একদিন
ঘুমটাই যদি ভাঙে কোমরের নিম্নদেশ বরাবর এক জোরদার লাথি খেয়ে মেজাজটা কেমন হয় তখন বলাই বাহুল্য।
যদিও পরমূহূর্তেই বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা স্বপ্ন ছিল তবুও যতটা না ব্যথায় তারচেয়ে বেশি অপমানে আমার তালু পর্যন্ত জ্বলতে লাগল। মেয়ের এতবড় সাহস স্বপ্নে এসে কিনা লাথি মেরে যায়!
কাহিনি কি? তেমন কিছুই না। আমি যেন তার জন্মদিন না ভুলে যাই।
আরে বাপ, জন্মদিন তোর দুইমাস পর, তার জন্য এখন থেকেই এই লাথিমার্কা অ্যালার্মের কি দরকার! জন্মদিনের একদিন আগে এসে মোলায়েম স্বরে স্বপ্নে এসে কানে কানে বলে দিলেই হয়। খালি খালি সকালটা নষ্ট করে দিল!
বিছানা থেকে খাট্টা মেজাজ নিয়ে নেমে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালাম। অমনি কি জানি হয়ে গেল!
দেখলাম পা যেন আকাশে উঠে গেল, আর আমি উপুড় হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি! :-(
কোন হারামজাদা আমার বিছানার পাশে এনে টুথপেষ্ট ফেলেছে কে জানে! এ নিশ্চয়ই কাজের মেয়ের পিচ্চি ছেলেটার কাজ। আজ ওর পিঠের চামড়া না তুলেছি তো আমার নাম বিন্টুই নয়।
উঠতে গেলাম, পিঠের সবগুলো হাড় যেন একসাথে সারেগামা গেয়ে উঠল।
সকালেই দস্তুরমত পর্যদুস্ত হয়ে আমার ষষ্ঠইন্দ্রিয় আমাকে সাবধান করতে লাগল, আজ বাইরে যাসনে বাছাধন। কপালে আজ খারাবি আছে। গোলগাল হিরো হইয়া যাবা, পরটা টাইপ জিরো ফিগার নিয়া ফিরবা।
তবুও উপায় নেই। বেরোতেই হবে। নইলে ম্যাডাম মেসে এসেই না আমাকে ফ্রাইং প্যানে চড়িয়ে দেয়! এমনিতেই মেয়ের নাকের ডগায় রাগ সবসময় কাঁথা বালিশ নিয়ে বসে থাকে, আর কথার নড়চড় হলে তো আর দেখতে হবে না; সোজা ভবের পার!
তাই তাড়াহুড়ো করেই বাথরুমে গিয়ে শাওয়ারের নিচে মৌজের মাথায় কোকিলকন্ঠে একটা হিন্দিগান ধরে গায়ে সাবান ঘষা শেষ করেছি মাত্র পানি খালাস!
এ নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার তাই এক কলসি পানি ঘরে রিজার্ভ থাকেই। তাই নিশ্চিন্তমনে গুণগুণ করতে লাগলাম গানটা-
“ভিগি ভিগি রাতোমে....” :-)
কিন্তু কলসির কাছে যেতেই গানটা স্যাত করে যেন আমার গলাতেই সেঁধিয়ে গেল!
নিশ্চয়ই ওই রবিনের বাচ্চা ওই পানি দিয়ে প্রাকৃতিক কার্য সম্পাদন করে ভেগেছে। সে যাই হোক, এখন তো আমার ত্রাহি ত্রাহি সংকট!
টেবিলের উপর আধাজগ পানি পেয়ে নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে হতে লাগল। কিন্তু, দুঃখের বিষয় সেটা দিয়েও পুরো কার্য সম্পাদন হলনা।
অতঃপর খান বিশেক টিস্যুপেপারের সৎকার করে মোটামুটি কাজ চালালাম। শরীর থেকে যে খুশবু বের হচ্ছে রাস্তায় বের হলে না আবার কুকুর পিছু নেয়। শুনেছি কুকুর ভালো এবং খারাপ মানুষ নাকি গন্ধ শুঁকেই বুঝতে পারে। আমার শরীর থেকে সে এখন শুধু সাবানের খুশবু ছাড়া ভালো মানুষ খারাপ মানুষ টাইপস কোন গন্ধই পাবেনা। তখন না আবার কনফিউজ হয়ে ঘ্যাক করে কামড়ে দেয়। আর কামড়ালেই তো ইয়া বড় বেলন সাইজের ইনজেকশন!
আমার আজকের দিনের রাশিফলটা দেখতে পারলে ভালো হত। পত্রিকা খুলে সিংহ রাশির ঘরটা দেখলাম খুঁটিয়ে।
“যাত্রায় সামান্য বিপত্তি থাকিলেও পরিণামে শুভ। ধন-সম্পদ মাঝারি। প্রণয় প্রশস্হ।”
আমি আশান্বিত হলাম। রাশির প্রথম অংশ তো মিলেই গেছে! যাত্রা ভীষণ রকম অশুভ। এখন বাকিটাও নিশ্চয়ই ফলবে।
পকেটে খরা যাচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরেই। ধার দেনা বহু, এমনকি আজকের ডেটিংয়ের টাকাও ধার করা। টাকা-পয়সা মাঝারি না, কিঞ্চিত আসলেও আমার ঠোঁট দুইখানা কানে ঠেকার কথা। আর প্রণয়ের প্রশস্হতায় আমার তালপাতামার্কা বুকখানাও যেন দ্বিগুণ প্রশস্হ হয়ে গেল। আজ আমাকে আর পায় কে?
যা আছে কপালে বলে বেরিয়ে পড়লাম। বেরোতেই দেখি ঠিকই একটা হাড় জিরজিরে কুকুর আমার পিছু নিল। আমি আঁতকে উঠলাম যথারীতি। সে ব্যাটা দেখি আমার কাছে এসে নাক ঘুরিয়ে খানিক কি যেন শুঁকল, তারপর ঘোঁ ঘোঁ-ঘ্যাক করে একটা ডাক ছেড়ে একছুট লাগাল। ছোটার প্রকৃতিতে মনে হচ্ছেনা দু’চার দশ মাইলের মধ্যে ওর থামার ইচ্ছে আছে। আমি নিশ্চিন্ত হলাম।
নিশ্চিন্ত মনে ফুরফুরে মেজাজে একখানা রিক্সা ডাক দিয়ে বসলাম। রিক্সায় বসতেই মন আরো ভালো হয়ে গেল। মনে হতে লাগল হাওয়ায় ভাসছি। অর্ধেক রাস্তা এসে হঠাৎ একটা সিগারেটের শখ জাগল। ভাবলাম, বাতাসে ভাসতে ভাসতে সিগারেট খাওয়ার অনুভূতিই আলাদা। রিক্সা থামিয়ে নেমে দোকান থেকে একটা বেনসন নিয়ে আয়েশ করে জ্বালিয়ে একটা কষে টান দিয়ে একবুক ধোঁয়া ছেড়ে যেই না পকেটে হাত দিয়েছি… পকেট ঠিকই আছে, পকেটের বস্তুটি গায়েব!
অর্থপ্রাপ্তির কথা ছিল, এতো উল্টো অর্থদন্ড হয়ে গেল! পকেটে ধারের টাকাটা ছিল আজকের ডেটিংয়ের জন্য। সব গেল!
টেনশনের ধাক্কায় যেই আরো কয়েকটা টান লাগিয়েছি সিগারেটে কষে, অমনি দোকানদার পয়সা চেয়ে বসল। আমার খেয়াল হল তাই তো! সিগারেটের পয়সা কে দেবে! আমার অবস্হা বুঝিয়ে বলতেই দোকানদার চরম ক্ষ্যাপা, বোধহয় আরো কিছুক্ষণ ঝারি চলত- ওই গায়ের অপরূপ গন্ধই শেষ রক্ষা করল।
রিক্সাওয়ালাকে বুঝিয়ে বলতেই, ফকির ঠগবাজ আরো হাবিজাবি কি সব বলে হনহন করে চলে গেল।
জানপাখি আছে হোস্টেল গেটে, আর সেখানে যাওয়ার জন্য পকেটে আমার ফুঁটোকড়িও নেই। সামনে রাস্তা তিন মাইল আর পিছনে দুই। কোনদিকে যাওয়া উচিত মনস্হির করতে পারলাম না।
তখনই মনে পড়ল পকেটে একখানা এক টাকার কয়েন আছে গতকালের। হাতড়িয়ে বের করলাম। ভাবলাম টস করেই দেখি কোনদিকে যাওয়া উচিত।
যেইনা কয়েন ছুঁড়েছি-
ওমা! অমনি ওটা মাটিতে পড়ে গড়ান দিল আর আমি হাঁ হাঁ করে আগেপিছে না দেখে ওটার পিছে দৌড় দিলাম। তারপর? তারপর আর কি ? কয়েন সোজা নালায় আর আমি পুরোপুরি না হলেও ডান পা খানি নালার জলে হাবুডুবু। এদিক ওদিক তাকিয়ে পা খানা টেনে তুলে দেখি স্যান্ডেলখানা সহি সালামতে নালাতেই রয়ে গেছে। উদাস নয়নে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম সেদিক পানে। মনের মাঝে আশা- যদি ভেসে ওঠে! মিনিট পনের তাকিয়ে থেকেও যখন জুতার টিকিটাও দেখা গেল না, তখন আর কি করা! বুঝলাম আমার পায়ের চেয়ে জুতাখানার বোধহয় নালার পানিই অধিক আরামপ্রদ মনে হয়েছে। বাকিটারই বা তাহলে মনস্কামনা অপূর্ণ রাখি কেন? তাই ওইখানা জুতাও নালায় সমর্পন করে বিরস বদনে চিন্তা করলাম ফিরে যাওয়াই উত্তম।
আবার রাশিফল মনে পড়ে গেল। “প্রণয় প্রশস্হ!”
ওই প্রশস্হ প্রণয়ের ভরসাতেই খালি পায়ে এগোলাম। জানপাখিটা নিশ্চয়ই বুঝবে এই জ্বালা। প্রণয়ের দ্বার আজ সুপ্রশস্হ বলে কথা!
কিন্তু, প্রশস্হ প্রণয়ের পথে এত বাঁধা কে জানত!
কিছুদূর গিয়ে মোড় ঘুরতেই দেখি- সে কি! সেই কুকুরটা দলবল নিয়ে দাঁড়িয়ে! মনে মনে বোধহয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে- আজ এই বেআক্কেল আজব জন্তুটার একদিন কি আমাদের যে কদিন লাগে।
আমারতো তখন মনটা করে উড়ু উড়ু, বুকটা করে দুরু দুরু! যদিও ডানার অভাবে ওড়ার উপায় খুঁজে পেলাম না।
ততক্ষণে ওরা দলবল নিয়ে আমাকে ঘেরাও করে ঘ্যাঁ ঘ্যাঁ-ভোঁক ভোঁক-ঘুঁ ঘুঁ-খ্যাক খ্যাক শুরু করে দিয়েছে।
কি সেই সমবেত রাগিনী! আমার অন্তর তখন খাঁচাছাড়া। ওদের ডাকাডাকি শুনে মনে হল যেন সবগুলো সমানে কুকুরে ভাষায় আমাকে গালাগালি শুরু করে দিয়েছে।
একজন ঘ্যাক ঘ্যাক করে যেন বলল, চল ঠ্যাং থেকে শুরু করি। আরেকজন ভোঁউউক করে গালি দিয়ে বলল এই শালার পা মজা হবেনা। দেখিস না খালি পায়ে ঘোরে! চল আগা থেকে স্টার্ট করি।
আমার তখন জানে পানি নেই। আগা থেকেই হোক আর গোড়া থেকে- বলির পাঁঠা তো আমি। কোনমতে চোখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম পেছনে আছে পাঁচটা আর সামনে তিনটা! আগপিছ চিন্তা না করে তাই সামনেই দৌড় দিলাম।
শেষ বিকেলে যখন ক্লান্ত বিদ্ধস্ত শরীরখানি টেনে টেনে হোস্টেলে পৌঁছলাম দেখি, জানপাখি আরো জনাদশেক বান্ধবী নিয়ে হোস্টেলের সামনের মাঠে ঘাসের উপর বসে বাদাম চিবাচ্ছে!
