মৃতভাষী
নিজের মৃতদেহ আগলে বসে থাকতে কেমন লাগে, সেই অভিজ্ঞতা আমার আগে ছিল না কোনদিন। কারই বা থাকে। কাল রাতে শোয়ার সময়েও টের পাইনি একদমই। পেলে না হয় আত্মীয় স্বজন যাও’বা কয়েকজন রয়েছে, একটা আগাম খবর দিয়ে রাখা যেত। কিন্তু এখন বেশ ভালোরকমের বিপদেই পড়ে গেলাম। কাউকেই আর খবর দেওয়ার উপায় নেই। মোবাইল একটা আছে বটে। কিন্তু একবার মরে গেলে আর উপায় কি? কার ফোন, কে করে। এদিকে সকাল হলে কেউ যে বাসায় আসবে, তেমনও নয়। বাসার কাজের জন্য কাউকেই রাখিনি কোনদিন। নিজের কাজ নিজেই করে নেওয়া অনেক বেশি সুবিধের। কারুর উপরে নির্ভর করতে হয় না। ফলে সকাল হলেই যে কেউ বাসার কলিং বেল টিপবে, তেমনটাও নয়। খবরের কাগজ পড়ার অভ্যাস সেই ২০১৪ তেই বন্ধ করে দিয়েছি। খবরের বদলে পয়সা দিয়ে প্রোপাগাণ্ডা মুখস্থ করার কোন ঠেকা আমার কোনদিনই ছিল না। ফলে কাগজওয়ালাও বাসায় নক করতে আসবে না। চিঠির যুগ কবেই গত। পোস্টম্যানদের আসা যাওয়াও তাই নেই। বন্ধুবান্ধব সবই তো ভার্চ্যুয়াল। নেটে ঢুকলে আছে। না ঢুকলে নেই। তাই ভাবছিলাম। এই যে আমার মৃতদেহটা বিছানায় নিথর পড়ে রয়েছে, কেউ জানতেও পারছে না। না পারলেও কারুরই কিছু যাবে আসবে না। কিন্তু দেহটাতে তো পচন ধরবে। দুর্গন্ধে টেকা যাবে না। কি করবো তখন?
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম। বেলা প্রায় দ্বিপ্রহর। এই প্রথম নতুন একটা উপলব্ধি হলো। অন্যদিন এই সময়ে খিদেতে পেট চোঁচো করে। কিন্তু আজ সেই জান্তব অনুভুতিটা আর হচ্ছে না। বিশেষ করে সকালেও তো কিছু খাওয়া হয়নি। অথচ কোন খিদেও নেই। তাই ভাবছিলাম বেঁচে থাকতে এমনটা হলে কত সুবিধেই না হতো। হেসে খেলে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যেত। যাহোক, নিজের ঘুমন্ত মুখের দিকে আর একবার তাকিয়ে দেখি কয়টা মাছি ভনভন করা শুরু করে দিয়েছে। এই বাসায় যে খুব মাছির উপদ্রব ছিল, এমনটাও নয়। মাথার পাশে পূবের জানলাটা খোলাই থাকে। দিনরাত। সেই পথেই হয়তো মাছিদের কানে খবর পৌঁছিয়ে গিয়েছে। সে যাক। কিন্তু আমার ভয় একটাই। আমি মোটে দুর্গন্ধ সহ্য করতে পারি না। অথচ যে গাড্ডায় পড়েছি, তাত দুর্গন্ধ না ছড়ালেও তো বাইরে থেকে কেউই টেরও পাবে না। বাসায় একটা দেহ মরে পড়ে রয়েছে। যদিও এক দিক থেকে আমি খুব লাকি। এমন কেউ নেই যে আমার শোকে পাগল হয়ে যাবে। কিংবা আমি না থাকলে কারুর বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে যাবে। ফলে নো দায় নো ঝঞ্ঝাট। এই বেশ ভালো আছি। না হলে মরেও তো শান্তি পেতাম না। প্রিয়জনের দুঃখ শোকের বোঝা বহন করা কম কথা তো নয়।
ঠিক সেই কারণেই আমার মুখটা পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে রয়েছে। কোন আক্ষেপ নেই। কোন ক্ষোভ নেই। কোন সাধ নেই আর। এমনকি স্বপ্ন দেখার ঝেমেলাও নেই কোন। এমন ঘুম যদি প্রতিদিন ঘুমানো যেত! বেঁচে থাকতে কোনদিন কি এতটা শান্তিতে ঘুমোতে পেরেছি? কই মনে তো পড়ছে না কিছু। কি আশ্চর্য! হঠাৎ করেই যেন কেমন একটা ধাক্কা খেলাম জোর। সমস্তটা যেন কেমন দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন আশ্চর্য একটা অবস্থা। দেখতে দেখতে বেশ ভালো রকম করেই টের পেলাম। সত্যিই আমার যেন আর কিছুই মনে পড়ছে না। এই বাসা, এই দেহ সবই তো আমার। কিন্তু তার তো একটা দস্তুর মতো অতীত থাকার কথা। কই, আমার তো সেরকম কোন অতীতের কথা মনে পড়ছে না। এ কি জ্বালা? আস্ত একটা মানুষ জ্যান্ত মরে পড়ে রয়েছে। একা একটা বাসায়। কিন্তু তার অতীত কি? কে সে? এই আমিই কি? না’কি আমিও ঠিক নয়। অন্য কেউ? কিন্তু এ তো ঠিক আমার মতোই দেখতে। আমার মতোই তো? আরে তেমনটাই তো মনে হচ্ছিল এতক্ষণ। কিন্তু আমি কি এই মৃতদেহটার মুখের মতোই দেখতে? ঠিক অবিকল এক? বুঝবো কি করে? কে বলে দেবে? তবে যে এতক্ষণ নিজের মৃতদেহ আগলিয়ে বসে রয়েছি বলেই ভাবছিলাম। এই মৃতদেহ যদি আমার না হয়, তবে আমিই বা এই মৃতদেহ আগলিয়ে বসে থাকবোই বা কেন? তবে তো এটি নিশ্চিত ভাবেই আমারই মৃতদেহ। ঠিক ঠিক।
যাক মৃতদেহটা যে আমারই। সে রকম একটা সমাধান না হয় পাওয়া গেল। কিন্তু আমার তো আর কিছুই মনে পড়ছে না। কে আমি? এই বাসাতেই বা কেন? মারাই বা গেলাম কি করে? সত্যিই কি আমার কেউ নেই? এই আনাদি অনন্ত জগতে আমি কি সম্পূর্ণ একা তবে? যদি তাই না হয়, তবে এই যে আমি মরে গিয়েছি বলে মনে হচ্ছিল এতক্ষণ। কই আমার তো, কাউকে ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য মনের ভিতরে কোন কষ্ট হচ্ছিল না। ঐ যে আমারই না’কি মৃতদেহটা পড়ে রয়েছে খাটে। এক ফোঁটা চোখের জলও তো নেই দুই চোখে। কারুর জন্যেই যদি কোন কষ্ট না হয়। তবে তো নিশ্চিত ভাবেই আমার কেউ ছিল না।
কেউ কি থাকে? কাকেই বা থাকা বলে? আমি কি কোনদিন কারুর জন্য ছিলাম? না’কি বরাবরই আমি নিজের জন্যেই বেঁচে ছিলাম? কেউ কি কেবলমাত্র নিজের জন্যেই বেঁচে থাকতে পারে? ভাবতে ভাবতে ক্রমেই যখন আমার দিশেহারা অবস্থা, ঠিক তখনই সেই বিকট মড়াপচা গন্ধটা পেলাম। তার মানে অনেকটা সময়ই ইতিমধ্যে চলে গিয়েছে। সে যাক। কিন্তু কি করবো এখন? এই বিকট গন্ধ নিয়ে থাকবো কি করে? না হলে যাবোই বা কোথায়? আমার তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। এই যে দেহটা পড়ে রয়েছে। ওর তো তবু একটা যাওয়ার জায়গা আছে। নিজে যেতে না পারুক। আজ না কাল। কেউ তো এসে ওকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। পুড়িয়েই দিক আর মাটিই দিক। ঐ দেহটার একটা গতিতো ঠিক হয়ে যাবে। যেমন করেই হোক। না হলে পোকায় খেয়ে নেবে। তা নিক। তাতেও কোন ক্ষতি দেখি না। সেও একটা গতি হওয়া তো বটে। কিন্তু আমি? কোথায় যাবো? এই বাসার চার দেওয়ালের ভিতরে এইভাবে দমবন্ধ থাকতে থাকতে তো পাগল হয়ে যাবো একদিন। তখন?
আর ঠিক তখনই মনে হলো, সত্যিই তো! আমরা কে কোথা থেকে এসেছি। সেটা কোন বড়ো কথা কি? নিশ্চয় নয়। কিন্তু কে কখন কোথায় গিয়ে পৌঁছাবো। কোথায় গিয়ে কিভাবে শেষ করবো। সেটাই কি আসল কথা নয়? কিন্তু এটাই কি তবে শেষ? এই চার দেওয়ালের বাসায়? এইভাবে আটকিয়ে যাওয়া? এই বাসা তো আর চিরকাল খালিও থাকবে না। কেউ না কেউ এসে এটার দখল নিয়ে নেবে। মনে করবে তার নিজেরই বাসা। তখন কষ্ট কি আর হবে না আমার? কে জানে? কার বাসা কে মালিক? সত্যিই তো, এইভাবেই হয়তো আমিও নিজেকে মালিক ভেবেছি অনেক কিছুরই। কিন্তু সত্যিই যদি মালিক হতাম। তবে তো সব কিছুর উপরেই আমারই নিয়ন্ত্রণ থাকতো। তাই না? কই, ঐ যে ওখানে খাটে আমার নিজেরই মৃতদেহটা না’কি পড়ে রয়েছে। যদিও এখনো অনেক প্রশ্ন রয়েছে। সত্যিই কি ওটা আমারই লাশ? না’কি আমিই অন্য কেউ। যদি আমারই লাশ হয়। তবে নিজের লাশ নিয়ে নিজেই বা কেন আমি এত বিব্রত বোধ করছি? নিজেরই তো লাশ। তবে আর চিন্তা কি? আমিই কি ঐ লাশের মালিক? তবে ঐরকম বিকট দুর্গন্ধটা বন্ধ করতেও পারছিনা কেন? কেনই বা এত ভয় পাচ্ছি। ঐ লাশের একটা গতি অন্য কেউ করতে পারলেও আমি হয়তো আর এই চার দেওয়ালের বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে পারবো না। সেই ক্ষমতাটুকু আছে আমার? তাহলে আর মালিকানা কিসের?
দিনের পরে রাত। রাতের পরে দিন। জীবনের পরে মৃত্যু। কিন্তু মৃত্যুর পরে? এই যে আমি আর নেই, এই না থাকাটাই বা কি? কি বলবো একে? স্থিরবিন্দু হয়ে যাওয়া? হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া। না’কি সব কিছুর শেষে একেবারে শেষ হয়ে যাওয়া। অস্তিত্বের পরে নাস্তি। সামনে আর কিছু নেই। আর পিছনে যা ছিল। একেবারে ছায়াবাজির মতো মিলিয়ে গেল। শুধুই রয়ে গেল একটা অনন্ত কষ্ট। কেন কারুর জন্যেই আমার ভিতরে কোন কষ্ট হচ্ছে না? তার তো একটাই মানে হয়। আমি কোনদিন কারুর জন্যেই ছিলাম না। কেউ আমার জন্যেও যদি থাকতো। তবে নিশ্চিত ভাবেই আমিও তাদের জন্যে থাকতাম। তাহলে? আমার জন্যেও হয়তো কেউ ছিলই না। যেমন আমিও কারুর জন্যেই ছিলাম না। কিন্তু এইভাবে সম্পূর্ণ একা হয়ে আমার ঐ পচা দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকা মৃতদেহটা তবে এতকাল জীবিত ছিল? কি ভয়ানক! তেমন ভাবে বেঁচে থাকাটাও কি এমন ভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার থেকেও বেশি কষ্টকর ছিল, না’কি কম কষ্টকর ছিল? কে বলে দেবে? এতকিছু কি আদৌ নিশ্চিত ভাবে বলে দেওয়া যায়? সম্ভব?
শ্রীশুভ্র / মৃতভাষী
Reviewed by শব্দের মিছিল
on
অক্টোবর ৩০, ২০২৫
Rating:
Reviewed by শব্দের মিছিল
on
অক্টোবর ৩০, ২০২৫
Rating:

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
সুচিন্তিত মতামত দিন