কথা হচ্ছিল"ছিন্নমূল" কলোনীর বাসিন্দা ৭৫ বৎসর বয়সী সুফিয়া বসুরায়ের সাথে। টকটকে ফর্সা,সাদা ধবধবে চুল কালোপাড় সাদা শাড়ী,বাঁহাতের কব্জিতে কালো বেল্টের একটি ঘড়ি। এই বয়সেও টানটান চেহারা শরীরে বাড়তি এতটুকু মেদ নেই । টিনেরচালের বারান্দায় মোড়াতে বসে ছিলেন। হাতে ঊলকাঁটা।একাত্তরের লড়াইয়ের পর স্বাধীন বাংলাদেশে আর ফিরে যাননি। কেন যাননি,ধনীর দুলালী হয়েও কিভাবে এই কলোনীতে কাটিয়ে দিলেন সুফিয়া বেগম থেকেকিভাবে বসুরায় হলেন জানতে বড় ইচ্ছে করছিল। রাশভারী মিতভাষী এই মহিলাকেঅনেকদিন ধরে দেখছি কিন্তু কথা বলার সাহস হয়নি। আজ জয় মা বলে নেমে পড়লাম ময়দানে।
আমি নমস্কার বলে দাঁড়াতেই আর একটি মোড়া আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বসতে বললেন। আমি ইতস্তত করছি দেখে বললেন জল খাবে? আমার ঘরে চায়ের ব্যবস্থা নেই। আমি সবিনয়ে না বলে আসল কথাটা পাড়লাম। উনি কিছুক্ষনের জন্য কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। শূণ্যে প্রসারিত দৃষ্টি। মুখে ঘন বিষাদের ছায়া।
নিস্তব্ধতা ভেঙে আমিই বললাম কি করে সময় কাটে আপনার? উনি স্মিত হেসে বললেন সময় পাই না। এতকাজ! কচিকাচাগুলোকে পড়াতে হয়না? এখনও পড়ান? এই বয়সে? উনি বললেন এটাই আমার ব্রত। জীবনের অন্তিমদিন পর্যন্ত এই কাজ করে যাবো। ভাষাশিক্ষা, ভাষাদান। মূঢ় ম্লান মুখে জোগাতে হবে ভাষা। হঠাৎ বক্তৃতার ভঙ্গিতে বলতে লাগলেন বাংলা ভাষা আমার ভাষা আমার অহংকার আমার আদর্শ আমার প্রেরণা। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললেন দুঃখিত! সে সময় তাকে ষোলো বছরের কিশোরীর মতো লাগছিল।
হ্যাঁ ষোল বছরই বটে। ঢাকারসম্পন্ন গেরস্থ আতর আলি চৌধুরীর আদরের দুলালী সুফিয়া চৌধুরী। তখন ক্লাস টেনের ছাত্রী।দেশ জুড়ে তখন শুরু হয়েছে ভাষা আন্দোলন। কিছুদিন আগেই তৎকালীন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী নাজিম উদ্দিন জনসভায় ভাষনে বলেছেনউর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। ফেটে পড়ল বিক্ষোভরত ছাত্র সমাজ। বাংলা ভাষার অপমান কিছুতেই সইবো না প্রাণ যায় যাক।বাংলাভাষাই হবে রাষ্ট্রভাষা। মিটিং মিছিলে উত্তাল হয়ে উঠলো পূর্ববঙ্গ। সে আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগলসুফিয়ার মনেও।পুলকেন্দু বসুরায় সুফিয়ার বড়ভাই জামালের বন্ধু। বরকত জাব্বার রফিক ভাইদের সহযোদ্ধা। পুলকেন্দুর ভাষনে অটুট মনোবল সুন্দর বাচনভঙ্গি ওদেশপ্রেম দেখে সুফিয়া মুগ্ধ হয়ে যায়। রঙ লাগে কিশোরী মনে। হাত বাড়িয়ে দেয় আন্দোলনে সামিল হওয়ার জন্য। পুলকেন্দু বোঝায় সুফিয়াকে এ পথে অনেক বিপদ সুফিয়া। তুমি ধনীর দুলালী।তাছাড়া তোমার বাবা আমাদের আন্দোলন সমর্থন করেন না। তোমার ঘরেও বিপদ।জামাল গোপনে আমাদের সমর্থন করে। সুফিয়া কোন কথাই শোনে না। ধীরে ধীরেজড়িয়ে পড়ে ভাষা আন্দোলনের সাথে।চোখে বাংলাভাষার স্বপ্ন মনে স্বাধীন দেশের আশা। পুলকেন্দু বলে সুফিয়া! যদি আমার দেশের একটি মানুষকেও তুমি সাক্ষর করে তুলতে পারো যদি আমার দেশের মানুষকে ভাষা সচেতন করে তুলতে পারো জানবে তোমার জীবন সার্থক।সেটাই হবে তোমার উপাসনা।
আজ থেকে তোমার জীবনের সাধনা হোক বাংলা বাঙালি ওবাংলা ভাষার গৌরব ফিরিয়ে আনা তাতে যদি প্রাণ যায় যাক না। মহৎ কার্যে তুচ্ছ প্রান বলিদান তো গৌরবের। সুফিয়া মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে।একসময় হাঁটুগেড়ে বসে পড়ে পুলকেন্দুর পায়ের কাছে।তোমাকে আমি গুরু মেনেছি পুলকদা।তোমার নির্দেশিত পথেই চলবো আজীবন তোমাকে কথা দিলাম।আবেগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সুফিয়া আরওবলে আমি তোমার সাথে থাকবো সব কাজে সব সময়কিন্তু তুমি কি আমার সাথে থাকবে পুলকদা? পুলক সস্নেহে সুফিয়ার মাথায় হাত রেখে বলে কথা দিলাম সুফিয়া জীবনেরশেষদিন পর্যন্ত আমি তোমার সাথে থাকবো।
অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী। আব্দুল হামিদ ভাসানীর নেতৃত্বে আন্দোলনের বহুবিধ শাখা ২১শে ফেব্রুয়ারীপ্রভাত ফেরি বের করবে সিদ্ধান্তনিল। চরম উত্তেজনা। মাতৃভাষার সন্মান রক্ষার লড়াই। চলবে হরতাল মিছিল। আগের রাত্রিতে ঘুম আসেনি সুফিয়ার। কখন সকাল হবে। সকাল হওয়ার অনেক আগে থেকেই তৈরী হয়ে পথে বেড়িয়ে পড়ে সুফিয়া চুপিসারে। কারন আব্বা জানতে পারলে রক্ষা নেই।
চলছে মিছিল । মুখে প্রভাতফেরীর গান। সে কি দৃশ্য!সে কি উন্মাদনা! আবেগ! মানুষের ঢল নেমেছে রাস্তায়। এবার সরকারকে বশ মানতেই হবে। বাংলা ভাষা হবে রাষ্ট্রভাষা। প্রথমসারিতে ছিল বরকত রফিক জাব্বার ভাই একটুপিছনে পাশাপাশি পুলকেন্দু সুফিয়া এবং আরও অনেকে।হঠাৎ কানফাটানো গুলির আওয়াজ। বর্বরপাকসেনার গুলিতে লুটিয়ে পড়েছে রফিক, সালাম জাব্বার বরকতভাই ওআরও কতজন।রক্তে ভাসছে রাজপথ।সুফিয়া বিভ্রান্ত ও খুঁজছে পুলককে।তারপর? আজও মনে আছে সুফিয়ার একটা গুলি ছুটে আসছিল তারই দিকে। একঝটকায় পুলক তাকে সরিয়ে দেয় গুলি সরাসরি এসে লাগে পুলকেন্দু র বুকে। ফিনকি দিয়ে রক্ত। ওঃ মা আর ভাবতে পারেনা সুফিয়া ... পুলকদা! একটা বীভৎস চীৎকার। কারো কানে যাচ্ছেনা কারো কথা। তান্ডবে লীলা চলছে তখন। পুলকেন্দুর রক্ত সুফিয়ার মুখে মাথায়। যেন এইমাত্র সিঁদুরদান হল। পুলক কোন ক্রমে সুফিয়ার মাথায় হাত রেখে বলল -লড়াই যেন না থামে। তারপর সবশেষ। এই পর্যন্ত বলে সুফিয়া থামলেন। তার চোখ দিয়ে বইছে শ্রাবনের ধারা। দীর্ঘদিনের জমে থাকা ব্যথা আজচোখের জলে অভিষিক্ত হল।আমি নীরব দর্শক তাকে দেখছি।
কিছুক্ষন পর ধাতস্থ হয়ে তিনি বললেন আর কি জানতে চাও? অবশ্য কিইবা জানবে তার পরের ইতিহাস তো সবার জানা। বাহান্নর বিপ্লব দিয়ে যা শুরু হয়েছিলএকাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের তার সমাপ্তি। কিন্তু আমার জীবনের ইতিহাসে একটু অন্যরকম।আমি জিজ্ঞেস করি কিরকম? উনি বলতে শুরু করেন।একুশের ঘটনাটা আব্বা আতর আলি চৌধুরী ভাল চোখে দেখেননি।সুফিয়ার উপর কড়া নজরদারি চলতে থাকল। সুফিয়া থেমে থাকেনি। পড়াশুনার সাথে সমানে চালিয়গেছে বিপ্লবের কাজ।মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। তারআব্বা অনেকবার বিয়ের জন্যতাকে জোর করেছেন নিপীড়ন করেছেনকিন্তু সুফিয়াকে টলাতে পারেননি। শেষেহাল ছেড়ে দিয়েছিলেন।
শুরুহল একাত্তরের লড়াই। সুফিয়া তখন ৩২/৩৩বছরের পূর্ণ যুবতী। অনেক পরিনত , একটা স্কুলে পড়াতো তখন। কিন্তু দেশের স্বার্থে সবছেড়েঝাঁপিয়ে পড়ল যুদ্ধে। ঘৃণাভরে ঘর ছাড়ল যেদিন জানল তারআব্বা রাজাকার। লড়াই চলাকালীন পার্টির উচ্চকর্মকর্তার নির্দেশে পার হয়ে এসেছে ভারতে। তার সবসময় মনে হয়েছে পুলকেন্দু যেন তারপাশে আছে সবসময়। তারই নির্দেশে সে চলছে। একটা মুহুর্তের জন্যও সে ভোলানি পুলকদাকে। কিন্তু যুদ্ধশেষে আপনিতো দেশে ফিরে যেতে পারতেন? কথার মাঝেই জিজ্ঞেস করি। কিন্তু আমি যাইনি। তিনি দৃঢ় ভাবে উত্তর দেন। আমি রাজাকারের মেয়ে এটা ভুলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি আপনার পদবী বসুরায় লিখেন কেন? একটু যেন দুঃসাহসী হয়েই প্রশ্ন করি। উনি বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বললেনমেয়েরা তো স্বামীর পদবীই ব্যবহার করে।
কিন্তুবিয়ে? থামো বাছা! তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন যেদিন ক্যাম্পে নাম রেজিস্ট্রিকরণ হচ্ছিল সেদিন যখন জিজ্ঞেস করল নাম? সুফিয়া বসুরায়
স্বামী? ঁপুলকেন্দু বসুরায়। সুফিয়া বলে চলেন যাঁর নামে জীবন উৎসর্গ করেছি , যিনি আমার জীবনদেবতা আমারগুরু,পথপ্রদর্শক যার রক্তে আমার সিঁথি রাঙা হয়েছে সে ছাড়া আমার আর কে স্বামী হতে পারে বলো? আজও তো তাঁরই নির্দেশে কাজ করছি। আদিবাসী গরীব মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের শিক্ষার আলো দিতে চেষ্টা করি । এদের মধ্যে আলো জ্বালাবার ব্রত নিয়েছি সেটাই আমৃত্যু করবো। সেই আমার প্রেম আমার পূজা। এখানেই আমি শান্তি খুঁজে পেয়েছি।আমি বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাকে প্রনাম করে বেরিয়ে এলাম।
![]() |
| পরিচিতি |
শুক্লা সান্যাল
Reviewed by Pd
on
ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
সুচিন্তিত মতামত দিন