আজ আমরা ‘আত্মার সান্নিধ্যে’ র পক্ষ থেকে মুখোমুখি বিশিষ্ট কবি , গল্পকার , প্রাবন্ধিক , ঔপন্যাসিক , সমালোচক এবং সম্পাদক শ্রী বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়ের । পুরুলিয়ার ভুমিপূত্র এই মানুষটি মিষ্টভাষী , রসিক এবং একনিষ্ঠ তার কাজের প্রতি , দায়বদ্ধ সমাজের প্রতি , দশের এবং দেশের প্রতি । এক কথায় তিনি আমাদের মুখোমুখি হলেন, ব্যয় করলেন তার অনেকটা সময় ভীষণ ব্যস্ত সিডিউল থেকে , তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ ।
আপনি তো জন্মেছেন এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে, আপনার বাবাকে সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতে দেখে বড় হয়েছেন , এভাবেই কি ঠিক হয়ে গেছিল আপনার ভবিষ্যত ?
আমার জন্ম এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে । বাবা সুপরিচিত কবি, সুবক্তা এবং কেতকী সম্পাদনার সাথে যুক্ত। আমার জেঠুর ছিল নাটক থিয়েটার নিয়ে উন্মাদনা, কাকু ভালো ছবি আঁকতেন, বই এবং পত্রিকার প্রচ্ছদ করতেন। পিসিমনিরা আবৃত্তি করতেন । এরকম এক পরিবেশের মধ্যে আমার এবং আমাদের সমস্ত ভাইবোনদের বেড়ে ওঠা। বাড়িতে কবিতা জগতের মানুষের যাওয়া আসা, প্রাণময় আলাপচারিতা দেখতাম। জেলার কবি সাহিত্যিকেরা আসতেন। জেলার বাইরে থেকেও আসতেন অনেকে। তাঁদের ভালোবাসা পেতাম, স্নেহ এবং আদর। বাবার বৈঠকখানার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। বইএর পৃথিবী। সেখানে দেশ দুনিয়ার পত্রিকা। এই জগতটা আমাকে আকর্ষণ করতে থাকে খুব ছোটবেলা থেকেই। শব্দ আর নৈশব্দের দুনিয়া। অক্ষরের মানচিত্রে আকরিক অনুভবপুঞ্জ ।একটি বন্ধু বিচ্ছিন্ন কিশোর। ধুলো রাস্তায় সে খুঁজে বেড়ায় শব্দের বিপন্ন ধ্বনি , আলপথে দাঁড়িয়ে শোনে রাখালের বাশি , নিভৃত ঘাসের গায়ে দেখে নীমিলিত অশ্রুর শিশির। শীতের উনুনে উষ্ণতার পাশাপাশি টের পায় খিদের বিশ্বরূপ। তার মনের ভেতরের আনবিক বুদ্বুদ টের পায়না তার স্কুলপাঠীরা। তাদের বোঝাতে পারেনা এই ভাঙনের প্রতিধ্বনি। সমস্ত ব্যস্ততা থেকে কোলাহল থেকে এক অব্যক্ত সন্ন্যাস টের পায় মেধার গভীরে । হয়তো এসবই আমার ইকুয়েশন অফ মোশন যা অনিবার্য ভাবে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে ।
আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা পুরুলিয়া জেলার মণিহারা শিয়ালডাঙ্গা গ্রামে । মণিহারা গ্রামটি ভৌগলিক দিক থেকে অন্যরকম। এর কিছু অংশ বাঁকুড়া জেলায় আর কিছুটা পুরুলিয়ায় । আমার বেশ ভালো লাগে এই বৈচিত্র । মনে হয় দুটো জেলার সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটিয়েছে গ্রামটি । জেলাগত ভাবে আমরা পুরুলিয়ার মানুষ হলেও বাঁকুড়ার সাথে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে । চিকিৎসার প্রয়োজনে তো বটেই অন্যান্য দরকারেও এই জেলা শহরটির সাথে আমাদের নিবিড় আত্মীয়তা। আমি যে কলেজে পড়েছি সেই বাঁকুড়া খৃষ্টান কলেজকে তখন বলা হত বর্ধমান ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্সি কলেজ। আজও সেই সুনাম অব্যাহত আছে । ফলে শুধু পুরুলিয়া বাঁকুড়া নয় , দুর্গাপুর , মেদিনীপুর এমন কি ধানবাদ থেকেও প্রচুর ছেলেমেয়ে এখানে পড়তে আসত । কলেজটির সুনাম এবং ঐতিহ্যের কারনেই আমার বাঁকুড়ায় পড়তে আসা ।
শর্মিষ্ঠা , এটা খুব ভালো প্রশ্ন । আমি নিজেও মাঝেমাঝে ভাবি । কর্মসূত্রে এক জরুরী পরিসেবার সাথে যুক্ত । যেখানে দিন বা রাতের আলাদা কোন সংজ্ঞা নেই আমাদের কাছে। তফাতও অনুভব করতে পারিনা অনেকসময় । সাহিত্যের কথা ছেড়েই দিলাম। হয়তো কোন নিকটাত্মীয়ের বিয়ে বা গ্রামের বাড়িতে পূজা বা আরও কোন জরুরী কাজ পরিকল্পনা করা আছে মাস খানেক আগে থেকে। তাও হয়ে ওঠে না। ভেস্তে যায় ছুটির অভাবে । ইচ্ছে থাকলেও অনেক কবিতা উৎসবে যেতে পারিনা। প্রতিটি রোববার আমার বিশ্রাম চিহ্ন বহন করেনা। আমি জানি আমার অনেকগুলো সত্ত্বা । যে কবিতা গল্প লেখে সে অন্য বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় । তার সাথে লেখার টেবিলে আমার দেখা হয়। চার পাঁচ ঘণ্টা আমি সেই স্বত্বা যাপন করি। পড়ি এবং লিখি । তারপর অন্য ভূমিকায় । এইভাবেই চলতে হয় । একজন হয়তো একটা তথ্যসমৃদ্ধ গদ্য চেয়েছে। পাঁচ দিনে লিখতে হবে। পড়াশোনা এবং লেখা। হাতে পাঁচদিন। তবুও না বলতে পারিনা । কারণ যে চেয়েছে সে ভালোবেসে ছোট কাগজ করে , বুকের রক্ত দিয়ে স্বপ্ন সাজায় । এই মানুষটির ভালোবাসার কাছে আমি আজানুপ্রনত । কাজের ক্লান্তি না মুছেই বাড়ি ফিরে তার জন্য লিখতে বসে যাই । ভাবনাগুলোকে সাজাই ।চাপ না দিলে তাগাদা না দিলে আমার লেখা হয়না । নিজের ভেতর থেকে খুব অল্পই লিখি । তবে চেষ্টা করি যারা লেখা চায় তাদের লেখা দেওয়ার । ক্লান্তি অনুভব করিনা কখনও ।লেখার মধ্যেই আমি সজীব হয়ে উঠি প্রতিদিন ।
আগের আথে এই প্রশ্নটাও যুক্ত ভাবতে পারেন । উপন্যাস লেখার জন্য শুনেছি অসম্ভব স্ট্যামিনা থাকা দরকার । আর টেনাসিটি । অনেকেই ভাবেন , সাহস পান না লিখতে । কীভাবে সাহস পেলেন এতে হাত দিতে ?
উপন্যাস আমি কোনদিনই লিখতাম না । সে সাহস আমার ছিলনা। শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক সমীর রক্ষিত আমাকে উৎসাহিত করেছেন । তাঁর সাহস এবং উদ্দীপনা ছাড়া এই কাজ সম্ভব হত না । আমার গল্পের বইটি তাঁকে পাঠিয়েছিলাম ( তোমাকেও পাঠাবো ) তিনি পড়ে একদিন ফোন করলেন – বেশ ভালোই তো গল্প লেখো। ভাষার ব্যবহারও চমৎকার । শুধু গল্প লেখার জন্য গল্প লেখা নয়, একটা নতুন কিছু করে দেখানোর প্রবণতা আছে তোমার মধ্যে। প্রতিটি গল্পে সুন্দর একটা মেসেজ আছে , যা মানুষের লড়াইয়ের সপক্ষে কথা বলে । আমার বিশ্বাস তুমি উপন্যাস খুব ভালো লিখবে। বললাম – কখনও লিখিনি, এমন কি চেষ্টাও করিনি । তিনি বললেন – প্রত্যেক কথাশিল্পীরই স্বপ্ন থাকে উপন্যাস লেখার। তোমার নেই ? বললাম – সাধ আছে, সাধ্য নেই । তিনি বললেন – পারবে , তোমাকে একটি গুরুদায়িত্ব দিচ্ছি । তিন মাসের মধ্যে ২২০০০ শব্দের মধ্যে উপন্যাস লেখো। এই কথাগুলো মনে সাহস সঞ্চার করল। ভরসা পেলাম । মনে হল দেখাই যাক না , একটা পরীক্ষা তো , তার বেশি তো আর কিছু না । দেড় মাসের মধ্যেই লিখে ফেললাম – আক্রান্ত বৃষ্টিদিন ।
এখনও অবধি কটা উপন্যাস আছে আপনার ? সেগুলির নাম কি ? কোথায় কবে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ? আমাদের পাঠকদের জন্য যদি একটু বলেন –
প্রকাশিত উপন্যাস মাত্র একটিই - আক্রান্ত বৃষ্টিদিন। এবছর শারদীয়া নন্দনে প্রকাশিত হয়েছে । আক্রান্ত বৃষ্টিদিন এই অস্থির সময়ের গল্প। পরিবর্তিত পশ্চিমবঙ্গের যে নৈরাজ্য এবং বিপন্নতার মধ্যে আমাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকা । শিকড়ে জলের শব্দ নেই , এক দীর্ঘ দহনপথ । আমি এই সময়ের ছবিটাই তুলে ধরতে চেয়েছি এখানে । আরও একটি ছোট উপন্যাস দমকা হাওয়ার বইমেলা সংখ্যায় প্রকাশিত হবে । মর্নিং ওয়াক। এর কৃতিত্ব পুরোটাই সম্পাদক পূজা মৈত্রের। ক্রমাগত তাগাদা না দিলে বোধ হয় তাও লেখা হত না । এটা অন্যধরনের উপন্যাস। হাসি এবং সিরিয়াসনেসের মেলবন্ধন। আরও দুটো উপন্যাস মাথার ভেতর আছে একটা কাশীপুর রাজবাড়ি নিয়ে কিছুটা ইতিহাস , জনশ্রুতি এবং কল্পনা মিশিয়ে দীর্ঘ উপন্যাসের পটভূমি। আর আমাদের জেলার গর্ব ছো শিল্পী পদ্মশ্রী গম্ভীর সিং মুড়াকে নিয়ে একটি উপন্যাস আমাকে লিখতেই হবে । দুটো লেখারই আউটলাইন করা আছে । কিছু তথ্য হাতে এসেছে কিছু সংগ্রহ করতে হবে । এই দুটো কাজ আমার কাছে খুব চ্যালেঞ্জের ।
একশ ভাগ পরিবারতন্ত্র । এবং আমি এই পরিবারতন্ত্রের তীব্র বিরোধী । কিন্তু মুশকিল কি জানো একটি অবাণিজ্যিক ছোট কাগজের দায়িত্ব নিতে কেউ এগিয়ে আসবে না। জানি কত প্রতিকূলতার মধ্যে পত্রিকাটি চালাতে হয় । বিজ্ঞাপনের কথা বাদই দিলাম। ভালো প্রেস নেই আমাদের মফঃস্বলে , যদিও বা মাঝারি মানের দু একটি প্রেস আছে , তারা প্রতিশ্রুতি পালন করেনা । অক্টোবরে কেতকীর উৎসব সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল । ডিসেম্বর হয়ে গেল। দু একদিনের মধ্যে হয়তো পাব । খুব মুশকিলে পড়ে যাই সবাই বারবার জানতে চায় পত্রিকা প্রকাশের খবর। মনের মতো লেখাও পাইনা আপোষ করে চলতে হয়। তবু পত্রিকাটি বাঁচিয়ে রাখতে চাই এই কারনেই , যে পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আজ থেকে ৪৭ বছর আগে আমার বাবা এই পত্রিকাটির শুভ সূচনা করেছিলেন অনেক আত্মত্যাগের ইতিহাস , আপোষহীন লড়াই , অনেক স্মৃতিচিহ্ন রয়ে গেছে এই কাগজটিকে ঘিরে । প্রেমেন্দ্র মিত্র , অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত , বুদ্ধদেব বসু থেকে আরম্ভ করে প্রতিটি শক্তিমান তরুণ কবি কেতকীতে লিখেছেন। এই আবেগ আমার মধ্যে কাজ করে। তবে তুমি যদি পত্রিকার দায়িত্ব নিতে রাজী থাকো তো বলো আজই দিয়ে দিচ্ছি । ( মৃদু হেসে ) এতে আমারই সুবিধে , অনেক সময় বাঁচবে । যা লেখার প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবো ।
কেতকীর দায়িত্ব তো আছেই । একসময় মাসিক কবিতাপত্র এর সম্পাদকমণ্ডলীতে ছিলাম । এখন কবিতাডিহির সাথে যুক্ত আছি । কবিতাডিহি তো শুধুমাত্র একটি পত্রিকা নয় , কবিতার পরীক্ষাগার বলা যেতে পারে ।
আপনাকে আমরা প্রাবন্ধিক হিসেবেও পাই। শূন্য দশকের ওপর আপনার মূল্যবান কাজ আছে । নাম কি সেই প্রবন্ধের ? কোথায় প্রকাশিত হয়েছে ? আপনার কোন প্রবন্ধ সংকলন আছে ?
শূন্য দশকের কবিদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে অবশ্যই আছে । তুমি যে প্রবন্ধটির কথা বলছ তা হল “ নারীর কবিতা দ্রোহের কবিতা এই সময় “ এখানে নব্বই , শূন্য এবং শূন্য পরবর্তী কবিদের নিয়ে আলোচনা করেছি । তোমার কাব্যভাবনা এবং কবিতারও উল্লেখ আছে। আমি সেখানে তোমার প্রসঙ্গে বলেছি - শর্মিষ্ঠার প্রতিবাদী কণ্ঠটি ভীষণ অন্যরকম। তাঁর কিছু কবিতা যেমন ন্যারেটিভ দৃশ্যমান জগতের ফ্রেমে আটকে থাকে। পাশাপাশি বিমুর্ত জগতের বিপন্ন ধ্বনিও তুলে আনেন নিজস্ব স্বরের অভিক্ষেপনে । কোন ভনিতা ছাড়াই নির্মিতির আড়াল ছাড়াই তিনি সরাসরি বলতে পারেন - পাপকথা সাফ সাফ শোন / পাদ্রীর ভূমিকা মহান / তুমি আমি মন টন খুঁড়ে / চোখে চোখে ক্রমশ তাকাই (তারপর ) । এই প্রবন্ধটি সুদীপ বিশ্বাস সম্পাদিত কবিতা এইসময় পত্রিকায় শীঘ্রই প্রকাশ পাবে । বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হলেও এখনও অবধি প্রবন্ধের কোন সংকলন প্রকাশিত হয়নি । আগামীতে তা অবশ্যই হবে । অন্তত স্বপ্নটা সেরকম ই আছে ।
গ্রন্থ সমালোচকের ভূমিকাতেও পাই আপনাকে। কি কি বিশেষ লক্ষন দেখে ভালো মন্দ নির্ধারন করেন ? ভয় লাগে না , বিরূপ সমালোচনা করলে লেখক ক্ষেপে যেতে পারেন ?
যেহেতু পত্রিকা সম্পাদনা করি অনেকে তাঁদের কাব্যগ্রন্থ বা গল্পের বই পাঠান । একজন কবি বা লেখকের কত বিনিদ্র রাতের সাক্ষী এই বইগুলি , আমি তা জানি । ফলে তাঁদের এই মূল্যবান সম্পদগুলি যত্ন নিয়ে পড়ি । মনে হয় কিছু লেখাও দরকার । লিখি । একে গ্রন্থসমালচনা বললে বলতে পারো। আমি পাঠ প্রতিক্রিয়া বলি । সত্যি বলতে কি আমি সমালোচক নই , একজন নিবিড় পাঠক হয়ে ওঠার চেষ্টা করি । ফলে কোন জায়গা আমার ভালো না লাগলে বন্ধুর মত বলি এই ভাবনটা এরকম হলে কেমন হতো। প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে কবি লেখকেরা তাদের নিজেদের শব্দদুনিয়া তৈরি করে। আমি তাঁদের সেই সঞ্চয়ের ভাণ্ডার দেখি , মুগ্ধ হই । নিজস্ব বোধের তরঙ্গে নতুন আলোর বিভাব অনুভব করি ।
গল্প আর অণুগল্পের মধ্যে কীভাবে সীমারেখা টানেন ? এটা কি কেবল দৈর্ঘ্য ভিত্তিক ফারাক নাকি আরও বেশি কিছু ?
অণুগল্প অবশ্যই স্বল্প পরিসরের গল্প। কিন্তু শুধুমাত্র পরিধি আর বিস্তার দিয়েই একটি সার্থক অণুগল্পকে বিচার করা যাবেনা । maximum effect with minimum words - এটাই অনুগল্প নির্মানের ভিত্তি । এখানে চরিত্র চিত্রণের কোন জায়গা নেই , ঘটনার বিবরণও অপ্রাসঙ্গিক । অণুগল্প আসলে সেই চ্যালেঞ্জ যেখানে প্রয়োজনীয় এবং জরুরী শব্দ দিয়ে তৈরি করতে হবে একটি বিদ্যুৎ চমক যা পাঠকের মনে দীর্ঘস্থায়ী অভিঘাত তৈরি করবে ।
সম্পাদক হিসেবে কীভাবে খুঁজে আনেন নতুন প্রতিভা ? কীভাবে এনকারেজ করেন নতুনদের ? না কি কঠোর ভাবে বিচার করেন , বলেন কিস্যু হয়নি ?
এখন তো সম্পাদকের কাজ অনেক সহজ হয়ে গেছে। ফেসবুকের দৌলতে নতুন নতুন কবিদের খুঁজে পাচ্ছি প্রতিদিন । তাদের লেখা পড়তে পাচ্ছি। কখনও কখনও চমকে উঠছি তাদের শব্দচ্ছটায়। ভাবনার মৌলিকতায় । একটি ছোট কাগজের শক্তি নবীন প্রতিশ্রুতিবান তরুণকবিরা । এরা যত বেশি সংখ্যায় একটি পত্রিকার পাতা আলোকিত করবে ততই উজ্জ্বল হয়ে উঠবে আগামী । কঠোরতার কোন জায়গা নেই নতুনদের জন্য । এদের সাহস এবং প্রশ্রয় দিতে হবে । সবাইকে নয় , যাদের মধ্যে সম্ভাবনা আছে । সঠিক প্রতিভা খুঁজে বের করাই একজন সম্পাদকের কাজ । বিখ্যাতদের লেখা ছাপিয়ে বাহবা নেওয়ার মধ্যে কোন বাহাদুরী নেই ।
আপনি তো ছোটদের জন্যও লেখেন। প্রকাশ হতে চলেছে ওদের জন্য ছড়ার বই । হঠাৎ এভাবে ভাবলেন কেন ? আমরা তো ছড়াকারদের আলাদা সারিতে রাখি । সাহিত্যের গুরুগম্ভীর শ্রেণীতে ফেলিনা । সুকুমার রায় আলাদা ব্যাপার। কিন্তু কজনকে নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা হয় ?
