স্টেশনে নেমে রিকশার অপেক্ষা করছি। হঠাৎ সাদা এক্স করোলা এসে থামলো পাশে। গাড়ি থেকে নেমেই ভদ্রলোক জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। আকমল সাহেব, আমাদের উপজেলা চেয়ারম্যান। খুব আন্তরিকভাবে বললেন, "প্রফেসরসাব, অনেকদিন পর দেশে এলেন। অবশ্য আপনার সাথে দু/একদিনের মাঝেই যোগাযোগ করতাম। এসে ভালোই করেছেন। আমরা ঠিক করেছি আমাদের উপজেলার কৃতি সন্তানদের একটি সম্বর্ধনা দেব। আপনি তো এ উপজেলার কৃতি সন্তানদের অন্যতম। আপনাকে এ অনুষ্ঠানে আসতে হবে"। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেকে মোটেই কৃতি সন্তান হিসেবে গণ্য করি না। জীবিকার তাগিদে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করি। পদার্থবিজ্ঞান আমার অধিত বিষয়। পিএইচডি করেছি বটে তবে জ্ঞান-বিজ্ঞানে আমার এমন কোন অবদান নেই যাতে নিজেকে একজন কৃতি পুরুষ হিসেবে গণ্য করতে পারি। তাই আকমল সাহেবকে বিনয়ের সাথে বললাম, " আপনাদের অনুষ্ঠানে আসবো ঠিকই কিন্তু আমাকে কৃতি সন্তানদের লিষ্ট থেকে বাদ দেন।"
-সে দেখা যাবে । আপনি কথা দিলেন আসছেন তাতেই আমি খুশি। চলেন, আপনাকে আপনার বাড়িতে নামিয়ে দেই। আমি তো ঐ পথেই যাচ্ছি।
বাড়ি যাওয়ার পথে আকমল সাহেবের সাথে এলাকার রাজনীতি বিষয়ে কথা হলো। ভদ্রলোক এখন স্থানীয় আওয়ামী লীগের বড় নেতা। শুনেছি আকমল সাহেবের জন্যই এখানে স্বাধীনতা বিপক্ষ অপশক্তি জামাত-শিবির আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। তাঁর প্রতি এ কারণে আমার এক সফট কর্ণার তৈরি হয়েছে।
বাড়িতে পৌঁছে দাদিকে কদমবুচি করতে যেয়ে দেখি তার রুমে বুড়িমা বসে আছে। দাদি বললেন, তোকে দেখার জন্যই বুড়িমা বসে আছে। বুড়িমা এ গ্রামেরই বৃদ্ধা মহিলা। কত বৎসর বয়স হলো বুড়িমা-র, গ্রামের কেউই তা' ঠিক করে বলতে পারে না। বুড়িমা-র ভাষায় একাত্তরে তার বয়স ছিল তিন কুড়ি। সে হিসেবে এখন বুড়িমা-র বয়স কম করে হলেও একশ বছর। অনেকদিন পর বুড়িমা-কে দেখছি। ঠিক সেই আগের মতোনই। কোচকানো গাল, কপালে অজস্র বলিরেখা। মনে হলো না সে বৃদ্ধ থেকে বৃদ্ধতর হয়েছে।
আমরা ছোটরা একসময় বুড়িমা-র কাছে গল্প শোনতাম। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের গল্প। তার স্মৃতিশক্তি প্রখর । খনখনে গলায় বলতো, "যুদ্ধের সময় আমি তো বুড়ি আছিলাম। পাক আর্মিগোর ক্যাম্পে রান্না কইরা দিতে হইতো। ইচ্ছা হইতো না, তবুও ওগোর না করার কি উপায় আছিলো ! আমাগোর পোলাপান দেশের লাইগ্যা যুদ্ধ করতাছে আর আমি ওগোর রুটি বানাইয়া দিতাছি ভাবতেই আমার নিজের উপর ঘিন্না হইতো। তাই একদিন করলাম কি জানো, আটা মাখাইবার সময় ইন্দুর মারার বিষ মিশাইয়া ওগোর রুটি বানাইয়া দিলাম। রুটি বানাইয়া দিয়া সেই যে এলাকা থেইক্যা ভাগা দিলাম ...দেশ স্বাধীন হয়োনের পর আবার ফিরত আইলাম।"
অনেকদিন পর বুড়িমা-কে দেখে আবারো ইচ্ছে হলো তার কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনি। বললাম,"বুড়িমা, আজকে তুমি কিন্তু যুদ্ধের গল্প বলবা। বুড়িমা আমার দিকে তাকায়, বলে -
-বাবা তুমি তো অহন অনেক বড় মানুষ হইছো। আমার কতা কি আর বিশ্বাস করবা! আইলা তো মকবুইল্যা রেজাকারের পোলার গাড়িত্ চইড়া। আমার চইখ্যের সামনে মকবুইল্যা রেজাকার এলাকার কতো মাইয়ারে যে ক্যাম্পে দিছে ... মকবুইল্যার পোলা আকমল হেইদিন পর্যন্ত জামাত করতো, এহোন হইছে উপজেলার চেয়ারম্যান, জয়বাংলা জয়বাংলা কইরা মুখে ফেনা তুলতাছে। আল্লারে শুধু কই, আমারে বাঁচাইয়া রাইখ্যা আরো কতো কি যে দেহাইবা ...
পরিচিতি |
1 মন্তব্যসমূহ
শেষ প্যারা..... অসাধারন (y)
উত্তরমুছুনসুচিন্তিত মতামত দিন