সাঈদা মিমি

mimi


সকালে আমার ঘুম থেকে উঠতে ভালো লাগে না, স্ট্যান্টার্ড টাইম আটটা। এর আগে কেউ আমাকে জাগানোর চেষ্টা করছে কি তার পুরো দিন আমি নরক করে দেবো, মিলি সেই নিয়ম ভঙ্গ করে আমাকে জাগিয়ে দিলো ভোর চারটে পয়তাল্লিশে । কেবল তাই নয়, দাঁত ব্রাশ করালো, আনকোরা পোষাক পরালো, যা কিনা গতকাল দর্জির দোকান থেকে আনা হয়েছে । টাইট করে চুলও বেঁধে দিলো, ব্রাত্য জনের কথা, খোলা চুল বেয়ে জ্বিনেরা দেহে ভর করতে পছন্দ করে । এমনিতেই গতরাতে বিশাল আড্ডা শেষে ঘুমাতে গেছি তিনটায়, এখনও আসলে আমার ঘুম ভাঙ্গেনি । কেননা, আমি প্রত্যুষ জাগরণজনিত ক্রোধ টের পাচ্ছি না, চা পান করার সময়ও নয় । তারপর ঠেলেঠুলে যখন গাড়িতে বসিয়ে দেয়া হলো, নানির কাঁধে মাথা রেখে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম । খাগড়াছড়ি পার হওয়ার পর একবার ঘুম ভেঙ্গেছিলো, তখন সবাইকে বলাবলি করতে শুনেছি, মইশকালি মানে মহেষখালি যাওয়ার জন্য যে ট্রলার ভাড়া করা হয়েছে সেটা নিরাপদ ।

ট্রলারের বিকট শব্দে তিনটে ব্যাপার ঘটলো। আমার ঘুম ভাঙ্গলো, ঘড়িতে সাড়ে সাতটা সুতরাং মেজাজ পুরোপুরি খিটমিট করতে শুরু করলো, খিদে পেলো । মিলি পরোটা মাংসের বাটি এগিয়ে দিয়ে বললো, খা, বেশি তেড়িবেড়ি করলে সাগরে ফেলে দেবো । এতক্ষণে আমার মনে পড়তে লাগলো, আজ আমরা জ্বিন সম্রাট রাফতান খুশনহরের আখড়ায় যাচ্ছি, সেখানে রাত্রিযাপন এবং জ্বিন কর্তৃক চিকিৎসা চলবে । ভিকটিম আমাদের পারু, আমার ফুপাতো বোন । সমস্যা তার বড়ই জটিল, যেই লোকটার সে প্রেমে পড়েছে তার বয়স চৌত্রিশ, আর পারুর মাত্র ষোলো । এ নিয়ে ঘরে প্রতিদিনের অশান্তি, পারু কে তালাবদ্ধ করে রাখা হয় যেনো সে পালিয়ে যেতে না পারে । পরিবারের সবাই নিশ্চিত, এই বুইড়া প্রেমিক পারু কে কালাযাদু করেছে । নইলে পারু তার জন্য উম্মাদ কেনো? সারাক্ষণ ঈশ্বর বন্দনার মত একই নাম পারুর মুখে, হামিদ.. হামিদ.. হামিদ...  হ্যাঁ, পারুও সঙ্গে আছে, ঘুমের দাওয়াই খাইয়ে আধা অচেতন করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে । 
- কোথায় যাচ্ছি আমরা মিলি? আদিনাথে মন্দিরে! 
- না, মৈনাক পর্বতের মাঝামাঝি এক দরগায় 
- সেখানে কি চিকিৎসা হবে? 
- বড় বেশি কথা বলিস! জ্বিন ওর চিকিৎসা করবেন । মিলি পারুর খালা, রাশভারী পীরসেবক, আমি আর কথা বাড়াই না ।

পাহাড়পথের বিবরণ দেবো? নাহ, আরেক কেচ্ছা হয়ে যাবে, বরং, দরগায় যাই । কতগুলি সিঁড়ি ভেঙ্গে পৌঁছেছি জানি না, কেবল জানি, মাংশপেশিতে খিঁচ ধরে আছে, হাড্ডিগুড্ডি ওলটপালট সিগনাল দিচ্ছে । প্রথমে যে ঘরটায় বসে ছিলাম, আলো বাতাস উপচে পড়ছিলো । মিলি টিফিন ক্যারিয়ার খুলে খাবার পরিবেশন করলো । দুপুর হয়ে গেছে, পেটে খাবো খাবো শ্লোগান । ভেবেছিলাম, এরা খানাখাদ্য দেবে! কিসের কি!! তা কিনা একটু জোর গলায় বলতে মিলি ধমকে উঠলো, চুপ, চুপ, বাবার কানে গেলে সর্বনাশ হবে । কোন বাবা? পীরবাবা । মিলির কি দোষ দেবো! ও তো নাইন পাশ দিয়েই গিন্নী । আমার বয়সীই তো! কত বড় বড় পাশ দেয়ারা পানির বোতল হাতে বসে আছে! দীর্ঘশ্বাস ফেলি । শুনলাম রাতে মাংশ দিয়ে খিচুরি রান্না হবে, মুরিদ দের জন্য; এটা সুখবর ।

পাহাড়ের রহস্যবাঁক খুঁজতে খুঁজতে বিকেল, সন্ধ্যাও খুব তাড়াতাড়ি এসে গেলো, সমতলের মত সেতারসুরে নয় । তখন বাড়ির মধ্যমভিটায় আমাদের ঢুকতে দেয়া হলো । বেশ বড় ছাউনি, পার্টিশন করে পুরুষ মহিলা আলাদা থাকার ব্যবস্থা, মেঝেতে চাটাই পাতা । এখানেই নাকি রাতে ঘুমাতে হবে! রাতের আজানের পর আরও কিছু সময়, উঠোনে চুলা তৈরি করে রান্না চলছে । একটা মিস্টি সুবাস আসছে কি? পায়েস । মন যখন খুশিতে চৌদ্দটুকরা, মিলি সাফ জানিয়ে দিলো, পায়েস কেবল জ্বিনের জন্য ।

ঘরটা অন্ধকার, ঠাসাঠাসি করে বসা মানুষের নিঃশ্বাস শোনা যায় কেবল। বারান্দায় সলতে কমানো একটা বাতি আছে বটে, তা এই জমাট তমসা দুর করতে সক্ষম নয় । দীর্ঘ অন্ধকার একসময় চোখে সয়ে আসে, কিছু দুরে একটা সাদা কাপড় ঘেরা জায়গা দেখা যায়; ওখানে জ্বিন বসবেন । ঘরটায় অপার্থিব ধোঁয়া, আতরের খুশবু, পীর সাহেবের জিকির, সেবকেরা হামিং দিচ্ছে । এ কোন ফ্যাসাদে পড়লাম? ভাবনাগুলো খিদে বাড়াচ্ছে । মৃদু গুঞ্জন, জনাবা এসেছেন । জনাবা? পরি নাকি? খুশবুদার পায়েস নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সাদা কাপড়ের আড়ালে । পীর সাহেব একেকজনের সমস্যা বর্ণনা করছেন, অন্যদিক থেকে কোন শব্দ পাচ্ছি না, কেবল পানিপড়ার বোতল নিরীহ ভিক্টিমদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে । এখন জ্বিনসাহেবা আমাদের কায়রোর স্পেশাল মিস্টি দেবেন; তবারক! আর পারা যাচ্ছে না ।

কায়রোর মিস্টি মানে? মুখ ফসকে বের হয়ে যায়, মিলি আমার গলা চেপে ধরার আগেই । এমন সময় কিছুটা সুরেলা, অনেকটা ধোঁয়াটে, খানিকটা কর্কশ একটা কন্ঠ বলে ওঠে, “আমি খায়রো ইনুভার্সিটির প্রফেসর । সময় খম, এখন বেশি খতা বলনের টাইম নাই, আমাকে তাড়াতাড়ি ছলি যাইতে হবে… আর অবিশ্বাসী বালিখা, শোনো, বেশি খতা বলিয়া নিজের সব্বনাশ ডাখিয়া আনিও না, তবারখ খাও…“ এরপর আমি ফিট পড়ে যাই । মিলি পরে জিজ্ঞেস করেছিলো, অনেক ভয় পেয়েছিলি? ফিট পড়ে গেলি! আমরা ভয় পেয়েছিলাম । কি করে বোঝাই, ভয় পেয়ে নয়, কায়রো ইউনিভার্সিটির প্রফেসর, সেই জ্বিনের ভাষা শুনে আমি অজ্ঞান হয়েছি। 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