মন খুঁজতেই জীবন কাবার। লাখো ঘন্টা ঝুলছে। দুলছে। টিং টং ডিং ডং… এর মধ্যে ঠিক বেঠিক খুঁজে ফেরে পরশপাথর প্রত্যাশী পাগল। “সারা জনম কাটলো রে মন, তবু তোকেই কেন পেলাম না!” বাউলের হাহাকারের রেশ ছুটে বেড়ায়, উড়ে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায় শ্বাপদচরা প্রান্তর থেকে শুদ্ধসত্ত আরাধনার আলপনায়। মন নির্বিকার। তার কোনো হেলদোল নেই। তার আকার নেই। প্রকার নেই। মান নেই। অভিমান নেই। সকাল সন্ধ্যেয় রাতবিরেতে উচাটন ভাবনায় জর্জরিত হওয়া নেই। সে নির্বিকল্প উত্তম পুরুষ। সে অবয়বহীন ব্রহ্ম।
অসম্ভব ব্যস্ততার কোনো প্রান্তিক অবসরে সাবকনসাস কুঠরীর থেকে হঠাৎই বেরিয়ে এসে চারপাশে গোল হয়ে ঘুরতে থাকে স্মৃতির হারানো আলোর খন্ডচিত্র। কত রঙ, কত রূপ, কত গন্ধ তার! কোনোটা উজ্জ্বল হয়ে নক্ষত্র বিদীর্ণ হওয়ার সময়ের দ্যুতি ছড়িয়ে চলে। তো তার পাশেরটাই বিবর্ণ, ফেড, শুধুই মনখারাপীর কোট প্যান্ট পরে উদাসী নদীর একলা তীরে গালে হাত দিয়ে একা চুপ করে বসে থাকে। এত উজ্জ্বলতা, এত অন্ধকারের ভেতরে অবাক হয়ে দেখতে হয় মানুষের যাওয়া আসার অফুরান সেলুলয়েড গল্প।
আসলে পাখী নয়, হাওয়া নয়, সুর নয়, জল নয়, মানুষই তো পরিযায়ী। মানুষই তো পাখী। এই আছে, চোখ বোজো, এই নেই। এই তোমার বাড়িতে হাত ধরে, ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে কত রাত্রিজাগরণ। দেখতে দেখতেই মিলিয়ে গিয়ে গোলার্ধের ওপারে বসে মিটমিট হাসিতে দেখ তোমাকে জিজ্ঞেস করে,” কি গো ভালো আছ আমার বিহনে!”
সেটা ছিল আমার জীবনের প্রাচীন প্রস্তরযুগ। ইচ্ছেঘুড়ি উড়িয়ে টো টো। একবার সাত বন্ধু সাইকেলে বেড়িয়ে পড়লাম ভারত সফরে। প্রথম রাতেই ঝারখন্ডের জামতাড়া ট্রেজারির পাশে থানায় আশ্রয় নিতে গিয়ে ট্রেজারির সেন্ট্রি চিৎকার করে বললে, “Who comes there?” জানতাম না উত্তরে বলতে হয়, “Friend”। ভ্যাবলাকান্ত সাত এগোতেই গুরুম। ভাগ্যিস ভয় দেখানোর জন্যে ওপরে তাক করে ছুঁড়েছিল। ভাগ্যিস লাগেনি সেদিন। তাহলে কি আর…
দিনগুলো শুধু ভুলের ছেঁড়া ছেঁড়া কাগজের টুকরো। যেদিকে তাকাই কেবলই ভুল-ভুল-ভুল। কোনো মিসটেক শুধরানোর অবসর দেয়নি কখনোই। তখন গুজরাতে। ঝাঁ চকচকে শহর অ্যাহমদাবাদের থেকে অনেকটাই দূরে প্রত্যন্ত মফস্বল শহর। আমার দোতলা বাসার ঠিক পাশের বাড়িতেই এক ফুরফুরে প্রজাপতি। জিভের টংকারের ভাষা বুঝিনা, কিন্তু চোখের ভাষা বুঝতে কষ্ট হয়না। এক সন্ধ্যেয় সে বাড়ির অভিভাবকেরা নেমন্তন্ন করলেন। ভারী টুংটাং মন নিয়ে খেয়ে এলাম গুজরাতি আহামরি খাবার বাজরাকা রোটি, চানাকে দাল, মিরচি কে আচার, সরষো কে শাগ, বেসন কে লাড্ডু অউর মাঠঠা। রাতদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ানো এক তরুনের অলিন্দ নিলয়ে সেই হাড়কাঁপানো শীতেও ফুরফুরে বাসন্তিক হাওয়া। অনেকদিন কেটে গেলেও, আমার ভাষা বোঝানোর হাজার ইচ্ছে সত্বেও চোখে চোখ মিলিয়ে লক্ষ্মণপুরের সেই মেয়েটাকে বলতে পারিনি, ‘তুমি আমার হবে!’
‘চলতে রহো,চলতে রহো মুসাফির! কাঁহা ছোড়কে আয়ে তেরা মঞ্জিল! হায় রাব্বা!’ সত্যিকথা বলতে কি মুসাফিরের কোনো মঞ্জিল হয় না। সে চলতে থাকে। আজ এখানে, কাল ওখানে। ঘটনারা ঘটে ঘটবার জন্যেই। ঘটনারা ওঁত পেতে থাকে যাযাবরকে জড়িয়ে ফেলার জন্যে। কিন্তু সূক্ষ্ম সময়ের ওস্তাগড় জন্মনৈপুণ্যে নির্বিকার সব জাল, সব মায়া কাটিয়ে দিব্যি আবার বেড়িয়ে পড়ে রাস্তায়। রাস্তাই তার প্রেমিকা, রাস্তাই তার বাড়ী, রাস্তাই তার আশ্রয়।
চাকরী পাওয়ার সুবাদে খাঁটি ভারতীয় ছেলেটা গেল নিউজার্সিতে। আজন্ম ভারতীয় উপমহাদেশের কালো চামড়া টেনশনে ঘাবড়ানো অবস্থা কাটিয়ে তুলে সে দেশের অদ্ভুত ইংরেজী-স্প্যানিশ-ইজরায়েলী খিচুড়ি ভাষায় রপ্ত হয়ে গাড়ি চালানো শিখলো। এদেশের মতো রাইট হ্যান্ড ড্রাইভ নয়, উলটো। ওখানে সব লেফট হ্যান্ড ড্রাইভ। আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার কোথাও কিছু নেই। শাসন করার কেউ নেই জেনে একটু উলোপাল্টা কিছু করলেই সাঁ করে উর্দিপরা হাজির। ওরা আবার যখন তখন গুলি করে। কি কান্ড! গাড়ী চালানো শিখেই একদিন রাস্তায় নির্দেশিত স্পিড লিমিট খেয়াল না করে স্পিডোমিটারের কাঁটা উঠে গেছে অনেকটাই ওপরে। ওমনি প্যাঁ পোঁ গাড়ী। তড়াং করে নেমে লাইসেন্স দেখে বিনাবাক্যব্যয়ে তিরিশ ডলার ফাইন। তখনকার মতো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থায় কেটে পড়লো ছেলেটা। ওমা! কদিন পরেই তার বাড়ীর রাস্তায় দেখে, সেই পুলিশব্যাটা সাধারণ জামা কাপড় পরে হাতে এক মস্ত কাগজের ব্যাগ হাতে হেঁটে আসছে। ছেলেটাও সামনের স্টোর থেকে রোজকার প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়ে ফিরছিল। তার হাতেও সেই কাগজের ঠোঙা। ঘাবড়ে গিয়ে থতমত খেতেই হাতের ঠোঙা ছিঁড়ে জিনিস রাস্তায়। ওমনি দৌড়ে এসে সব জিনিস কুড়িয়ে এক্কেবারে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে কফি খেয়ে বিদায় নিলো পুলিশব্যাটা। মাইক নামের সেই কালো পুলিশের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল এরপরে। তার কথা ছেলেটা কোনোদিন ভোলেনি।
‘চলো মুসাফির বাঁধো গাঁঠরি রাস্তা বহোত দূর হ্যায়’। একটা উইকএন্ডে ছেলেটা ভাবলো মেক্সিকো দেখে আসি। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ছাড়পত্র জোগাড় করে ঝাঁ চকচকে বাসে সটান পাড়ি। পাশের সিটে সহযাত্রিনী এক লম্বা চওড়া পুরুষালী চেহারার মেয়ে। ভারতীয় সংস্কারে ছেলেটা জানতো ওখানে মেয়েরা বোধহয় দেখা হলেই, পরিচিত হলেই চুমু খায়। তাই সিঁটিয়ে বসেছিল। ওরকম ছেলে ছেলে চেহারার কাউকে চুমু খাওয়ার একটুও ইচ্ছে ছিল না তার। বাস কিছুটা ছুটতেই নিজেই যেচে আলাপ করলো মেয়েটা। লিনডা। আদতে জার্মান, কিন্ত দু পুরুষের ইয়াঙ্কি। আশ্চর্য! ওরকম কড়া চেহারার ভেতরে যে খুব নরম মন থাকতে পারে প্রথম জেনেছিল ছেলেটা। আর বন্ধুত্ব একটু বাড়তেই মন খুলে ভারতীয় ধারণার কথা বলতেই হা হা করে হেসে উঠেছিল লিনডা। না, ওখানকার মেয়েরাও শুধুমাত্র প্রেমিক ছাড়া অন্য কাউকেই চুমু খায় না।
সুখ কিম্বা দুখ সময়ের ইতিবৃত্তে যে মানুষ স্থবির নয়, যার মনের মধ্যে শ্যাওলা পড়েনি, সেই তো পরিযায়ী। নদীর একলা কূল ধরে এগিয়ে চলে পরিযায়ী বাউল। নদীর মাঝখানে জাল ফেলে মাছ ধরতে ধরতে আনন্দে ভাটিয়ালী ধরে পরিযায়ী মেছুয়ারা। থৈ থৈ আনন্দে নেচে ওঠে জল, নদীর দু পাড়। বাউল আর ভাটিয়ালী মিশে যায় একসময় একসুরে। ঘরের কোণ ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে আসতে প্রাণের আনন্দে গেয়ে ওঠে পরিযায়ী মানুষ ব্রহ্মকবির গান।
‘আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ..
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন