৩১ শে মে ১৮৫৫... পবিত্র স্নানযাত্রার দিন উদ্বোধন হল দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির। ১৮৬১ সালের ১৮ ই ফেব্রুয়ারী মন্দিরের ভার ট্রাস্টির হাতে সমর্পণ করলেন প্রতিষ্ঠাত্রী রানী রাসমনি। এবং সে রাতেই দেহত্যাগ করলেন।
বলিউড সিনেমার শুরুতেই যেমন ভেসে ওঠে কিছু লেখা এবং তারপরেই শুরু হয় মিউজিক বাজিয়ে মূল সিনেমাটি... আমার এই অর্বাচীন লেখাটিও তেমনি করেই শুরু করলাম। কতবার গেছি এই দক্ষিণেশ্বরে। মনে পড়ে ছোট ছিলাম যখন তখন খুব বেশি রকমের বাঁদরের উপদ্রব ছিল পঞ্চবটীতে। শীতকালে সেখানে গেলেই অবধারিত বাঁদরের থাপ্পড় খাওয়া মাস্ট ছিল আমার। কেন আমাকে ওরা অপছন্দ করত কে জানে!! শুনেছি অপোজিট অ্যাট্রাক্টস মানে সিমিলার ডিজলাইক্স এরই উদাহরণ হবে হয়ত! তা যাক গে বুড়িদের মত এটটু স্মৃতি চিবোই!
তখন এত গুচ্ছের খাবারের দোকান আর বেলন চাকি পাথরের শিবলিঙ্গ লোকনাথ বাবা রুদ্রাক্ষের মালা পুঁতি দিয়ে তৈরী নানা রকম মালা প্লাস্টিকের এরোপ্লেন গাড়ি নকল জবা ফুলের মালা ইত্যাদি নানা রকম সাড়ে বত্রিশ ভাজার এত দোকান ছিল না। খাবার ও তখন আমরা টিফিনকারি করে লুচি তরকারি কমলা নিয়ে যেতাম। আর হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়লেই সতরঞ্চি বিছিয়ে খাবার খেতে বসতাম। আর অমনি বাঁদরকুল গাছের মাথা থেকে সড়সড় করে নেমে এসে এক থাপ্পড়ে হাতের লুচি নিয়ে উধাও। গঙ্গার দিক থেকে শীতল হাওয়া এসে সোয়েটার ফুটো করে হাড় কাঁপিয়ে দিত। ফুলো ফুলো গালের ফাটা শিরজালিতে ভেসলিন লাগানো আমি দিদির পেছনে লুকোতে চাইতাম। তা সে যাই হোক সার সার ওই শিব মন্দির গুলোয় ঢুকে সেই সব নদীশ্বর জলেশ্বর জটিলেশ্বর-এর নাম বাড়ি ফিরে ছোড়দাকে বলা আর ফিজিক্যাল সায়েন্সের ম্যান্ডেলের পর্যায় সারণি মনে রাখার চেয়ে কিছু কম নয়। যথারীতি কোন দিন সবকটার নাম বলতে পারতাম না। ( ছোড়দা তো সেটুকুও পারত না, তবে আমার ওপর দাদাগিরি ফলানোর এই সুযোগ ছাড়ত না। তবে কি না চাঁটি দিত না। মুখেও- এ মা কিস্যু জানিস না...বলেই থামত।)।
দক্ষিণেশ্বরের কথা বললে বোধহয় আমার ফুরাবে না। সেই সব কচুরির দোকান। আমরা বরাবর মন্দিরে পুজো দিয়ে এসে দু নম্বর দোকানটায় কচুরি খেতাম। আজও তাই খাই। যদিও কোন যোগ্যতায় সেটি প্রথম দোকানের চেয়ে বেশি ভালো জানি না। ওখানেও তো খাবারের স্টিলের থালা তেলতেলে আর ছোলার ডাল একটু খানি আর কচুরিও একই রকম ছোট ও মোটা যাতে ঠান্ডা হলে দাঁত দিয়ে ছেঁড়া আর আখের খোসা ছাড়ানোর মতই ব্যায়াম হয়।
ঘাটে গিয়ে গঙ্গার জলে হাত ডুবিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে সেখানেই থাকা ডালার দোকান থেকে পুজোর ডালা নিয়ে আসা ছিল হ্যাবিট। পরে যখন ডালা র পুনর্বাসন হল তখনও ৩৯ নম্বর দোকান থেকেই বরাবর ডালা নিই। কেন? তা কি জানি। ওখানেও তো দেখি বাসি ক্ষীরের ছোট্ট ছোট্ট প্যাঁড়া আর তিন চারটি জবা ফুল দিয়ে তৈরী বিশাল মালা আর বিয়ের ওড়নার টুকরোর মত একটা ঢাকনি দেওয়া থাকে ডালায় অন্য দোকানের মতই! জুতো খুলে সেই যে মন্দির চত্ত্বর পরিভ্রমণে বের হই ফেরার পরে যথেষ্ট পুণ্য এবং ফাটা গোড়ালিময় মাটি নিয়ে তবেই ফিরি। তার আগে নয়।
প্রেম করতে এখন অনেকেই দক্ষিণেশ্বরে যায় শুনি, দেখিও। সিঁড়িতে বসে প্রেমিক প্রেমিকা সেলফি তোলে নিবিষ্ট হয়ে। আমাদের সময়ে ভাবতেই পারতাম না এই সব জাগতিক বিষয় করব দক্ষিণেশ্বরে। সে যে আধ্যাত্মিক বিষয় সমূহের ব্যাপার আর কচুরি খাওয়ারও! খাওয়া নিয়ে প্লিজ কোন কম্প্রোমাইজ নয়!
সেই বিরাট পাথরের চত্ত্বরে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা টনটন করার পরে যখন একগাদা ধুপ পাশের থামে জ্বালিয়ে গুঁজে রাখার পরে ভবতারিণী মায়ের মুখ দেখতে পাই... সত্যি বলছি প্রাণ জুড়িয়ে যায়। জানি না কেন দেবী কন্যাকুমারীর মতই লাগে সেই মুখ। ভক্তি টক্তি এ শর্মার আছে কচু পোড়া কিন্তু বালিকার মত পবিত্র সেই মুখ দেখার পরে মন থেকে ভ্যানিশ হয়ে যায় এতক্ষণ লাইনে দাঁড়ানোর কষ্ট। প্রার্থনার নামে বখশিস চাওয়া অপরাধ সে কথা ছোট্ট বেলায় মা মাথার ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল । ব্যস। তার ফলে রেজাল্ট ভালো করে দাও মা থেকে অমুক টা পাইয়ে দাও এসব চাইতে লজ্জা করে। অতএব একটা পুঁথিগত প্রার্থনা ঠুকি আর তার সঙ্গে মনে মনে হয়ত শক্তিই চাই। কে জানে!
কালী মন্দির ও শিব মন্দির গুলি দর্শন করার পরে রাধাগোবিন্দ মন্দিরে ঢুকলেই আমার মুন্ডুটা বিগ্রহের সামনে ঠুকে থালায় প্রণামী দিয়েই ঝটপট চরণামৃত নেওয়া সারি। আসল নজর থাকে পাশের ঘরেই রাখা সেই রাধা গোবিন্দ বিগ্রহ যেটিতে কৃষ্ণের মূর্তির পা ভাঙ্গার পরে শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে সেটি জোড়া লাগান। ইতিহাস বরাবরই প্রিয় জিনিষ। ভাবলে শিরশির করে মন এই সেই বিগ্রহ যেটিকে শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং ধরেছিলেন। এখন তো এমনকী মায়ের মূর্তির নিচের বেদীটি সারানোর নামে যথেচ্ছ অদলবদল ঘটানো হয়েছে। যাই হোক।
ছোটবেলায় শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরের সামনের বই বিক্রির দোকান ছিল আমার অন্যতম আকর্ষণ। প্রতিবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেসব বই নাড়তাম চাড়তাম পড়েও ফেলতাম পুরো চটি বই তারপর বাবার কাছে বায়না করে কোন না কোন বই হস্তগত করে ঠাকুরের ঘরে প্রবেশ। তখন মেঝে ছিল অন্যরকম মূলে সময়ের ইঁট পাতা। আর ঘরে ঢোকা মাত্রই মুহূর্তে মন শান্ত হয়ে যেত কী জানি কোন ম্যাজিকে। সকলেই দেখতাম জপ করছেন নয় চুপ করে বসে আছেন। আর দেওয়াল জোড়া ছবি। রানী রাসমনির ছবি ছিল না তখন। এখন তো ইতিহাস পুনরলিখিত হচ্ছে। সন্ধ্যাকালে অন্য ছবি। তখন আবার ঘর থেকে বের হলেই ‘খন্ডন ভব বন্ধন’ হত বেশ ভুলভাল সুরেই, কিন্তু হত তো অবশ্যই। আর উল্টো দিকে নহবত।। তখন সেটি পুরোনো দিনের মতই ছিল। মায়ের অপরূপ মূর্তিটি তখন ছিল না। কিন্তু কি জানি কেমন শীতল লাগত মনটা। মনে হত বাড়িতে এসেছি।
আমার মা এখন সেই বয়সে যে বয়সে মানুষ ধর্মে মন দেয়। আমার মা আবার আমার মতই উল্টোপাল্টা। তাই আমার ছোট থেকেই মানে মার তখন প্রখর যৌবন, মা তখন থেকেই ধর্ম নয় স্রেফ ভালোবেসেই এখানে আসে। কদিন না এলেই গলা শুকিয়ে যায় তার। পা দুটো তো প্রবল খারাপ অবস্থা। তবে তেজীয়ান মহিলাকে দমানো মুশকিল। তাই আবার যখন বললাম চলো একটু দক্ষিণেশ্বর যাই। তবে সকালে নয় বিকেলে। এক লাফে থুড়ি এক লেংচে রাজি হলেন তিনি। আমিও নানা কসরত করে এনে ফেললাম এখানে। তারপর সেই গঙ্গা- ডালা- মন্দির- নদীশ্বর জলেশ্বর- রামকৃষ্ণ দেবের ঘর- মায়ের ঘর- কচুরি...
ফেরার সময় ট্যাক্সিতে চেপেই আহ্লাদে খুকী বলে উঠল “ যত কৃপা ত্বমহং বন্দে/ পরমানন্দ মাধব।” সত্যিই তাই এত অসুস্থ মানুষ নিয়ে কিভাবে যে আবার ও ঘুরে এলাম পরম তীর্থ কিংবা প্রাণের আরাম দক্ষিণেশ্বর!
মূকং করোতি বাচালং
পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিং ...
শ্রীচরণে শতকোটি প্রণাম।।
* ছবি - জয়া
* ছবি - জয়া
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন