আর কিছুক্ষণ।তারপর আমরা যাচ্ছি। চার মাইল উত্তরে হাঁটতে হবে। মাঝে একটি খাল পার হতে হবে। এরপর ক্ষেত ধরে সোজা চলে যেতে হবে।নদীর পরেই সীমান্ত । তারপরেই ভারতে পৌঁছে যাব। শুরু হবে ট্রেনিং। যুদ্ধ করব,দেশ স্বাধীন করব! জয় বাংলা ! জয় বাংলা! কথাগুলো বলতে বলতে শরীর কাঁপতে লাগল মতিনের।তার সমস্ত শরীর দুলে দুলে উঠছে। সবাই সজোরে বলতে লাগল 'জয় বাংলা,জয় বাংলা'।
ওরা মোট তেরজন ।মুক্তিবাহিনীর একটা দল ইতিমধ্যেই ভারতে গিয়ে পৌঁছেছে। ওরা তেরজন থেকে গেছে । গোলাবারুদ আর কিছু রসদপত্র নিয়ে যেতে হবে। রাত আটটার পূর্বেই সবাই প্রস্তুত হয়ে রইল।এ কয়েকদিন অনেক হাঁটাহাঁটি হয়েছে,সবার পা ফুলে উঠেছে।তবে সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই । সবাই বিজয়ের চিন্তায় মগ্ন । শয়তানে দেশ ছেয়ে গেছে,তাড়াতেই হবে ওদের ।
রাত প্রায় আটটার দিকে মুক্তিদল রওনা দিল। উত্তর দিকে খুব সাবধানে যেতে হবে। আশেপাশেই একটা পাকিস্তানি ক্যাম্প,তাদের অতিক্রম করতে পারলেই নিরাপদে ভারতে পোঁছানো যাবে। তবে খাল আর নদী অতিক্রম করতে হবে পায়ে হেঁটে। খাল পর্যন্ত ওরা কোনরকম বাঁধা ছাড়াই যেতে পারল। সবাই খালে নেমে পড়ল। বুকসমান পানি,বেশ ঠাণ্ডা। শহীদুল সামলাতে পারল না।সব মালামাল নিয়ে প্রায় ডুবে গেল। কবির তড়িৎগতিতে তাকে উদ্ধার করল।গোলাবারুদ কিছু পানিতে ভিজে গেছে,যাকগে সেসব,যাত্রা আবার শুরু হোলো। এবার দলটি খেতের উপর দিয়ে হাঁটছে। দুইদিকে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। রাতের গন্ধ সবাইকে এক সম্মোহনী শক্তিতে টেনে নিয়ে যায়,সে শক্তি মুক্তির,দেশের মাটির,প্রত্যেকটা মানুষের।একটা শব্দ সবার কানের কাছে বয়ে চলে গেল। আর কিছুক্ষণ আগেই শব্দটি শোনা যাচ্ছিল।এখন স্পষ্ট শুনা যাচ্ছে,গুলির শব্দ !সবাই দ্রুত মাথা নিচু করে ফেলল।কিছুক্ষণ পর গুলি আওয়াজ থেমে গেল,সম্ভবত মুক্তিবাহিনীর অন্য কোন দলের সঙ্গে পাক হানাদারদের যুদ্ধ হয়েছে। দলটি এবার নদীর দিকে এগিয়ে গেল।প্রায় সবাই খালে নামাতে ভিজে গিয়েছিল,অনেকের জ্বর আসছে। পা আর চলতে চাইছে না।মুক্তির মোহটানে তবুও সবাই সংকল্পবদ্ধ। নদীতে নামল ওরা ।পাকিস্তানি ক্যাম্প আগেই পার হয়ে গেছে।সবাই নদীর শীতল জলে নামল।ঠাণ্ডা পানি,শরীরে শিহরণ বয়ে যায়।কিন্তু আবার বিপত্তি।একটা নৌকা এগিয়ে আসছে এদিকে।নৌকায় মাঝিসহ তিন-চারজন হবে।পাকিস্তানিরা টহল দিচ্ছে নাতো?রসদপত্র নিয়ে দ্রুত পৌঁছতে হবে ওদের।তিনটি রাইফেল ছাড়া আর বেশি কিছু নেই।
'সবাই নদী পার হয়ে যাও,জলদি! আমি আর আমজাদ থাকছি।আমরা ওদের দৃষ্টি এখান থেকে সরাতে দেবনা।এ ফাঁকে তোমরা চলে যাও,জলদি!' নেতার ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল মতিন।সে আর আমজাদ বাদে বাকি সবাই চলে যাচ্ছে নদীর ওই পারে। দুটি রাইফেল দিয়েই শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।ওদের কাছাকাছি চলে এসেছে নৌকাটি।আশঙ্কা ঠিক হলো।হানাদারদের নৌকার থেকে প্রথম আঘাত আসল।একটার পর একটা গুলি আসছে।ওরাও থেমে নেই।রাইফেল দিয়ে গুলি করা শুরু করল।আমজাদ এক পা এগিয়ে প্রায় নৌকার সামনে গিয়ে পড়ল।কিছুক্ষণের জন্য ডুব দিয়ে গুলি করতে লাগল।মনে হয় কাজ হয়েছে! চিৎকার শোনা যাচ্ছে নৌকা থেকে।আমজাদ আবার সরে আগের জায়গায় আসছে।কিন্তু চোখের পলকে একটা বুলেট এসে লাগল আমজাদের গলায়।রক্তে লাল হচ্ছে নদীর পানি।আমজাদ কাতরাচ্ছে। মতিন কাছেই ছিল।আমজাদকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসছে,নৌকাটি আস্তে আস্তে দূরে চলে যাচ্ছে,সাইরেন বাজাচ্ছে।ওরা আরো সেনা নিয়ে আসবে,এর আগেই চলে যেতে হবে এখান থেকে ।
মুক্তিদলটির বাকিরা পাড়ে এসে কিছুক্ষণ যাওয়ার পরই কয়েকজন মানুষের হাতে আটকা পরেছে,এরা মুক্তিবাহিনীর দল।তবে দলটিকে পাকিস্তানি চর বা অন্যকিছু ভেবে আটক করেছে।সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে মুক্তিবাহিনীর দিকে।ওইতো ওরা আসছে।মতিন আর আমজাদকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল আলম।আমজাদকে ধরে রেখেছে মতিন।
ওদের চিনতে পেরেছে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার।সবার খাওয়াদাওয়া আর শুকনো কাপড়চোপড়ের ব্যাবস্থা হলো।আমজাদ ও চিন্তামুক্ত। গুলিটি ওর গলার পাশ কাটিয়ে চলে গেছে,কয়েকদিন বিশ্রাম নিতে হবে। সবাই আগামী দিনের জন্য প্রস্তুত,ট্রেনিং শুরু হবে। তাড়াতেই হবে শত্রুদের।
জয় বাংলা
পরিচিতি |
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন