সাঈদা মিমি











পঞ্চম পর্ব 

সামছু কাকার ভাবনা 
চশমা দিয়াও দেখা যায় না মুখ? 
(এদিক ওদিক থেকে শোনা) 

অনেকদিন সামছু কাকার খবর নাই, স্বরূপকাঠি থেকে মোবারক এসেছিলো, জানালো, কাকা চশমা দিয়েও ভালো দেখতে পায় না। এরমধ্যে একদিন খুফু এসেছিলো সিন্ধি ছাগলের রূপ ধরে, আচুক্কা তাকে গুঁতো দেয়ার চেষ্টাও করেছে কিন্তু কবচের কারণে পারে নাই! আড়তে সিন্ধি ছাগল কোথা থেকে এলো তাও রহস্য! এদিকে কিরছু ফালাগের বিশেষ দূতেরা, মাওলানা দানেশ হিরতানী, ধর্মগুরু আদভান কৃষানু, পোপ মেলবার্তো হাইয়ান এবং রাব্বি খলফান বুহরান ও মহাথেরো তাইমাদুস ভান্তে অপেক্ষমান, খু ফু কে এবার পাকড়াও করতে হবে,  সামছু কাকা এবং ঈমাম সাহেব মিলে চার ধর্মের চার প্রধানের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু ইহুদি ধর্মগুরু পাওয়া যাচ্ছে না ।

-একি যন্তনা হইলো ঈমাম সাব? ইহুদি হুজুর পামু কই? 
-হেইয়া তো ব্যাডা মুইও ভাবতেয়াছি, একটা বুদ্ধি মাতায় আয় আয় হইররাও চইল্লা যাইতেয়াছে । 
-কি মুশকিল? উফায় করেন 
-চল দফার বাপের কাছে যাই, হ্যায় ভালো পরামিশ দেতে পারবে, শিক্ষিত মানু । ষোল চুঙ্গা বুদ্ধি আছে দফার বাপের, ব্রিটিশ আমলের মেট্রিক ফেল, সে নিজেই ইহুদি যাজক সাজতে প্রস্তুত, তৌরাতের কাহিনী জানে অল্পসল্প, কেবল একটা চান্দি ঢাকা সাইজের গোল টুপি লাগবে!  বৃদ্ধ মানুষের খায়েশ, খু ফু দানদানকে বন্দি দৃশ্য দেখতে তার উৎসাহ সবাইকে অতিক্রম করেছে । 
-টুফিডা কেমন হইবে ঈমাম সাব? সামছু কাকা প্রশ্ন করে। 
-একটা একমুডা সালুনের বাডির মত ল’, মোর একখান পুরান টুফি কাইড্ডা বানামুয়ানে, টিভিতে ইহুদি হুজুরগো টুফি মুই দেখছি। 
-কি কন! আম্নে টিভি দেহেন! 
-দুর ব্যাডা মাউরার পো, কিয়ের মদ্যে কি কতা শুরু হরছো?

পাঁচ ধর্মের জ্বিন ধর্মগুরুদের সঙ্গে পাঁচ মানব ধর্মগুরু বসবেন, আলোচনা ফাইনাল, রাব্বি হুজুরের ঘিয়ারঙা টুপিও তৈরি  কিন্তু অন্দরমহলে জোর গুজব রটেছে, দফার বাপ এই বুড়া বয়সে ইহুদি হয়ে গেছে! দফার মা মরেছে সেই কবে  দফা ক্ষিপ্ত  তার বৌ রণরঙ্গিনী মূর্তি ধারণ করে রসুইঘরের সামনে একটা দুই মাথাওয়ালা লাকড়ি হাতে দাঁড়িয়ে,  
-হেরে মুই ভাত দিমু না, মোর পাপ অইবে, সারা জেবন নমাজ কলাম পইরড়া এহন ধম্ম বদলাইছে? হুদি অইছে? 
-বুইরড়া মানু, খানা না দেলে তো মরবে, মুই ঈমাম সাইবের কাছে যাইতেয়াছি, একটা হিল্লা হইরাই আমু। 
-হেইয়াই যাও, হেরে আবার কলমা পড়াইয়া তোবা হরাও, আরেকবার খতনাও দেতে অইবে। 
-আ, ওয়া কও টও কি? আবার কাডার জাগা কোম্মে? 
-গোঁড়া গোনেই কাডো…. এত অশালীন সব কথা বলতে পারে এরা! বুড়ো মানুষটাকে নিয়ে সারা পাড়ায় তোলপাড় হচ্ছে । সকালে ঘরে খাবার মেলেনি তাই দফার বাপ ঈমাম সাহেবের হুজরায় অবস্থান নিয়েছে,  দফা যখন সেখানে এলো তার দফারফা করতে, দেখতে পেলো, ঈমাম সাব আর তার বৃদ্ধ বাবা একসাথে দুপুরের খানা খাচ্ছে, তার চোখ ছানাবড়া হলো ।

এইয়া আম্নে কি হরতেয়াছেন হুজুর? সারা গেরামে ঢোল পইরড়া গেছে, মোর বাপ ধম্ম বদলাইয়া হুদি অইছে! ঈমাম সাহেব হেসে ফেলেন, 
-আরে ব্যাডা হুদি অয় নাই, সে এইয়ার পার্ট হরবে। 
-পার্ট হরবে মানে? 
-খু ফু হালারে আটকাইতে অইবে না? কোহকাফ থে পাঁচজন ধম্মের লিডার আইছে, একজন আবার হুদি, মোগো গেরামে তো মোসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রেস্তান সবই আছে, হুদি নাই, তর বাপে তো হুদি ধম্মের কিছু কিছু জানে, হের লইগ্যা হেরে দিয়া হুদি রাব্বির রোল হরাইতেয়াছি । 
-রাব্বি কি? 
-হালার মুরুক্ষো, আলেমের ঘরের জালেম, রাব্বি হইলে হুদিগো হুজুর…. এতক্ষণে দফার মাথা পরিষ্কার হয়ে আসতে শুরু করে, হালার মাইয়ামানুষ কারে কয়, সকাল থেকে এইসব উদ্ভট বানানো কানকথা পাড়াময় রটিয়ে তার মাথা খারাপ করে দিয়েছে, কথা নাই বার্তা নাই তার বাপ ইহুদি হয়ে যাবে কেনো! 
-এহন বাড়ি যাইয়া বৌরে বুঝা আঁচলখাগি কোম্মেকার… ঈমাম সাহেব বলেন, আর শব্দ হরিস না, তেনারা ভরপেট মিস্টি খাইয়া বৈঠকখানায় ঘুমাইতেয়াছেন, দফা আরেকবার ভিড়মি খায় ।

