এয়ারপোর্ট - “যাওয়া -আসারই এই কি খেলা !”
এই কথাটার মধ্যে যেন একটা বিষাদ আর আনন্দ-এর ছোঁয়া লেগে থাকে। আজকাল আর লোপা দেবীর এই এয়ারপোর্ট নামের ওপরে একটা ফ্রাস্ট্রেশন এসে গেছে। নামটা শুনলেই একটা মাইল্ড স্ট্রোক-এর মতন হয়। অথচ আগে কি ভালই না লাগত। যখন প্রায়-ই এখানে ওখানে যেতে হত স্বামীর সাথে। ১৯ বছর বিদেশে কাটিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন ওনারা। কোলকাতায় ম্যান্ডেভিলি গার্ডেন্সে একটা ২ রুম ফ্ল্যাট কিনেছেন। বিদেশেই আছে দুই ছেলে আর ৩ মেয়ে। তারা পুরোপুরি সংসারী। ওখানে এত বেশী একাকীত্ব -কে সহ্য করতে না পেরে দেশে ফিরে এসেছেন।
আজকাল এয়ারপোর্ট-এ যান প্রধানতঃ দুটি কারণে। ছেলে মেয়েরা আসে। আবার তারা চলে যায়। যেদিন আসে সেদিন হার্টের কথা ভুলে যান। স্বামীর গায়েও যেন যৌবন ফিরে আসে। কেউ দেখলে বলবে না সেদিন যে, আট বছর আগে তার শরীরের অর্ধেকটা ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। দুজনে মিলে এটা ওটা করেন। আর তিনি ছেলে মেয়েরা ছোটবেলায় কি কি পছন্দ করত তৈ্রী করতে শুরু করেন।
বড় ছেলে চুকচুকে ঘিয়ে ভাজা সুজির বরফি, ছোটছেলের মায়ের হাতের তৈ্রী সাদা চমচম ভীষণ প্রিয় ছিল। এই বয়সেই কোলেস্ট্রলের ভয় ঢুকে গেছে তাই এই সব মিস্টি জাতীয় খাবার দাবার এ্যভোয়েড করে। বৌমা নামকরা কলেজ জন হপকিন্সের নার্সিং-এ স্নাতোকোত্তর। তাই চিনির উপর তার কড়া চোখ। মেয়েরাও আজকাল সব কিছুতেই ফ্যাট দেখে। ভাত, আলু, মিস্টি সব বাদ। স্যালাড, বয়েল্ড, স্যুপ - এই সব খেতেই অভ্যস্ত তারা।
তাও তো মায়ের মন...এ কদিন খেলে কিছু হবে না ভেবে সারাদিন রান্নাঘরে থাকেন। হার্টের রোগীরা হয়ত বেশিক্ষণ আগুনের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। বাড়ির কাজের লোকগুলোকে দিয়ে করানোতে তিনি মোটেই রাজী নন।
ছোট মেয়ের প্রিয় জিনিস চিংড়ি ভর্তা। অনেক করে পেঁয়াজ লবণ ঝাল আর সড়ষের তেল মাখানো ভর্ত্তা। যত ঝাল ততই তার পছন্দ। কাঁচা লংকা নাকি ফ্যাট বাড়তে দেয় না।
ভাজা মরিচ আর তেল মেশানো ছোলার চটপটি আবার মেজ মেয়ের প্রিয় জিনিস। ভাজা ছোলা আজকাল আমেরিকান-রাও খাচ্ছে। কথায় কথায় জানিয়ে রেখেছে মাকে আসবার আগেই।
বড় মেয়ে আবার মায়ের হাতের এঁচোড়ের চপ খেতে খুব ভালবাসে। একটা হাত একটু অচল হয়ে পড়েছে তাতে কি? সেই হাতেই তৈ্রী করছেন সব খাবার।
মেয়েরা, ছেলে-বৌ-রা এখানে আসলেও বাচ্চাদের রেখে বাইরে বাইরেই থাকে তাদের শপিং-আর যাবতীয় কাজ সারে। রাত টুকুনি হয়ত এক সাথে খাওয়া দাওয়া হয়।
চলে গেছেন নিজের প্রয়াত মায়ের কাছে। কষ্ট করে মা-ও তো এমনি সব সখের জিনিসগুলো বানিয়ে রাখতেন বিদেশে থাকা ছোটমেয়ের জন্য। মায়েরা বেঁচে থাকতে তাঁদের কষ্টের কথা আমরা কেউ ভাবি না, মনে মনে বিড় বিড় করে বলে উঠলেন। আজ নিজে 'মা' হয়ে সব কিছু বুঝতে পারছেন।
ছেলে মেয়েরা ঘরে ঢুকতেই চলে আসে যাওয়ার দিনটা। “এবার বিদায় দাও!”
আসার দিনটা চোখের পলকে আসে না, শুধু যাবার দিনটাই আসে। ওরা বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে দুয়ারে প্রস্তত হয় বিদায় নেবার জন্য। এয়ারপোর্টের বারান্দায় গিয়ে বাক্সবোঝাই গাড়িটা খালি হয়ে যায়। গাড়ী হাল্কা হয় কিন্তু মনটা হাল্কা হয় না। “ডুবে যায় হাসি আঁখিজলে-”
মালপত্র চেক-ইন করার পর ওদের সঙ্গে ডিপোর্চার লাউঞ্জএ যান। দুবছর, তিন বছরের নাতি নাতনি সমস্ত লাউঞ্জ দাপিয়ে বেড়ায়। কারুর গায়ে ধাক্কা লাগতে পারে সেদিকে হুঁশ নেই। মা বাবা পেছন পেছন ছোটে। ঠিক আমাদের মতন। এখন আমরা ছুটতে পারি না, শুধু এই মন, অন্ধ নির্বাক মন, কেবলি ছুটে বেড়ায়। হাঁতড়ে বেড়ায় স্মৃতি।
কিছুক্ষণ পর ওরা সিকিউরিটি চেকের দরজা পার হয়ে হাত নাড়তে নাড়তে ভেতরে ঢুকে যায়। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন দুজনে। একটা ক্লান্তি আর শূন্যতা ঘিরে থাকে দেহে আর মনে তাঁদের।
জীবনের আরো একটা অধ্যায় যেন শেষ হয়ে যায়। এই শেষ আর কোনদিন পূর্ণ হবে না। এই শূণ্যই থেকে যাবে অনন্তকাল। খালি গাড়িতে দু’জন নির্বাক পুতুল বাড়ি ফিরে আসেন। মনকে সান্তনা দেন...বিদেশে থাকতে ওরা আসত মাত্র লং উইকেন্ডে। থাকত দু দিন। তাও তো এখানে কিছুদিন থেকে গেল।
অথচ এই সেদিনও বাবা মাকে, শ্বশুর শাশুড়িকে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। যাবার সময় বুকে জড়িয়ে থাকতেন কিছু সময় আর ফেরার সময় মা-দের মুখে আঁচলের খুঁটি আর বাবাদের এড়িয়ে যাওয়া নয়ত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা।
তাঁদের ছেলে মেয়েরাও এখন ঠিক তেমনি এদিক ওদিক না তাকিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। বিদায়কে বড্ড ভয় পান আজকাল। এই বিদায়-ই সব মা বাবাদের নিয়তি। ওরা থাকার জন্য আসে না, ফিরে যাবার জন্য আসে।
তারপর একদিন মা বাবা ছাড়াই বাড়ির লোকজনেরা এসেছিলো এয়ারপোর্টে। একদিন আমরাও পারব না আমাদের ছেলে মেয়েদের আনতে বা বিদায় জানাতে এয়ারপোর্টে । অনেক আধুনিক হয়ে গেছে আজকের মানুষ। আধুনিক হয় না শুধু মায়েরা, বাবারা। তারা সেই একইভাবে এয়ারপোর্টে গিয়ে নিরিবিলি কোনায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন আজও, চোখের জল চোখেই শুখিয়ে যায়।
“শুধু যাওয়া-আসা/শুধু স্রোতে ভাসা...”
পরিচিতি |
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন