজ চালক সিকন্দরসাব। মধ্যবয়সী কম কথার মানুষ। হেসেই ম্যানেজ করছেন বেশি। আজ গন্তব্য কোর এরিয়া। বিট নম্বর ২। পৌছতে দেখা গেল সারি দিয়ে পনেরো কুড়িটা জিপসি দাড়িয়ে আছে। খুব চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছে। কালকের মত এন্ট্রাস গেট থেকে গাড়ীতে উঠলো নতুন গাইড। লম্বা চওড়া পওনকুমার। ড্রেস দেখেই মালুম হল ফিল্মস্টার অক্ষয়কুমারের অন্ধ ভক্ত। বিট ২এর মাটিও অনেকটাই রুক্ষ। লালচে ধুলো ওড়া বাতাসে পাথরগুলো অবধি লালচে হয়ে গেছে। কত্ত রকমের চেনা-অচেনা গাছ— শাল, সেগুন, অর্জুন, কদম, কুসুম, জারুল, কেন্দু, খয়ের, গুলমোহর, বট, নানা ধরনের বাঁশ, মহুয়া— নিজেদের মতো করে একে অপরের গায়ে গা ঠেকিয়ে, মাথা এক করে হেলছে দুলছে। আমদের মত অনাহুত অতিথিদের দিকে চেয়ে আছে পরম বিস্ময়ে। হাওয়ায় ফিসফিস করে বুঝি ওদের কথাই ভেসে আসছে। কেউ বা সবার চেয়ে উঁচু হয়ে, উঁকি মারছে জঙ্গল ছাড়িয়ে বহুদুর কোথাও। অনেকে আবার ঘন ঘাসের ছড়ানো প্রান্তরে একাকী চুপচাপ ধ্যানস্থ মুনির মত গম্ভীর। বাক্যহীন। বৈদিক কুলীন ব্রাহ্মনসন্তান — আদিম অনার্য্য অরণ্যে সকলের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে জঙ্গলে নিজ-অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রেখেছে। এখানেও দেখলাম ঘন বাঁশবন আর খয়ের গাছের প্রাচুর্য্য নজরে পড়ার মত। প্রচুর পাখি নজরে পড়ছে এখানে। সব তো ছাই চিনিও না। পওন বললো একশোর বেশি প্রজাতির পাখি এখানে পাওয়া যায়। অনেক নাম বলেছিল। তখন তো আর লিখে রাখিনি। যে কয়েকটা এখন লিখতে বসে মনে পড়ছে সেগুলো হল, ময়ূর , বনমুরগি, বনঘুঘু, বুনো পায়রা, বনটিয়া, ধনেশ, লরেড বা ইয়েলো ওয়াটেল্ড ল্যাপউইঙ্গ, ওয়াগটেইল, বাঘের মুখে ঠোঁট ঢুকিয়ে দাঁত খোচানো ড্রঙ্গো, ছাই রঙের ওপর ছিটছিট কালো দাগের চিল, সবুজ মাছরাঙা, নীল মাছরাঙা, কাঠঠোকরা, হলুদ-বসন্তবৌরি, মুনিয়া, তিতির, বটের, বুলবুল, — যাই হোক আমরা এর মধ্যে প্রায় অনেককেই দেখতে পাইনি, হয়ত গাইডরা অত স্পিডে চিনিয়েও উঠতে পারেনি। এ অনেকটা ওই দার্জিলিং গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়ার মতো ব্যাপার! আসলে প্রকৃতি এতই খামখেয়ালি,যে কোন জঙ্গলে গিয়ে কোন প্রাণী দেখা গেল সেটা একেবারেই ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেওয়া ভাল। 

বান্ধগড় জঙ্গল জুড়ে চিতল হরিণের অবাধ রাজত্ব। চলতে ফিরতে নজরে পড়ছে একাধিক চিতলের। শীতের শুরু , কাজেই চিতলের শিংয়ে ভেলভেটের আস্তরণ। গরমকাল যত এগিয়ে আসবে ততই শিং শক্তপোক্ত হয়ে উঠবে। বছরে একবার শিংটা খোলসের মত খুলে ফেলে। পওন দেখালো রাস্তায় ধুলোর ওপর ছড়িয়ে পড়ে আছে হরিণের সিং। গাছের ডালেও ঝুলছে। বনরক্ষীরা সযত্নে careful carelessly স্টাইলে ওগুলো সরিয়ে একজায়গায় রেখেছেন দর্শকদের জন্য। সোনালি বাদামি ভেলভেটি জমিনে সাদা বুটিদার চিতল ভারতের প্রায় সব জঙ্গলে হামেশাই দেখা গেলেও ওদের সৌন্দর্য যেন কিছুতেই একঘেয়ে হয় না। ভাসাভাসা কাজলটানা চোখ, চকচকে শরীর, লম্বা লম্বা পা, দেখলে মনটা এমনিতেই খুশিতে ভরে ওঠে। শুনলাম চিতল হরিণরা বর্ষার সময় নাকি এক জায়গাতে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এবং অধিকাংশ সময়েই ফাঁকা জায়গায়। বৃষ্টির শব্দে অন্য শব্দ শোনা যায় না বলে, সেই সময়ে তৃণভোজীদের উপর বাঘ হায়না জাতীয় মাংসভোজীরা সহজেই অতর্কিতে আক্রমণ করতে পারে ভেবেই ওরা হয়তো ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ায়!

পওনের কাছেই শুনলাম, এখন মোটামুটি ৫৮-৫৯ টা বাঘ আছে বান্ধবগড়ে। তবে যে সাদা বাঘের জন্য বান্ধবগড় বিখ্যাত, সেই সাদা বাঘ থাকলেও তাকে চোখে দেখা যায় না। বাঘ বাদে প্রাণীদের মধ্যে বান্ধবগড় টাইগার প্রজেক্টে আছে কালো ভাল্লুক, চিতা, সম্বর, চিত্রল বা চিতল হরিণ, কোটরা বা বার্কিং ডিয়ার, হায়না, বুনো কুকুর, শিয়াল, নেকড়ে, হনুমান, রিসাস ম্যাকাক বা লালমুখো বাদর,ক্ষুদে বুনো বাঁদর, বনবিড়াল, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, বেজি, ব্যাঙ, গিরগিটি, কাঁচপোকা, প্রজাপতি, মাকড়সা, পিঁপড়ে, এসব ছাড়াও এই জঙ্গলে রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রাচীন গুহা। দশম শতকে তৈরি ৩০ফুট লম্বা বিষ্ণুর শায়িত মূর্তি রয়েছে পাহাড়ের চূড়ায়। নাম ‘শেষ শয্যা’। বিষ্ণুর পায়ের তলা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে গুপ্তনদী চরণগঙ্গা। বিষ্ণুর মাথার দিকে একটি বিরাট শিবলিঙ্গ এবং পায়ের দিকে ব্রক্ষ্মার মূর্তি রয়েছে। এ জঙ্গলে দেওচক্রধারা, বড়াগুহা, সীতাকুণ্ডের মত অনেক কাহিনী কিম্বদন্তীর সাক্ষী রয়েছে অতীতের স্পর্শ নিয়ে। পাহাড়ের একদম ওপরে রয়েছে কালচুরি রাজাদের ভগ্নপ্রায় রাজপ্রাসাদ এবং রামজানকী মন্দির। এখনো পুজো হয়। রামনবমীতে মেলাও বসে। দর্শকদের আকর্ষণ বাড়াতে সরকার থেকেই বান্ধবগড়ে হাতির পিঠে “টাইগার শো”-এর বন্দোবস্ত হয়। কিন্তু পওনের মতে শুনলাম, প্রাচীন দুর্গ, বনপাহাড়ি, গুম্ফা আর শিলালিপির এই জঙ্গলকে অনুভব করতে হলে জিপ সাফারিই ভাল। 

গল্পের মধ্যেই বিভৎস ক্যাঁক ক্যাঁক ডাক। পিলে চমকে ওঠার মত। পওন দেখাল রাজধনেশ । মাথার উপর দিয়ে হঠাত্ই একদল লালমুখো বাঁদর চিত্কার করতে করতে গাছ-বদল করল লাফিয়ে! কী কর্কশ আওয়াজ! দেখা হল এক দল লঙ্গুরের সঙ্গেও, পাথরের ওপর সভা করছিল ওরা। ওদের পেরিয়ে ঢুকছি আরও ভিতরে। অনেকটা জায়গা জুড়ে বিছিয়ে থাকা শালবন, ঘাসবন আর বাঁশবন। এখন আর কোন প্রাণী দেখা যাচ্ছেনা। কোথাও বা ঝোপঝাড়, তার পরেই ন্যাড়া পাথুরে সমতল, কোথাও নিবিড় ঘাস বা বাঁশবন, ছোট-বড় টিলা, মাটির বুকে ক্ষতচিহ্নের মত শুকনো দহ, শুকনো ঝোপে ঢাকা নালা, পাথুরে অগভীর খাদ মত, আর অরণ্যের বুক চিরে এ দিক সে দিক বয়ে যাওয়া তিরতিরে নালা। বাঘ দেখার টেনশনে সবাই চুপ। আশেপাশেও নিস্তব্ধ সব। দূরে কোথাও একটা হাট্টিটি-টিটির-টি-টি আওয়াজ হল— কোনও পাখির ডাক হবে! হঠাৎই সিকন্দর সাব গাড়ী থামিয়ে ঈশারায় চুপ করতে বললেন। আশেপাশে দু’চারটি গাড়ী নজরে আসছিল তারাও দেখি স্থির। কি ব্যাপার? না, ডাক শোনা যাচ্ছে। সেটা আবার কি? বলতে না বলতেই ক্রিকাও ক্র্যাকক ,ক্রিকাও ক্র্যাকক, আওয়াজগুলো গাছের শাখাপ্রশাখায় ধাক্কা খেয়ে কেমন ছড়িয়ে পড়ছিল। সাথে ‘ফিউউউউউউউউ ফিউউউউউউ’.. ‘টিরররর টিট্টিট’ ডাকগুলো মিলেমিশে কেমন অদ্ভুত জান্তব ধ্বনি লাগছিল। এই নাকি ডাক। বাঘ দেখলে বানররা গাছে ঝুলে ঝুলে ঐরকম আওয়াজ করে। ফিউউউউউ ডাকটা শিয়ালের।
সামনের রাস্তার দু’ধারে সান্ত্রীর মতো লম্বা লম্বা গাছ পাহারা দিচ্ছে আর মাঝখান দিয়ে লাল এবড়োখেবড়ো মেঠো রাস্তা একেবেকে চলেছে। সকালের রোদ হলদে হয়ে যাওয়া শীতের পাতার ওপর পড়ে এক অসামান্য পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বুক ধুকপুক করছিল। বিবি আর বেগম দেখি ক্যামেরা বাগিয়ে রেডি। জিপগুলো স্পিডে একটা নির্দিসষ্ট দিকে চলছে। আরো কয়েকটা জিপ ঝোপঝাড় ঠেলে উঠে এল। গতি কমাচ্ছে সবাই।কি হয় কি হয় একটা ভাব। আর আওয়াজ নেই। যাহ, এ যাত্রা বোধহয় আর দেখা হল না। ভাবতে ভাবতে মোড় ঘুরতেই দেখি সামনে রাস্তাটা আচমকাই নীচু হয়ে একটা নালা টাইপের জলাশয়ে মিশেছে , তার অন্যধারে বেশ দুরেই বাঁশঝাড়ে ঘেরা খানিকটা খোলা জায়গায় বসে একটা বাঘ। আমাদেরটা নিয়ে নালাটার উল্টোদিকের উঁচুপাড়ে তখন তখন গোটা বারো জিপ। ক্লিক ক্লিক শব্দে শাটার টেপা চলছে। বাঘটা ক্লান্ত ভঙ্গিতে খোলা রোদে টান হয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর আপনাআপনি হাইটাই তুলে আড়মোড়া ভাঙতে লাগলো। আমরা দেখেই যাচ্ছি আশ মিটিয়ে। আস্তে আস্তে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল আরো দুটো ছোটবাঘ। গাইড জানাল এরা মা আর তার দুই সন্তান। ওদের বয়স মাস আঠারো। কদিন পরে ওরা আলাদা হয়ে যাবে। মা তো চিতপাত হয়ে শুয়ে; বাচ্চাদুটো চলতে চলতে ওপর থেকে আমাদের উৎসাহিত কলরব শুনে একবার মুখ তুলে আমাদের দেখে মায়ের কাছে গিয়ে নাক দিয়ে ঠেলতে লাগলো। ধীরে ধীরে উঠে দাড়াল মা বাঘিনীটি। তারপর বাঁশবনের ভেতরে ঢুকে গেল তিনজনে। এদিকে দু’বোনের চোখমুখ জ্বলজ্বল করছে। দুরন্ত অভিজ্ঞতা মানতেই হবে। পরিতৃপ্ত মনে সবাই যে যার জিপে উঠে পড়লাম।

আমরা খুশি বাঘ দেখে, সিকন্দর আর পওন খুশি আমাদের বাঘ দেখিয়ে। বাঘ দেখার পর শুরু হল আরেক রাউণ্ড ঘোরা। ক্ষীণ আশা ছিল হয়তো আরেকবার বাঘের দেখা পাব। পাইনি। লালধুলোর ওপর বাঘের পায়ের ছাপ অবশ্য দেখেছি। একআধবার নয়। একাধিকবার। তবে অন্য একটা ব্যাপার হল। ডাক জিনিষটা অনেকদুর থেকে শোনা গেছে। এবার উল্টোপথে যে জিপই আসে ওরা থমকে জানতে চায় ‘ডিড ইউ সি ইট?’ আমরা কলরব করে উঠি ‘হ্যাঁ ওই তো ওইখানে.... ‘এখন শুধু ওরা আর আমরা। ওরা যাদের এখনো বাঘের দর্শন হয়নি, আমরা যাদের বাঘবাবাজি দয়া করে দেখা দিয়েছেন। ওরা অভাগা, আমরা ভাগ্যবান। ওরা বাঘের দেখাই পায়নি, আর আমাদের মাথায় বাঘবাবাজি ইচ্ছে করলেই সস্নেহ থাবা রাখতে পারতেন। বাঘ দেখে ফেরার পথে জঙ্গলে নজরে আসলো অনেক ময়ূর, চিতল হরিণের ঝাঁক, রিসাস ম্যাকাক বা লালমুখো বানর, কালোমুখের হনুমান, বুনো শিয়াল, বন শুয়োর , সম্বর , পেয়েছিলাম সজারু আর বন মুরগির দেখাও। বেলা সাড়ে এগারোটা। এবার ফেরার পালা। সবার দিলখুশ!!!মনের আশাপূরণ হয়েছে। পওন বকবক করে শোনাচ্ছে বনের খুঁটিনাটি ইনফরমেশন। গম্ভীর কমকথার মানুষ আমার কর্তাটি নিশ্চুপে শুনছেন। আপন মনে কলকলাচ্ছে আমার দুই মেয়ে।


পর্ব ৫

- মা ঐযে আরেকটা ময়ূর। ওমা ঐ লাল কালো পাখিগুলো দেখছো, কি নাম ওদের?
- বোনু ঐ দেখ তোর বন্ধুরা গাছের ওপর কি সুন্দর বসে আছে। 
- তোরও বন্ধু বুঝি? নয়ত চিনলি কি করে?
- ঐ কিংফিশারটা সবুজ হলুদ কেন মা? আমরা তো নীল কিংফিশারই দেখি...
- আমি ড্রঙ্গোর ক্লোজশটে ছবি নেব।ঐ পবনভাইয়া যে পাখিটার স্টোরি বললোনা, আর তখন রাজধনেশটার ছবিও ঠিক আসেনি। আবছা আসছে। তারপর পবনভাইয়া দেখালো না ইয়েলো ওয়াটেল্ড ল্যাপউইঙ্গ, ওয়াগটেইল, ক্ষুদে হর্নবিল, সেগুলোও ক্লোজশটে ছবি চাই। পাখিগুলো কোথায় পাবো? জিজ্ঞাসা করো না।
- আমি কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে এবার স্পটেড ডিয়ারের ছবি নেব।ওরা একটুও ভয় পায়না। আমিও মা ক্লোজশটে ছবি নেব।
- ওদের নিয়ে সেল্ফি তুলবি? হেব্বি হবে রে..- দেখ না দিভাই তোর ক্যাননের থেকে আমার নোকিয়ায় বাঘের ফটোটা বেশি ভালো এসেছে।
- মৌ দ্যাখো বনরক্ষীদের অফিসটা। লাল মাটির কুঁড়েঘর কিন্তু কি সুন্দর রঙীন ট্রাইবাল আলপনায় সাজানো। দিদিভাইরা, তোরাও দ্যাখ। কেমন মাটির বাঘ ভলুক হরিণের থ্রি ডাইমেনসনাল মোটিফে সাজানো দ্যাখ।
- এখনো মোবাইলে টাওয়ার নেই। ছবিগুলো আপলোড হচ্ছে না। আয় বোনু সেলফি তুলি। দাদু তুমিও একটু এদিকে চেপে আসো তো!
- হি হি হি ঐদ্যাখ দিভাই ডাকু মঙ্গলসিং, কেমন পাকানো মোটা গোঁফ। কি বড়বড় গোলগোল চোখ! 

এইসব প্রলাপ শুনতে শুনতে এবং বকতে বকতে জঙ্গলের এন্ট্রি গেট পেরিয়ে উমরিয়া বরহি রোডে উঠে এলাম। এতক্ষনে টের পেলাম খিদেতে পেট চুইচুই করছে। চা চা বলে কান্নাকাটি করছে ভেতো বাঙালি প্রাণ। 

সকালের সাফারি শেষে ব্রেকফাস্ট। স্নান, মোবাইল ল্যাপটপের সদব্যাবহার শেষে তাড়াহুড়ো করে জমাটি লাঞ্চ।বেলা তিনটেতে আবার সাফারি। এবার গন্তব্য ১৮ কিমি দুরের পনপথ বা পানপাতা বিট।এবারের ড্রাইভার তালপাতা সেপাই চেহারার সুরজভান। এই শীতেও বুকখোলা খাকিশার্ট। গাড়ি চালাতে চালাতেই বলছিল ১৯৬৮ সালে নাকি বান্ধবগড়কে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই সময় এর আয়তন ছিল ১০৫ বর্গ কিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রণয়নের পর বোঝা গেল বান্ধবগড়কে বাড়িয়ে তুলতে হবে। ১৯৮২ সালে খিটৌলি, মাগধী আর কাল্লাওয়াকে বান্ধবগড়ের আওতায় আনা হলে আয়তন বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪৮ বর্গ কিলোমিটারে। ১৯৯৩ সালে বান্ধবগড় আসে ব্যাঘ্র প্রকেল্পর আওতায়। সেই সময় পানপাতা বা পনপথ অভয়ারণ্যকে বান্ধবগড়ের অংশ করে নেওয়া হয়। আপাতত বান্ধবগড়ের প্রধান বা কোর এলাকা ৬৯৪ আর পারিপার্শ্বিক বা বাফার এলাকা হল ৪৩৭ বর্গ কিলোমিটার। আগে এখানে বাঁশ বা কাঠের কাজের জন্য ঠিকাদারদের প্রবেশাধিকার ছিল। কিন্তু অভয়ারণ্য ঘোষণা হওয়ার পর তাদের প্রবেশ নিষেধ। জঙ্গলে ক্যামেরা বসানো আছে, শুধু বাঘ নয় উষ্ণ রক্তের কোনও প্রাণী সামনে দিয়ে গেলেই ক্যামেরা তার ছবি তুলে ফেলে। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় ক্যামেরার সংখ্যা খুবই কম শুনলাম। বান্ধবগড় রিজার্ভ ফরেস্টে টু্যরিস্টদের জন্য সেরা জায়গা মিরচানি, রাজবেহরা, চক্রধারা। মোটামুটি ওদের ইউনিয়নের ১৭৫- ১৮০টি জিপসি আছে। এছাড়াও প্রাইভেট কিছু জিপসিও আছে, তবে সেগুলো আশেপাশের হোটেলওয়ালাদের। বাস আছে দুটো, মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের।তবে এক একটা জোনে একসাথে গোটা তিরিশেকের বেশি একবেলায় ঢোকার পারমিট পায়না। সে কারনেই অনলাইন বুকিং চালু হয়েছে। পনপথে বাঘ সাধারণত আসেনা, গরমকাল ছাড়া। কারন জঙ্গলের এই অংশেই আছে ভদ্রশীলা নদী।

তাই জলের জন্য গরমকালে এদিকে বাঘেদের আনাগোনাও বাড়ে। বাঘ দেখার ভালো সময় নভেম্বর-মার্চ।তবে সুরজভানও বললো গরমকালটাই সুসময়। বাঘ নাকি অনেকসময় স্টেট হাইওয়ের ওপরও এসে বসে থাকে। ট্রাফিক জ্যাম হয়ে যায়। জানতে চাইলাম মানুষ মারা যায় কিনা। বললো এমনিতে বনে প্রচুর জানোয়ার আছে বলে লোকালয়ে হামলা কম হয়। তবে মানুষ যে মারা যায়না তাও নয়। দল বাঁধা মানুষকে বাঘ লেপার্ড এড়িয়েই চলে। দলছুটকো একা মানুষই হামলার শিকার হয় বেশি। গবাদি পশুও মারা যায়, তবে কিনা বর্ষাকালে আর চুড়ান্ত গরমেই বেশি হামলা হয়। পনপথ বিটে গাইড পেলাম আরেক পবন, পবন সিং। পনপথে পাওয়া যায় লেপর্ড, ভাল্লুক নীলগাই, গাউর, চিতল হরিণ, সম্বর, কোটরা বা বার্কিং ডিয়ার, শিয়াল, হনুমান, লাঙ্গুর, লালমুখো বাদর,ক্ষুদে বুনো বাঁদর, বনবিড়াল, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, কীটপতঙ্গ, প্রজাপতি। পনপথের গাছগুলো লম্বা বেশি। খয়ের জারুল শাল বট পলাশ কৃষ্ণচূড়া গুলমোহর মহুয়া কেন্দু কুসুম অশথ্থ্ব আম অর্জুন জাতিয় প্রচুর চেনা গাছ নজরে পড়ল। রয়েছে ঘন বাঁশবন। লম্বা লম্বা ঘাসের ঝোপ, প্রান্তর। তাতে কাশের মত লালচে ফুল। তখন অবশ্য শুকিয়ে এসেছে ।নলবন টাইপের ঘাসের দঙ্গলও নজরে পড়লো। অদ্ভুত সুন্দর একটা জায়গা আছে ওখানে। কাঠের ব্রিজসহ ওয়াচ টাওয়ার। ভদ্রাবতী নদীর তীরে অর্জুন গাছের ছাওয়ায়। চরাশে লম্বালম্বা অর্জুন গাছের ভীড়। শহরের মত বাকলতোলা অর্জুনগাছ নয়। বন্য সৌন্দর্য্যে ভরা গম্ভীর অর্জুনের জঙ্গল। গেলে মন ভরে যাবে। সহজে ফিরতে ইচ্ছে করবে না। নেমে হাত পা ছড়িয়ে বিশ্রাম করে নেওয়া যায় অনায়াসে। জায়গাটায় ঢোকার মুখে অনেকটা জায়গা টানেলের মত নীচু পথ বেয়ে যেতে হয়, দুপাশে গাছে ঢাকা উঁচু পাথুরে দেওয়াল। ছায়ায় ছায়ায় অন্ধকার। অস্বাভাবিক নৈঃশব্দ্য সেখানে। জায়গাটার নামই নাকি টাইগার্স ডেন। টাইগার যদিও দেখিনি কিন্তু শীতঘুম ভাঙা ভালু দেখলাম।লেপার্ড দেখানোর জন্যও অনেক চেষ্টা করেছিল সুরজভান আর পবন। গাছের গায়ে বাঘের নখের আঁচড় দেখেছি, চিতল হরিণের খোলসের মত খুলে ফেলা শুকনো শিং এর ঢিবি দেখেছি। লেপার্ড কিন্তু দেখা হয়নি। তবে সাধ মিটিয়ে দেখেছি নীলগাই। একাধিকবার। কখনো একা কখনো জোড়ায়। সম্বর আছে প্রচুর। বার্কিং ডিয়ারও দেখলম এখানেই বেশি। দু এটা গাউরও ঘুরতে ফিরতে নজরে এলো। যদিও আমি দুর থেকে খুব একটা ভালো বুঝতে পারিনি। তবে একাধিক ওয়াচ টাওয়ার আছে এই জোনে আর তাদের সবকটার লোকেশনই দুর্দান্ত জায়গায়। বুনোবিড়ালও নাকি আছে তবে দর্শন হয়নি। খরগোস মাপের জায়ান্ট স্কুইরেল আছে শুনলাম তবে দেখিনি।

সাধারণ খুদে কাঠবেড়ালিরাই ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে দেখলাম। সাদা খুদে বানর রয়েছে প্রচুর। শীতের দিন বলে সন্ধ্যাও তাড়াতাড়ি নামে, আবার ১৮ কিলোমিটার পাড়ি দিতে হবে, সেও অভয়ারণ্যের বুক চিরে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে। টহলদার বনরক্ষীদের জিপ দুবার হুশিয়ারি দিয়ে গেল। ফিরতে হবে এবার।অতএব সাফারি শেষ। এবার গেস্টহাউসের দিকে ফেরা। ফেরার পথও নিরামিষ নয়। আধো অন্ধকারে হেডলাইটের আলোয় ছিটকে সরে যাচ্ছিল সাদা বানর, লেঙ্গুরের দল। যত অন্ধকার বাড়ছিল তত রাস্তার কাছে চলে আসছিল ময়ুর হরিণ বানর শিয়ালের দল। দু’ বার গাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তা পার হোল বুনো শুয়োরের দল। প্রথমবার গোটা ছয়েক। দ্বিতীয়বার আরেকটু বেশি। পনপথে আজ ট্যুরিস্টদের ভীড় কম। ২ আর ৩ নং কোর জোনে বাঘ দেখা যাচ্ছে শুনে ভীড় ওদিকেই বেশি। তবু গোটা আটেক জিপ বা জিপসি দেখলাম মোটামুটি একসাথেই চলছি কিছুটা আগে পরে দুরত্ব রেখে। অসধারণ অভিজ্ঞতা, অনিন্দ্যসুন্দর এটা গোটা দিন। মনে রাখার মত, মনে থাকার মত সোনালি কিছু ভালোলাগার মুহুর্ত। সব পিছে ফেলে আমরা শহুরে কটি মানুষ আরামদায়ক উষ্ণতার খোঁজে ফেরত যাচ্ছি যান্ত্রিক সভ্যতার দিকে।পিছনে অন্ধকারে ধীরে ধীরে সজাগ হচ্ছে আদিম অরণ্য। মনখারাপ লাগা শুরু হল এবার। আগামিকাল সকালেই ফেরত যাবো কাটনি। কর্তার অফিস, বেগমের স্কুল, বিবি পরশু ফেরত যাবে হস্টেলে। জঙ্গলের টান বড় মারত্মক। বড় মোহনীয় এর নেশা। আবার আসবো। অনেক দেখা বাকি রয়ে গেছে, অনেক অচেনাকে চিনতে পারিনি। জানার ঝুলির ভগ্নাংশও ভরতে পেরেছি কিনা সন্দেহ। সুতরাং বান্ধবগড়কে বিদায় বলবো না। বলবো ‘আসি’। শুনে ঠিক আমার মায়ের মতই বান্ধবগড়ের মাটি হাসিমুখে বলবে ‘সাবধানে যাস। আর যত তাড়াতাড়ি পারিস ফিরে আসিস, কেমন!’



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