🇮🇳 শ্রীশুভ্র | জন্মতিথিতে শ্রীঅরবিন্দ

“কারুর পক্ষেই আমার জীবনী লেখা সম্ভব নয় কারণ আমার জীবনী মানুষের দৃষ্টিগোচরেই অনুপস্থিত” । বক্তা শ্রী অরবিন্দ। শিষ্য দিলীপ কুমার রায়’কে একটি পত্রে তিনি এই কথা লিখে জানিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ শ্রী অরবিন্দের কথা কেন? আমাদের অনেকেরই স্মরণে থাকে না। এই পনেরোই আগস্টই অরবিন্দের জন্মতিথি। সংখ্যার হিসাবে অধিকাংশ বাঙালির কাছেই এই দিনটি শোকের। শুধুমাত্র মাতৃভাষাকে রক্ষার উদ্দেশে বিশ্বের একমাত্র স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশ বাংলাদেশের জাতির পিতার মৃত্যুদিন আজ। তাই এই দিনটি সেদেশে শোকদিবস। বাঙালির বাকি অংশের কাছে এই দিনটি ভারতের অন্যান্য জাতির মতোই আনন্দের একটি দিন। দিনটি পরাধীনতার থেকে মুক্তির দিন। দিনটি স্বাধীনতা দিবস। কাঁটাতারের উভয় প্রান্তের বাঙালির কাছেই তাই এই দিনটি দুইটি ভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যে হিসাবে এই দিনটি আপামর সকল বাঙালিরই গর্বের দিন। অর্থাৎ বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান শ্রী অরবিন্দের জন্মদিন। সেই হিসেবে প্রায় কোন বাঙালিই এই দিনটি পালন করেন না। না, তার কার্যকারণ নিয়ে আজকের আলোচনা নয়। অনেকে এও বলতে পারেন। অরবিন্দ কি নিজেকেই কোনদিন বাঙালি বলে অনুভব করতে পেরেছিলেন? অনেকে এও বলতে পারেন। শ্রী অরবিন্দের মতো মহাপুরুষদের দেশ কাল জাতির পরিচয়ে বাঁধা সম্ভব নয়। সেই চেষ্টাও অবান্তর। স্বামী বিবেকানন্দ তো নিজ মুখেই বলে গিয়েছিলেন। তিনি নির্দিষ্ট কোন দেশের, জাতির বন্ধনে আবদ্ধ নন। কথাটা এক অর্থে ঠিকই। মহামানবরা যে দেশেই জন্মান। যে জাতিরই অংশ হন না কেন। তাঁরা সকল দেশের সকল জাতির। এবং সকল কালের। এখানেই তাঁদের মহত্ত। 

দুঃখের বিষয়। এমনই মহত্তর একজন ব্যক্তি শ্রী অরবিন্দের জন্মতিথিটি বাঙালি হিসাবে আমরা প্রায় ভুলেই থাকি। একথাও সত্য, শ্রী অরবিন্দ তাঁর জীবনের বেশির ভাগ সময়টাই বাংলার ত্রিসীমানার বাইরেই কাটিয়ে গিয়েছেন। ফলে বাংলা ও বাঙালির সাথে তাঁর সম্পর্ক গভীর হওয়ার কোন রকম সুযোগ পায়নি। তিনি নিজে কতটুকু বাঙালি জাতিকে চিনেছিলেন। সেটা তত বড়ো কথা নয়। কারণ তাঁর সাধনা সকল মানবের মুক্তির জন্য। নির্দিষ্ট ভাবে কোন জাতির জন্য নয়। কিন্তু বাঙালি হিসাবে আমাদের নিজেদের স্বার্থেই। তাঁকে কিছুটা অন্তত চেনার চেষ্টা করার দরকার আছে বইকি। ব্যক্তি স্বার্থেই হোক আর সমষ্টির স্বার্থেই হোক। দুঃখের বিষয়, আমাদের অধিকাংশ বাঙালির কাছেই শ্রী অরবিন্দ, স্কুল পাঠ্য রচনা বইয়ের ভিতরেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়ে গিয়েছেন আজও। তার বাইরে তাঁকে চেনার বা জানার চেষ্টা কিন্তু আমরা বিশেষ করিনি। ফলে আমাদের কাছে তিনি প্রথমে ব্রিটিশ রাজের আমলা হওয়ার লক্ষ্যে স্বচেষ্ট হওয়া আরও পাঁচজন শিক্ষিত পরাধীন ভারতবাসীর মতোন একজন। পরে কলেজের একজন অধ্যাপক, অধ্যক্ষ। তাও বাংলা থেকে কয়েক হাজার মাইল দুরের এক প্রদেশের। পরের পর্বে তিনি স্বাধীনতা যু্দ্ধে নিবেদিত প্রাণ বিপ্লবীদের অন্যতম একজন। সব শেষে বাংলা থেকে বহুদূরে সুদূর দাক্ষিণ্যত্যে চলে যাওয়া একজন যোগীপুরুষ। 

অরবিন্দের জীবনের এই চারটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ের ভিতরে সমন্বয় সাধন করে ব্যক্তি অরবিন্দকে জানার চেষ্টা খুব একটা হয়েছে বলে জানা যায় না। কাজটি কঠিন সন্দেহ নাই। ভাবলে খুবই অবাক হয়ে যেতে হয়। যিনি ব্রিটিশ রাজের আমলা হওয়ার লক্ষ্য সামনে রেখে বিদ্যাশিক্ষা অর্জন করলেন। তিনি সেই কাজে না গিয়ে অধ্যাপনার কাজ দিয়ে জীবন শুরু করলেন। সেই তিনিই আবার দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচনের উদ্দেশ্য মাথায় নিয়ে বিপ্লবী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। নিন্দুকেরা যাই বলুক না কেন। ব্রিটিশের হাতে ধরা পড়ে তাঁর হঠাৎ যোগী শ্রী অরবিন্দ হওয়া নিয়ে। কিন্তু একথাও সত্য। আলিপুর বোমা মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর চিরদিনের মতো বাংলা ত্যাগ করে সুদূর পণ্ডিচেরীতে গিয়ে যোগ সাধনায় সিদ্ধিলাভের বিষয়টি সাধারণ বাঙালির কাছে আজও বোধগম্য নয়। তাই অনেকের কাছেই তিনি আজও পলায়নবাদী ব্যর্থ বিপ্লবী হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে রয়ে গিয়েছেন। বিপ্লবী না যোগী? কে আসল আরবিন্দ? এই প্রশ্ন আজ হয়তো অবান্তর। কিন্তু সাধারণ বাঙালির মনে এই প্রশ্নের আজও কোন মীমাংসা হয়েছে কিনা সন্দেহ। 

তবে এই সব পরিচয় ছাড়িয়েও যে অরবিন্দের আরও একটি সত্য পরিচয় রয়েছে। আমরা অনেকেই প্রায় ভুলতে বসেছি সেই কথা। শ্রী অরবিন্দের সাহিত্যকীর্তির বিষয়ে আসলে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। জানি না তাঁর রচিত মহাসৃষ্টি মহাকাব্য সাবিত্রী’র কথাও। না, ক্ষুদ্র একটি লেখায় শ্রী অরবিন্দকে ধরা কোনভাবেই সম্ভব নয়। সম্ভব নয় সমগ্র অরবিন্দের সম্বন্ধে সামগ্রিক একটি ধারণায় পৌঁছানো। সেই চেষ্টাও করছি না আমরা। আমরা শুধু বিস্ময়ের সাথে উপলব্ধি করছি। একজন মানুষ। কিন্তু কি বহুমুখী কর্মকাণ্ডের এক মহাজীবন! যে জীবনের কোন একটি পর্বের সাথে অন্য একটি পর্বকে মেলানো সাধারণ জীবনবোধের ব্যাপ্তিতে প্রায় অসাধ্য! 