রণাঙ্গন এখন শান্ত বরং দর্শক ব্যাকুল, না জানি কি হয়! কৃষ্ণপক্ষের অবশিষ্ট তিনদিন অতিক্রম হওয়ার পর ঈমাম সাহেবের খানকায়ে শরীফ আজ রাতে ভরপুর, মহিলাদের জন্য কাপড় টানিয়ে আলাদা ব্যাবস্থা করা হয়েছে । পুরো গ্রাম চাঁদা দিয়েছে এই আয়োজনের জন্যে, তেনাদের খানা, যত্নাদি হতে হবে উৎকৃষ্ঠ, আগুনের তৈরী জীব, ক্ষেপে গেলে রক্ষা নেই । পশ্চিম কোনায় সাদা পর্দা ঘেরা, তেনারা ওখানে মখমলের তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে আছেন, খাঁটি দুধের মধ্যে সামান্য চিনিগুড়া চাল মিশিয়ে তৈরি হয়েছে অমৃত সিন্নি, তাঁদের ভোগ, ঘ্রাণে সারাঘর উতলা, বাতি নিভে যাচ্ছে, একটামাত্র হারিকেন নিভু নিভু, আকস্মিক হ্যাজাকের আলো নিভে যাওয়ায় সবাই ভয়ে জবুথবু হয়ে আছে, উপায় নাই, জ্বিনেরা অহেতুক আলো সহ্য করতে পারে না । কর্যক্রম শুরু হতে চলেছে, তার আগে কোরাল মাছের ডিমের মতন গোল গোল কোহকাফি মিস্টি দেয়া হলো সবাইকে, বড়ই স্বাদ, আহা, আরেকটা যদি মিলতো! দফার বৌ ভাবে । সামনে একটা উঁচু গোল টেবিল, সেখানে একটা খোলা বোতল, খু ফুকে এর মধ্যেই প্রবেশ করতে বাধ্য হবে । ঈমাম সাহেব সুরা পাঠ করলেন, পণ্ডিতজি গম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণ শেষে একখণ্ড ধূপ ছুঁড়লেন আগুনের বৃত্তে, ভান্তে মশায় বুদ্ধবানী শেষ করতেই পাদ্রিসায়েব বাইবেল পাঠ করলেন, এবার রাব্বি দফার বাপের পালা, কোথা থেকে কি হয়ে গেলো বোঝা হয়ে উঠলো না, দফার বাপ সুর করে গেয়ে উঠলো, “ইয়া নবী সালামু আলাইকা… ইয়া রসুল সালামু আলাইকা.. ইয়া হাবিব…” , এইহেন তৌরাত পাঠ শুনে সামছু কাকা ধপ করে অজ্ঞান হয়ে পড়লো ঈমাম সাহেবের কোলে, তার পায়ে লেগে টেবিল উল্টে গেলো, বোতল ভাঙলো.. ঝনঝন.. চড়া পাওয়ারের চশমা ঘোলা হয়ে এলো তার, মনে হলো, দুদ্দাড় করে কিছু রাগি বাতাস এদিক ওদিক ছুটছে, কোন এক বুদ্ধিমান রসিক কালক্ষেপন না করে হ্যাজাক বাতিগুলি জ্বালিয়ে দিতে শুরু করলো।

কাসুরে তোর ছাওয়াল গেলে গোয়াল দেখবে কে? 
(কাসেমের মায়ের হাহাকার)
 কাসেম নিরীহ প্রকৃতির মানুষ, প্রথম বৌটা তার দোস্তের সাথে ভেগে যাওয়ার পর সে অনেক ভেবেছে, কি এমন দোষ ছিলো তার? ঐ বিটিকে পেয়ার মহব্বত সে তো অনেক করতো! বেশীদিন ভাবার অবসর মিললো না, ঘরে বুড়ি মা একা কেমনে সব সামাল দেবে? ক্ষেত খামারি নিয়ে কাসু সারাদিন ব্যাস্ত থাকে, সুতরাং দ্বিতীয় বিয়েটা সারতে হলো তড়িঘড়ি । বৌটা ভালো, আগের জনের মত বাঘা সুন্দরী নয়, উল্টো কালোকুলো, বেশ ভারী তেলতেলে শরীর, বড় মায়ার মুখ । কাসুর মা ও খুশি, সে গ্রাম্য মহিলাদের মত ঝগুড়ে না, বাড়ি বাড়ি গিয়ে বৌ ঝি দের গল্প নিয়েও বসে না, সে ভালো শিকা বানায়, নকশি কাঁথার কারিগর, সবাই তাকে পছন্দ করে, দুঃখের গোপন কথাটা এসে তাকে বলে যায়, কাসুর মা ও সবাইকে ভালোবাসে, একটু বেশি চুপচাপ, একমাত্র সন্তানের বৌটির জন্যেও তার বড় মায়া ।

হাসনু, কাসুর বৌ, গর্ভবতী, দাই বলেছে, জমজ হবে । আনন্দ উবলাচ্ছে, তবে কাসুদের বাড়ির একটু বর্ণনা দেয়া জরুরী, পাড়াগাঁয়ের ঘরগুলির বিন্যাস ছাড়াছাড়া, এই যেমন কাসুদের ভিটায় দুই পড়শী, কাসু আর তার জ্যাঠাতো ভাই, দুই ঘরের মাঝখানে ছোটখাটো একটা ফলপাকুরের বাগান, ডাকাত পড়লেও বোঝার উপায় নাই কার বাড়িতে কি ঘটছে । কাসুদের বাড়ির দক্ষিণে একটা ডুবো জমি অনেকটা দূরত্ব নিয়ে, শীতকাল বাদে সারাবছর পানিতে ডুবে থাকে, সেখানে পাট আর বোরো ধানের চাষ হয়, এই জমির পূব কোনায় প্রেতসিদ্ধ পুরুষ একুব মিয়ার কবর তার ভিটার অবহেলিতো কোনে, একুব মিয়া কালা যাদু করতো বলে মুসলিম গোরস্থানে তার কবর হয়নি । রাজ্যের জংলায় ভরা, কেউ ওখানে যায় না, কবরের ওপর দুইটা পৈশাচিক হিজল গাছ, যেখানে দিনের বেলায়ও তাকানো নিষেধ, আর সেখানেই হাসনুর চোখ সেখানে গেলো ভরসন্ধ্যায় ।

