জীবন যত এগুতে থাকে, তত বাড়তে থাকে সম্পর্কের জাল। তাতে জড়িয়ে পড়ে মানুষ। সেই সম্পর্কের মধ্যে আছে দুঃখ, আছে আনন্দ। সে সবই যতটা সম্ভব অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়। ভাগ করে নিলে দুঃখের ভার যেমন কমে, তেমনি আনন্দ যায় বেড়ে। এক মুখ থেকে আর এক মুখে ছড়িয়ে যাওয়া হাসি, একজনের চোখ থেকে আর একজনের চোখে ছড়িয়ে যাওয়া আলো যে ভাবের আদান প্রদান করে, তাই বিন্দুকে করে তোলে সিন্ধু। মনের ভিতর কালিমা থাকলে তা অনেকটা মুছে যায়। হৃদয়ে ভার থাকলে তা নেমে যায়। হালকা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে তখন পরিক্রমা করা যায় মন খারাপের পথও।
কিন্তু ভাগ করে নিতে হয়। আসলে নিতে জানতেও হয়। না হলে হয়না। সুখ বা দুঃখ যাই বলি, কোনোটিই মেপে দেখবার তেমন কোনো স্কেল নেই। আনন্দ বেড়ে যাওয়ার বা দুঃখ কমে যাওয়ারও কোন রেডিমেড ফর্মুলা নেই। তবু এগুলো বাড়ে, কমে। মেপে দেখা না গেলেও কতটা খুশি বা আনন্দিত তা অনুভব করা যায়। কতটা দুঃখে কাতর, দুখীজন তা নিজে নিজেই বুঝতে পারে। অন্যরাও কিছুটা পারে বৈকি! দুঃখ চিনতে ভুল হয়না। দেখলেই বোঝা যায়। আসলে দৈনন্দিন জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে শ্রম, ক্লান্তি, মন খারাপ, অবসন্নতা এবং দুঃখ। এগুলো এড়িয়ে থাকা প্রায় অসম্ভব। দীর্ঘদিন এসবের সঙ্গে থাকতে থাকতে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে মন। কারও কারও ক্ষেত্রে ঘনিয়ে আসে চরম বিপর্যয়। ডিপ্রেশনে চলে যায় অনেকে। সেক্ষেত্রেও দরকার অন্যের সঙ্গে তা ভাগ করে নেওয়া। তাহলে তা কমে যায় অনেকটা। মনের ভার অনেকটা লাঘব হয়। অনেক লড়াইই মানুষ একা পারেনা। অন্যকে সঙ্গে নিতে হয়। এ অনেকটা তেমনই।
আনন্দের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সেরকম। আনন্দ ভাগ করে নিলে বাড়ে। কী আশ্চর্য না! একটিকে ভাগ করলে কমে, অন্যটি ভাগ করলে বাড়ে। একগুণ আনন্দ থেকে বহুগুণ আনন্দ। পরম কাঙ্ক্ষিত যা পেলাম, তার একটা আলাদা অনুভূতি আছে। তা কোনো সম্পর্ক থেকে হতে পারে। সাফল্য থেকে আসতে পারে। বেড়ানোর আনন্দ থেকে হতে পারে। অনেক তুচ্ছ কিছু থেকেও হতে পারে। তা শুধু চাওয়া আর পাওয়ার হিসাব মিলে যাওয়ায় নয়, তা এক দ্যুতির মতো, যা শরীর আর মনকে আলোকিত করে তোলে। তা যদি কৃপণের মতো নিজের মধ্যেই বন্দী করে রেখে দিই, অন্য কাউকে তা না জানাই, তার ভাগ না দিই, তাহলে তা শুধু আমার মধ্যেই একচিলতে জায়গা নিয়ে ঘোরাফেরা করবে কিছুক্ষণ। তারপর থিতিয়ে যাবে খুব শিগগির। কিন্তু যদি ছড়িয়ে দিতে পারি, পরিবার, প্রিয়জন বা চেনাজানা মানুষগুলোর সঙ্গে যদি সেই আনন্দ নিয়ে কিছুটা মশগুল হতে পারি, তবে তা ফুলে ফেঁপে উঠবে বহুগুণ। তখন আর তা আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে তার নিজস্ব আভায় রাঙ্গিয়ে তুলবে অন্যদেরও। আবার তাদের থেকে তা বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে আমার কাছেই। তারা যেন সমুদ্রের মতো। যা দেব তা আবার ফিরিয়ে দেবে আমার দিকেই। তাতেই পরিপূর্ণ হয়ে উঠব আমি। আসলে সেইটিই আমার বর্ধিত আনন্দের অবয়ব। সেইটিই সার্থক আনন্দ।
আর এভাবে না পারলে? প্রাপ্তিকে ব্যাপ্তির মধ্যে রাখতে না পারলে তখন তা একপেশে, অর্থহীন, ছোট ছোট স্বার্থের অঙ্গীকার মাত্র। ব্যক্তি জীবন ছাড়িয়ে বৃহত্তর জীবনে এর উদাহরণ তো কিছু কম নেই। সেখানে যে আনন্দের উদযাপন, তার মধ্যে থাকে চূড়ান্ত অহং বোধ। একচ্ছত্র আধিপত্যই তার উৎস। হাজারও সমস্যা বুকে নিয়ে একরকমের নিরানন্দ জীবন যারা যাপন করে চলেছে, সেখানে তাদের কোনো ভাগ নেই। একার আলো সেখানে অন্ধকারের মতোই। অন্যকে তা পথ দেখায়না।
তাই ভাগ করে নিতে হয়। বলা যায় বিলিয়ে দিতে হয়। যত দেবে, তত পাবে। জগতে যে আনন্দ যজ্ঞের অনুষ্ঠান, তা কোথায় হয়, কখন হয় কিছুই জানিনা। কিন্তু আনন্দের তো স্থান আছে জীবনে! আনন্দ তো পায় মানুষ! দরকার সেটুকু পুরোপুরি উপভোগ করা। তাতে অন্যকে অংশীদার করতে পারা। তবেই তা হয়ে উঠবে পূর্ণ আনন্দ। সেইটুকুই জীবনের দাবি।
তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় | জগতে আনন্দ যজ্ঞে
Reviewed by Test
on
জুন ২৮, ২০২৩
Rating:
Reviewed by Test
on
জুন ২৮, ২০২৩
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
সুচিন্তিত মতামত দিন