তাপসকিরণ রায়




রমাকান্তর বয়স ষাট পার হয়েছে। স্ত্রী শৈলবালার বাহান্ন। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বয়সের ব্যবধান আট বছরের। এই ব্যবধান কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা রমাকান্ত ভাবতে চাননি কখনও। তবু ঘুরে ফিরে বয়সের নামাবলী গায়ে জড়াতেই হয়। মানুষ নির্বিশেষে এই বয়স নিয়ে টানাটানির একটা প্রবণতা তিনি লক্ষ্য করেছেন। বছর বাড়িয়ে কেউ নিজের বয়স বলতে চায় না, বরং চাপাচাপি করে একটা বছর মারকাট করে চেষ্টা চলে কমিয়ে নেবার। রাগলেও কিছু করার নেই, মেয়েদের এই প্রবণতা একটু বেশী বলতে হবে। বয়সের ব্যাপারে রমাকান্ত স্ত্রীকে বলতে শুনেছেন, ওর থেকে আমি ন বছরের ছোট। আটের জাগায় ন বলেছে, স্ত্রীর এই একটা বছর বাড়ানোর ব্যাপারে রমাকান্তর গায়ে বড় একটা লাগত না। 

রমাকান্ত নিজের বেলায় দেখেছেন, বয়স বড় একটা কষ্টের না। আসল বয়সে আর মনের বয়সে অনেকেরই পার্থক্য হয়ে যায়। বয়সের চে বেশী বুড়িয়ে যাওয়া মানুষ তিনি অনেক দেখেছেন। আবার বৃদ্ধ বয়সের লোককে অনেক পুলকিত হতেও কম দেখেন নি। স্বয়ং রমাকান্তর মনটা এখনও যেন কাঁচা, কাঁচা বলা ঠিক না, ডাঁসা বলা ঠিক হবে। 

ফুল তো ফুলই হয়, সৌন্দর্য কি ঢেকে রাখা যায় ? রসালো জিনিস দেখলে কেউ শুকনো কাঠের মত নিরস হয়ে থাকতে পারে ? পারে না। তিনিও তাই পারেন নি। দীর্ঘ জীবনের ফাঁক ফোকর গলিয়ে তিনিও দেখেছেন, ফুল,  রঙচঙের। তিনিও পাখির ডানা পার করে স্বপ্ন রাজ্যের চিন্তার ফাঁকে বাস্তব রাজ্যেও বিচরণ করেছেন বৈকি ! 

মনে পড়ে মণিকুন্তলা নামের মেয়েটিকে। ওর নামের সৌন্দর্যটাই ছিল বেশী, বাস্তবের শরীর থেকে। সে সব কিছু না, দেখতে যাই হোক না কেন, চাকচিক্য বলেও তো কথা থাকে, হতে পারে কালো শ্যামা, তবু লুক ছিল ! মণিকুন্তলার চলন বলনে ছিল লুকানো এক ধরণের চাতুরী। রমাকান্তর চোখে চোখ পড়লে, সে চোখ সরিয়ে নিত বটে, কিন্তু মুখে তার ফুটে থাকত এক ধরনের গুপ্ত চোরা হাসি। এই হাসির রহস্য রমাকান্তকে এক দিনের জন্যে হলেও মাতিয়ে তুলে ছিল। 

স্ত্রীর করা শাসন চলছিল। বিশ বছরের বিবাহ কাল সগৌরবে পার করেছেন তিনি। তখন স্ত্রীর প্রতি আকর্ষণ বিকর্ষণ বাস্তব নিয়মেই অনেকটা ফুরিয়ে আসে। কিন্তু তখনও স্ত্রীর মনে ভয় থাকে তার প্রেমিক স্বামীটির পরকীয়ার কুণ্ডলী পাকে পড়ে যাবার ! ভয়টা অবশ্য একেবারে অহেতুক নয়।  

--বাজারে যাচ্ছেন ? মুচকি হেসে মণিকুন্তলা ঘরের দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। রমাকান্তর ওর সঙ্গে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। এক পাড়ার মেয়ে, সময়ে পাত্তা দেননি রমাকান্ত। মণিকুন্তলা হয় তো রমাকান্তর অজান্তে তাঁর দ্বারে এসে অনেক ঘুর ঘুর করার ব্যর্থ চেষ্টাও করেছিল। অনেকগুলি বছর নিষ্ফলা ও অবিবাহিত কাটিয়ে দিল। হতে পারে চেহারাই তার জন্যে দায়ী। 

এই যে রামু দা, তোমার সঙ্গে কথা ছিল ? মণিকুন্তলার রামু দা, ডাক কেমন যেন দিন-মজুর গোছের ডাক। কিন্তু স্থানকাল পাত্রে বেজার হওয়া যায় না। জীবনের চলার পথে এমনি পার্শ্ব প্রেমিকাদের মুখে রমাকান্ত নিজের প্রতি সম্বোধন শুনেছেন, রামু দা, রাম দা, রমা দা ইত্যাদি ইত্যাদি। 
--আমার সঙ্গে, কি ব্যাপার ?  
--একটু ঘরের ভেতর আসবেন ?
কি ব্যাপার, ফাঁদ চক্র নাকি ! রমাকান্ত ভাবলেন। মানুষকে বলা যায় না, বিশেষ করে মেয়ে মানুষের ব্যাবহার হাবভাব কোন সাঁচে পড়ে যে পরিবর্তিত হতে থাকে--তা বোধহয় দেবতাদেরও জানার বাইরে থাকে !
মণিকুন্তলাকে ছোট থাকতে পাড়ার গলি ঘুপচিতে দেখেছেন রমাকান্ত। দু জনেই প্রায় সমবয়সী ছিল। সে সময় রমাকান্তও নাকের সিকনি চেটে খেতেন আর তলদেশ থেকে প্যান্ট বারবার কোমরে টেনে তুলতেন। সেই তবে থেকে দেখাদেখির পরিচয় মনির সঙ্গে ! তারপর বড় হতে হতে দেখা হয়েছে বেশ কয়েক বার। কিন্তু সম্পর্ক কখনও জমতে পারেনি।   
--বাজার করে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে—রমাকান্ত বলে উঠলেন।  
--জানি, আপনি খুব ব্যস্ত। বৌদির ভয়ে আপনি তো ঘর থেকে বেরোনই না !  মণিকুন্তলার সেই চাপা হাসি ঝিলিক মেরে উঠলো না ! বয়স হলেও অবিবাহিত শরীরের ভরাট জমাট অবস্থাটা একেবারে খারাপ নয় মণিকুন্তলার। মনের মাঝে গুঢ় রহস্য চাপা রেখে রমাকান্ত ভাবলেন, কে জানে মেয়েটা ডাকছে কেন ? হতে পারে লুকোচুরির কোন কারণ নেই। তিনি ধীরে ধীরে ওদের ঘরের দরজার কাছে এগিয়ে গেলেন, কি ব্যাপার, বল ?
--আসুন না, ভেতরে--
রমাকান্ত মণিকুন্তলার দাদার কথা ভাবলেন, ওটা তো একটা আস্ত গুণ্ডা ! কিন্তু এক জলজ্যান্ত মেয়ের কথা তিনি কি করে অস্বীকার করতে পারেন ? তিনি সুড়সুড় করে ঢুকে গেলেন ওদের ঘরের ভেতর। 
--ভয় নেই, দাদা বাড়ি নেই--
রমাকান্ত কিছুটা নিশ্চিত হলেন কথাটা শুনে। তারপরেও অনেক প্রশ্ন ঠেলা দিয়ে উঠছিল তাঁর মনে। ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মণিকুন্তলা তাঁর হাতটা চেপে ধরে ছিল, নিবেদনের ভাব নিয়ে বলেছিল, রামু দা, দাদা দুদিন ধরে ঘরে আসছে না, ঘরে খাওয়া নেই, আমি না খেয়ে আছি--কান্নার কাছাকাছি ছিল মণিকুন্তলা। 
সব গুলিয়ে ফেলছিলেন রমাকান্ত, বল কি ? 
--আমায় কিছু টাকা দিতে হবে, রামু দা ! মনি রমার হাত আরও বেড় দিয়ে ধরে নিয়ে ছিল। তোমার টাকা আমি দাদা আসলেই ফেরত দিয়ে দেবো। 

গলে যাচ্ছিলেন রমাকান্ত, বয়সের ভার কেটে মনের অন্তঃস্থলে জমা হরমোন গ্রন্থি সজাগ হয়ে উঠছিল। শরীর, স্বভাব, ভার বয়সের মানসিকতা সব কিছু ঘুলিয়ে এক অস্পষ্ট অনুভূতি জন্ম নিচ্ছিল। তিনি তাঁর একটা হাত মণিকুন্তলার মাথায় ঠেকালেন। মনের দ্বিধা দ্বন্দ্ব সরিয়ে পকেটে হাত দিয়ে ফস করে একটা একশ টাকার নোট বের করে মণিকুন্তলার হাতে ধরিয়ে দিলেন। মণিকুন্তলার শ্বাস টের পাচ্ছিলেন তিনি। নিজের ধকধক বুকের পেন্ডুলাম আওয়াজ আসছিল কানে। কিন্তু পুরোটাই আবেগের। আবেগের দুটি পজিটিভ নেগেটিভের অবস্থান ক্রমশ চৌম্বকীয় পর্যায়ে আসার চেষ্টা চলছিল। রমাকান্তর মন বলছে হাতটা তাঁর সরিয়ে নিলে হত না—কিন্তু কিছুতেই হাত সড়াতে পারছিলেন না তিনি। এ জন্য মন নামক বস্তুটাই দায়ী--ওই যে বলা হল না, তাঁর মন যে এখনও ডাঁসা !

মণিকুন্তলা বলে চলেছে, মাঝে মাঝে এস রামু দা--পরিচিত জন তো ছুটে গেছে--এখন গুনে গেঁথে দু একজন লোক, তার মধ্যে তুমি ! 

অন্য সময় হলে ছুটে গেছে, কথাটা নিয়ে হয়ত রমাকান্ত নাড়াচাড়া করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু এটা সে বিশ্লেষণের সময় নয়। আসলে পুরুষ জাতির চরিত্র বলতে গেলে ঠুনকো জিনিস, নারীর আপ্যায়নে সে চরিত্র যেখানে সেখানে  নড়বড়িয়ে  যেতে পারে। এক্সেপসনাল ব্যাপার আলাদা। অন্তত রমাকান্তর ধরনা তাই। 

মণিকুন্তলার চোখদুটি চিকচিক করছে কেন, সিক্ত ? নাকি মায়া ছড়াচ্ছে ! সামান্য পিছবার চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু উপায় কোথায় ? পেছনে দেওয়াল। তবু কষ্টে মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো, আবার আসবো আমি। 

মনি হাত ধরে আছে বেশ কিছু সময় ধরে। আবেগের কথাগুলি তখনও চলছে। ঘরে ঢোকার পর থেকেই রমাকান্ত কেমন যেন আঁশটে একটা গন্ধ পাচ্ছিলেন, সে গন্ধটা সামলাতে কোনও পারফিউম ছিটানো হয়েছে হবে। সব মিলিয়ে সেখানেও সলিপ্ত একটা ভাবনা যেন ছড়িয়ে আছে। তিনি অন্তঃস্থল থেকে সজাগ হচ্ছিলেন। ভাবনাগুলি ধোঁয়াটে হয়ে আসছিল। তিনি জানেন এর পরেই আঁচ-তাপ আর তারপরেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ !

এই তো চার চোখ এক হয়েছে, সান্নিধ্য স্পর্শ উতলা হয়ে আসছে। পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানের নির্বাপণ তখন। আর ঠিক সন্ধিক্ষণে, রমাকান্তের দুর্ভাগ্য বা সুভাগ্য বলতে হবে, মনির দাদার কাষ্ঠ কণ্ঠের চীৎকার শোনা গেল--মনি, দরজা খোল্ ! 
দুটো মানুষ শারীরিক ভাবে চমকে উঠল। রমাকান্ত কিছু বলতে গেলেন, চুপ, বলে মণিকুন্তলা তাঁর মুখ চেপে ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল ঘরের পেছন দরজার কাছে আর সে দরজা খুলে রমাকান্তকে ধাক্কা দিয়ে দরজার বাইরে ঠেলে দিল। 

বাপরে, অনেক বাঁচা বেঁচে গেলেন রমাকান্ত। নতুবা এ বুড়ো বয়সের কেলেঙ্কারি ছ্যা, ছ্যা, নিজেকে সামলে নিয়ে হনহন করে বাজারের দিকে হাঁটা দিলেন। পয়সার অভাবে মাছ আর নেওয়া হল না। বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতে স্ত্রী যেন তৈরি ছিল, বলে উঠল, কি ব্যাপার, এত দেরী ? স্ত্রীর কোমরে কাপড় জড়ানো না থাকলেও মনে হয়েছিল কোমরের কাপড় কষাই আছে !

--ছোট মাছ আনো নি তো ? আমি মাছ কুটতে পারবো না ?
--না, আজ মাছ আনিনি। 
--কেন ? শৈলবালা জেরা করে উঠলো যেন। 
--ওই, ভাবলাম আজ মঙ্গলবার কি না ?
--আজ কি বার সেটাও ভুলে গেছ?
স্ত্রীর কথা গায়ে মাখতে নেই, রমাকান্ত ঝটপট হাতের ব্যাগ রেখে হাত পা ধুয়ে এলেন, স্ত্রী শান্ত হয়েছেন ভেবে সাহস ভরে স্ত্রীর আরও কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, কি গো একটু চা হবে ?
শৈলবালা নাক সিটকালো, পরক্ষণেই মেজাজ চড়িয়ে বলে উঠল, হয়েছে, আর আমার কাছ ঘেঁষো না, তোমার গা থেকে অমন গন্ধ আসছে কেন ?
রমাকান্ত ভয়ে সরে গিয়ে বলে উঠলেন--গন্ধ ?
--তোমার গায়ে চামেলি তেলের উগ্র গন্ধ কেন ? 
--হবে বাজার ঘোরা দেহ !
--কে জানে, কোন আদারে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াও !

সেদিন খুব বাঁচা বেঁচে গেলেন রমাকান্ত, আর একটু হলেই রমাকান্ত-মণিকুন্তলা সংবাদ, সারা বাজারে ঢোল পিটে যেত ! কি  অবস্থা যে হত--সে দিন নির্ঘাত সবকিছু লেটুস হয়ে যেত ! 

 
পরিচিতি 
    

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