আমি লেখালেখির জগতে এসেছিলাম ছোটদের জন্য লিখতে লিখতেই । ক্লাস এইট হবে দৈনিক বসুমতির ছোটদের পাতায় একটি ছড়া প্রকাশিত হয়েছিল আমার একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে। তারপর সত্যযুগে ছোটদের পাতায় একটা মজার ছড়া ( শ্রদ্ধেয় শিশু সাহিত্যিক হরেন ঘটক তখন ওই বিভাগটি পরিচালনা করতেন ) পরের বছর সুসাথী, টুকলু, ছোটদের কথা , মুনিয়া , টাপুর টুপুর , ছড়াছন্দ এরকম আরও কয়েকটি কিশোর কাগজে আমার লেখা বেরুলো । সুতরাং ছোটদের জন্য একটি ছড়ার বইএর ভাবনা এটা আকস্মিক নয় । আমি নিয়ম করে প্রতিবছরই বাচ্চাদের জন্য কিছু না কিছু লিখি । শিশুরা আমার প্রিয় বন্ধু । তাদের সাথে গল্প করতে, ছড়া শোনাতে আমার খুব ভালো লাগে । তারা খুশি হয় , মনের দরজা জানলাগুলো খুলে দেয় আমার সামনে । আমার লেখা নিয়ে সিরিয়াস চর্চা হোক বা না হোক আমার কিছু এসে যায়না । কিশোরদের জন্য একটি উপন্যাস লেখার ইচ্ছেও আছে । কবে পারব তা জানিনা । আমি ছোটদের কথাগুলো বলতে পেরে আনন্দ পাই , তারা আমাকে অমল শৈশব ফিরিয়ে দেয় । তুমিই বলো শর্মিষ্ঠা , এই আনন্দের জন্যও কি আমি লিখবো না ? প্রতিটি পরিনত মানুষের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকে শৈশবের সোনালি রোদ্দুর , মানুষ নস্টালজিয়ার কচুরিপানা সরিয়ে সেই আলোটা দেখতে চায় । তুমি যে কথাগুলো বলেছ একদম সত্যি । শিশু সাহিত্যিকদের সেভাবে মূল্যায়ন হয়না । অথচ শিশুদের মনের মত লেখা , শিশু মনস্তত্ব জানা এসব কিন্তু খুব সহজ ব্যাপার নয় ।
এই মুহুর্তে কী নিয়ে লিখছেন ? সারাক্ষণই তো ভীষণ ব্যস্ততায় কাটে আপনার । নানা ধরণের লেখা নিয়ে । অসুবিধে হয়না একটা ধরণ থেকে অন্যটায় শিফট করতে ? মনে হয়না , একটার উপরই বেশি জোর দিলে আরও ভালো হতে পারে ?
