ঋষি











সকাল থেকে সন্ধ্যা যে অপেক্ষার অভ্যাস গা সওয়া সোহমের ,যে অপেক্ষায় আজ কেটে গেছে আট বছর ,তার পরিবর্তন কিছু হয় নি। আজ বিয়াল্লিশে দাঁড়িয়ে সোহম দাঁড়িয়ে থাকে তৃষ্ণার অপেক্ষায় বারান্দার দরজার দিকে তাকিয়ে । দমদমের এই বাড়িটা সোহমের পিতৃদত্ত। ভাই বোন বলে কেউ নেই। গত বছর মা মারা গেলেন সুতরাং মাথার উপর কোনো ভার নেই। সরকারী চাকরি রোজকার যা করেন তাতে বেশ আরাম সে চলে যায়। এখন ব্যাচলর সোহম ,বিয়ে হয় নি বলা ঠিক নয় তবে বিয়ের মত কিছু একটা ছিল তৃষ্ণার সাথে যৌবনের বেশ কিছু বছর। 

রোজকার পরিবর্তনের সাথে তাল রেখে আজ সোহম অনেকটা পিছিয়ে পড়েছেন। প্রায় শোনেন পার্টির রোজকার আলাপচারিতা ,খবরের কাগজে প্রকাশ্যে নগ্নতা ,টিভি তো রয়েছেই ,সোহমের এই সব ভালো লাগে না। তাই খবর কাগজ আর টিভি নিউজ কে একটু এড়িয়ে চলেন। বিরক্ত লাগে সোহমের মানুষের মুখোশে লুকোনো মুখগুলোকে। আজ  রোববার ,শনি ,রবি সোহমের ছুটি থাকে। তাই একটু গা ছাড়া ভাব সকাল থেকে। করার কিছু নেই বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে সোহম ডাক দিল কানু এক কাপ চা দিবি। কানু ছেলেটা ছোকরা ,বছর তেইশের হবে। মা মারা যাবার সময় কানুকে সোহমকে দেখার ভার দিয়েছিলেন।যেদিন মা মারা যায় ,সেদিন বুধবার ছিল। অফিসে একটা ফোন এসেছিল ,সোহম বাড়ি ফিরতে ফিরতে সব শেষ। কাঁদতে পারে নি সেদিন সোহম হয়তোবা কিছুতেই মানতে পারছিল না। সেদিন সোহম তৃষ্ণাকে ফোন করে  খবরটা দেই সেদিন তৃষ্ণা ফোনে কেঁদেছিল খুব কিন্তু  আসেনি হয়তো আসা সম্ভব ছিল না ফিরে । 

কানু চা দিয়ে গেল ,সোহম কানুকে কিছু টাকা দিয়ে বাজারে পাঠালো। কানু ছোকরাটা রান্না বান্না ভালই করে। মা যোগার করেছিলের কোথা থেকে।মা বলেছিলেন বিয়ে তো তুই করলি না ,আমার বয়স হচ্ছে আর পারি না ,এই ছেলেটা রাখলাম ,ও আমাকে সাহায্য করবে। মা  ,বাবা মরা ছেলে কানু তবে থেকে রয়ে গেছে এই বাড়িতে। 

সেই কলেজজীবনে প্রথম দেখেছিল তৃষ্ণাকে । হাসিখুসি ,চঞ্চল প্রকৃতির প্রজাপতি।সোহমের তখন ফাইনাল ইয়ার,কলেজের কালচারাল সেক্রেটারি ছিল সে।তৃষ্ণা সদ্য তখন কলেজে এসেছে বাংলা বিভাগে।   সেই বছর কলেজ পত্রিকায় একটা গল্প দিয়েছিল তৃষ্ণা। কত  পরিনত লেখা ,মুক্ত চিনতে সেদিন ভুল হয় নি সোহমের।সোহমের লেখালিখির অভ্যাস ছিল ছোটবেলা থেকে। এদিক ওদিক পত্রিকায় বেশ কিছু লেখা ছাপা হতো নিয়মিত কিন্তু তৃষ্ণার লেখার ধরন যে একদিন বেশ পরিচিত হয়ে উঠবে তা সোহম টের পেয়েছিল তখনি। তারপর স্বরস্বতী পুজোর সেই বিকেলটা যেদিন তৃষ্ণা বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়ে কলেজে এলো,সোহম আর পারে নি ,প্রপোস করলো। দু সপ্তাহ টালবাহানার পরে প্রপোস এক্সসেপ্টেড হলো। এদিকওদিক ঘোরাঘুরি,ধর্মতলা ,ফুটপাথ কত সময় একসাথে। গঙ্গার ধারে প্রথম চুমুটা সোহমে আজও মনে আছে। সেদিন কলেজ কেটে বেড়িয়ে এসেছিল ওরা। তৃষ্ণা বললো আজ গঙ্গায় যাব চল। গঙ্গার ধারে এসে সহমকে জোর করে নৌকায় তোলে তৃষ্ণা। টিপটুপ বৃষ্টি পরছিল ,নৌকার ছাইয়ের তলায় ওরা বসে। তৃষ্ণা বললো সোহম আজকের মুহূর্তটাকে কি করে ধরে রাখা যায়। সোহমের হাতে সিগারেট বাড়িয়ে দিল সোহম,নিও সিগারেট খাও ,আজ প্রথম হবে তোমার ,স্মরনীয় থাকবে। তৃষ্ণা কিছু উত্তর না দিয়ে সোহমের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এমন চুমু সোহমের কাছে নতুন ছিল ,এক নতুন আমন্ত্রণ আশার আলো সোহমের চোখে। সেই দিনটা আজও মনে পড়লে বুকটা মুচড়ে ওঠে। 

সেই বছর সোহম বেড়িয়ে এলো কলেজ থেকে। মধ্যবিত্ত পরিবারের অন্যান্য একমাত্র সন্তানের মত সরকারী চাকুরীর পরীক্ষায় বসতে লাগলো নিয়মিত। আর নিয়মিত দেখা করতো তৃষ্ণার সাথে। চাকুরীর পড়াশুনা ,হাতখরচার টিউশুনির মাঝে একমাত্র নিঃশ্বাস ছিল তৃষ্ণার সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো।সারাদিন সোহম তাকিয়ে থাকতো অপেক্ষায় কখন দেখা হবে তৃষ্ণার সাথে। যে বছর তৃষ্ণা কলেজ শেষ করে বেড়োলো ,সে বছর চাকরি পেল সোহম। আর তৃষ্ণা জার্নালিসমের স্পেসাল কোর্সে ভর্তি হলো। দুবছর কোর্সের শেষে চাকরি পালো তৃষ্ণা একটা দেশের নামকরা পত্রিকায়। সেই দিনগুলোতে সোহমের মনে হত বোধহয় ভাগ্যদেবী বেশ সন্তুষ্ট তার উপর। হিসেব মাফিক জীবন চলছিল সোহমের । এতদিনে লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছে সোহম কিন্তু তৃষ্ণা লেখালিখি শুরু করেছে। নিয়মিত পত্রিকার কলামে তৃষ্ণার  রিপোর্টিং নিউসগুলো পড়ে ,গর্বে বুক ফুলে যেত সোহমের।তখনি বাড়িতে কেউ জানে না তাদের এই প্রেমকাহিনী। কিছুটা আন্দাজ করতো সোহমের মা। দু বছর চাকরি করার পর বেশ কিছু টাকা জমিয়ে ফেলেছিল 

সোহম তৃষ্ণা আর তার আগামী জীবনের জন্য। তৃষ্ণা আর মধ্যে বেশ কিছু গল্প লিখে নাম করে ফেলেছে লেখিকা হিসেবে। তৃষ্ণার প্রথম উপন্যাস "তৃষ্ণা" লিখে তৃষ্ণা যখন উপন্যাসের পান্ডুলিপি সহোমকে পড়তে দিল তখন তৃষ্ণা বলেছিল পড়ে দেখো এই লেখা ফাটিয়ে চলবে। এটা তৃষ্ণার অভ্যাস ছিল প্রথম কিছু লিখেই সোহমকে পড়তে দিত ,সেই তার রিপোর্টিং নিউস হোক কিংবা গল্প। সেদিন সারারাত জেগে উপন্যাসটা শেষ করেছিল সোহম,বুঝেছিল তার প্রেমিকা সাধারণ নয়। " তৃষ্ণা " উপন্যাসটা লেখার জন্য তৃষ্ণা বেশ কিছু পুরস্কার পেল। ওর অফিস থেকে একটা অফার দিল আরো পড়াশুনার জন্য তাকে বিদেশে যাওয়ার। তৃষ্ণা প্রথমে রাজি হয় নি কিন্তু সোহম বুঝিয়ে রাজি করেছিল। এতদিনে দুই বাড়িতে জেনে গেছে ওদের সম্পর্কের কথা ,কোনো সমস্যা নেই। ওরা ঠিক করলো দু বছর পড়াশুনা শেষ করে তৃষ্ণা ফিরলেই ওদের বিয়ে হবে। তৃষ্ণা চলে গেল দুবছরের জন্য। 

সোহমের দিন আর কাটে না। ফোন কথা হয় কিন্তু কলরেট এত বেশি সোহমের পকেট পারমিট করে না। সময় চলতে থাকে নদীর মত ,আকাশের রং বদলায় নিজের স্বভাবে তেমনি মানুষ বেঁচে থাকতে পারে বাঁচার তাগিদে মৃত্যুর মাঝে। সেই দিনগুলো সোহমের কাছে মৃত্যুসম ছিল। একবার মাঝখানে ফিরেছিল দেশে তৃষ্ণা দিন দশেকের জন্য কিন্তু তাতে বোধহয় সোহমের কষ্ট আরো বাড়িয়ে গিয়েছিল । পাগলের মত সোহম প্রতিদিন খুঁজতো তৃষ্ণার লেখা ,খবরের কাগজে, গোগ্রাসে গিলতো তার তৃষ্ণার লেখাগুলো।অফিস আর বাড়ির মাঝে সোহমকে পাওয়া যেত সর্বদা কোনো নির্জন জায়গায়। সোহম অপেক্ষায় ছিল তৃষ্ণার ,জীবনের ভালো থাকার। 

এরপর সেই অভিশপ্ত দিনটা এলো অফিস শেষে পাড়ার ফোনের দোকান থেকে তৃষ্ণাকে ফোন করলো সোহম। হ্যালো হ্যালো শুনতে পাচ্ছো। ওপাশে বহুদিনকার চেনা গলা হ্যা বলো কেমন আছ তুমি। স্বাবাভিক শুভেচ্ছা বার্তার পর তৃষ্ণার গলাটা হঠাত  বড় অচেনা লাগলো সোহমের।ফোনটা রেখে দিল সোহম, নিজেকে ভীষণ শীতল লাগছিল সোহমের।সময়টা যেন থেমে গেছিল সোহমের।রাস্তার গাড়িঘোড়া ,মানুষ জনের কোনো শব্দ কানে ঢুকছিল না , একি বললো তৃষ্ণা তুমি এতো সিরিয়াস হচ্ছো কেন। আমরা তো ভালো বন্ধু আছি ,আমরা তো পাশাপাশি আছি ,কিসের অভাব। ঠিক ঠিক কিসের অভাব ,তৃষ্ণা আর দেশে ফেরে নি। মাঝে মাঝে আসে ঠিক ,দেখা করে প্রতিবারে সোহমে সাথে। এখন ওর ভীষণ নাম,দেশের অন্যতম নামকরা লেখিকা ,বেশ কিছু সাহিত্য পুরষ্কার ওর ঝুলিতে।  আগের মত চঞ্চল প্রজাপতির আছে তৃষ্ণা ,বয়স ওকে ছুঁতে পারে নি  যখনি আসে ছুঁয়ে যায় সোহমকে। কিছুদিন আগে তৃষ্ণা সোহমকে প্রশ্ন করেছিল কিগো বিয়ে করবে না চুল তো পেকে গেল। সোহম উত্তর দিয়েছিল সময় আসে নি আমার বিয়ের আমি অপেক্ষায় আছি। উত্তরে তৃষ্ণা মুচকে হেসে ছিল শুধু।


ঋষি ঋষি Reviewed by Pd on মে ০৯, ২০১৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.