জগদ্ধাত্রীপুজোর চন্দননগর- এক অবরুদ্ধ নগরীর কথা
রাজেশ কুমার
জগদ্ধাত্রীপুজোর চন্দননগরের কথা বলতে গেলেই মনে পড়ে যায় কোনও এক আশ্চর্য, অবরুদ্ধ নগরীর কথা। রূপকথার দুর্ভেদ্য আলো ঘেরা, ঝলমলে এক নগর সভ্যতা যার রাজপথে শুধু ব্যানার, হোর্ডিং, এল ই ডি আর হাজার হাজার মানুষের ঢল। রাতভর তাদের হেঁটে যাওয়া। অ্যাসফল্টের রাস্তায় যেন একটু আগেই সুর ছড়িয়ে গেছে হ্যামলিনের সেই অদৃশ্য বাঁশিওয়ালা।
দূর-দূরান্ত থেকে আসে দর্শনার্থীর দল। তাদের হাসি, ঠাট্টা, আনন্দ, কথার গুঞ্জন। হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠা কিম্বা চমকে দেওয়া ভেঁপুর শব্দ। বাচ্চার কান্না। দু-হাত দূরে দূরে মাইকের আওয়াজ। গান। মধ্য রাতে হয়তো বা কারও হারিয়ে যাওয়ার ঘোষণা। সার্কাস মাঠে ইলেকট্রিক নাগরদোলার বিষণ্ণ উটের মতো জাবর কাটা। তারপর সেসব ছাপিয়ে ভোর রাতের আধো ঘুমে জেগে ওঠা স্ট্র্যান্ড রোড। এঁঠো শালপাতা, মাড়িয়ে যাওয়া কাগজের কাপ, চিপসের ছেঁড়া প্যাকেট। বাবার কাঁধে ঘুমন্ত মেয়ে, প্রেমিকের বাহু জড়িয়ে সারারাত পথ চলা ক্লান্ত প্রেমিকা, ভিড়ের চাপে ছিঁড়ে যাওয়া জুতোয় কিংকর্তব্য-বিমূঢ় বাড়ির নতুন বউ কিম্বা অনভ্যাসে ফোলা পা নিয়ে কলুপুকুরের কোনও রকে সামান্য জিরিয়ে নেওয়া গৃহকর্তা।
পুজোর ক’টা দিন জনপদে যান চলাচল নিষিদ্ধ। দুপুর থেকেই ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে নামে প্রশাসন। বাইরের গাড়ি আটকে দেওয়া হয় চন্দননগর ঢোকার অনেক আগেই। দিল্লি রোডের মুখে, মানকুন্ডু কিম্বা চন্দননগর কানেকটরে। তারপর শুধু পায়ে পায়ে পুজো পরিক্রমা। বউবাজার, কলাবাগান, ফটোকগোড়া, মধ্যাঞ্চল অথবা ট্রেন থেকে নেমে মানকুন্ডু স্পোর্টিং ক্লাব, নতুনপাড়া, নিয়োগী বাগান হয়ে সোজা জ্যোতি- তেমাথা। এই সময় শহরের অলিন্দে যান চলাচল নিয়ন্ত্রিত হলেও পূর্ব রেলওয়ে উদার হস্ত। হাওড়া ব্যান্ডেল শাখায় সে সারারাত যাত্রী উগড়ে যায় বর্ষায় ইলিশে পাওয়া নদীর মতো।
আজকাল চতুর্থী থেকেই শহর চলে যায় বিজ্ঞাপনদাতা, দর্শনার্থী, মিডিয়া, ব্যবসায়ীদের হাতে। কর্পোরেট পুঁজি খেলা করে নানানভাবে, নানান কায়দায়। একাধিক বাণিজ্যিক সংস্থা প্রতিযোগিতায় নামে পুরস্কার ঘোষণার।
মণ্ডপসজ্জা, প্রতিমাসজ্জা, আলোকসজ্জা, মুখশ্রী ইত্যাদি নানান বিভাগে পুরস্কার প্রদানের ঢল। চালু হয়েছে মায়ের গহনার স্পনসরশিপের ধারণাও। কোথাও কোথাও পুজোর চারদিন প্রতিমাকে দানের গহনা না পরিয়ে বিখ্যাত কোনও ব্র্যান্ডের গহনা পরানো হচ্ছে। তারপর দূর দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সেই খবর। আহ্বান জানানো হচ্ছে জনসাধারণকে। কোথাও যেন মিলেমিশে যাচ্ছে জগদ্ধাত্রী আর স্পনসরড ব্র্যান্ড। বাণিজ্য তার লম্বাটে ছায়া নিয়ে এভাবেই এসে দাঁড়াচ্ছে আমাদের পুজো মন্ডপগুলোতে। আর তারই কোল ঘেঁষে অজ্ঞাতে বসে থাকছে আমাদের আবেগ, উন্মাদনাগুলি। পতঙ্গ আর আগুনের সহাবস্থান। আশঙ্কা জাগে, কর্পোরেট না থাবা বসায় আমাদের ঐতিহ্যে। মাত্রাতিরিক্ত পুঁজি না গিলে খায় এই সাবেক শহরের বৈচিত্র।
অথচ মাত্র কিছু বছর আগেও বিষয়টা এমন ছিল না। মানুষজন ঠাকুর দেখত লাইন দিয়ে। মাথাপিছু টাকার বিনিময়ে ভি আই পি গেট পাসের ব্যবস্থা চালু হয়নি। সামান্য একটু স্বীকৃতির জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকত বড় বড় পুজো কমিটির উদ্যোক্তারা। সে এক সময় ছিল, সেন্ট্রাল কমিটির বিচারে মুখশ্রীতে প্রথম কিম্বা মন্ডপসজ্জায় অমুক স্থান মানে অদ্ভুদ এক উন্মাদনা, পাড়ার ক্লাবের বিশ্বকাপ জেতারই সামিল। চোখ বুজলেই দেখা যায়, এই তো কিছু দিন আগেও ফুল পাজ্ঞাব লরি বোঝাই হয়ে ঝাঁক ঝাঁক বাঁশ নামত গোন্দলপাড়া মনসাতলা, চারমন্দিরতলা কিম্বা অম্বিকা অ্যাথলেটিক ক্লাবের মাঠে। জগদ্ধাত্রী পুজোর কিছু আগে আগেই। দুর্গাপুজোর দশমীর দিন হয়ে থাকত কাঠামো পুজো। এখনও তাই। তবে নারকেল দড়ি আর পেরেক পোঁতার ঠুকঠাক শব্দ যেন কমে এসেছে আচমকাই। বড় বড় বারোয়ারিগুলোর হাতে অতিরিক্ত অর্থ। রাতেরবেলা লরি করে ফিটিংস আসে। প্যান্ডেলের হাত, পা, পেট, মাথা। তারপর ফেভিকলের মজবুত জোর কাজে লাগিয়ে কয়েক দিনেই গড়ে ওঠে আস্ত একটা জগদ্ধাত্রী মন্ডপ। আর এই পথেই কলকাতা দুর্গাপুজোর বুর্জ খলিফা বারাসাতের কালী হয়ে হয়তো বা হানা দেয় চন্দননগরে। ধীরে ধীরে কবে যেন ফুরিয়ে আসে নতুন প্যান্ডেল তৈরির উদ্দম।
কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে জগদ্ধাত্রীর পূজা। দেবী দুর্গা ও তামসিক কালীর পরেই সত্ত্বগুণের দেবী জগদ্ধাত্রী। তাই প্রথম সূর্যের মতো তাঁর গায়ের রঙ। অর্থাৎ গাত্রবর্ণ কমলা। জগদ্ধাত্রী কৃষ্ণনগর ও চন্দননগরের প্রাণাত্মিকা, জগতের ধারিণী শক্তি।