ওদিকে চোখ গেলো ক্যান হাসনুর? বেশ তো হাঁস মুরগীগুলোকে খোঁয়ারে ভরে, গাই আর গরুদের ছাবনা-খড় দিয়ে, কলপাড় থেকে হাত মুখ ধুয়ে, অজু সেরে ঘরে আসছিলো সে, দুইটা সিঁড়ি উঠেছেও, এমন সময় মনে হলো কেউ ফিসফিস করে ডাকে, তাকালো বামদিকে, একুব মিয়ার কবরের ঝোপে প্রেত হিজল দুইটা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে, ঝিলের জলে তাদের সন্ধ্যারঙ ছায়া, কিন্তু এটা কি? ছায়াগাছের মাথায় একটা বাতি জ্বলছে! এবার গাছদুটোর দিকে তাকায় হাসনু, মগডালে একটা হারিকেন বাতি জ্বলছে, ধীরে ধীরে সেটা নিভে আসছে, কেউ একজন চাবি ঘুরিয়ে কমিয়ে দিচ্ছে আলো! আবার জ্বলছে, কমছে, একসময় দপ করে জ্বলেই নিভে গেলো, হাসনু জ্ঞান হারিয়ে পড়লো সিঁড়ির ওপর ।

জমজ ছেলে হয়েছিলো কাসুর, একজন মারা গেলো দুইদিন পর, আরেকজন রইলো ধুকেটুকে । সেই ঘটনার পর অনেক তাবিজ-কবচ, ঝাড়ফুঁকের বন্যা গেছে হাসনুর ওপর দিয়ে, -ও বৌ, তর চউখ ওম্মে গেলে কা! সারা পাড়ায় হুনি, খু ফু জ্বিনে সুযোগ পাইলেই হগ্গলের খেতি হরতেয়াছে, তর প্যাডে ছাও, এহন শয়তানডায় ওইদিকে নজর দেবে…” হা হুতাশ করে যাচ্ছিলো বুড়ি । কত ওঁঝা, পীর, দোয়া, মিলাদ, একটাকে নিয়েই গেলো খু ফু দানদান । কাসুর মনটা খারাপ, সন্তানের কষ্টে তো বটেই কিন্তু প্রথম বিবি জুলেখার কথা সে ভুলতে পারে না, কি যে সুন্দরী ছিলো সে! বিয়ে করে নিয়ে এলো পালকিতে, নিজে হেঁটে হেঁটে, একটা পা ছোট তার, খুঁড়িয়ে হাঁটে তবুও পালকিতে চড়লো না, এত রূপবতী কন্যার পাশে বসতে তার সংকোচ হচ্ছিলো, যেন জুলেখা একদলা মাখন, তার খসখসে চামড়ার ঘষা খেলে গলে যাবে । বৌ বরণ করতে একটা বড় পিড়ি আনা হলো, সেখানে দাঁড় করানো হলো দুইজনকে, ধান দূর্বা দিয়ে বরণ করা হলো জুলেখা কে, এবার গৃহপ্রবেশের পালা, পিঁড়ি থেকে নামতে গিয়েই বিপত্তি, খাঁটো পা বেকায়দায় নীচে পড়তেই ধড়াম করে কাসু পড়লো জুলেখার পায়ের ওপর, হা হা করে হেসে উঠলো উপস্থিত নারীপুরুষ, -ওরে কাসু বিলাই তর বৌ ই আগে মারলে….

ও কাসু, হাফেজ সাবেরে বোলা শিগগির, কাসুর মা তড়পাতে তড়পাতে ঘরে ঢোকেন, বোঝেন সবই, ছেলে জুলেখার জন্য পাগল, হাসনু তার মন পায়নি কিন্তু তার নাতি, তার বংশের বাতিকে বাঁচাতে হবে, খু ফু দেউয়ের বদনজর আছে ওর দিকে, বাচ্চাটার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, ক্ষণে ক্ষণে নীল হয়ে উঠছে শরীর, আবার কালচে । কাসু ক্ষেতের মরিচ তুলছিলো, সব ফেলে দৌঁড়ালো, তার ছাওয়াল মরলে মুখে মাটি দেবে কে? একজন গেছে, আরেকজনের মৃতদেহের বোঝা সে বইতে পারবে না । হাফেজ সাহেব পবিত্র জল দিয়ে গোসল করালো বাচ্চাটাকে, ঝাড়লো, তাবিজ দিলো, যাওয়ার আগে বলে গেলো, এই শিশু বাঁচবে না, অনেক দেরি হইয়া গেছে, নিঃশ্বাসের লগে তার বুক দাইব্বা যাইতেয়াছে, খু ফু এর দেহে প্রেবেশ করে রক্তমাংস চুইষ্ষা নেতেয়াছে… কোকা কবিরাজের কাছে ছুটলো কাসু, কবিরাজ এসেই বললো, গঞ্জের হাসপাতালে লইয়া যা, পোলার বুক ভরা পানি, ছেলেকে বুকে চেপে হাসপাতালে ছুটলো স্বামী-স্ত্রী, জায়নামাজে পড়ে রইলো কাসুর মা । যেদিন ফিরলো হাসনু, ছেলের বয়স পাক্কা একমাস দশদিন, মারাত্মক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলো বাচ্চাটা, যদিও এখন সে সুস্থ কিন্তু সবসময় তার দিকে রাখতে হবে বিশেষ দৃষ্টি। পরদিনই ঘরে মিলাদ দিলো কাসুর মা আর দক্ষিণ ঝিলের ধারে কদম গাছের নীচু ডালে ঝোলালো একটা লেবু, খু ফু দেউ আর নজর দিতে পারবে না। লেবুর ঘাটতি নেই, বাগানে অনেক আছে।

দেলার বাপে কয়, জন্মিলে মরিতে হইবে 
ইহাই সত্য, হয়! 
(দেলার বাপের বর্তমান) 

ঘাটশ্রমিক দেলার বাপ, সেই জৌলুস তার নেই তবে কাজে যেতে পারে এখন, যদিও মালিকের ডানহাত আর নেই সে, ঢিলেঢালা শরীর নিয়ে কম ওজনদার, খুচরো কাজ করে,  ভারী কিছু বওয়ার শক্তি নেই, তাই বলে ধরে নেয়া ভুল হবে দেলার বাপের খাসলত বদলেছে, অসুখে ভোগার দিনগুলি ছিলো আলাদা, এখন নিয়মিতই শুঁড়িখানায় যায় সে, নিতাই নন্দীর আড়তের পিছনে এই আখড়া, সবাই জানে, পুলিশও জানে কিন্তু পুলিশী ঘেরাও পড়ে না এখানে, নিয়মিত চাঁদা পায় তারা, আর কখনও যদি বড়কর্তা দলবল নিয়ে এসেই পড়েন, কোন কিছুই দেখতে পান না তারা চালের বস্তা ছাড়া! এই কুপির আলো ঘেরা ঘরটায় ভাত পচা চোলাই, ধামসা নয়তো শুটকো নারীদের আনাগোনা, জুয়ার চাক্কি, বিড়ি-মদ আর ঘামের মিশেল দেয়া উৎকট গন্ধ ।

ঘরে মারধরটা লেগেই আছে, নিম্নাঙ্গ অনাবৃত, কঞ্চি হাতে দেলার বাপ, সেদিন বেতো মহিলার আর সহ্য হলো না, স্বামীরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো তারপর উল্টা মাইর, মহাপিটুনিতে হাত লাগালো দেলাও । মোরে মাইররা হালাইলে বলে দৌড় লাগালো দেলার বাপ, মুন্সিবাড়ির বাঁশঝাঁড় পার হওয়ার মুখেই এক বিশাল কুয়াশা চিৎ করে ফেললো তাকে, কুয়াশার মধ্যে এ কোন মুখ! সেই নুরাণী সুরত কই? রামছাগলের মত চোপা ভাঙা চেহারা, নাদুসনুদুস সেই শিংগুলি বিকট ধরনের ত্যাঁড়াব্যাকা হয়ে মুঁচড়ে নেমে এসেছে দুই পাশে, একটা ভাঙা শ্ব-দন্ত দেখা যাচ্ছে, 
-তোর গলার রগ কাটমু 
-না হুজুর, মুই কি হরছি? 
-আমারে ধরতে তুই সামছু মিয়ার লগে যোগ দিছো? 
-না হুজুর, মুই আমনের পক্ষে…… বাংলা সিনেমার একটা ভিলেনি হাসি দিয়ে মুখটা নেমে আসতে থাকে, পরক্ষণেই সরে যায় বিদ্যুত ঝলসানোর মত, হইলেডা কি! মনে পড়লো, কবচ আছে সঙ্গে । 

দেলার বাপ এখন খুব ভয়ে ভয়ে থাকে, একদিকে খু ফু’র ভয়, আরেকদিকে দেলার মা আর দেলা, ওরে কি মাইরডাই না দেলে হেইদিন! বাইত্যা মাগীর গতরে এমুন জোর আইলে কেম্মে? দেলার বাপ ভাবে, তার এখন অশক্ত দেহ, এতসব সয়? মরতে তো হবেই, বড় ভয় লাগে কিন্তু ওটাই সত্য, মেদা পীরবাবার দরগায় সেদিন গান হচ্ছিলো, ‘জন্মিলে মরিতে হইবে, অমর কোথায় কে রবে…’ সত্য… সত্য… এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে এক ভদ্রলোকের মালপত্র লঞ্চ থেকে নামাচ্ছিলো সে, সর্দার থেকে নগণ্য কুলি হয়েছে আজ? এইসব চিন্তা কিংবা ঘৃণাও আসছিলো, মাথায় দুইটা সুটকেস, দুই বাহুতে দুইটা ট্রাভেল ব্যাগ, পা হড়কে একটা সুটকেস পড়লো লোহার জেটিতে, তেড়ে এলো ভদ্রলোক মুখোশ খসিয়ে, একটা চড় বসিয়ে দিলো সপাটে ।

-নিতাই’দা, আইজ মুই বাড়তে যামু না, এহানেই ঘুমামু 
-কও কি ব্যাডা? এইয়া কি ঘরদুয়ার? 
-সমেস্যা অইবে না, হোগলার পাডিতে হুইয়া থাকমু 
-তর শরীল ঠিক আছে আয়? দেলার বাপের গাল জ্বলে ওঠে, থাপ্পরটা তার সহ্য হয়নি, মালপত্র ওখানেই ফেলে দুইদলা থুতু মেরে চলে এসেছে সে, তারপর থেকে নিতাইয়ের আড়তে, পকেট শূন্য, কেঁদেছেও, নিজের গরীবি কে অভিসম্পাত করেছে, নিতাই তাকে রাতের খাবার খাইয়েছে, বিনে পয়সায় ধেনো মদ, জিজ্ঞেস করেনি কিছু কিন্তু পুড়ছে দেলার বাপের রোষ । অন্ধকার চারদেয়ালের মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে আছে দেলার বাপ, দুইটা ঘুলঘুলি থেকে সামান্য আলো আসছে, জ্বলছে পরদাদার আমলের ফ্যানের বাতা,স এমন সময় বিড়ালটার দিকে চোখ পড়লো তার, হাঁটছে সিলিংয়ের ওপর! পিঠ নিচের দিকে, পা কড়িকাঠে! কিভাবে সম্ভব? ঝট করে উঠে বসলো সে, নেশা কেটে গেছে, দরজা খুলতে পারছে না, বাইরে থেকে তালা মারা, আবারও সিলিংয়ের দিকে তাকালো সে, নেই, কিছুই নেই, একটা ঘটরমটর শব্দ তোলা ফ্যান আর কয়েকটা টিকটিকি ছাড়া ।

বাসায় ফিরে ঘরে রাখা পচা পান্তা খেয়ে মরার মত ঘুমালো দেলার বাপ, মরার মতই, সারাদিন, বিকেল, সন্ধ্যা, রাতে তার অসুরের মত খিদে পেলো, কিন্তু ঘরে পুঁই পাতা আর মিস্টি কুমড়ার চচ্চড়ি, ডাল আর বোরো চালের গুয়ো গুয়ো গন্ধ ভাত, তার মন চাইছিলো বিরিয়ানী খেতে, আহা, সুখলালের কাচ্চি! কিন্তু বৌ, মেয়ে যদি আবার মারে, তাই চুপ হয়ে থাকলো । 
-খাইতে আও না কা? আছালা কোম্মে সারারাইত? 
-নিতাই দার বাড়তে… মিথ্যেই বললো, সত্যটা বললো তুলা মিয়া কে, 
-বাজান, হে তো তোমার পিছনে জুইত মতই লাগজে, তুমি মাল খাওয়া ছাড়ো, মোর লগে মজজিদে যাবা রোজ 
-হয়, ঠিকই কইছো, ছাইড়া দিমু বাপ, কাইল চোপাড়ডা খাইয়া মাতার ঠিক আছেলে না 
-সামছু কাহারে সব জানাইতে অইবে 
-হেইয়া জানামুয়ানে, এহন মোরে এক প্যাকেট বিড়ি আইন্না দেতে পারবি? পকেট মোর খালি । 
রাতের স্বপ্নে খু ফু দানদানের আগমন, পান খেয়ে ফিচিক করে রস মারলো তার শরীরে—
-আমারে ছাইড়া সামছুরে ধরছো? ‘দেখামুয়ানে হাইঞ্জার কালে ইনরেজের পুত মকা, তোর খসবে তাবিজ হাতখান টেনে নিবে টেরাকের চাকা…’ চিৎকার করে উঠে বসে দেলার বাপ, তুলা মিয়া ঝাড়ফুঁক করে তাকে, মদ না খাওয়ার প্রতিজ্ঞা নেয় আবার, কিন্তু পুনশ্চ দেলার বাপকে দেখা যায়, গুটি গুটি পায়ে হেঁটে চলছে নিতাই নন্দীর আড়তের দিকে ।

চুন্নু মিয়ার সঙ্গোপন 
জ্বিন তাড়াবে বিড়ির আগুণ 
(চুন্নু বাবুর্চির কাছ থেকে যা জেনেছিলাম)

চোন্না মিয়ার খাবার দেখলেই ছোকছোক করার অভ্যেস, প্রতিটা পাতিলের ঢাকনা খুলে খাবার চাখবে আর এটো করবে সব, ব্যাপারটা যেদিন ধরা পড়লো নয়াদাদীর চোখে, হুলুস্থুল পড়ে গেলো বাড়িতে, দাদি চোন্নাকে খেদাবেই, দাদাজানের কাঁকুতির কাছে হার মানলেন, শর্ত হলো, রান্না শেষে চোন্না রসুইয়ে একমুহূর্ত থাকতে পারবে না, রান্নার সময় কাজের লোক দুইজনই থাকবে রান্নাঘরে আর থাকবে বড় আর মেজ বৌ, কাজ শেষে তারা রসুই পরিষ্কার করে তালা মেরে বের হয়ে আসবে, খাবার আগেই ঘর খোলা হবে । বেশ এবার বলি চোন্না কে? আমাদের বাবুর্চি, চুরি করে খাওয়ার অপরাধে তার নাম চুন্নু থেকে চোন্না হয়ে গেছে ।

চুন্নু দাদার (আমি তো দাদাই বলবো নাকি? সে যখন আমাদের বাড়িতে এসেছিলো, তখন আমার জন্মের নামগন্ধও নেই) মহা বিপদ, সে আর চুরি করে খেতে পারছে না, এমন নয় যে তাকে খালিপেটে থাকতে হয়, প্রয়োজনের বেশি খাবার তাকে টালমাটাল করে রাখে কিন্তু ওই যে, চুরিটা করাই হচ্ছে না! আহা, কি সোয়াদ চুরি করে খেতে! এই চোন্না, তুই চুরি করে খাস কেন? কাকিমা প্রশ্ন করেন…. আর কইয়েন না ভাবিছাব, খাসলত, শনিবার আর বিষ্যুতবার চুরি হইররা খাইলে বাতের ব্যামো সাইররা যায়…. এই কথার কি জবাব হয়? কাকিমা লা-জবাব হয়ে উনুনের পাশে একটা টুলে বসে থাকেন । চুরি করতে না পেরে চোন্না দাদার অবস্থা হাঁসফাঁস, একদিন ডালের পাতিলে মা আবিষ্কার করলেন, একটা সুদৃশ্য তেলাপোকা ভাসছে! আরেকদফা সোরগোল, এইটা কি চোন্না? দাদি তেড়ে আসেন……. ‘ওয়া উরাস… উরাস বের করছি তর, শয়তানি? ডাইল নালায় ঢাল জলদি….. হ্যাকা আম্মা, পয়সার কেনা জিনিস, এই বলে ডাল থেকে তেলাপোকাটা ফেলে ডালটা সুরুত সুরুত করে খেয়ে নেয় সে, একটি প্রকাশ্য ডাকাতি জাতীয় অভিনব চুরি ।

আমার বর্তমানে আসা যাক, চুন্নু দাদা তখন বুড়ো, তার সংসার ছিলো, সন্তান ছিলো না, গিন্নী প্রভুর প্রিয় হয়ে যাওয়ার পর দাদা একা হয়ে গেলেন । সারাজীবন এই পরিবারে কাজ করে গেছেন, কেউ তাকে ফেলে দিলো না, আমাদের বৈঠকখানায় সে ঘুমাতো আর যখন যার ঘরে মন চায় খেতো, সে বুড়ো হয়েছে, কাজ করার শক্তি নেই তবুও কারো ঘরের টুকটাক বাজার সদাই করে দিতো । বিড়ি ফুঁকতো অবিরাম, রোজা রেখেও! 
-ও দাদা বিড়ি খেলে রোজা ভেঙে যায়, জানো না? 
-বেশি জানো? বিড়িতে কি আছে? ধুমা, (ধোঁয়া) গলা দিয়ে ঢুইক্কাই নাক দিয়া বাইরইয়া যায়, স্টেমাকে যায় না, রোজা ভাঙবে কেমনে! মহা যুক্তির কথা কিন্তু স্টেমাক কি জিনিস? আজকেই লজিং স্যার কে জিজ্ঞেস করতে হবে ।

মুই একখান জামা বানামু, কোচে কালার, চডি পেলেড…….. চুন্নু দাদার এই কথা শুনে আমি মহাচিন্তায় পড়ে যাই, 
-এর মানে কি দাদা? 
-হেইয়া বুজবি কা? কউচ্চা রঙ আর জামার কলার হইবে কড়া মাড়ের বহরম(বখরম) দেওয়া । 
-ও বুজছি, বানাইয়া ফেলো 
-টাহা দেবে কেডা, তুই? 
-আমি পামু কই? আব্বারে বলবো । কিছুক্ষণ চুপচাপ, এই ঝিম মারা দুপুরে সবাই যখন আয়েসি ঘুমে ,আমি দাদার সঙ্গে গল্প করতে এসেছি, দাদা একটা পুরোনো জামা সেলাই করছিলো, চোখে আধাভাঙ্গা একটা চশমা, একটা ডাণ্ডা নেই, মোটা সুতা দিয়ে কানের সঙে বাঁধা । ও দাদা, তুমি চুরি করে খাবার খাইতা কেন? দাদায় ক্ষেপে উঠতে গিয়ে বিষন্ন হয়ে পড়ে, হেইয়া কি মুই হরতাম? মোরে দিয়া খু ফু হালায় করাইতে । এবার আমার চমকে ওঠার পালা, তুমি খু ফু’রে চিনতা! হয় হালার ছোঁচা (লোভি) দেউ, চোরের একশেষ ।

