শ্রীশুভ্র

“যদি মানুষের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা থাকে তবে লোকের ঘরে আগুন লাগানো এবং মারধর করিয়া গুণ্ডামি করিতে আমাদের কদাচই প্রবৃত্তি হইবে না: তবে আমরা পরম ধৈর্যের সহিত মানুষের বুদ্ধিকে হৃদয়কে, মানুষের ইচ্ছেকে, মঙ্গলের দিকে, ধর্মের দিকে আকর্ষণ করিতে প্রাণপাত করিতে পারিব। তখন আমরা মানুষকেই চাহিব, মানুষ কী কাপড় পরিবে বা কী নুন খাইবে তাহাই সকলের চেয়ে বড়ো করিয়া চাহিব না। মানুষকে চাহিলে মানুষের সেবা করিতে হয়, পরস্পরের ব্যবধান দূর করিতে হয়’ নিজেকে নম্র করিতে হয়। মানুষকে যদি চাই তবে যথার্থভাবে মানুষের সাধনা করিতে হইবে; তাহাকে কোনমতে আমার মতে ভিড়াইবার, আমার দলে টানিবার জন্য টানাটানি মারামারি না করিয়া আমাকে তাহার কাছে আত্মসমর্পণ করিতে হইবে” [-সদুপায়]

বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ! আজ থেকে ঠিক একশ সাত বছর আগে। তারপর একটা গোটা শতাব্দী ইতিহাসের পাতায় স্থান পেলেও তাঁর স্বদেশের অবস্থা সেই তিমিরেই পড়ে রয়েছে। আজকের আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক পটভূমিতে দাঁড়িয়েও তাঁর কথাগুলি কতই না প্রাসঙ্গিক! ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যে তাঁর এই কথায় আদৌ কর্ণপাত করে নি, সে কথা বলাই বাহুল্য। বিশেষত কাঁটাতার বিড়ম্বিত দুটুকরো হয়ে থাকা আমাদের এই দ্বিখণ্ডীত বাংলায়! 

আমরা ইংরেজদের শিখিয়ে দেওয়া গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে দিয়ে মানুষকে আর মানুষ হিসেবে গণ্য করি না। মানুষের একটাই পরিচয়, একটি মানুষ একটি ভোট! সেই ভোটের সংখ্যাগণনার আবর্ত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে সমাজ। এটাই আমাদের স্বদেশের মূল চিত্র। আর সেই চিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে বিশ্বকবির চোখের দিকে তাকালে সেই স্মিতহাসির স্থিতপ্রাজ্ঞ চোখের প্রতিভাসে নিজেকেই অপরাধী বলে মনে হয়। হয় না কি? কি করেছি আমরা, আমাদের স্বদেশ সমাজ স্বজনের জন্যে! কি করছি প্রতিদিনের আখের গোছানোর ব্যস্ততায়? এটাই কি কথা ছিল বন্ধু! অন্তত, আমাদের যাদের হতেখড়ি হয়েছিল বর্ণপরিচয় আর সহজপাঠে! কি করলাম আমরা স্বাধীনতাত্তোর বিগত সাত দশকে! 
না, এমন কিছুই করি নি যা বিশ্বকবির মর্য্যাদা রক্ষা করতে পারে, একমাত্র মাতৃভাষাকে কেন্দ্রকরে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দেওয়া ছাড়া। যদিও সে স্বাধীনতার চার দশক মূলত ক্ষমতা লুণ্ঠনের ইতিহাসের সাক্ষ্যই দেয়। জাতিকে সুস্থ সবল উন্নত ও আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে গড়ে তোলার কোনো প্রয়াসের সাক্ষ্য দেয় না! বস্তুত কাঁটাতারের দুই পারেই আমরা বাঙালিরা ক্রমশই বিশ্বকবির চেতনার বলয়ের থেকে ক্রমাগত দূরতর দিগন্তে সরিয়ে আনছি নিজেদের, প্রতিদিন একটু একটু করে। 

শৈশব থেকে মাতৃভাষায় শিক্ষার গুরুত্বের উপর সবিশেষ জোর দিয়ে কবি বলেছিলেন; “ আমাদের মন তেরো-চোদ্দো বছর বয়স হইতেই জ্ঞানের আলোক এবং ভাবের রস গ্রহণ করিবার জন্য ফুটিবার উপক্রম করিতে থাকে: সেই সময়েই অহরহ যদি তাহার উপর বিদেশী ভাষার ব্যকরণ এবং মুখস্থবিদ্যার শিলাবৃষ্টিবর্ষণ হইতে থাকে তবে তাহা পুষ্টিলাভ করিবে কি করিয়া?”  আর এরই বিষময় ফল কিভাবে কাজ করতে থাকে, সেই কথা বুঝাতে কবি আরও বলেছিলেন; “এইরূপ শিক্ষাপ্রণালীতে আমাদের মন যে অপরিণত থাকিয়া যায়, বুদ্ধি যে সম্পূর্ণ স্ফূর্তি পায় না, সে কথা আমাদিগকে স্বীকার করিতে হইবে। আমাদের পাণ্ডিত্য অল্প কিছুদূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়, আমাদের উদ্ভাবনাশক্তি শেষ পর্যন্ত পৌঁছে না, আমাদের ধরণাশক্তির বলিষ্ঠতা নাই। আমাদের ভাবনাচিন্তা আমাদের লেখাপড়ার মধ্যে সেই ছাত্র-অবস্থার ক্ষীণতাই বারবার থাকিয়া যায়; আমরা নকল করি, নজির খুঁজি, এবং স্বাধীন মত বলিয়া যাহা প্রচার করি তাহা হয় কোনো না কোনো মুখস্থ বিদ্যার প্রতিধ্বনি, নয় একটা ছেলেমানুষি ব্যাপার। হয় মানসিক ভীরুতাবশত আমরা পদচিহ্ন মিলাইয়া চলি, নয় অজ্ঞতার স্পর্ধাবশত বেড়া ডিঙাইয়া চলিতে থাকি”। [-শিক্ষা সংস্কার]

বিষয়টির গুরুত্ব কতটা সেটা কবির কথাতেই ধরা যায়, তিনি আরও বল্লেন; “আমরা যতই বি.এ. এম.এ. পাস করিতেছি, রাশি রাশি বই গিলিতেছি, বুদ্ধিবৃত্তিটা তেমন বলিষ্ঠ এবং পরিপক্ক হইতেছে না। তেমন মুঠো করিয়া কিছু ধরিতে পারিতেছি না’ তেমন আদ্যপান্ত কিছু গড়িতে পরিতেছি না, তেমন জোরের সহিত কিছু দাঁড় করাইতে পারিতেছি না। আমাদের মতামত কথাবার্ত্তা এবং আচার-অনুষ্ঠান ঠিক সাবালকের মতো নহে। সেইজন্যে আমরা অত্যুক্তি আড়ম্বর এবং আস্ফালনের দ্বারা আমাদের মানসিক দৈন্য ঢাকিবার চেষ্টা করি। ইহার প্রধান কারণ, বাল্যকাল হইতে আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই। কেবল যাহা-কিছু নিতান্ত আবশ্যক তাহাই কণ্ঠস্থ করতেছি। তেমন করিয়া কোনোমতে কাজ চলে মাত্র, কিন্তু বিকাশলাভ হয় না”। [-শিক্ষার হেরফের]

আর ঠিক সেই পরিপূর্ণ বিকাশলাভের জন্যেই মনুষত্বের পূর্ণ উদ্বোধনের জন্যেই বৃটিশ প্রবর্তীত শিক্ষা ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবেই বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা! যেখানে সারা বিশ্বের জ্ঞান এসে মিলবে। যেখানে শিশুরা যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা পাবে, মেকলে- প্রবর্তিত শাসনতন্ত্রের খাপের মাপ অনুযায়ী চাকুরীজীবি বনসাই তৈরী হবে না! কিন্তু দূর্ভাগ্য কবির, দূর্ভাগা আমরা, স্বাধীনতাত্তর বিগত সাত দশকে তাঁর সাধের বিশ্বভারতীই মুখস্থবিদ্যার ডিগ্রী বিতরণেরই আর একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।  অথচ সারা দেশে এই মেকলে প্রবর্ত্তিত শিক্ষা ব্যবস্থার অবসান ও কবির বিশ্বভারতীর অনুসরণেই স্বাধীন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার পরিকাঠামো গড়ে ওঠা উচিত ছিল! কি করতে চেয়েছিলেন কবি! আর কি ফল ফলল! আজ সারা বাংলায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলির ইট-কাঠ-পাথরে বন্দী শিশুদেরকে ইংরেজী ভাষায় দিগ্গজ বানানোর জন্যে বাবা মায়েদের কি উৎসাহ কি উদ্দিপনা! দেখে মনেও হয় না এই মানুষগুলি রবীন্দ্রনাথের দেশের মানুষ! এই বিষয়ে কাঁটাতারের দুই পারেই সমান চিত্র! সবারই একটিই অজুহাত, বিশ্বায়নের ভাষা ইংরেজী! তাদের পরিপক্ক বিচক্ষণ মস্তিষ্কে কবির বাণী ও কর্ম কোনোই রেখাপাত করে না! কারণ একটাই! কবি আখের গোছানোর শিক্ষার অ আ ক খ জানতেন না! স্বাধীন দেশের প্রতিটি বাবা মায়েরা সেই আখের গোছানোর অ আ ক খ জেনে গেছেন প্রথমেই! তাই তাদের চিন্তা ও চেতনা কবির স্বদেশ চিন্তার বিপ্রতীপে! তাই তাদের ভোট সেই রাজনৈতিক দলকেই, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকলে নিজেদের আখের গোছানোর কাজটি সহজ হবে! সেই কাজের জন্যে যতরকম বাঁকা পথ নেওয়ার অধিকার যে দল যত বেশি নিশ্চিত করতে পারবে, সেই দলই তত বেশি জনপ্রিয় জনগণের কাছে! এটাই দুই বাংলার সামগ্রিক চিত্র। যে চিত্র দেখে বিশ্বাস করা শক্ত, রবীন্দ্রনাথ নামক ব্যক্তিটি এই দেশেরই সন্তান! 

সারা বাংলার জনজীবনের কোনো স্তরেই, সমাজ জীবনের কোনো পরিসরেই, রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো অলিন্দেই রবীন্দ্রনাথের কোনো প্রভাব পরেনি এযাবৎ! শুনে অনেকেই রে রে করে উঠতে পারেন। কেন বঙ্গসংস্কৃতির পরতে পরতে বিশ্বকবি! বাঙালির অন্নপ্রাশন থেকে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান- সর্বত্র রবীন্দ্রনাথ! দু দুটো দেশের জাতীয় সংগীতেই বিশ্বকবি! এই বঙ্গে পরিবর্তনের প্রভায় প্রতিটি ট্র্যাফিক সিগন্যালে অহরহ রবীন্দ্রসংগীত! সরকারী সৌজন্যে! ঠিক, আবার সেই সাথেই কবির বোলপুর, বীরভুমের রাঙামাটি এখন অনুব্রত দুধকুমারদের চোখরাঙানি, গর্জানির উস্কানিতে মানুষের রক্তে লাল! বাংলাদেশে কবির নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষণায় একদল ইসলামের সর্বনাশ মনে করে উৎকন্ঠিত! কবির নিজের বিশ্বভারতীতেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে পড়ুয়া! হতে হয় ধর্ষণের শিকার! শিক্ষার পরিসরে ছাত্ররাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির নিরন্তর খণ্ডযুদ্ধ! জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অসাধু রাজনীতিবিদদের দাপাদাপি। শিল্প বাণিজ্য অসাধু ব্যবসায়ী মজুতদারদের নির্দেশে পরিচালিত! রাষ্ট্রযন্ত্রের দখল নিতে রাজনৈতিক দলগুলির রেষারেষি, সংবিধানকে নিরন্তর বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নেতা নেত্রীদের ক্ষমতার অপব্যবহার! মানুষের মনুষ্যত্বকে সম্পূ্র্ণ পদদলিত করে তাকে ভোটযন্ত্রের ছাপে পরিণত করা; এসবই ঘটেছে কবির স্বদেশে তাঁর ছবি টাঙিয়ে রেখেই!

এই সার্বিক জাতীয় চালচিত্র চোখে দেখার জন্যে কবি হয়তো বেঁচে নেই, কিন্তু তাঁর কীর্তি তাঁর সকল সৃষ্টি, যা আমাদের উত্তরাধিকার; তাকে আমাদের ঐতিহ্যে পরিণত করতে পারলে আজ আমরাও ইউরোপ আমেরিকার উন্নত দেশগুলির থেকেও উন্নত হতে পারতাম! কারণ তাদের সব থাকলেও একজন রবীন্দ্রনাথ নেই। তাই কবি না থাকলেও তাঁর সৃষ্টি তাঁর কর্ম আজও হয়তো সজল চোখে তাঁর স্বদেশের সুমতির জন্যে অপেক্ষা করে। করে অনাগত সুস্থ প্রজন্মের বলিষ্ঠ পদধ্বনির জন্যে। যে প্রজন্ম কবিকে ঠাই দেবে তাদের জীবনের প্রতিটি পর্বে, প্রতিটি স্তরে, পরিপূর্ণ পরিসরে! যা আমরা সচেতন ভাবেই দিতে চাইনি কোনোদিন। কারণ আমরা আখের গোছানোর অ আ ক খ শিখে নিয়েছি প্রথমেই! আর ভগবানের মূ্র্ত্তি গড়ে ধর্মব্যবসায়ীদের ভণ্ডামীর মতো; আমরাও কবির ছবি টাঙিয়ে রবিঠাকুর বানিয়ে রেখে দিয়েছি তাঁকে।



শ্রীশুভ্র শ্রীশুভ্র Reviewed by Pd on মে ০৯, ২০১৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.