রিয়া রিয়া

ভাষা হল কতগুলি অর্থবহ ধ্বনি সমষ্টির বিধিবদ্ধ রূপ যার সাহায্যে একটি বিশেষ সমাজের লোকেরা নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করে। যে জন্য সমষ্টি একই ধরনের ধ্বনিসমষ্টির বিধিবদ্ধ রূপের দ্বারা নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করে ভাষা বিজ্ঞানীরা তাদের একটি ভাষা সম্প্রদায় বলে থাকেন। অর্থাৎ আমরা যারা বাঙালী তারা একটি বিশেষ ধ্বনিসমষ্টির সাহায্যে ভাব প্রকাশ করে থাকি এবং যারা বাঙালী তারাই কেবল এই ভাব বুঝতে পারে। সুতরাং বাঙালিরা একই ভাষা সম্প্রদায় এটা বলাই যেতে পারে। 

আনুমানিক ৯০০ থেকে ১০০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মাগধী ভাষা থেকেই বাংলা ভাষার জন্ম হয়, এবং একটি নব্য ভারতীয় আর্যভাষা রূপে বাংলা ভাষা এখনো জীবন্ত রয়েছে। আনুমানিক ৯০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষার বিবর্তনের প্রায় এক হাজার বছরের ইতিহাসকে আমরা মোটামুটি তিনটে যুগে ভাগ করতে পারি। 

প্রাচীন বাংলাভাষা, মধ্য বাংলাভাষা আর আধুনিক বাংলাভাষা। প্রাচীন বাংলাভাষাঃ- এই বাংলা ভাষার দেখা পাওয়া যায় বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের রচনা করা চর্যা গানে, তাছাড়া ‘অমর কোষে’ র সর্বানন্দ রচিত টীকায়, বৌদ্ধ কবি ধর্মদাস রচিত ‘বিদগ্ধ মুখমণ্ডন’ গ্রন্থের দু’চারটে বাংলা কবিতায়, ‘সেক- শুভোদয়া’ য় উল্লেখ করা গানে ও ছড়ায়। এই প্রাচীন বাংলা ভাষার অনুমানিক কাল ৯০০ খ্রীস্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত। এই ১২০০ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় রচিত কোন নিদর্শন পাওয়া যায় নি তাই সেই সময় কে অনুর্বর পর্ব বা অন্ধকারাচ্ছন্ন পর্ব বলা যায়। সেইজন্য এই সময় কে প্রাচীন যুগ বা মধ্য যুগ কোন সময়ের সাথেই যুক্ত করা সম্ভব হয় নি। 

মধ্য বাংলাভাষাঃ- বাংলা ভাষার এই পর্বের বিস্তার ছিল ৪০০ বছর। আনুমানিক ১৩৫০ থেকে ১৫০০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত। আবার এই ৪০০ বছরের দীর্ঘ পর্বটাকে দুটো উপপর্বে ভাগ করা যায়। 
ক) আদিমতাঃ- বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এর রচনাকাল বিতর্কিত হলেও অনুমান করা যায়। এছাড়া মোটামুটি ভাবে কৃত্তিবাসের ‘রামায়ন’, মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ এই সময়ের রচনা। অর্থাৎ ১৩৫০ থেকে ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। 
খ) অন্ত্যমধ্য বাংলাঃ- এই উপপর্বের ভাষার সমৃদ্ধ রচনা আমরা পাই মনসা মঙ্গল, চণ্ডী মঙ্গল, ধর্ম মঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, বৈষ্ণব পদাবলী, বিভিন্ন সংস্কৃত বইয়ের অনুবাদ, আরাকানের মুসলমান কবিদের রচনার অনুবাদ ইত্যাদিতে পাওয়া যায়। তবে এই সময়কাল থেকেই বাংলা ভাষায় আরবি, ফারসি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে, বৈষ্ণব কবিতায় ব্রজবুলি ভাষার প্রাচুর্য দেখা যায়। আনুমানিক ১৫০০ থেকে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এই যুগের বাংলাভাষা নানা ধারায় সমৃদ্ধ। 

গ) আধুনিক বাংলাভাষাঃ- মধ্যযুগের শেষ কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর মৃত্যু বরণ করেন ১৭৬০খ্রিস্টাব্দে। এবং তখন থেকেই বলা যেতে পারে বাংলাভাষার মধ্যযুগের সমাপ্তি আর আধুনিক যুগের সূচনা। আর এখনও পর্যন্ত বাঙালীর মুখের বাংলা ভাষাই এই পর্বের বাংলার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এই সময়েই আমরা পাই রামমোহন-বিদ্যাসাগর-রবীন্দ্রনাথ-বঙ্কিমচন্দ্র-শরৎচন্দ্র-মুধুসূদন দের মতো বাঙালি সাহিত্যিকদের এর পাশাপাশি আমরা পাই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকবৃন্দ ও খ্রিস্টান মিশনারীদের লেখা বিভিন্ন বাংলা বই। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এই সব সাহিত্যিকদের রচনায় বাংলা জনসাধারণের মুখের ভাষার মিল সবক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সেটা সাহিত্যের ভাষা মাত্র। আধুনিককালের বাঙালীর মুখের ভাষার প্রধান পাঁচটি আঞ্চলিক রূপ যেমন – মধ্য পশ্চিমবঙ্গের উপভাষা ‘রাঢ়ী’, দক্ষিন-পশ্চিমবঙ্গের উপভাষা ‘ঝারখন্ডী’, উত্তরবঙ্গের উপভাষা ‘বারেন্দ্রী’, পূর্ব ও দক্ষিনপূর্বের উপভাষা ‘বাঙালী’ এবং উত্তর পূর্বের উপভাষা ‘কামরূপী’ বা ‘রাজবংশী’। এগুলো ছাড়াও গঙ্গাতীরবর্তী তটে কলকাতার শিক্ষিত মানুষের সর্বজনীন এর আদর্শ চলিত ভাষার রূপ গড়ে উঠেছে। 

অনেকে বলে থাকেন গদ্যের জন্ম আধুনিক যুগের বাংলা ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য। যদিও বাংলা গদ্যের জন্ম আধুনিক যুগেই হয় নি। বাঙালির মুখে মুখে গদ্যের ব্যবহার অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। রোজকার কথাবার্তায় বাঙালী যে আধুনিক যুগের আগে পদ্যে কথা বলতো তা কিন্তু নয়। আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য এই যে গদ্য বাঙালীর দৈনন্দিন ব্যবহারে, কর্মক্ষেত্রে, তো ব্যবহার হতোই, তবে এই যুগে সাহিত্যে গদ্য পদার্পণ করলো। তবে এই গদ্যের আবার দুটি ধারা হল সাধু ও চলিত। মুলত কলকাতা ও তার নিকটবর্তী হুগলী, হাওড়া, নদীয়া, উত্তর চব্বিশ পরগণা ইত্যাদি জেলার কথ্য ভাষার ওপরে ভিত্তি করে চলিত গদ্যের রূপ গড়ে তোলা হয়েছিল। আধুনিক যুগে বাঙালীর ভাষা চিন্তা- চেতনার সাথে বিশ্বসংস্কৃতির বিশেষত পাশ্চাত্য ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির মেল বন্ধন ঘটে। তারফলে আধুনিক বাংলা ভাষায় বিভিন্ন ভাষার শব্দ গৃহীত হয়। যেমন- চেয়ার, টেবিল, রেডিও, কলেজ, স্কুল, ফাইল, টিকিট, কোর্ট, লাট,সিনেমা, থিয়েটার, হতেল, কমিটি ইত্যাদি শব্দগুলো ইংরেজি ভাষা থেকে এসেছে, আনারস, আলপিন, আল্মারি, ইত্যাদি পর্তুগীজ থেকে এসেছে, কুপন, বুর্জোয়া ইত্যাদি শব্দগুলি ফরাসী থেকে এসেছে, গেজেট যেমন ইতালি থেকে এসেছে, জার, নাৎসি আবার এসেছে জার্মানি থেকে, চীন থেকে চা, চিনি, বার্মা থেকে ঘুগনি, লুঙ্গি, ফারসি থেকে সরকার, দরবার, বিমা, আমীর, উজির, ওমরাহ, বাদশা, খেতাব এছাড়া আর্য-হিন্দি থেকে লাগাতার, বন্ধ্, বাতাবরন, সেলাম, দোস্ত, ওস্তাদ, মস্তান, ঘেরাও এসেছে। অন-আর্য অর্থাৎ অস্ট্রিক বংশের ভাষা থেকে ডাব, ঢোল, ঢিল,ঢেঁকি, ঝাঁটা, ঝোল, ঝিঙ্গা, কুলা ইত্যাদি এই সব নানান ভাষা মিলেমিশে বাংলা ভাষায় দেশীয় রূপ নিয়েছে। তাদের এখন বিদেশী বলেই চেনা যায় না। 

ছন্দরীতিতে নানান আধুনিকতা বাংলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পুরনো পয়ার ছন্দ থেকে বেড়িয়ে অমিত্রাক্ষর আর গৈরিক ছন্দের জন্মই তো হল এই আধুনিক বাংলাভাষার সময়ে। তাছাড়া আধুনিক কবিতায় গদ্যছন্দের ও সূচনা হল এই সময়ে। 

তবে একথা বললে খুব ভুল বলা হবে না যে এই অতি আধুনিক যুগে আমরা বাঙালিরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যা কথা বলি তার মধ্যে ইংরেজির প্রভাব বেশী মাত্রায় থাকে। যেমন আমরা ঘুম থেকে উঠেই ‘বাথরুমে গিয়ে টুথ ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজি আবার ব্লেড/ রেজার দিয়ে শেইভ করি, খুব সকালে হকার পেপার দিয়ে গেলে ডাইনিং টেবিলে ব্রেক ফাস্ট করতে করতে চোখ বোলাই। তাছাড়া ম্যানেজার, রিসেপশনিস্ট, সেইলস ম্যান, রিপ্রেজেন্তেটিভ, জুনিয়র, সিনিয়র, অ্যাসিস্ট্যান্ট, এমনকি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নানা যোগ্যতার ফিরিস্তি যেমন বি এস সি, বি এ, বি কম, বিদেশের ভাষাই আজ আপন হয়ে গেছে। আমরা এই সবের বাংলা নাম বলতেই পারবো না। মানিব্যাগ, অফিস, মেট্রো, ক্রসিং, ইনজেকশন, ক্যাপসুল অর্থাৎ আমাদের নিত্য রোজকার কোথায় এই সব শব্দের প্রভাব অনেক বেশী এখন। একদিন হয়তো এমন আসবে যে আমরা বাঙালীরাই বাংলায় কথা বলতে ভুলে যাবো অন্য দেশের ভাষার প্রভাবে। 

সুতরাং দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর প্রাচীন আর আধুনিক সব ভাষাতেই রয়েছে সেখানকার নানান আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব। আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষাতেও এর ব্যাতিক্রম ঘটেনি। ভাষার সম্মান নির্ভর করে তার প্রকাশের ওপরে। যে ভাষা যত বিচিত্র ভাব ও বস্তু এবং যত গভীর অনুভূতি প্রকাশ করতে সক্ষম সে ভাষা তত উন্নত। আর ভাষার এই প্রকাশ ক্ষমতার মূল আঁধার হল শব্দসম্পদ। আবার এই শব্দ সম্পদ কিন্তু কিছুটা উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া। আবার কখনও অন্য ভাষা থেকে ঋণ গ্রহন করে আবার কখনও নতুন শব্দ সৃষ্টি করে নিজেকে সমৃদ্ধ করে। আজকের উন্নত বাংলা ভাষাও এই ত্রিবিধ উপায়ে নিজের শব্দ ভাণ্ডার কে সমৃদ্ধ করেছে।
________________________________
এই লেখা বিনা অনুমতি তে কোথাও প্রকাশ আইনত দন্ডনীয়।

পরিচিতি  
রিয়া রিয়া রিয়া রিয়া Reviewed by Pd on ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫ Rating: 5

২টি মন্তব্য:

  1. অনেক ভালো লাগলো লেখাটা। অনেক ধন্যবাদ।
    তবে প্রচ্ছদের ছবিতে লেখিকার চোখে চশমাটা না দিলেই বোধহয় ভালো হতো।

    উত্তরমুছুন
  2. ভাষা সন্ধান প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব আগেই পড়েছিলাম। তৃতীয় পড়লাম। নিঁখুত ময়নাতদন্ত। ধন্যবাদ রিয়া এত চমৎকার বিশ্লেষণ সাহিত্যের রসের মোড়কে উপহার দেবার জন্য। আপনার এই নিবন্ধ আগামীদিনে বই আকারে পাওয়ার আশা রাখলাম।

    উত্তরমুছুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.