ভাবতেঅবাকলাগেতিনদিনআগেইছিলামদিল্লিতে। কর্মসূত্রেএখনহিমাচলপ্রদেশেএসেছি।কাজসারতেএকদিনলাগল।কাসোলশহরেএকদিনকাটিয়েশরীর-মনএকেবারেচনমনেহয়েগিয়েছে।কাসোলকেবলাহয়ভারতের ‘ইজরায়েল’।এখানেপার্বতীনদীআরঅপরূপপাহাড়ছাড়াওএকটাদারুণজিনিষআছে।একসাথেএতইজরায়েলিআপনিভারতেরআরকোথাওপাবেননা।দোকান-পাট, খাবার-দাবারসর্বত্রইইজরায়েলিসংস্কৃতিরছাপদেখতেপাবেন।তবেএইমুহূর্তেএসবেরথেকেওএকটাতীব্রটানঅনুভবকরছি।মলানাগ্রামেরমায়াবীকুহকআমায়ডাকছে।আস্টেরিক্সেরদেশ ‘গল’।অবিকলওইএকইদেশ।ভারতবর্ষেইআছে।আবারভারতবর্ষেরবাইরেযেন।অনেকেবলেনএগ্রামেঅ্যালেকজান্ডারেরউত্তরসূরিরাথাকেন।ভারতেরভেতরেএকটুকরোগ্রীসযেন।
১।
‘... ভেতরে একটা চলো-চলো জলোচ্ছ্বলতা প্রায় সময়ই জাগে। সেটাকে থাবড়ে চুপ করাতে হয়। ওই ব্যাপারটা আমাকে ফুসলে নিয়ে যেকোন দিকে ভেগে পড়ে। তছনছ করে দেয়। বৈরাগীর ছাই মাখাতে থাকে দু’হাতে-চারহাতে। আমি ওই উড়নচণ্ডীপনার সাথে এঁটে উঠি না’। (শক্তি চট্টোপাধ্যায়, এলোমেলো জীবনযাপন)।
জারি পার করে এসে হাঁফ ছাড়লাম। একটা সবুজ গেট। আর দেড় কিলোমিটার দূরেই মলানা পাওয়ার হাউস। পাহাড়ের বুকে পাথুরে ধাপ। ধাপ ধাপ রাস্তা সোজা চলে গিয়েছে। আশেপাশের পাইন বনে এখন মেঘ ভাঙা আলো। এসময় সচরাচর আকাশ পরিষ্কার থাকে। বাতাসে কুয়াশার গন্ধ। সবুজ পাতার ফাঁকেফাঁকে কুয়াশার সর কেটে মনোরম আলোর রেণু জড়ো হচ্ছে এই উপত্যকায়। মলানা পাওয়ার হাউস থেকে আরও দশ কিলোমিটার হেঁটে একটা ড্যাম পাওয়া গেল। আরও সাত কিলোমিটার পায়ে হাঁটতে হবে।
এতদূর হেঁটে চলেছি, কোন ক্লান্তি নেই।
পাথরের গায়ে ঝরে পড়ছে ঝরনার জল। এই শব্দ আমার বড্ড পরিচিত। মাঝে মাঝে কয়েকটা কাঠের ঘর। এ ধরণের ঘর হিমাচলের পাহাড়ে প্রায়শই দেখা যায়। পুরোনো কালো কাঠের গায়ে ছিতিছিতি শৈবালের ছোপ। ঠাণ্ডা হাওয়া কেমন পুলওভারের ভেতর দিয়ে সুড়সুড় করে বয়ে গেল। শরীর জুড়ে একটা ঝাঁকুনি, দাঁতে দাঁত ঠেকে যায়। এভাবেই চলছি।
বুকের ভেতরটা হাপরহুপর করছে। একটু বসে গেলাম। খাতা বের করে স্কেচ করছি। এমন সময় চারদিক কেমন থমকে গেল। এই দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ক্যানভাস। এইসব পার্থিব রঙ, অপার্থিব আলো কেমন কাফন বিছিয়ে দিচ্ছে। মাথার ভেতর, চুলের ফাঁকে বিলি কেটে উঠছে ডিলান থমাসের কবিতা। ডিলান থমাসের অনুসরণে খাতা ভরানোর আদর্শ সময় এটা।
যখন আমার শিল্প অথবা তমসার ছবি
আঁকা হয়েছিল তখনও রাত।
যখন চাঁদ তার রাগ নিয়ে
আর প্রেমিক যুগল বিছানায়
অজস্র বিষাদ জড়িয়ে শুয়েছিল,
আমি পেলব তুলি বুলিয়েছি ক্যানভাসে
উচ্চাশা অথবা দু’মুঠো ভাতের জন্য নয়
হাতির দাঁতের কাজ অথবা
আনন্দ ফেরি করার জন্যও নয়
বরং তাদের গোপনতম হৃদয়ের
সামান্য মজুরী হিশেবে আঁকা হয়েছিল।
সমুদ্রের সফেন লহরী’র মত পৃষ্ঠায়
মৃত্যুর অত্যুচ্চতায় মহৎ স্তোত্র-কবিতা,
তাজমহল অথবা বসন্তের কোকিলের জন্যও নয়
বরং দু’টি শালিখ অথবা প্রেমিকের জন্য, তাঁদের বাহুজুড়ে
জমে থাকা সুপ্রাচীন বিষাদের জন্য,
যারা প্রশংসা, মজুরী অথবা
আমার তুলির মনোযোগ- কোনটাই পায়নি।
২।
পাইনবীথি আর দেবদারুসারি ভেদ করে পাথুরে ধাপ রাস্তা সোজা চলে এসেছে মলানা গ্রামে। কুল্লু উপত্যকার চাঁদেরখনি পাসের নীচে ছোট্ট জনপদ মলানা। অজস্র কিংবদন্তি আর লোকগাথার চারণভূমি এই গ্রাম। আসার আগেই অনেকে সাবধান করে দিয়েছিল এই বলে ,এখানে কারও সাথে বিশেষ কথা বলার দরকার নেই। সখ্যতাও নয়। কোন জায়গার হুটহাট ছবি তোলা যাবে না। আর সাথে অবশ্যই কাউকে নিয়ে যাওয়া উচিৎ।
জারি থেকে একজন সাথী জুটেছে। হরিদেও ওয়াংরু। মধ্যবয়স্ক লোক। থাকেন কাসোলে। অজস্র গল্প আর লোকগাথার ভাণ্ডার তিনি। সে সব গল্প শুনে আঁতকে উঠতে হয় বৈকি!
জারি থেকে একজন সাথী জুটেছে। হরিদেও ওয়াংরু। মধ্যবয়স্ক লোক। থাকেন কাসোলে। অজস্র গল্প আর লোকগাথার ভাণ্ডার তিনি। সে সব গল্প শুনে আঁতকে উঠতে হয় বৈকি!
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লেখায় তাঁর ছেলেবেলার গ্রাম আরাকাটাকা’র কথা যেভাবে উঠে এসেছে, অনেকটা সেরকম একটা গ্রাম। ইতিউতি ছড়িয়ে আছে সুপ্রাচীন বৃদ্ধাদের মুখ নিঃসৃত ভুত-প্রেত, দেবতা-উপদেবতার গল্প। এসব গল্প এখানের জনজীবনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। এদের সাথেই বাঁচা-মরা। এক অদ্ভুত মায়াবী কুহক হাতছানি দেয় বারবার।
এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯,৯৩৮ ফুট ওপরে। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে খেলনার মত ২০০’র কিছু বেশী পাথরের বাড়িঘর ছড়িয়ে আছে। ১৫০০ মানুষের আবাস এই মলানা। পাহাড়ের খাদের ধারে একটা পাথুরে ঘর চোখে পড়ল। তার গা জুড়ে কুন্ডলী পাকিয়েছে মেঘ। এ এক অদ্ভুত দৃশ্য।
মলানার লোকগাথা অনুযায়ী তাঁরা অ্যালেকজান্ডারের গ্রীক সেনাবাহিনীর বংশধর। অথচ বিভিন্ন গবেষণাপত্র ঘেঁটে জানতে পারলাম, এদের ভাষার সাথে গ্রীক অথবা মেসিডোনিয়ান ভাষার কোন সাযুজ্য নেই। এদের কথ্য ভাষা কুল্লু উপত্যকার অন্য কোথাও ব্যবহার হয়না। গবেষকরা প্রমাণ করেছেন এটা কোন ভাষা নয়। বরং উপভাষা। এরা একটা ডায়ালেক্টের মাধ্যমে কথা বলে। চলতি ভাষায় এই ডায়ালেক্ট কানাশি নামে পরিচিত। এই ভাষার সাথে মিশে গিয়েছে হিন্দি আর তিব্বতি শব্দমালা। এঁরা মূলত সিনো-তিবেতিয়ান ভাষা গোষ্ঠীর মানুষ। মলানিয়ান মানুষেরা অজস্র গোপন বিদ্যার ধারক ও বাহক। বলাহয়, কানাশি ভাষাও সেসব গোপনীয় কর্মকাণ্ডের অঙ্গ। এই ভাষায় কথা বলার অধিকার সবার নেই। এই অঞ্চলে জুলাহা আর লোহার নামে আরও দু’শ্রেণির মানুষ বাস করেন। তাঁদের এই ভাষায় কথা বলার অধিকার নেই।
সেপ্টেম্বরের শেষের সুড়সুড়ে হাওয়া নিভিয়ে দিচ্ছে দুপুরের উত্তাপ। প্রতিটি প্রহর এখানে গুমোট গল্প জমা করে। পাহাড়-অরণ্য, মেঘের শীত, পাইনের তীব্র সবুজ সবার কাছেই অজস্র গল্প জমে রয়েছে। ছিপছিপে কুয়াশার চাদর ঢেকে রেখেছে পাথুরে ঘরগুলোকে। মাঝেমাঝে মেঘের চাদর ছিঁড়ে আলো চুঁইয়ে পড়ে। সে আলো গায়ে মেখে মানুষজন আড্ডা জমায় পাথরের চট্টানে। এই আলো ম্লান হতে না হতেই সকলে জড়ো হয় হান্ডুলার কাছে। হান্ডুলা আগুন জ্বালাবার জায়গা। গ্রামের ঠিক মাঝে অবস্থিত। এখনেই বসে হাক্কামা বা সনাতনী গ্রামসভা। এখানে ভারত সরকারের কোন আইনকানুন চলেনা। জামদাগ্নি ঋষির সনাতন বিচার ব্যবস্থা এখনও এখানে চলছে। এঁদের নিজস্ব বিচার ব্যবস্থায় ত্রিস্তর কোর্টের প্রভাব দেখা যায়। নিজেদের শাস্তি-বিধান নিজেরাই ঠিক করে। পুরোহিত বংশানুক্রমে জমলা দেবতার প্রতিভূ। নিম্নআদালতের অন্যতম ধারক-বাহক এঁরা। প্রত্যেক উপগ্রাম (জেস্থা) থেকে চারজন নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকেন। এঁদের একজন করদার। এছাড়াও প্রতি জেস্থা থেকে একজন পগুদার নির্বাচন করা হয়। সবমিলে আটজনের একটি কমিটি তৈরি করা হয়। এই আটজনের মধ্যে একজন প্রধান আর একজন উপপ্রধান নির্বাচিত হন। তবে এই বিচার ব্যবস্থায় সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদ হ’ল ‘গুর’। স্থানীয় মানুষেরা বিশ্বাস করেন ইনি ঈশ্বরের মুখপাত্র। তবে একই সময় একাধিক গুরের অস্তিত্ব থাকতেই পারে। এঁদের লম্বা চুল আর অদ্ভুত টুপি দেখে আর পাঁচজনের থেকে এঁদের আলাদা করা যায়। জামলা দেবতার আদেশ পেয়ে গুর তান্ডব নৃত্য শুরু করেন এবং আশুকর্তব্য স্থির করেন। তাই শুরুতেই বলেছিলাম, মলানা ভারতের মধ্যেই আছে, আবার ভারতে নেই। মলানাকে বলা হয় পৃথিবীর প্রাচীনতম গণতন্ত্র।
পাহড়ের গায়ে গায়ে একটা ভীরু হাওয়া দোল খেলে যায়। লিখে বা বলে বোঝানো যায় না। অদ্ভুত সব কিংবদন্তি জেগে থাকে মানুষে মত আকার নিয়ে। ইতিহাসের জরায়ু থেকে ডালপালা মেলে জেগে ওঠে জামলু ঋষির ইতিবৃত্ত। এখানে তরল গল্পের বিভীষিকা এত প্রগাঢ় যে সভ্যতার সমস্ত আলো ম্লান হয়ে আসে। নিঝুম দ্বীপের মত জেগে থাকে মলানা। ক্লিন্ন অতীতবেত্তা লোকজন বেঁচে থাকে রূপকথার গল্প অবলম্বন করে। ক্রমে এখানের মায়াবী কুহককেই বাস্তব বলে ভ্রম হয়। তাই পাহাড়ের ওপর সূর্য সবটা তাপ দিলেও রোদ জুড়ে জড়সড় অনুভূতি। মাল্যবান এইসব গিরি-কন্দরের বুকে জমা হওয়া তমসাচ্ছন্ন লোকগাথা আর স্তূপীকৃত ইতিহাসের পাহাড়কে অনেকদূরে বসে অনুধাবন করা মুশকিলই নয়, অসম্ভবও বটে। আনমনে এসব গল্পের পাতা উল্টে গেলে কোন হলদেটে ঘ্রাণ পাওয়া যায়না। কেননা, এখানে এসব অতীত নয়। সুতীব্র ভাবে বর্তমান। মিহি-স্নিগ্ধ নিলচে-সবুজ এসব গল্পমালায় ধরে রাখা আছে মলানার জনজীবনের রূপরেখা। যেখানে বারবার জামলু ঋষির ইতিবৃত্ত ঘুরে ফিরে আসে।