শোনা যায় সেই আড়াইশো বছরেরও আগে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পুজো দেখে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ ও তৎকালীন ফরাসি সরকারের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টিতে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবর্তন করেন। এই দেবীই চন্দননগরে আদি মা নামে পূজিতা হন। যদিও মতান্তর আছে। সেসময় ফরাসডাঙা ছিল বাণিজ্য কেন্দ্র। নদী পথে বড় বড় বাজরায় চাল ব্যবসায়ীরা আসত নানান জায়গা থেকে। জড়ো হত চাউলপট্টিতে। এভাবেই কৃষ্ণনগরের চালের ব্যবসায়ীদের আগমন ফরাস ডাঙায়। কোনও এক বছর জগদ্ধাত্রী পুজোয় ঘর ফিরতে না পেরে তাঁরাই নাকি ফরাসি সরকারের অনুমতি নিয়ে শুরু করেছিলেন এই পুজো।
ইতিহাস রেখে যেতে পারে বিতর্ক। সময়ের সারণীতে তবু চন্দননগর হয়ে ওঠে জগদ্ধাত্রীর দেশ। এক সীমাহীন আবেগের ক্ষেত্র। চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী, প্রতিমার গঠনে স্বতন্ত্র। দেবীর মুখমন্ডল ভূমি থেকে প্রায় ৪.৫ মিটার উচ্চতায়। আর চালচিত্রের উচ্চতা এর দ্বিগুণ, প্রায় ৯ মিটার। প্রতিমার সাজ, চালচিত্র সবই মূলত সাদার ওপর সোলার কাজ। তবে ইদানিং রাংতা, পুঁথি, জরির কাজও চোখে পড়ে। এসেছে থিম পুজোর কনসেপ্ট। এব্যাপারে হাটখোলা দৈবকপাড়া অবশ্যই অগ্রগণ্য।
চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী মানেই কার্তিকের হিম ঝরা রাত, আলোর বন্যা। পথে পথে অস্থায়ী আলোক স্তম্ভ আর আকর্ষণীয় সব তোরণ। যেন সক্কলকে স্বাগত ফরাসিদের ছেড়ে যাওয়া এই উপনিবেশে। ছোটবেলায় মা বলত, হাত ছাড়বি না। টুকরো কাগজে ঠিকানা লিখে গুঁজে দিত বুক পকেটে। রাস্তার চাইতেও অবাক লাগত বিদ্যালঙ্কার কাছে পুকুরের জলে ভেসে থাকা আলো। ধ্যানস্ত বুদ্ধ, গুপি বাঘা কিম্বা শুঁড়ে করে হাতির জল ছিটানো। তখন ছিল টুনির কাজ। বাঁশের ছোট ছোট স্ট্রাকচার তৈরি হত হাজার হাজার টুনি দিয়ে। মুড়ে দেওয়া হত লাল, নীল, সবুজ, হলুদ পলিথিন। ঝিকিমিকি আলো মায়া ছড়াত। শ্রীধর দাস, বাবু পাল-এর মতো বিখ্যাত সব আলোক শিল্পী দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়তেন এইসব মায়াবী আলোর মধ্যে দিয়ে। আজকাল টুনির কাজ চলে না। সবই এল ই ডি। তাতে অবশ্য আকর্ষণ কমে না এতটুকু। আলোর একটা স্বভাবসিদ্ধ অভিমুখ থাকে। যোগ্য শিল্পীর হাতে তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে পারে দেশ দেশান্তরে।
আর এই আলোক শিল্পের হাত ধরেই আজ পৃথিবীব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করেছে চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী প্রতিমা নিরঞ্জন ও শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রারও এক প্রাচীন ইতিহাস আছে। ১৮৫৪ সালে চালু হয় রেলপথ। পুজো উপলক্ষে বেড়ে যায় জনসমাগম। শহরের বিভিন্ন স্থানে চারদিনের জন্য গড়ে উঠতে থাকে ছোট বড় বিভিন্ন রকমের স্টল। মেলা। বেড়ে যায় জগদ্ধাত্রীর সমৃদ্ধি ও জৌলুস। সেই সময় মৃন্ময়ী প্রতিমা কাঁধে করে ঘোরানো হত সারা শহর। বাহকরা ছিল মূলত জুটমিল, ইটভাটার শ্রমিক, আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায়। সঙ্গে থাকত জমিদারের পাইক বরকন্দাজ। হাতে তাদের মশাল। সেই মশালের আলোয় আলোকিত হত মৃণ্ময়ী মায়ের মুখ। তারপর এল বাঁশের খাঁচা। শোনা যায় এই সময় পর্যন্ত প্রতিমা নিরঞ্জনের দিন বাড়ির মহিলারা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতেন ফুল নিয়ে, মাকে বরণ করার জন্য। রাস্তা হয়ে উঠত পুষ্পরঞ্জিত। এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য যেন ছড়িয়ে পড়ত সমস্ত বিশ্ব সংসারজুড়ে।
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে গতি। বেয়ারার জায়গায় এসেছে লরি। জগদ্ধাত্রী আজও সারা রাত প্রদক্ষিণ করেন শহর। মশাল পরবর্তী সময়ে শোভাযাত্রা আলোকিত করত পেট্রোম্যাক্স, অ্যাসিটিলিন গ্যাস ও ডেলাইটের আলো। সেখান থেকে আটের দশকের ৬.২ টুনি বাল্বের কাজ। তারও দুই দশক পর ব্যাটারি চালিত এল ই ডি আলো। আলোক সজ্জার এই বিবর্তন চন্দননগরের জগদ্ধাত্রীকে তুলে ধরেছে অন্য এক মাত্রায়। তবে শোভাযাত্রায় শুধু আলোক সজ্জাই নয় মনোরঞ্জনের জন্য থাকে বিভিন্ন ধরনের সঙ। সঙ শিল্পীদের কলাকৌশল। নিজ নিজ প্রতিমার সামনে সারিবদ্ধভাবে থাকে প্রতিটি দল। থাকে ক্লাবব্যান্ড, ঢাকের বাদ্যি, ধুনুচি নাচ। লাইট লাগানো বাগবাজারের বিরাট বেলুন। শোভাযাত্রা যেন এক চলমান মিলন মেলা, মানুষের জোয়ার। ঢাকের গগন বিদারি তীব্র আওয়াজ নগরবাসীকে জাগিয়ে রাখে সারারাত।
এত আলো, এত আওয়াজ। মানুষের জেগে থাকা। তবুও জগদ্ধাত্রী আসলেই কেন জানি মনে পড়ে সেই ছেলেটির কথা, অনেক বছর আগে মাঝরাতে জেনারেটরে মাফলার জড়িয়ে মারা গেছিল যে। কিম্বা সেই ছেলেটি, প্রতিমা নিরঞ্জনে নেমে চাপা পড়েছিল কাঠামোর তলায়। মনে পড়ে যায় তাদের বাড়ির কথা, আমার ক্লাসমেট বাদলের কথা। চোখ ধাঁধানো আলোর মধ্যেও একযুগ আগে হারিয়ে গেছিল যে, কোনও এক অজানা অন্ধকারে। ফিরে আসেনি আর কখনও।
রাজেশ কুমার / জগদ্ধাত্রীপুজোর চন্দননগর- এক অবরুদ্ধ নগরীর কথা
Reviewed by শব্দের মিছিল
on
অক্টোবর ২৭, ২০২৫
Rating:
Reviewed by শব্দের মিছিল
on
অক্টোবর ২৭, ২০২৫
Rating:

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
সুচিন্তিত মতামত দিন