শব্দের মিছিল

কিন্তু স্বয়ং অরবিন্দ! ঠিক কি চেয়েছিলেন তিনি নিজে? আমাদের মতো সাধারণের বোধগম্য কোন অবস্থায় কি পৌঁছাতে চেয়েছিলেন তিনি? মেলাতে চেয়েছিলেন নিজের জীবনের বহুবিধ দিগন্তকে কোন এক উচ্চতর মহত্তর স্বরূপে? না’কি এই পার্থিব জগতের মায়া মোহ লোভ থেকে মুক্তি পাওয়াই ছিল তাঁর সাধনার লক্ষ্য? এই প্রসঙ্গে স্বভাবতঃই স্মরণে আসে গৌতম বুদ্ধের কথা। অরবিন্দের জন্মের কয়েক হাজার বছর আগে গৌতম বুদ্ধও কি যোগের পথে বোধিলাভ করেননি? আসলে গৌতম বু্দ্ধের ‘নিবার্ণ লাভে’র মূল লক্ষ্য ছিল চারপাশের এই ইন্দ্রিয়জগত থেকে নিস্কৃতি। তাঁর সাধনা ছিল জীবনলীলার প্রকাশচক্র থেকে অব্যাহতি পাওয়া। পক্ষান্তরে শ্রী অরবিন্দের লক্ষ্য ছিল ‘জীবনের পূর্ণ রূপান্তর’। অরবিন্দ কোনভাবেই বাস্তব জীবনকে পরিহার করতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন বস্তু জগতকে অধ্যাত্মের আলোয় আলোকিত করে তুলতে। তিনি আমাদের জগতের একটি মূলগত রূপান্তর ঘটানোর সাধনায় এগোতে চেয়েছিলেন। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। বস্তুজগত একাধিক চেতনাস্তরে বিদ্যমান। নিম্নতম চেতনা স্তর থেকে উর্ধতম চেতনা স্তরের ভিতরে যাতায়াতের একটা রাজপথ গড়ে তোলাই ছিল তাঁর প্রাথমিক লক্ষ্য। কারণ তিনি জানতেন নিম্নতম চেতনা স্তর থেকে ক্রমাগত উর্ধতর চেতনা স্তরে উন্নত হওয়াই এই বিশ্বজগতের অন্তঃস্বরূপ। তিনি বিশ্বাস করতেন। একাধিক চেতনা স্তরের অবস্থানে। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, মানুষের সভ্যতা বর্তমানে এমন একটি নিম্নতর চেতনাস্তরে বিদ্যমান। যে স্তরে এত অন্ধকার। এত অসুখ। এত অজ্ঞানতা। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, হাজার বার সৎ পরামর্শ দিয়েও মানুষকে এই নিম্নতর চেতনাস্তর থেকে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় বলেই গৌতম বুদ্ধ থেকে শুরু করে স্বামী বিবেকানন্দ পর্যন্ত কেউই মানবজতিকে উদ্ধার করতে পারেননি। তাঁরা সকলেই একটি জায়গায় ভুল করে বসে ছিলেন। সেটি হল, মানুষ যতক্ষণ না পরবর্তী উর্ধতর চেতনাস্তরে উন্নীত না হচ্ছে। ততক্ষণ কোন মহাপুরুষের সৎ পরামর্শেই কোন কাজ হবে না। আর এইখানেই শ্রী অরবিন্দের অনন্যতা। তিনিই প্রথম ব্যক্তি। যিনি টের পেয়েছিলেন এই মহা সত্যের। নিম্নতর চেতনা স্তরে অবস্থানরত মানবজাতিকে যতক্ষণ না পর্যন্ত উর্ধতর চেতনাস্তরে টেনে তোলা সম্ভব হবে। ততক্ষণ গৌতম বুদ্ধ থেকে শুরু করে স্বামী বিবেকানন্দ। কোন মহামানবেরই দেখানো কোন পথই মানুষের কোন কাজে আসবে না। 

ফলে শ্রী অরবিন্দই প্রথম উপলব্ধি করলেন, যদি কোনভাবে উর্ধতর চেতনা স্তরের আলো ও শক্তিকে নিম্নতর চেতনালোকে নামিয়ে নিয়ে আসা যায়। একমাত্র তবেই সম্ভব হবে বর্তমানে যে নিম্নতর চেতনাস্তরে আমাদের অবস্থান। সেই চেতনাস্তর থেকে উর্ধতর চেতনালোকে মানবজাতিকে টেনে তোলা। না হলে আমাদের মুক্তি নেই। আর নয়তো অপেক্ষা করতে হবে ডারউইনবাদের অভিযো‌জন তত্ত্বের নির্দেশ মতো। বাঁদরের চেতনাস্তর থেকে যে পথে আমরা আজ মানুষের চেতনাস্তরে এসে পৌঁছিয়েছি। একদিন হয়তো সেই পথেরই ক্রমবিকাশে আমরা গিয়ে পৌঁছাবো অতিমানবের চেতনালোকে। কোন একদিন। কবি জীবনানন্দের ভাষায়, “সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে- এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;- সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ”। কিন্তু না, শ্রী অরবিন্দ অত দিনের জন্য নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকার মানুষ ছিলেন না। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। চেতনালোকের এই একাধিক স্তরের ভিতরে একটি রাজপথ যদি একবার গড়ে তোলা যায়। তাহলে সময়ের হাতে দৈবের উপরে ভরসা করে ডারউইনবাদের মতো তত্ত্বের উপরে নির্ভর করে বসে থাকতে হবে না লক্ষ লক্ষ বছর। তার অনেক আগেই সেই রাজপথ দিয়ে উর্ধতর চেতনাস্তরের আলোকিত শক্তিকে নীচে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে আমাদের এই নিম্নতর চেতনালোকে। আর একবার সেই কাজটি সাফল্যের সাথে করে ফেলতে পারলেই কেল্লাফতে। নিম্নতর চেতনালোকে অবস্থানরত এই মানবজাতিকে তখন উর্ধতর চেতনালোকের শক্তিতেই পরবর্তী উর্ধতর চেতনা স্তরে টেনে তোলা সম্ভব হব। আমূল বদলিয়ে যাবে মানব সভ্যতার রূপ ও বিকাশ। চিন্তা চেতনা, বোধ ও শক্তি। স্বরূপ এবং অন্তরাত্মা। 

তাই শ্রী অরবিন্দকে চিনতে হলে। আমাদের শুরু করতে হবে ঠিক এইখান থেকেই। ঠিক কি করতে চেয়েছিলেন মানুষটি। তিনি কি সত্যই ব্রিটিশরাজকে মুচলেকা দিয়ে সন্ন্যাস নিয়ে ফরাসী অধিকৃত পণ্ডিচেরী পালিয়ে ছিলেন আত্মরক্ষার তাগিদে? না’কি সমগ্র মানবজাতিকে সীমাহীন অজ্ঞানতা লোভ ঔদ্ধত্য, অপরিমেয় নীচতা ক্রূরতা শঠতা’র এই নিম্নস্তরীয় চেতনালোক থেকে উদ্ধার করতেই যোগ সাধনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত? বিশ্বাস করেছিলন। এক অসম্ভবকে সম্ভব করার আশা! শ্রী অরবিন্দের মৃত্যুর পর এখনো একশ বছরই পার হয়নি। ফলে আপাতদৃষ্টিতে তাঁর পরিকল্পনা এবং সাধনার কোন বাস্তব প্রতিফলন, জগতের কোথাও দেখা না গেলেও। তিনি বা তাঁর মত ও পথ যে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ছিল। ব্যর্থ ছিল তাঁর সাধনা। একথা বলার সময় আজও আসেনি। কে বলতে পারে। তিনি যে পথের রূপরেখা দিয়ে গিয়েছেন। সেই পথের দিশাতেই সদূর ভবিষ্যতের মানুষ ও মনীষা সেই পথটিই বাস্তবিক ভাবে তৈরী করে ফেলতে পারবে না? খুলে যাবে না একাধিক চেতনাস্তরের ভিতরে চলাচলের এক উন্মুক্ত দিগন্ত? আমাদের আজকের সীমাবদ্ধ চেতনা শক্তিতে যে সম্ভাবনা অলীক স্বপ্নের মতো লাগছে। বিশেষ করে, ফিরে আসি যদি জীবনানন্দেরই সেই অমোঘ উচ্চারণে,  “সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে- এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;- সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ”। না, তাই বলছিলাম। শ্রী অরবিন্দকে বিস্মৃত হওয়ার সময় এখনো আসেনি। এখনই বলা সম্ভব নয়। শ্রী অরবিন্দের মত ও পথ ভ্রান্ত। বরং এখনই সময়। আরও বেশি করে তাঁর মত ও পথ নিয়ে নিরন্তর আলচনা ও সাধনা শুরু করার। তাই আজকের দিনটিতে যদি আমরা তাঁকেও স্মরণ করতে পারি। উপকার ছাড়া ক্ষতি হবে না কোন। 

১৫ই আগস্ট ২০২৩
কপিরাইট শ্রীশুভ্র কর্তৃক সংরক্ষিত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