দাদায়ও খু ফু’কে চিনতো,
- আচ্ছা কেমন ছিলো সে দেখতে? 
-এক্কেরে বিলোইর (বিড়াল) নাহান, আমারে কইতে, মাছের বড় পেডিডা দে, মাংস দিবি হাড্ডিছাড়া, ঘোনো ডাইল চাই, দুধ খামু সর হুদ্দা, মুই কি খাইতাম? মোরে দিয়া খুফু চুরি হরাইয়া নিজেই খাইতে, একদিন মুইও কইয়া দেলাম, তুই একটা ছোঁচা বিলোই, তোরে মুই ধইররা কিলোই……. ভুতের পো মোরে দেলে খামচি আর মুইও ধরলাম বিড়ি । 
-কই বিড়ি আর কোথায় দেউ! তোমার মাথা পুরাই গেছে দাদা 
-অই লেটকি, তুই কি বুজবি? জ্বিনেরা বিড়ি সিগারেটের আগুন ভয় পায়, শুয়ারডায় এহনও মোরে জ্বালাইতে আয়, টের পাইলেই মুই বিড়ি ধরাই…………

আবারও রূপচান মামু খাইলো আছাড় 
একি তামাশার জাল? বেচারা নাচার… 
(আমার প্যাঁচাল )

রূপচান মামু আপাতত আমাদের বাসায় থাকছেন, আমরা আনন্দিত কিন্তু মামুর মনে সুখ নাই, সে পরাধীন, যতক্ষণ আব্বা বাসায় থাকেন তার পড়ার টেবিল থেকে ওঠা নিষেধ, ছয়টায় তাকে ঘুম থেকে উঠে আব্বার সঙ্গে জগিংয়ে যেতে হয়, তার চাকরিও আব্বার অফিসে এখন, অর্থাত সারাক্ষণ নজরবন্দী, সিনেমা দেখা বন্ধ, বিকেলে একটু ঘোরাফেরার টাইম দেয়া হয় কিন্তু সন্ধ্যা হলেই ঘর, নামাজ বাধ্যতামূলক, এরপর পড়তে বসা । তার দেহের তিনটি জায়গায় চৌকো সাইজ মাদুলি ঝুলে আছে, কোমরে, ডান হাতে আর গলায়, একজন জ্বিন কে দেখে ফেলার অপরাধে তার এই শাস্তি । কাহিনী একটু পরেই বলছি, মামুর আটকদশা বয়ান করি, সে স্বেচ্ছাবন্দী একপ্রকার, কেননা সেই ঘটনার বয়ান প্রকাশিত হওয়ার পর জামান ওরফে খুফু তার ওপর ক্ষিপ্ত, মামু পেটপাতলা মানুষ, সবাইকে বলে বেড়িয়েছে, তারপর হোস্টেলের ভাঙ্গা টাট্টিখানায় আটকা পড়লো একরাতে, কি বেগ চাপলো! কি কুক্ষণে গেলো রাত দুটোর সময়! কে যে ডাঁসা তুলে দিলো বাইরে থেকে? সারারাত ওখানে, পরদিন উৎকট গন্ধের মধ্যে তাকে খুঁজে পেলো চাপরাশি।

সেই থেকে রূপচান মামু আমাদের বাসায়, মা ভীতু মানুষ, বাড়াবাড়ি ধরনের ভীতু, ঘরের কোথাও কোন শব্দ হলে তার মনে হয় বিকট শব্দে কিছু ভেঙে আমরা আহত হয়েছি, এটা তার রোগ, আমরা বড় হতে হতে দুষ্টামির মাত্রা কমিয়ে দিয়েছি কারণ, মা কে আমরা অতিরিক্ত ভালোবাসি । আবার মা তার আদরের ভাইটিকে নিয়ে উৎকন্ঠায় ভোগেন, এটা মামু জানে, সুযোগ নেয় ষোলআনা । মামু খবিস প্রকৃতির, দুদিন অন্তর অন্তর স্নান করে, জোর করে করানো হয়, আব্বা পুকুরঘাটে তাকে টেনে নিয়ে ঘাড় ধরে ফেলেন পানিতে, যেভাবে আমাদের কুকুর হিপ্ পো কে ফেলা হয়, সেভাবেই, পার্থক্য বলো হিপ্ পো কে আব্বা ডলে স্নান করিয়ে দেন  মামুকে নিজেই ঘষামাজা করে স্নান করে । এই পুকুরঘাটেই ঘটলো ঘটনা, মামু সন্ধ্যায় অজু করতে বসে দেখলো, একটা নীলাভ শরীর দক্ষিণ পশ্চিম কোনে উড়ে যাচ্ছে, আগুনের আভা ছিটকে পড়ছে আর লাল টুকটুকে একটা লেজ তার পিছনে!  বিকট চিৎকার দিয়ে সে পড়লো দাওয়ায়, পরদিনই প্রথম কবচ বাঁধা হলো তার ডান বাজুতে ।

এক তাবিজে চলছিলো বেশ, আব্বার অত্যাচার, মায়ের অনাচার, আমাদের কাউমাউ সহ্য করে মামু দিব্যি টিকে গেলেন । হায় প্রভু, মনে পড়লে এখনও গা গুলিয়ে ওঠে, খবিশ মামুর তার দুই পা পড়েছিলো গুয়ের চারিতে, তখন দিনকাল অন্যরকম, সেনেটারী টয়লেটের প্রচলন তেমন হয়নি, সাবান- সোডা- ডেটল দিয়ে গোসল করিয়ে ঘরে তোলা হলো তাকে কিন্তু সাতদিনেরও বেশি সময় তিনি ঠিকমত কিছু খেতে পারলেন না । যাক মামুর তাহলে ঘেন্না আছে? তাছাড়া মামু এখন রাত জেগে পড়ে, কি পড়ে? সে আমি জানি না কিন্তু পড়ে, তাকে দেয়া হয়েছে আব্বা মার পাশের কামরা, আর আমিও তখন নেহায়েত বালিকা, বাবা মায়ের সাথেই ঘুমাই, এক রাতে মামুর পুনরায় বিকট চিৎকার: আফাআ… দুলাবাই… কে যেন আহে! মাগো রে… আমারে খাইবো… আমরা দৌড়াই তার কামরায় -কে আসে? কে খাবে? ঘরে ঢুকে দেখি, মামু কাঁপছে, চোখ বন্ধ ।- কে আইছে? মা প্রশ্ন করে মামু পূবের জানালা দেখিয়ে দেয়, -কই, কিছু তো নাই! আছে, কালো পানির পুকুর, অসংখ্য গাছের কালশিটে ছায়া আর কিছু ছিলো না তো! মামু বলে, ছিলো, একটা পাঁচ মানুষ সমান লম্বা সফেদ দেউ, পুকুর পাড় দিয়া আসতেছিলো, চেহারা দেহি নাই, যমদূতের মতন, আব্বা দুইটা খেজি মেরে চলে গেলেন, মা আর আমি রইলাম মামুর সাথে । পরদিন তাগায় বেঁধে দ্বিতীয় তাবিজ ঝোলানো হলো মামুর কোমরে ।

একি অত্যাচার? আমার ভয় লাগে, আরো ভাইবোনেরা আছে আমার, খু ফু যদি ওদের কোন ক্ষতি করে? আমাকে যদি উড়িয়ে নিয়ে যায়! মামুর সঙ্গ এখন ভালো লাগে না, দুষ্ট লোক, একটা পাজি জ্বিন কে হায়ার করে এনেছে, আমরা ক্রমশ মামু কে এড়াতে শুরু করলাম, তাতে তার সুবিধা হলো এন্তার, মায়ের দেয়া পয়সা থেকে আমাদের ভাগ দিতে হয় না, নিজেই সব উড়ায়,  সেইসব করতে যেয়েই পুরোনো স্বভাবের কাছে ফিরলো সে, ঘরে বসে লুকিয়ে গাঁজা খেলো দুই দিন, তিন দিনের দিন লাপাত্তা, রাত বাড়ছে, মা ঘর উঠান করছেন, আব্বা সমানে খিস্তি চালিয়ে যাচ্ছেন, মরুক শালায়.. খবরদার অরে কেউ ভাত দিবি না… এই ঘরে অর দানা পানি শেষ । 

মামু কে আলগি দিয়ে বাসায় নিয়ে এসেছে দয়াল কাকা আর নাসির পাটোয়ারি, গাঁজা খেয়ে আজও পড়ে ছিলো শংকর মঠের পিছনে, শোনা কথা, উপস্থিত অনেকেই নাকি অদৃশ্য কারো সাথে তাকে তর্ক করতে দেখেছে, কাহিনী কি? জানা গেলো মামুর মুখে,ই পাবলিক টয়লেটের কাছে ছিলো সে, এমন সময় দেখে একটা গোখরা তার চারপাশে সোজা হাঁটে, তখনি কাহিনী বুঝে গেলো মামু,  সাপ হাঁটে আঁকাবাঁকা আর জ্বিন সাপ হাঁটে সিধা, তড়াক করে উঠে বসলো মামু, 
-আমার চাইরপাশে হাঁটো কা? পারলে কাছে আয় 
-তাগা খোল অশ্বের ডিম, বড় বড় কথা বাদ মে… এইরকম চলছিলো, এমন সময় কে বা কারা তাকে চ্যাংদোলা করে বাসায় নিয়ে এসেছে । ঘটনা শুনে আব্বার মাথায় রক্ত চড়ে গেলো, মামুকে সে দিলো মাইর, অনেক কষ্টে মা থামালেন তাকে, আমার বাপ মরা ভাইটারে কি আপনে মাইরা ফালাইবেন? থাকুম না আপনের লগে, পোলাপান নিয়া যামু গা, আমরা বরিশালের স্থানীয় না হওয়ায় আমাদের ভাষার ওঠানামা একটু আলাদা । আব্বা গজর গজর করে থামলেন, স্ত্রী চলে যাবে বাক্যটায় তার ভীতি আছে,  পরদিন মামুর গলায় ঝোলানো হলো রূপার চেইন সহ তাবিজ ।

বড়দা স্থানীয় শুদ্ধ ধর্ম পরিষদের সদস্য, সে মামুর এই গাঁজাখুরী গল্প মানতে নারাজ, নিশ্চই কোন কু-পরিকল্পনা মামুর আছে, বড়’দার বিশ্বাস । বড় দা যাই বলুক, মামু এখন শান্ত, সারাদিন পড়ালেখা করে, খায়, ঘুমায়, নামাজ পড়ে, বাবার অফিসে খানা নিয়ে যায়, তার মুখে হাসি কম এবং চোর চোর ভাব বেশি থাকে! হয়তো এবার সে বি এ পাশ দিয়েই ছাড়বে!

এইটা ছিলো আখড়া আমার 
রে পাগলের ঝাঁড়, একটা কইরা খেদাই 
দিমু, বুঝবি খু ফু’র মাইর 
(খুফু দানদানের কল্পিত জার্ণাল) 

সময় তালুকদারের পোড়া বাড়িটায় আমার দীর্ঘ দিনের আখড়া, একটু শান্তির সাথে বসবাসের জন্য আমি এখনে আসি, জংলায় ছাওয়া সাপের রাজ্য, দিনে দুপুরেই কেউ এখানে আসে না, অথচ কি কৌশল করে এই ভিটা বেঁচে দিলো সময় হারামজাদা? খোঁজ লাগাতে হয়, বেশ অনেকদিন আমি শরীর ও মনে সুস্থ নেই, কোহকাফি দের সহায়তায় সামছু হারামজাদা আমাকে আটকে ফেলেছিলো প্রায়, কিন্তু দফার বাপের ভুল মন্ত্রে সব বাণ কেটে যাওয়ায় আমি মুক্ত হয়ে ছুটে আসি এখানে, আর এই ভিটাই কিনা বিক্রী হয়ে গেছে! দেখাইতেছি আমার কেরামতি, সময় তালুকদার ইন্তেজার কর ।

ম্যাদ মাছের মতন চেহারা করে বসে থাকে বুইড়া তালুকদার, যেন কিছুই বুঝে না সে, এই পোঁড়ো বাড়ি বেচলো কেমনে? বেঁচেছে এক কুঠিয়ালের কাছে, সে সব জেনেই এই ভূতনিবাস কিনেছে, শুরুতেই স্বরূপ দেখাতে হবে, নইলে সমূহ বিপদ, নমুনা বলি, যে বাড়িতে পশুপাখিও প্রবেশ করে না সেইবাড়িতে একদল হুজুর এলো, চারপাশের সীমানা ঘিরে দোয়া পাঠপূর্বক পিলার তৈরি করলো, পরদিন এলো দুই সিদ্ধপুরুষ জময তান্ত্রিক, তারা মন্ত্রপাঠ করে আরেক পরত বাড়ি বন্ধক দিলো, তারপরদিন এলো দুইজন পাদ্রি, তারা পবিত্র জল ছিটিয়ে কিসব পড়লো, তার পরের দিন এলো একদল সাপুড়ে, দূর্ধর্ষ দক্ষতার সাথে সব সাপ ধরে নিয়ে গেলো, এরপর বুলডোজার এসে আমার বুকের ওপর চাকা তুলে দিলো, দুইদিনে জঙ্গল শেষ, বাড়ি ফকফকা! তারপরেই আনাগোনা শুরু হলো বদ পোলাপানের, তারা এখানে ফুটবল খেলা শুরু করলো, আর সহ্য করা যায় না, আমি কাকড়া বিছে সেজে একজনকে কামড়ালাম, সবাই চটকে দেয়ার জন্য আমাকে খুঁজলো, আমি গা ঢাকা দিলাম ।

বাড়ির উত্তরমুখে একথোক সুপারি গাছ আছে, দুইটা আম গাছ, একটা ল্যাংড়া, আরেকটা ফজলি, তিনটা কাঠাল গাছ, এগুলো কাটা পড়লো না, কিন্তু তরুণ পাকুড় গাছটা কেটে ফেলা হয়েছে, ওখানেই আমি বিশ্রাম নিতাম, আপাতত ফজলি আম গাছটায় আখড়া গেঁড়েছি, কিন্তু কয়েকদিন পলাতক থাকতে হবে, কাঁকড়া বিছে হয়ে একটা ছেলেকে কামড়ে আধামরা করার পর, সব হুজুর আর তান্ত্রিকেরা পালাক্রমে সারাবাড়িতে ঝাড়ফুঁক অভিযান চালাচ্ছে, ধরা পড়ার সমুহ সম্ভবনা, তাই পালাচ্ছি সামছু মিয়ার আড়তের গুহায়, ভারী মজার ব্যাপার, সামছু মিয়া আর তার ভাই জানেও না তাদের আড়তের নীচে একটা ভূতল ঘর এবং সুড়ঙ্গ আছে, আগে এই আড়ত ছিলো নাজিম বহুরূপির, হালায় দিনের আলোতে ছিলো আড়তদার, রাইতে সোনা রূপার চোরাকারবারী, পুলিশ আসলে বহুরূপি কে পেতো না, সে এই সুড়ঙ্গ দিয়ে পালাতো । একবার ধরা খেলো, জেলে ঢোকার আগেই ভাব ধরলো হার্ট অ্যাটাকের, ওপরওয়ালার লীলা বোঝা দায়, কল্পিত অ্যাটাক সত্যি হয়ে গেলো ।

সামছু মিয়ারে জ্বালা দিয়া আমার বড়ই সুখ হয়, সেই আমার কথা বলে বেড়িয়েছে প্রথমে, না বললে মোহর তারে আমি দিতাম, দূর্গাসাগরে লুকিয়ে রেখেছি মহামান্য কেদার রায়ের মোহরের ঘটি । আজ রাতে সামছু মিয়া কে ত্যাক্ত করবো, নাজিম বহুরূপি কে আমি সহযোগিতা করতাম, ঐ ব্যাটা নিজেই ছিলো নাপাক মানুষ, আমি তার ছায়া দোস্ত কিন্তু সত্যিই মরলো অভিনয়ের হার্ট এ্যাটাক দেখাতে যেয়ে, আমিও এই তলঘরের মালিক হয়ে গেলাম, আর বহুরূপির পোলাগো কাছ থেকে আড়ত কিনলো কুতুবি বদমাইশটায় । যাই, সামছু মিয়ারে একটু ভয় দেখাইয়া আসি, আড়তের পিছনের পায়খানায় আসছে সে, হাতে পিতলের বদনা, এমন সময় তার ঘাড়ের উপর পড়লাম আমি একটা উড়চুঙ্গা (একধরনের পোকা, মাটির নীচে থাকে, গরমের সময় বের হয়ে আসে) সেজে, সঙ্গে মারকাটারি গোস্ত তুলে নেয়া কামড়--, বাবা গো, বলে ছুটলো সামছু মিয়া, যা হওয়ার লুঙ্গির মধ্যেই হয়ে গেলো তার।

আসতেয়াছি সামছু মিয়া, আগে আমার আখড়ার খোঁজখবর নিয়ে আসি, তারপর তোরে আরও জ্বালাবো, আমার গুপ্ত জীবন প্রকাশ করেছিস, আবার আমাকে বন্দি করতে যত যা করার করছিস? আমি তো এখন বাকিংহাম প্যালেসে বেশিরভাগ সময় থাকি, আরামের ঘাটতি নেই কিন্তু তোরা যজ্ঞ শুরু করলে না এসে থাকতে পারি না, শালা গজনফর কুতুবি, তোর রক্ত আমার দেহে মিশে আছে বলেই আজ আমার এই অবস্থা, তোরই ফুপুর দাদী  মেঘলীলা আমার মা ছিলো! এইসব ভাবতে ভাবতেই আখড়ায় যাই, এ কি? ইতিমধ্যে একতলা উঠে গেছে, এখানে দুইতলার কাজ চলছে, ওরে কুঠিয়ালের পো, সরিষার তেল বানাইতি বলদ গুলারে দিয়ে ঘানি টানাইয়া, এত টাকা পাইলি কই? বাড়ির ভিতর ঢুকতে গিয়েও পারি না, মন্ত্রশক্তিতে বাঁধা, এটা ভাঙার উপায় আমি জানি, তাই বের হয়ে পড়ি শহরের সবচেয়ে ঘিরিংগী আর বজ্জাত কুকুরটার সন্ধানে, এই দেয়ালের গোড়ায় সে হিসি করে দিলেই এই বাঁধ কেটে যাবে ।


- আগামী সংখ্যায় সমাপ্য - 


~ কবি পরিচিতি ~



সাঈদা মিমি সাঈদা মিমি Reviewed by Pd on অক্টোবর ২৩, ২০১৪ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

সুচিন্তিত মতামত দিন

banner image
Blogger দ্বারা পরিচালিত.