আমার তখন পায়ে জুতো নেই, চুল চেহারার কথা বাদই দিলাম, শার্ট ঘামে ভিজে সাবান আর ঘামের মিলিত মহাসুগন্ধ বের হচ্ছে, প্যান্টের এক পায়ের নিচের একহাত নেই! এক বজ্জাত কুকুর নাগাল পেয়ে গিয়েছিল। তাই প্যান্টের ওই অংশটুকু ওর মুখে রেখেই পালিয়েছি।
আমাকে দেখেই সবগুলোর চোখগুলো হাঁসের ডিমের মত হয়ে গেল। একজন তো আরেক বান্ধবীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে মহানন্দে হাই তুলছিল, আমাকে দেখেই তড়াক করে উঠে বসল, তারপরই ও মাই গড বলে একটা চিৎকার দিয়ে আবার ওই বান্ধবীর কোলেই ধপাস করে পড়ে গেল। হার্টফেলই করল কিনা কে জানে!
আরেকজন একখানা বাদাম সবে মুখে দিয়েছিল বোধহয়, সেটা সরাসরি গলায় চলে গেল; আর মেয়ে তো খোঁয়াক খোঁয়াক-খ্যাঁ খোঁ করে কাশতে কাশতে অস্হির!
আমি লজ্জায় কোথায় মুখ লুকাবো ভাবছিলাম। প্রশস্হ প্রণয় তখন সংকীর্ণ হয়ে লুকোনোর একটা গর্ত খুঁজছে!
মনে মনে আওড়ালাম- শালার জ্যোতিষ, তোরে পেয়ে নিই। তোর রাশিফল আমিই লিখব।
তখনই ওদের মধ্যে টিকটিকিমার্কা এক মহাফাজিল মেয়ে এহেন পরিস্হিতিতে কোত্থেকে আমার জানপাখিকে বলে উঠল, এই স্যাম্পলটাই বুঝি তোর? অফটাইমে চৌরাস্তার মোড়ে বসে বুঝি? আমাদের বাদামের বিলটা তাহলে দিয়ে দিতে বলনা। আমার কাছে ভাংতি নেই। তোর ফকিরের কাছে নির্ঘাত পাবি।
পকেটের দৈন্যতার কথা চিন্তা করে আমার তখন মাথা চক্কর দিচ্ছে।
তখনই জানপাখি হুংকার ছেড়ে ছুটে এল, “তবে রে হতচ্ছাড়া!”
আমি? আমি তখন আর কিই বা করতে পারি?
সহজ যেটা মাথায় এলো তাই করলাম। কুকুরের দৌড়ানি খেয়ে তো ছোটার শক্তি নেই। তাই স্রেফ চোখ বন্ধ করে ধপাস করে পড়ে গেলাম!
সবাই যখন আমাকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে তখনও চোখ বন্ধ করে জানপাখির তর্জন গর্জন শুনছি; আর মনে মনে বলছি, যতই কিছু বল সোনাময়না, চোখ তো খুলছি না। বহুত ছুটছি আজ। এবার তুমিও খানিক ছোটো।
তবে আড়চোখে ওর কাজলচোখে জলের কণা দেখে বুঝলাম, রাশিফলটা পুরোপুরি মিথ্যাও নয়। সত্যিই আজ প্রণয় প্রশস্হ!
চট্টগ্রাম ।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন