কলেজের করিডরে দাঁড়িয়ে ছিল পৃথিবী,চোখ ছিল দূরে সবুজের দিকে। একভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কিনা বোঝা যায় না চোখের কোনায় জল জমেছে! আচমকা একটা চেনা শব্দে চমকে ওঠে পৃথিবী ...
- কি গো আজ ক্লাসে যাবে না?
বাঁ-হাতের কব্জি উল্টিয়ে ঘড়ির কাঁটার দিকে চোখ রাখে ও,সময় হয়ে গেছে পরের ক্লাসের। তড়িঘড়ি চোখের কোণ মুছে ভাবনা গুলিকে এক শ্বাসে গিলে ফেলে প্রশ্নকর্তার উত্তর না দিয়েই ক্লাসের দিকে রওনা হয় মেয়েটি।
পৃথিবী দত্ত রায়। কলেজের নতুন গণিতের অধ্যাপিকা। মাত্র কয়েকমাস আগেই চাকরিতে যোগ দিয়েছে। তীক্ষ্ণ চেহারার সাথে মেধাবী চোখের চাউনি,ভীষণ অমায়িক স্বভাবের এই মেয়েটি কলেজে সবার প্রিয় হয়ে উঠেছে কিছুদিনের মধ্যেই। তবুও মাঝে-মাঝেই মেয়েটি কেমন যেন উদাস উদাস থাকে,কেউ জিজ্ঞাসা করলে সযত্নে হাসির আড়ালে এড়িয়ে যায়, বলে -না তেমন কিছুই নয়,হয়তো কাজের প্রেসার ইত্যাদি ...
আজও পৃথিবীকে একইরকম বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। ওর উজ্জ্বল চোখ দুটির তলায় আজ মাত্রাতিরিক্ত কালি! কারন জিজ্ঞাসা করার সুযোগ পায়নি নীল। পরপর ক্লাস চলছে আজ নীলের। মনে মনে ভাবছে কখন টিফিন হবে। নীল রাজপুত। এম.এসসি.র শেষ বর্ষের ছাত্র।
ক্লাসে গিয়ে অঙ্কে ডুবে যায় সবাই। এটা পৃথিবীর আর এক ক্যারিশমা, অঙ্কর সাথে থাকলে ও পারে জগতের সকল বিষ কে নিজের শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলতে এবং অন্যরাও বাধ্য ওর সাথে ওর সবথেকে প্রিয় দুনিয়ায় বুঁদ হয়ে যেতে। টিফিনের বেল বেজে উঠলে ক্লাস শেষ হয়, পৃথিবী টিচার্সরুমের দিকে এগোতে থাকে রোজকারের মতই আজও ওর পিছু নেয় নীল, প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় টুক করে- “আজ আবার কি হলো?” পথ চলতে চলতেই উত্তর আসে-
- একই,নতুন কিছু নয়।-
- আবার তোমার গায়ে হাত তুলেছে ইডিয়টটা?
- হুম...
রাগে মুখটা লাল হয়ে যায় নীলের, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে - আর কতদিন চলবে এইসব? কাল ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ছিল গেছিলে? নাকি তাও যেতে দেয়নি?”
- না গেছিলাম জোর করেই,তাই তো রাতে বাড়ি ফিরে মেরেছে,বলেছে আমি নাকি তোমার সাথে ছিলাম ওই সময়।
বলতে বলতে আবার কেঁদে ফেলে পৃথিবী। নীল খুব কড়া গলায় আদেশের সুরেই বলে, আমি বাগানের উত্তর দিকে অপেক্ষা করছি,তুমি এসো দেরি করোনা...একসাথেই টিফিন খাবো।
পৃথিবীর একটা অসুখ করেছে,সবাই জানে না যে ও মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে, প্রতিদিন একটু একটু করে ক্ষয় পাচ্ছে ভিতর থেকে। সব থেকে অবাক করা বিষয় হল এই সময় যার সবথেকে বেশি ওর সাথে থাকা উচিৎ সেই সব দায় নিজের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে। এইচ.আই.ভি পসেটিভ ধরা পড়েছে মেয়েটির, কিন্তু রোগ মেয়েটিকে মানসিক ভাবে যতো না দুর্বল করেছে,তার থেকে কয়েকগুণ বেশি ভেঙ্গে গেছে ও ওর স্বামী সিদ্ধার্থের চিন্তা ভাবনায়। গত ছয়-আট মাস আগেই কলেজের এই নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছিলো,তার কিছুদিন পর থেকেই ওর সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে নীলের,ছেলেটি মেধাবী অঙ্কে খুব ভালো এবং সহজে বন্ধু হতে পারার বিশেষ গুনটি নীলের মধ্যে ভরপুর,তাই হয়তো বয়সের কিছুতা তফাৎ থাকা সত্ত্বেও ওরা খুব সহজে বন্ধু হয়ে গেছে ওরা। সিদ্ধার্থের এসব কিছুই অজানা নয় তাও পৃথিবীর এই রোগ ধরা পরার পরেই ও সব দায় ঠেলে দিয়েছে পৃথিবী আর নীলের সুন্দর নিষ্পাপ বন্ধুত্ত্বের উপর। এরপর থেকে নিত্যদিন শারীরিক এবং মানসিকভাবে অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে ওকে,মুখ বুজে সহ্য করছে সব। এইভাবেই হয়তো কেটে যেত শেষ দিনগুলো। নীল অনেক বুঝিয়েও পারেনি, কেন কোনও প্রতিবাদ করে না মেয়েটা...! ওর অদ্ভুত যুক্তিতেই ও অটল থাকে, বলে- যে পাপ আমরা করিনি তার জন্য প্রতিবাদ করব কেন, সিদ্ধার্থ একদিন ঠিকই ওর নিজের ভুল বুঝতে পারবে। হয়তো সেদিন অনেক দেরি হয়ে যাবে, তবুও বুঝবেই...।
আজ ডাক্তারি পরীক্ষার একটি অন্য রিপোর্ট আসার কথা,যাতে করে ধরা পড়বে পৃথিবীর এই রোগের উৎস কি বা কে? এই পরীক্ষা করার কোনও ইচ্ছেই ছিল না ওর, কিন্তু বাবা-মায়ের চাপাচাপিতেই ও বাধ্য হয়েছে টেস্টটি করাতে...। রিপোর্ট এসেছে, আর ঠিক তার পরেই মাথার উপর থেকে আকাশ পায়ের তলার মাটি...সব সরে গেছে, এক পাঁজর ফাঁকা নিশ্বাস সাথে নিয়ে হতবম্ভের মতন দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবী, এই মুহূর্তে কোথাও কিছুই নেই...একটা অদ্ভুত অমানিশায় ডুবে যাচ্ছে মেয়েটি...! এইদিনের পর আর কেউ খুঁজে পায় নি মেয়েটাকে,কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে...বাড়ির লোকজন অনেক খুঁজেছে,খুঁজেছে নীলও...সিদ্ধার্থ খুঁজেছিল কি...! না, ও হেসেছে আর বুক ফুলিয়ে পৃথিবীর বাবা-মাকে বলেছে- নিজের পাপের ফল হাতে পেয়ে লজ্জায় মুখ দেখাবে কি করে,তাই চলে গেছে।
পৃথিবী ভালো ছিলোনা কখনই, পৃথিবীর ভাল থাকতে নেই...বুকের ভিতর খনন চলছে দিনরাত, কিভাবে ভাল থাকবে সে...! আঁধারে হারিয়েছে পৃথিবী, কেন...? কারন ওর শরীরে রোগের জীবাণু প্রেরকের নাম জানতে পেরে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি মেয়েটা, রাতের অন্ধকারে আদরের ছলে ওর শরীরে নিজের লুকানো রোগটি হয়তো কিছুটা চালাকি করেই পাচার করে দিয়েছিলো স্বয়ং সিদ্ধার্থই। লজ্জায়,ঘেন্নায় কোথায় যে হারাল মেয়েটা......দু বছর পেড়িয়ে গেছে তাও মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকে নীল প্রতিদিন।
২৪০/ বি. এই বাসেই রোজ কলেজ আসতো ওর প্রিয় বন্ধু...আজও অপেক্ষা করে থাকে,মনে মনে ভাবে-যদি আসে...।
পরিচিতি
পরিচিতি
1 মন্তব্যসমূহ
sundor
উত্তরমুছুনসুচিন্তিত মতামত দিন