বলা হয়, জামলু ঋষি এখানেই থাকতেন। তিনিই এখানের জীবনশৈলী আর আইনকানুনের প্রণেতা। পৃথিবীর প্রাচীনতম গণতন্ত্রের প্রণেতা এই মানুষটিকে গল্পের চরিত্র বলেই এতদিন উড়িয়ে দেওয়া হ’ত। ইদানীং গবেষকরা দেখিয়েছেন, পুরাণে জামলু ঋষির উল্লেখ পাওয়া যায়। লোকগল্প অনুসারে জামলু ঋষি আসলে পরশুরামের বাবা। ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে একটি হলেন জামলু ঋষি। তাঁর প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান শিব তাঁকে প্রকৃতির সন্তান মলানা উপত্যকা উপহার দেন। ঋষির দুভাই তাঁর সাথে যেতে চাইলে তিনি বারণ করেন। এরপর তাঁরা লাহোউল এবং বাঞ্জার উপত্যকায় চলে যান। জামলু ঋষি এই মলানা উপত্যকাকে বাইরের মানুষদের থেকে রক্ষা করার জন্য উপত্যকা জুড়ে তৈরি করেন কুহক জাল। কিন্তু সেসময় মলানা উপত্যকা ছিল বাণাসুরের অধীনে। জামলু ঋষি আর বাণাসুরের মধ্যে এরপর চুক্তি হয়। এই উপত্যকার প্রশাসন সামলাবেন বাণাসুর আর আইনকানুন দেখবেন জামলু ঋষি। কথিত আছে এসময়ই মলানা’র সংবিধান তৈরি হয়। আর নিজেদের গোপন রহস্যগুলো রক্ষার জন্য তৈরি হয় কানাশি ভাষা।
এখনও মলানা গ্রামে জামলু ঋষির মন্দির আছে। তার গায়ে ঝুলিয়ে রাখা আছে মৃত পশুপাখির কঙ্কাল আর দেহাবশেষ। মলানিয় মানুষেরা তাঁদের গুপ্ত বিদ্যার মধ্যমে এইসব দেহাবশেষ রক্ষা করে চলেছেন। চুরি যাওয়া বিকেলের আলোয় এ মন্দির দেখে যে কেউ আঁতকে উঠবেন।
মলানার উপরিভাগকে বলা হয় ধারা বেদা। নীচের অংশ সোরা বেদা নামে পরিচিত। অনেকে মনে করেন, এঁদের দেহে রাজপুতদের রক্ত রয়েছে। তবে অপেক্ষাকৃত সামাজিক ভাবে নিচু শ্রেণীর ‘লোহার’ আর ‘জুলাহা’দের এঁরা বহিরাগত বলেই মনে করে। এঁদের সাথে রাজস্থানী রাজপুতদের সংযোগ নিয়ে একটু ধোঁয়াশা আছে। রাজস্থানি ‘রাজপুত’দের সাথে তাঁদের একটা যোগ থাকার কথা যারা বলছেন, তাঁদের যুক্তি- রাজস্থানি রাজপুতরা এশীয়-ইউরোপ জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। এমনকি রোমানিয়ান জিপসিদের সাথেও রাজপুতদের জেনেটিকাল যোগ আছে। আসলে এই জাতিটি নানা ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। এঁরা সিটু এবং সুই জেনেরিজের অন্তর্গত এবং নিজেরা নিজেদের ‘রাজপুত’ বলে অভিহিত করে। ফলত ধরে নেওয়া যেতেই পারে এটা তাঁদের শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যের শব্দমালার একটি শব্দ।
মলানার পুরুষদের বিয়ে হয় রাসোল গ্রামের পাত্রীর সাথে। তাঁদের বিশ্বাস অনুযায়ী, রাসোল গ্রামের কন্যা রেনুকাকে বিয়ে করেছিলেন জামলু ঋষি। সেই সময় থেকে তাঁদের গ্রামের এটাই ঐতিহ্য। রাসোল গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন রেনুকা। মলানায় বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা খুব কম। তবে সনাতনী আইন অনুসারে পাত্রীর পুনর্বিবাহের অধিকার আছে।
৩।
শরতের শেষে পিলপিল করে পিঁপড়ের মতো দেশ-বিদেশের মানুষ ভিড় জমায় এই গ্রামে। অস্বচ্ছ কুয়াশার আবরণ ক্রমে কেটে গিয়ে ঝলমলে আলো ছড়িয়ে পড়ে উপত্যকায়। এটা ফসল তোলার সময়। মলানার প্রধান ফসল চরস। ক্যানাবিস। পৃথিবীর সবথেকে প্রসিদ্ধ চরস ‘মলানা ক্রিম’-এর উপর দাঁড়িয়ে আছে এ গ্রামের অর্থনীতি। সরকারের সাহস নেই এই চাষ বন্ধ করার। যদিও সারাদেশে চরস চাষ বেআইনি বলে ঘোষিত। এখান থেকে চরস ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। এখানে পর্যটকেরা ‘মলানার মালে’র সন্ধানে আসে। যত খুশী নেশা কর, তবে এখান থেকে মাল নিয়ে যাওয়া যাবে না। টাইমস ম্যাগাজিনের হিসেবে ১৯৯৪ এবং ১৯৯৬ সালে এখানের চরস পৃথিবীর সেরা চরসের শিরোপা পায়। এরসাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে মাফিয়া চক্র। এখানে ছেলে-মেয়ে-বুড়ো সবাই নেশাসক্ত। মলানায় প্রবেশের সাথেই একটা ভিড় আপনাকে ঝেঁকে ধরবে, ‘মাল চাই?’
নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগে বেশ কিছু ট্যুরিস্টের নিখোঁজ হবার বৃত্তান্ত সারা পৃথিবীতে ঝড় তোলে। পাহাড়ে, অরণ্যে, নদীর জলে ভেসে ওঠতে থাকে মৃতদেহ। অনেকে চিরতরে গায়েব হয়ে যান। অথচ পুলিশ-প্রশাসন নিরুপায়। লন্ডনের বিখ্যাত ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকা একটি স্পেশাল অণুসন্ধান কমিটি পাঠায় এখানে। গ্রামবাসীর প্রতিরোধের সামনে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
অবিশ্রান্ত চরসের ধোঁয়ার গন্ধে ভিড় জমাতে থাকে এখানে। ভঙ্গুর পাথুরের দালানে শুকোতে দেওয়া ক্যানাবিস পাতার দিকে লোভী চোখে চেয়ে থাকে বহিরাগতরা। এইসব পাথরের ফাটলের গভীরে সঞ্চিত গল্পমালা হিংসা –দ্বেষের নালিপথ বেয়ে অজস্র হত্যাবৃত্তান্তরূপে ছড়িয়ে পড়েছে আশেপাশের পাহাড়ে, গ্রামে। প্রজ্ঞা নয়, বিশ্বাসের কুলপ্লাবী ধারায় বহমান ঐতিহ্যের সাথে এইসব হত্যাবৃত্তান্ত তৈরি করেছে ভয়ভীতির আঁধি।
৪।

ক্রমে সভ্যতার বিষবাস্প অরন্যের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে প্রবেশ করেছে এখানে। তৈরি হচ্ছে ড্যাম। কাটা হচ্ছে অরণ্য। গল্পটা একই।
অসংখ্য সবুজের ভিড়ে দিগন্তের খোসা ভাঙা আলো অথবা অন্ধকারের তবক আঁকড়ে বেঁচে থাকার মধ্যে ভালো-মন্দ – প্রভৃতি এসব যা-ইথাকে, তাকে একান্ত নিজের বলেই ধরে নিয়েছিল মলানা। এখন কোথায় যেন একটা ছন্দ পতন। এক্সপোর্ট বিজনেসের হাতছানি। ফেরার আগে দেবদারুর গোছা আর শুকনো ক্যানাবিস পাতা খাতার ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছিলাম। এখন যে কোন বিবর্ণ, বিমর্ষ মেঘে ঢাকা দুপুরে ভূত-পেত্নির গল্পের মত আমার মাথায় বিলি কাটে মলানা। মাঝে মাঝে পাতা উল্টে ঘ্রাণ অনুভব করি। একটা বিমর্ষ দুপুর আমি ফেলে এসেছি মলানা গ্রামের পাথুরে দেওয়ালের ফাঁকে।
তথ্যসূত্র-
• The most ancient democracy in the world is a genetic isolate: an autosomal and Y-chromosome study of the hermit village of Malana (Himachal Pradesh, India) – R. Giroti, I. Talwar
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন