ইফতেখারুল হক

ifte

আজ থেকে প্রায় ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগের সময়ের কথা আজকাল খুব বেশি মনে পড়ে।  সম্পূর্ণ একা কোলাহল হীন সময়ে ব'সে ব'সে যখন ভাবি সেই দিনগুলোর কথা,শত কষ্টের মাঝেও বেশ সুখ পাই আমি। আরাম পায় আমার হৃদয়। চোখ বন্ধ ক’রে খুঁজে বেড়াই আমার ছেলে বেলার ভোর, নরম ঘাসের উপর শিশিরের ফোঁটা, মোরগের ডাক, কাদা মাখা শরীর ও তার গন্ধ।  কাঁচা পাট আর রুপালী মাছের গন্ধ, বিলের রাজহাঁস, বাতাসে ঢেউ খেলা সরিষা খেতের রূপ, পুকুর পাড়ের বয়স্ক জলপাই গাছ ও তার ছায়া শীতলতা, জেলেপাড়ার কোলাহল, পুবের লাল সূর্য । বাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা অর্জুন গাছটি যার ডালে বাসা বাঁধতো টিয়া পাখি। অনেকপাখিই দেখেছি আমি আমার ছেলেবেলায়; কিন্তু কোন পাখিই আমাকে মুগ্ধ করতে পারেনি ওই টিয়া ছাড়া । আজো গ্রামে গেলে কিংবা এই ঢাকা শহরে কোথাও যখন টিয়া দেখি বেশ লাগে আমার, আমি আনন্দ পাই। আমি প্রায়-ই অর্জুন গাছে চড়ে বসতাম যদিও ভীষণ কষ্ট হতো অর্জুন গাছে চড়তে। কিন্তু টিয়া পাখির বাসার কাছে যেতে সাহস পেতাম না। ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম, কারণ মা টিয়া এমন ভাবে তাকাতো আর ডাকতোযে বাচ্চা টিয়া আমি কোনোদিনই হাতে তুলে নিতে পারিনি। একবার চেষ্টা করেও পরে ফিরে আসি আমি । কী সাঙ্ঘাতিক তীক্ষ্ণ ঠোঁট ওদের, মনে হতো এক ঠোকরে ছিনিয়ে নিতে পারে প্রাণ ।

চড়ুই পাখি ভালো লাগতো না আমার কিন্তু ওদেরসরলতায় আমি মুগ্ধ না হয়ে পারতাম না। পাখিটি আকর্ষণীও মনে হতো না আমার কাছে। তবুও তারাই একমাত্র পাখি যারা যখন তখন দেখা দিত চোখের সামনে । শালিক, দোয়েল, মাছরাঙা, ঘুঘু, ময়না, ডাহুক, বক আরও অজস্র পাখি দেখেছি, তাদের ডাকশুনেছি । কোন কোন পাখিকে বুকে জড়িয়ে চুমো খেয়েছি তার বুকে, পিঠে, ঠোঁটে ।

ছেলেবেলায় প্রকৃতির রঙ ও রূপ এবং চারপাশের রঙিনের ভেতর দিয়ে কেটেছে আমারশৈশব, কিশোর বেলা । আমার চারপাশে সবুজ আর হলুদের ছিল ছড়াছড়ি । সবুজ, ফ্যাকাশে হলুদ ঘাস, মাইলের পর মাইল জমি জুড়ে বিছানো সবুজ ফসলের চাদর,কাঁচাপাকা ধানের খেত । তবুও লাল, নীল, শাদা, বেগুনি কমলা রঙ গুলো খুঁজতাম যখনতখন; পেয়েও যেতাম । না পেলে ছুটে যেতাম বনে, উঁচু টিলায়, পুকুর পাড়ে, ফুলেরবাগানে । আর নীল দেখার জন্য আমি যখন তখন তাকাতাম আকাশের দিকে । চোখ জুড়েযেতো আমার । আশ্চর্য এক অনুভূতি খেলা করতো মনে, সমস্ত শরীর জুড়ে। অজস্র রঙ দেখে দেখে আমার শৈশবের চোখ কৈশোরে পৌঁছেছিল । কিশোর আর যৌবন বেলায় এসে সেই চোখ দিয়ে আমি খুঁজেছি অনেক কিছুই । খুঁজেছি নারীর প্রেম, দেখেছি তাঁকে অদ্ভুত সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার চোখে সামনে।  আমি মুগ্ধ হয়েছি, আমি ভেসে গেছি, আমি কেঁপে কেঁপে উঠেছি তাঁর ভিতর, বাইরের রূপে গুণে ।

নারীতে আমি আজো মুগ্ধ । আজো তাঁদের স্পর্শে, গন্ধে মাতাল হয়ে যাই ! তাঁদের কাছে গেলে আমার ভেতরের নীরবতা ভেঙে আমি জেগে উঠি ! আমার নরম, কাতর হৃদয় তাঁদের সংস্পর্শে ভুলে যায় পৃথিবীতে এখনো একবেলা খাবারের জন্য একটি শিশুকে ভিক্ষে করতে হয় তার কথা, ভুলে যায় দারিদ্রতা কতটা ভয়ংকর রূপ ধারণ করে ভাঙ্গছে মানুষের মন, খেলছে তাঁদের অস্তিত্ব নিয়ে, তার কথা । ভুলে যায় পীড়ন, নিপীড়নে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ আজো অসহায়, তার কথা কথা।  ভুলে যায় সেকেন্ডে সেকেন্ডে গুলিতে নিহত হচ্ছে নিরাপরাধ মানুষ গুলো, তার কথা।  অনাহারে, প্রচণ্ড শীতে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে গিয়ে মরে যাচ্ছে দরিদ্র মানুষেরা, তারকথাও ! তবে কি আমি স্বার্থপর একজন মানুষ ? তবে কি আমার মন, হৃদয় বলে কিছুনেই ? তবে কি আমিও পারি না কারো কারো মতো মানবিক হতে ? আমি কি শুধু প্রেম খুঁজি ? খুঁজি শুধুই ভালোবাসা ? মাঝে মাঝে ভাবি, ভেবে যা উত্তর পাই- দেখি, আমার মতো মানবিক মানুষ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই । উত্তর পেয়ে ভালো লাগে আমার ।

চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা সৌন্দর্য আর রঙের প্রাচুর্য দেখে ছেলেবেলা থেকে যৌবনকাল পর্যন্ত আমার চোখের কোন অসুখ হয়নি । কিন্তু এখন যত দিন যাচ্ছে, বয়স যত বাড়ছে , যত এগিয়ে যাচ্ছি বয়সের রাস্তা কেটে কেটে সামনের দিকে, আমার চোখধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ছে । আমার চোখ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।  একসময় আমি কিঅন্ধ হয়ে যাব ?

আমি এখন আর দেখি না কোন সৌন্দর্য।  দেখিনা কোন সুন্দররূপ।  দেখি না রঙের বাগান, যে রূপে যে রঙে আমি আজ মুগ্ধ হয়ে রক্ষা করবো আমার চোখ।  আজ কেবল একটা রঙই সারাক্ষণ চোখে পড়ে আর তা হলো ‘লাল’ ! কিন্তু আমি ছেলেবেলায় যে লাল রঙ দেখেছি তার সাথে এর অনেক পার্থক্য । এই লাল খুন হয়ে যাওয়া মানুষের শরীরের, এই লাল শিশুর পবিত্র শরীরের, এই লাল যুদ্ধাহত সাধারণ মানুষের। এমন লাল দেখে কি চোখ সুস্থ থাকতে পারে ? চারপাশে আজ কেবলই ভয়ঙ্কর, ভীতিকর দৃশ্য ও তার বর্ণনা । খুন, শিশু হত্যা, ধর্ষণ,মানুষের হাহাকার, আর্তনাদ অভাব অনটনের কথাই আজকাল বিশেষ ও তাজা সংবাদ! লেখক কবিদের উপজীব্য বিষয় । 

কবিদের ভেতরেও নেই কোন সৌন্দর্য, প্রীতি নেই সুন্দরের প্রতি, ভালোবাসা নেই প্রকৃতির প্রতি ! আর থাকবেই বা কেমন করে ? যেখানে কবিতার ভাষা ও তার অক্ষর গুলো লাল, কেবলই লাল ।  খুন হয়ে যাওয়া রক্তের মতো !


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