মণি-মুক্তো
সোমা দত্ত
মণি সুন্দর। মণি কনকলতার মতো ঈষৎ স্বপ্নাচ্ছন্ন পায়ে পার করে যেত ধূসর বিকেলবেলা। মণির কিশোরজীবনের পাপড়ি খসিয়ে তাকে বৃন্তচ্যুত করল অশোক। লোকটার পদবি জুড়ে গেল মণির নামের সঙ্গে। পাশের গ্রামে বাড়ি। মণির এত সকাল সকাল বিয়ে দিতে চায়নি তাঁর মা। কিন্তু উপায় কোথায়? মণির বাবা যে তার জন্মের পরেই মারা গেছিল। মা মামার আশ্রয়ে মণিকে নিয়ে থাকত। তা বিয়ের ক'দিন পরে সেই মাও চলে গেল।
বসন্ত ঘুরল, গরমের তেষ্টায় চুরমার হল মাটি। বৃষ্টি পড়ল বাড়ির চাতালে টুপটাপ। মণির ছাদে বেড়ে উঠল পুঁইডাটা। বারান্দার ধার ঘেঁষে লকলকিয়ে তাজা লাউডগা বাতাসে পাখা মেলে দিল। একদিন মণির স্বপ্ন ছিল শহরে গিয়ে সিনেমা করবে। নায়িকার মতো ঘাসের বুকে শুয়ে থাকবে সিলসিলা হয়ে। শহরে যাওয়া হয়নি তার। নয় ক্লাস পেরোনো হয়নি। ওই পুঁইডাটা আর লাউডগা পুষ্ট করার জন্য তাকে মাটি খুঁড়ে জল তুলতে হয়েছে। বহুবছর ধরে 'হে ধরণী দ্বিধা হও' বলতে বলতে জলের সন্ধানে সে পৌঁছে গেছে মাটির অনেক গভীরে।
প্রতি বসন্ত আসলে মণি ভাবে যদি জীবনটা হঠাৎ ম্যাজিকের মতো পালটে যেত। যদি মেয়েবেলার স্বপ্নগুলো হঠাৎ পূরণ হয়ে যেত। ভাবতে ভাবতে বহুদিন ব্যয় হয়ে গেল।
অশোক বদ্ধ মাতাল হল। রোজগারে তালা পড়ল। ঘর চালানোর দায়ে মণি লোকের বাড়ি গিয়ে রান্নার কাজ ধরল। দুটো মেয়ে হল । এক মেয়ের বিয়েও হয়ে গেল একদিন। তবে অন্য মেয়েটাকে অনেক কষ্টে মণি উচ্চমাধ্যমিক পাশ করিয়েছে। সে এখন কলেজে পড়ে। নিজেও ক'টা ছেলেমেয়েকে পড়ায়।
মণি প্রায় রোজ মার খায়। অশোক মদ খেয়ে রাত দুপুরে ফেরে, হল্লা করে,চেঁচায়। মণির ছোট মেয়েটা মাকে বাঁচাতে চেষ্টা করলে নিজেও মার খায়। প্রায়ই অশোক টাকাকড়ি কেড়ে নেয়। না দিলে ফের মারে।
এসবের জন্য মণির আর তত কষ্ট হয়না এখন। সেও মারে অশোককে। সর্বশক্তি দিয়ে আটকাতে চেষ্টা করে অত্যাচার। হেরে যায় বেশির ভাগ সময়। মণির নালিশ করার জায়গা নেই। কাজের বাড়ির বৌদিরা মণিকে বলে, তোর বরকে পুলিশে ধরিয়ে দে। মণি চুপ করে থাকত। পুলিশ কী চতুর্থ শ্রেণীর কথা শোনে? মণির হয়ত সন্দেহ ছিল। তাছাড়া শত হলেও অশোক তার বর। সেই কচি বয়স থেকে ঘর করছে, রাঁধছে তার জন্য দুবেলা। ভালো নাই বা বাসল, মণি ফেলবে কী করে তাকে?
একটা দক্ষিণের জানলা ছিল অবশ্য। পুরুষবন্ধু ছিল একজন তাঁর। পাড়ারই ছেলে। ওই সম্পর্কের জোরেই মণি পাহাড় ডিঙিয়ে উপত্যকায় ফেরার স্বপ্ন দেখতে ভোলেনি কখনো। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। একদিন অশোক মণির পাখনার সন্ধান পেয়ে গেল। রক্ত উত্তপ্ত হয়ে মাথা ফুঁড়ে বেরোতে চাইল রাগ।
সেদিন মণির ছোটমেয়ে কলেজ থেকে ফিরে ঘরের দরজা খুলে দেখল মণির মর্মান্তিক ছেঁড়া কাটা দেহটা শুয়ে আছে তার মৃত স্বপ্নের উপর। অশোক তাকে কুপিয়ে খুন করে পালিয়েছিল।
এটা কোনো গল্প নয়। সত্যি ঘটনা। কিছুদিন আগে খবরের কাগজে বেরিয়েছিল। যারা তাদের পরিচিত অনেকেই আঁতকে উঠেছিল। কেউ কেউ আবার বলেছিল, স্বভাব ভালো ছিল না মণির। অশোক যা খুনে মাতাল, তার ঘরের বউ হয়ে প্রেম পীড়িত করতে গেলে এরকম ঘটনা ঘটারই ছিল। এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মফসসল এবং গ্রামের দিকে এখনো প্রায়ই ঘটে চলেছে।
নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত সামাজিক পরিকাঠামোয় মেয়েদের একটা আশ্চর্য স্বভাব লক্ষ্য করেছি। ওঁরা স্বামীর দোষ আড়াল করবেই করবে।
স্বামী হয়ত মদ্যপ, বাড়িতে ফিরে তুমুল মারধোর করছে, টাকাপয়সা কেড়ে নিচ্ছে, তাও দিনের শেষে কত সহজে পরমেশ্বর হয়ে উঠছে। তার নিন্দে করা যাবে না। কেন? না তিনি বুবাই টুবাই এর বাবা। – মদ না খেলি লোকটা ভদ্দরলোক গো দিদি। ন্যাশা করলি ওর মদ্যি শয়তান বাসা গেড়ে বসি যায় গো। ভূ ভারতে কেউ এই পতিলক্ষ্মীকে আর কোনো যুক্তি দিয়ে কিছুই বোঝাতে পারবে না। তিনি শিবরাত্রি থেকে শুরু করে স্বামীর মঙ্গলকামনার সব চেষ্টা করে নেবেন কিন্তু তার নিন্দা করবেন না। স্বামী নেশা করলেও মহাদেব, পেটালেও মহাদেব, চুরি ডাকাতি ছিনতাই করলেও তাই।
পরিসংখ্যান হয়ত বদলেছে তবে খুব আশাজনকভাবে নয়।
মফসসলজীবন, গ্রামীণজীবনের কথা ছেড়ে এবার ধোপদুরস্ত শহুরে জীবনে কী এরকম উদাহরণ নেই? অজস্র উদাহরণ রয়েছে।
অনেক ছোটবেলার একটি স্মৃতি আছে। সেটাই বলি।
তখন, সল্টলেকের বৈশাখী আবাসনে একটি ফ্ল্যাটে আমরা ভাড়া থাকতাম। এক প্রতিবেশী কাকিমার সঙ্গে পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা ছিল। প্রায়ই ওদের বাড়িতে যেতাম। ওদের পাশের ফ্ল্যাটে এক দম্পতি থাকতেন যারা প্রায়ই রণক্ষেত্র করে তুলতেন ফ্ল্যাটটিকে। ঝগড়া, চিৎকার গালাগালি থেকে মারপিট পর্যন্ত। মায়েরা গল্প করত, আমি শুনতাম। একবার সেই ঝগড়া এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে পাড়ার লোক পুলিশে খবর দিল। পুলিশ এসে মারকুটে সেই ভদ্রলোকটিকে তাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে গেল।
এখনো মনে আছে, সেই প্রতিবেশী কাকিমার ঘরের বিছানায় আধশোয়া হয়ে মারকুটে ভদ্রলোকের বউ নীরবে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলেছিলেন, –সকালে উঠে থেকে লোকটা কিছু খায়নি গো।
সোমা দত্ত / মণি-মুক্তো
Reviewed by শব্দের মিছিল
on
সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৫
Rating:
Reviewed by শব্দের মিছিল
on
সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৫
Rating:

খুব পরিচ্ছন্ন এবং আধুনিক মনের প্রকাশ
উত্তরমুছুন