এই মুহূর্তে তিন চারটি লেখা লিখছি । সবগুলোই কিন্তু গদ্য । বাঁকুড়া জেলার এই সময়ের গল্প , তার গতি প্রকৃতি অভিমুখ নিয়ে একটি কাজ করছি । লেখা এবং তথ্য সংগ্রহ পাশাপাশি চলছে । ডিসেম্বরের মধ্যেই লেখাটি জমা দিতে হবে । ছো শিল্পী পদ্মশ্রী গম্ভীর সিং মুড়াকে নিয়ে একটি গদ্য লিখছি । মুলত তাঁর লড়াই এবং উত্তরণের জায়গাটাই ধরতে চাইছি । এই লেখাটি প্রায় কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে । শেষ করতে হবে । শ্রদ্ধেয় কবি অবনী নাগকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখতে হবে একালের বোধিস্বত্ত্ব পত্রিকার জন্য। আর আছে একটি ব্যক্তিগত গদ্য। এছাড়া দুতিনটি গল্প আছে। লেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে আমার বেশ ভালো লাগে । গল্প থেকে কবিতা , কবিতা থেকে গদ্য এই চেঞ্জওভার এটা তো শুধুমাত্র ক্যানভাসের বদল । মূল বিষয় হল ভাবনা , যা আমাকে তাড়িত করছে । তাকে কোন রঙে বর্ণময়তা দেব । কীভাবে লিখলে তা নীরক্ত অনুভূতি হয়ে উঠবে না । এই অনুসন্ধানের আলো থেকেই শস্যের যন্ত্রনা খুঁজি নানা ভাবে, নানা প্রকরণে । আমার কিছু হয়ে ওঠার নেই ছায়াপুঞ্জের ভেতর নিজেকেই খুঁজে দেখা বিভিন্ন আঙ্গিকে ।
কাজের স্বীকৃতি পেলে সবাই খুশি হয় । সেটা অবশ্য একেকজনের এক একরকম ভাগ্য । আপনি কি কি স্বীকৃতি পেয়েছেন ? কথিত আছে কবি মানেই ব্যর্থ কবি , কিন্তু আপনি তো সব্যসাচী শুধু কবি নন ...
পুরস্কার নিয়ে আমি বিশেষ ভাবিনা। তবে কেউ লেখা পড়ে প্রতিক্রিয়া জানালে বেশ ভালো লাগে । উপন্যাসটি পড়ে এত মানুষ তাদের অনুভূতির কথা জানিয়েছেন আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি, সাহস পেয়েছি । এর মূল্য আমার কাছে পুরস্কারের চেয়ে কোন অংশে কম নয় । বরং বেশি । বিভিন্ন ছোট কাগজ যারা আমাকে ভালবেসে পুরস্কৃত করেছেন তাদের কথা আলাদা ভাবে বলতেই হয় – শ্রেষ্ঠ ছড়া ( পরিমল মিত্র স্মৃতি পুরস্কার , ছোটদের কথা , ১৯৮৭ ) / অণুপত্রী সাহিত্য পুরস্কার ( শ্রেষ্ঠ অণুগল্প , ২০১২ ) / পূর্বাশা এখন আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কার ( শ্রেষ্ঠ অণুকবিতা , ২০১৪ ) / কফিহাউস পুরষ্কার ( শ্রেষ্ঠ অণুকবিতার কারিগর , ২০১৫) / এছাড়া দাগ (পুরুলিয়া) , প্রবাহ এবং আরও দু একটি পত্রিকার সম্বর্ধনা । এই যে তোমার সাথে পরিচয় হয়েছে , প্রতিদিন কত মানুষের সাথে পরিচয় হচ্ছে , প্রসারিত হচ্ছে সংযোগের সাঁকো । সঙ্কীর্ন অণু মানচিত্রের সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়ার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি । ভাবনার বিনিময় ঘটছে । অন্ধতা এবং নিঃসাড়তা অতিক্রম করে দরজা খুলে দিচ্ছে এক সংবেদনশীল পৃথিবীর পরিসর । এটাই প্রাপ্তি । ব্যর্থতা বলে কিছু নেই , সাফল্য বলেও কিছু হয়না একজন কবির কাছে একজন শব্দশিল্পীর কাছে । এক রজতাভ শূন্যতার ভেতর তাঁর অনন্ত জিজ্ঞাসা কখনও ফুরোয় না ।
ধরুন যদি লেখালেখি থেকে আপনাকে নির্বাসন দেওয়া হয় কখনও কি করবেন বিকল্প হিসেবে যা আপনাকে আনন্দ বা তৃপ্তি দেবে ?
আমি বারো বছর নির্বাসনে ছিলাম । ১৯৯৮- ২০১০। এখন যা লিখছি তা আমার দ্বিতীয় পর্বের লেখালেখি । আবার যদি নির্বাসন দিতে চাও, দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াব না । বিষ পান করে মরেও যাব না । বই পড়তে পড়তে বাকি জীবন কাটিয়ে দেব ।
আজকাল দেখি কোন একটা সাহিত্য পত্রিকাকে ঘিরে রাজনৈতিক গ্রুপবাজি ও দাদাগিরির একটা বাতাবরণ । আপনি কিছু বলবেন এ বিষয়ে ?
নিশ্চয়ই বলব। দেখো আমরা যারা কমবেশি লিখি। তারা এক দুঃখ বোধ এবং মানবিকবোধের জায়গা থেকে লিখি । আমাদের শব্দগত ভিন্নতা , অন্বয়গত তফাত , প্রতীক এবং প্রতিমানির্মানের পার্থক্য থাকবেই। কিন্তু ভালোবাসার জায়গায় আমরা একটি একান্নবর্তী পরিবারের সদস্য। প্রচল প্রথার প্রতি কারও আনুগত্য থাকতেই পারে কেউ বা বিরোধিতা চালিয়ে যেতে পারেন নিরন্তর। কিন্তু শান্ত উদাসীন অমোঘ নীলিমার ভেতর দাঁড়িয়ে আমাদের মনে রাখতে হবে যে ,একজন মাইকেল , রবীন্দ্রনাথ , জীবনানন্দ বা বিনয় মজুমদারের কাব্যভাষা অসংখ্য কবির তৈরি করা ভাষাচেতনার ভেতর থেকেই জন্ম নেয় । আমরা এই মিসিংলিঙ্কটা মনে রাখিনা । বা সচেতনভাবে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি। দল এবং শিবিরবিভক্ত না হয়ে পারস্পরিক ভাবনা সমন্বয়ের মধ্যে কাজ করলে শিল্পদুনিয়া আরও প্রসারিত হয়ে ওঠে । তুমি সত্যিই ভালো লেখো , কিন্তু মন খুলে ভালো বলতেও অনেকের সংকোচ । কেন ? কারন গ্রুপ তাকে অন্ধ করে দিচ্ছে । তুমি আমাদের দলের বাইরে কাউকে স্বীকার করো না ।বল – ওটা কোন কবিতাই না, আসল কবিতা হবে এরকম । এটা একরকম মাতব্বরি । সাহিত্যের দুনিয়ায় এই স্বৈরতান্ত্রিকতা অত্যন্ত ক্ষতিকর । এইসব মাফিয়ারা দখল করতে চাইছে সাহিত্যের মৌরসিপাট্টা ।এই বিপজ্জনক প্রবণতা ক্ষতি করছে সুস্থ শিল্পের ।
অনেক কথাই বললাম অকপটে । এবার থামা উচিত । তোমাকে বাহবা জানাবো । বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন চয়ন এবং তথ্য সংগ্রহের জন্য । কারন ১৬ টি প্রশ্নই আমি বারবার পড়েছি । অনেকেই প্রশ্ন করেন সেসব প্রশ্ন আমার বদলে অন্য কাওকেও করা যায় । কিন্তু এখানে অন্তত দশটি প্রশ্ন শুধুমাত্র আমার জন্যই । খুব ভাল থেকো । শব্দের মিছিল এবং আত্মার সান্নিধ্য পরিবারের সকলকে আমার শুভেচ্ছা ।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে । আশাকরি আপনাকে সাথে পাবো ভবিষ্যতেও । আপনার প্রতিভা আরো কস্তুরি ছড়াক , আমোদিত করুক বাংলার সাহিত্য জগত । আমাদের অপার ভালোবাসা আর শুভেচ্ছা রইলো আপনার সাথে ।
|
|
1 মন্তব্যসমূহ
আমার খুব ভালো লাগলো। বলা যেতে পারে, কাজেও লাগলো। অনুভব করার ব্যাপারটিকে যদিও শুধুই কাজ বলতে চাই না, তবু..।
উত্তরমুছুনসুচিন্তিত মতামত দিন