__" নিন জামাইবাবু, আপনার জন্য সুখবর আছে।"
রাগে গা কিরকির করে ওঠে তরুণের। প্রতি বছর পৌলমীর এইভাবে দেঁতো হাসি দিয়ে ওকে ছ্যাঁকা মারা, সহ্য হয় না ওর। ইচ্ছে করে আচ্ছা করে একটা ঘুঁষি মারে পৌলমীর নাকে, কষে গাল দেয়। কিন্তু উপায় নেই। বলে নাকি 'ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়', যত্তসব গাঁজাখুরি কথা।
এদিকে প্রতিবারের মতো এবারেও যথারীতি ফোন হাতে তরুণের সামনে পৌলমী এসে হাজির। বাধ্য হয়ে ফোন'টা হাতে নিল তরুণ। দাঁতে দাঁত চিপে বলল
__" হ্যাঁ, বলুন, কেমন আছেন আপনারা? শরীর সব ভালো তো? কয়েকদিন আসুন এখানে, ঘুরে যান।"
ফোনের ওপার থেকে তখন এক মহিলা কণ্ঠ, একরাশ আলহাদ নিয়ে গদগদ হয়ে বললেন, যেমন প্রতিবার বলেন,
__" যাবো বাবা, যাবো... আসলে বুঝতেই তো পারছো এই বয়সে শরীরগুলো আমাদের আর...চলে যাচ্ছে একপ্রকার, তবে যাবো, গরমটা কমুক...তা বাবা, সামনের শুক্রবারের জন্য ছুটি অ্যাপ্লাই করেছ তো? ঐদিন কিন্তু এখানে আসতেই হবে, কোনো 'না' শুনবো না...জামাই ষষ্ঠী!"
তরুণ জানতো ফোন'টা কেন তাকে ধরানো হয়েছিল তবুও এই 'জামাই ষষ্ঠী' শব্দ দুটো শুনলেই মাথাটা জ্বলে ওঠে ওর, প্রতিবারই এমন হয়। মনে মনে বলে,
__" নিকুচি করেছে জামাই ষষ্ঠীর! ষষ্ঠীর নাম করে গোটা গুষ্টির খাবার ঐ এক জামাইকে খাইয়ে দেওয়া হয়। শালা, অত পারা যায় নাকি? আরে বাবা, জামাইদেরও তো বয়স বাড়ে নাকি, খাওয়ার ক্ষমতা কমে। কিন্তু কেউ বুঝলে তবে তো!
__" এবার এগুলো বন্ধ করুন, অনেক বছর তো হল, বয়সও বাড়ছে... আর কী পারা যায় অত অত খাবারদাবার?"
তরুণ সামান্য বিরক্তির সুরেই বলল। ফোনের ওপারের বয়স্কা ভদ্রমহিলা কিছুই বুঝলেন না। কিন্তু ফোনের এপারে তার গুণধর পুত্রী ঠিক বুঝে গেলেন। চোখের ইশারায় তরুণকে বলেও দিলেন, 'যত্তসব ঢং, ফকটায় চব্যচোষ্য গেলার সুযোগ পাচ্ছে তার উপর আবার লেকচার...কত রঙ্গ যে দেখবো!'
এদিকে ফোনের ওপার থেকে প্রবীণা বলে উঠলেন,
__" ওমা! সে কী কথা, বয়স বাড়ছে বলে কি জামাইকে ডেকে খাওয়াতে পারবো না? এখনও অতটা অকেজো হইনি বাবা! বেশি কিছু তো করি না, ওই সামান্য একটু মাংস ভাত। সকাল সকাল এসো কেমন?... একটু আগে থেকেই বলে রাখলাম, ছুটির ব্যবস্থা যাতে করতে পারো"।
__" যাহ! শালা! আমি কোথায় আমার বয়স বাড়ার কথা বললাম আর ইনি নিজের বয়সের কথা ভেবে বসলেন! এই হচ্ছে মুশকিল। দুনিয়ার সব শাশুড়িরা মনে করেন, পৃথিবীতে সব কিছুর বয়স বাড়লেও তাদের জামাইদের বয়স কখনো বাড়ে না। নিজের মেয়েটিকে যেমন খুকি ভাবেন তেমনি ভাবেন জামাইটিও তার একদম চিরসবুজ! অথচ কে বোঝাবে, তার ঐ খুকির দৌলতে জামাই বাবাজীবনের সবুজ কবেই উবে গেছে... মাথার চুলগুলো যে হারে পর্ণমোচী গাছের পাতার মত ঝরে ঝরে পড়ে টাক বার করে দিচ্ছে, তাতেই প্রমাণ হয় কী একখানা 'খুকি' দিয়েছেন জামাইয়ের ঘাড়ে!"
মনে মনে এইগুলোই ভাবছিল তরুণ। ভেবেই তাকালো পৌলমীর দিকে। মাইন্ড রিড করে ফেললো না তো? বলা যায় না বাবা! এই মহিলা জাতি যে কী সাংঘাতিক এক জাতি! পুরুষ মানুষ যত যাই বুঝিয়ে বলুক না কেন তার কথা এরা ভুল বুঝবেই বুঝবে। আর যখন পুরুষ মানুষ কিছুই বলে না, তখন আবার ঠিক বুঝে যায় ব্যাটার মনে কী আছে! শাঁখের করাত! মুখ খুললেও দোষ, না খুললেও দোষ। যাইহোক তরুণ একবার সব দাঁত বার করে ওরাংগুটান টাইপ হাসি হেসে শাশুড়ি মা'কে নেকুনেকু ভাব করে বলল,
__" বেশ, বেশ, ছুটির জন্য বলে রাখবো...আপনারা অস্থির হবেন না, আর বেশি কিছু করবেন না...যা গরম পড়েছে এবারে, নিন আপনার মেয়ে'কে দিচ্ছি কথা বলুন"।
নিমন্ত্রণের পাঠ চুকলো, পৌলমীও দু-একটা কথা বলে ফোন রাখলো। তরুণ ততক্ষণে সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছে। টেনশন থেকে মুক্তির এই একটাই উপায়। টেনশন বলে টেনশন! একে তো ষষ্ঠীর দিন'টা ভাবলেই বুক ধড়ফড় করছে। ইয়াব্বড় একটা থালা তার চারপাশে গ্রহ-উপগ্রহের মত ছোটো বড় বাটি...আস্ত একটা সৌরমণ্ডল সাজিয়ে বলা হবে, 'নাও বাবা শুরু কর'। অনেকটা যেন এমন, 'দেখি বাবা তোমার কত দম!' দৃশ্যটা ভাবলেই দম আটকে আসছে তরুণের। তার উপর পৌলমীর আসন্ন বাক্যবাণের কথা ভাবলেই কপালে ঘাম জমতে শুরু করছে ওর।
__" কপাল করে জন্মেছ তোমরা! টাক পড়ে গেল মাথায় অথচ কদর সেই একই রকম। সত্তর পার করা শ্বশুর যাবেন বাজার থেকে সবচেয়ে বড় মুড়োটা আনতে। আর ষাট পার করা শাশুড়ি বসবেন চিংড়ি-মালাইকারির জন্য নারকোল কুড়তে। উফ! জামাই বাবাজীবন বলে কথা! এক্কেরে দেবদূত! সোজ্জা স্বর্গ থেকে নেমে এসে তাদের কন্যাকে উদ্ধার করেছেন!"
__" করেছি তো!"
ফস করে বলে উঠলো তরুণ। পৌলমী দুই ভুরুর মাঝে সন্দেহের রেখা টানলো।
তরুণ দেরি না করে,
__" এ্যাই ওইভাবে তাকাবে না তো! বছর বছর এই ষষ্ঠী এলেই তোমার টিটকিরি শুরু হয়ে যায়! অতই যদি হিংসে, তাহলে বারণ করে দাও না কেন তাদের? কে বলেছে অমন ঘটা করে আমার গুষ্টির ষষ্ঠী পুজো করতে? শালা খেতে পারি না, তবুও খেয়ে যেতেই হবে, খেয়ে যেতেই হবে। ভাবখানা এমন যেন,' নে খা, যত খাবি খা, আরও খেলে আরও খাওয়াবো, যা চাইবি তাই খাওয়াবো... শর্ত একটাই, তোর মাথাটা আমার মেয়েটাকে খেতে দিস, বাদবাকি তুই খা গে যা...।"
পৌলমী এবার একলাফে খাট থেকে নেমে গোটা ঘর দুমদুম করে নেচে নিল। তারপর বিছানা থেকে রিমোট নিয়ে পটাপট মেশিনটার টেমপ্রেচার নামিয়ে দিল, রাগে শরীর মাথা তখন তার আগুন। তাই দেখে তরুণ জমে বরফ, ঠোঁটে ধরে রাখা সিগারেটে জোরে জোরে টান দিতে লাগলো। বড় জ্বালা তরুণের, কিছু বলতে গেলেই বিপদ। আবার না বলে থাকা যায় নাকি? প্রতি বছর এই এক অত্যাচার আর অপমান সহ্য করা যায়! আগে পৌলমী তাও দুক্ষু দুক্ষু মুখ করে বলত,
__'তোমরা কত লাকি গো! তোমরা শ্বশুর বাড়িতে কিছু না করেও কত খাতির পাও। আর আমরা? তিনশ পঁয়ষট্টি দিন কলুর বলদের মত খাটি তবু্ও কোনো ষষ্ঠী ফষ্ঠী জোটে না!'
উত্তরে তরুণ পৌলমীর গা'য়ে পিঠে হাত বুলিয়ে বলত,
__'কেন আমার মা তো তোমাকে একটা সময়, যখন শ্রীরামপুরের চাকরিটা করতে, রোজ সকালে উঠে সিদ্ধভাত করে দিত না? তারপর অফিস থেকে ফিরেও তো প্রায়দিনই চা পেতে। আমরা তো একদিন ষষ্ঠী পাই, তুমি বা তোমার মত আরও কত মহিলা আছে যারা বছরে অনেকদিনই তো এমন ষষ্ঠী পাও!'
শুনে পৌলমী যে শান্ত হত তা মোটেও না।উল্টে বলত ওটা তো নাকি শাশুড়ির ডিউটি, একসাথে থাকতে গেলে একে অপরের জন্য অমন একটু আধটু করতে হয়। কিন্তু ষষ্ঠী হল বিশেষ সম্মান প্রদর্শন, যা বউমাদের জোটে না।
__" নিকুচি করেছে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন! সব মেকি কারবার! বছরের একদিন বলবে, 'সবসে আচ্ছা জামাই আপনা'। আর বাকি তিনশ চৌষট্টি দিন বলবে, 'জন জামাই ভাগ্না তিন নয় আপনা'!
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে তরুণ উত্তর করেছিল। আর ব্যাস তার পরের বছর থেকে পৌলমী এক নতুন ট্রেন্ড শুরু করল, জেন্ডার ইকুয়ালিটির নামে ধুন্ধুমার লেকচার! পেট্রিয়ার্কল সমাজ ব্যবস্থা, মেয়েদের সেকেন্ড সিটিজেন হিসেবে দেখা, তাদের এক্সপ্লয়েট করা, আপার-হ্যান্ড নেওয়া... ইত্যাদি ইত্যাদি সব ইস্যু খাঁড়া করে দিল।
আজও তাই করল বলে, ঘর জুড়ে নাচন বন্ধ হলে হয়!
__" শোনো, তোমরা পুরুষ মানুষেরা যতই পড়াশোনা কর, যতই সফল হও একটা জিনিস কিছুতেই মেনে নিতে পারো না, আর সেটা হল মেয়েদের সমান অধিকার লাভ। এই যে 'জামাই' বলে তোমাদের একটা আলাদা তকমা আছে সেটা যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে তার জন্য তোমরা আমাদের মেয়েদের ঠেলে দিতে পিছুপা হও না।নিজেদের ষষ্ঠী নিয়ে নাক সিঁটকাবে অথচ আমাদের ষষ্ঠীর পথে বাধাও দেবে! একটা পুরুষও কেন বলে না, তার মা-বাবাকে, যে তার বউয়ের জন্যও ষষ্ঠীর ব্যবস্থা হোক? বল, কেন বলে না? তুমি বলেছ কোনোদিন?"
পৌলমী আঙুল উঁচিয়ে প্রশ্ন তুলে ধড়ফড় করে খাটে উঠে এলো, পারলে তরুণের গলা টিপে ধরে। তরুণ সিগারেটে আরও জোরে জোরে টান দিল। তারপর মিনমিন করে,
__" না, বলিনি। বলবও না...কারণ অত চাপ তুমি নিতে পারবে না। মাছের মুড়ো, গলদা চিংড়ি, খাসি, দুনিয়ার ফল সব্জি, তার উপর অত মিষ্টি...অত অত ক্যালরি, তোমার ফিগার নষ্ট হয়ে যাবে না?আর ফিগার নষ্ট হলে আমার তোমাকে আদর করার ইচ্ছেটাও যে নষ্ট হয়ে যাবে। তুমি কি চাও আমি তোমাকে আদর না করি? বল চাও? চাও না তো? তাই বলি না।"
পৌলমী আবার একবার রিমোট খুঁজতে লাগলো। মেশিনটার আবার কিছু টেমপ্রেচার কমিয়ে ঘরময় দুমদুম করে নেচে বেড়ালো। ভেবে পাচ্ছে না এমন অসভ্য, ইগোয়েস্টিক লোকটাকে সে কী বলবে! বয়স্ক শ্বশুর, শাশুড়ি এত খেটে, পয়সা খসিয়ে, আদর করে ডেকে নিয়ে গিয়ে খাওয়ায়। আর সেটাকে নাকি এনার নাটক লাগে, আদিক্ষ্যেতা লাগে! পৌলমীর সহ্যের বাঁধ আর রইল না। আর ঘরময় নাচন নয় এবার সোজা সুর ধরল। নাকের সর্দি টেনে ফ্যাচ ফ্যাচ করে,
__" দুটো বয়স্ক মানুষ এতটা আন্তরিকতার সাথে তোমাকে নিমন্ত্রণ করে ভালো মন্দ খাওয়ায়, আদর দেয়, সম্মান দেয় সেই মানুষ দুটোর প্রতি কোনো কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা তুমি ফিল কর না? এমন যত্ন-খাতির আর কোথাও পেয়েছ? পাবে কোথাও?"
তরুণ দেখলো ঝড়ের তান্ডব থেমেছে, বিপদ কেটেছে। এখন মুষলধারে বইবে কিচ্ছুক্ষণ। সিগারেটটা তাই ফেলে তরুণ এবার গুছিয়ে বসল,
__"কে বলল আমায় তারা সম্মান দেবেন বলে আমার খাতির করেন? কোন্ শ্বশুর বা শাশুড়ি এমন করেন? জামাই ষষ্ঠী জামাইদের উৎসব এই কথাটা কোথায় বলা আছে? তুমি শুধু উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট আর জেন্ডার ইকুয়ালিটি নিয়ে নাচনকোঁদন করতে পারো, গভীরে গিয়ে কিসুই বোঝো না"।
পৌলমী কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে তাকালো, 'লোকটা বলে কী? জামাই ষষ্ঠী জামাইদের জন্য নয়?'
__" তোমরা মেয়েরা ক্ষুরধার বুদ্ধি ধর। ঠিক ছলেবলে এই জামাই ষষ্ঠী চালু করে দিয়ে যুগে যুগে নিজেদের জন্য একটা পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করে নিয়েছ। মেয়ের মা চব্য চোষ্য খাইয়ে জামাইটিকে কাবু করবেন আর তারপর আকারে ইঙ্গিতে বলবেন, 'অনেক রসগোল্লা, রসমালাই খাইয়েছি বাবা তোমায়, পরিবর্তে মেয়েটিকে রসেবশে রেখো'। ব্যাস! জামাই ঘুষ খেয়ে গেল। ঠিক এইভাবেই, প্রজন্মের পর প্রজন্ম জামাইরা ঘুষ খেয়ে চলেছে। যে মেয়েটির আজ রসেবশে থাকা নিশ্চিত হল সেই মেয়েটিই পরে তার মেয়ের রসেবশে থাকা নিশ্চিত করবে...তার জামাইটাও ভাববে, 'আহা কী সম্মানটাই না পেলাম'। কিন্তু আসলে জামাই ষষ্ঠী সম্মান নয়, সমন। বাড়ি ডেকে নিয়ে গিয়ে মিষ্টি করে বুঝিয়ে দেওয়া, 'একদম বেশি ট্যাঁ ফোঁ করবি না, মেয়ে দিয়েছি, ঠিকঠাক রাখবি তাকে। তাহলে আমরাও তোকে ঠিকঠাক রাখবো'।
তরুণ এবার সামনে থেকে দু'হাত পৌলমীর কাঁধে রেখে,
__" বুঝলে ম্যাডাম! আমাদের জামাই ষষ্ঠী আসলে তোমাদের মেয়ে ষষ্ঠী। এটা নামেই জামাইদের জন্য, আসলে উল্টো। এটা এক ধরনের ইনসিওরেন্স, মেয়ের দাম্পত্য জীবনের ইনসিওরেন্স...আর ওই খাওন-দাওন, ওইগুলো হল গিয়ে ইয়ারলি প্রিমিয়াম, দিতে হয়। আমরা ছেলেরা সব গবেট! কখনো ভেবেও দেখিনি এমন পলিসি আমাদের জন্যও দরকার। কোনোদিন কোনো বাবা কি তার বউমাকে এমন প্রিমিয়াম দিয়ে ছেলের দাম্পত্যের ইনসিওরেন্স করার কথা ভেবেছেন? ভাবেননি। আর তুমি বলছ আমরা পুরুষরা পেট্রিয়ার্কল ব্যবস্থায় অভ্যস্ত, ইগোয়েস্টিক? ধুর আমাদের মত পাঁঠা আর দুটো নেই। বুঝতেও পারি না যে, শাশুড়ির জন্য দইয়ের হাঁড়ি আর লাল পেড়ে শাড়ি নিয়ে সেখানে জামাই হতে নয়, জবাই হতে যাচ্ছি, এক্কেরে বলির পাঁঠার মত, সেজেগুজে, আতর ঢেলে গিয়ে সোজ্জা ঘ্যাঁচাং ঘ্যাঁচ।"
পৌলমী হাঁ করে তাকিয়ে তরুণের মুখের দিকে। কিছুই বলতে পারছে না, সব কেমন এলোমেলো লাগছে। লোকটা যে কী এক অদ্ভুত পদার্থ কে জানে! পৌলমীর তিলে তিলে আয়ত্ত করা ফেমিনিজমের তত্ত্বটাই ব্যাটা গুলিয়ে দিল। ওর নিজের জন্য ভিকটিম ভিকটিম ফিলিংসটাই ঘেঁটে গেল। মন'টা খিচখিচ করতে লাগলো পৌলমীর। এতদিন প্রাপ্য সম্মান পাচ্ছিল না বলে একটা ফেমিনিস্টিক ক্ষোভ ছিল, এখন ফেমিনিস্টিক ক্ষোভটাই থাকছে না দেখে নতুন ক্ষোভ হচ্ছে। খুব মুশকিল। মেয়েরা যেদিকেই যাক না কেন এই পুরুষগুলো হেয় করবেই করবে।
তাছাড়াও তরুণের ব্যাখাটা যদি ঠিক হয় তাহলে সেটাও তো মেয়েদের জন্য একটা অপমান! মেয়েরা এতই অবলা যে তাদের সুরক্ষা, নিরাপত্তার জন্য তাদের মা-বাবা জামাইকে মাছের মুড়ো খাওয়াবে? ছিঃ এমন সস্তা ডিল! এমন হিউমিলিয়েশন! শুধু মহিলা বলে!
__" এ্যাই শোনো, পারলাম না মানতে তোমার ফালতু যুক্তি, আমাদেরকে কী ভাবো তোমরা? আমরা এতটাই দুর্বল, অসহায় যে আমাদের ইনসিওরেন্স লাগে? আর আমাদের মা-বাবা বছর বছর প্রিমিয়াম ভরে? ছি ছি, এই চোখে মেয়েদেরকে দ্যাখো, হাউ চিপ! যেমন করেই হোক মেয়েদের সেকেন্ড সিটিজেন ভাবতেই হবে, না?"
__" লে হালুয়া, তোমাদেরও কি যেমন করেই হোক নিজেদের ভিকটিম ভাবতেই হবে? জামাই ষষ্ঠী জামাইদের জন্য হলে বলবে, 'কেন শুধু জামাইদের জন্য হবে? কেন মেয়ে-বউদের জন্য হবে না?'
আবার যদি বলি জামাই ষষ্ঠী মেয়ে-বউদের জন্যই, জামাইদের জন্য নয়। তখনও বলবে, 'কেন শুধু মেয়ে-বউদের জন্য? আমরা কি সব ফেলনা?'
আজব তো! তোমাদের সমস্যাটা ঠিক কী বল তো? তোমরা আমাদের টপকে সামনে যেতে চাও নাকি আমাদের পিছনে থেকে আমাদের বাঁশ দিতে চাও? কোনটা তোমাদের ঠিক আনন্দ দেয় বল তো?"
__" আমি কিছু জানি না"।
বলেই পৌলমী আবার নাকের সর্দি টেনে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্না জুড়ে দিল। তরুণ এবার আর কথা না বাড়িয়ে পৌলমীকে বুকে টেনে নিল,
__" থামো এবার, অনেক হয়েছে। এবার না হয় আমি তোমার শাশুড়িকে বলব তোমার ষষ্ঠী করতে, বাজারহাট সব আমি করব...তুমি কব্জি ডুবিয়ে খেও আর মা'কে কথা দিও যে তুমি তার ছেলেকে রসেবশে রাখবে...কী, ঠিক আছে?"
পৌলমী গোলগোল চোখ পাকিয়ে,
__"বয়ে গেছে তোমাকে রসেবশে রাখতে, চাই না ষষ্ঠী...আমি ঘুষ কোন দুঃখে নিতে যাবো? যা স্বাভাবিক, তাই করব, কমও না বেশিও না"।
তরুণ জোর হেসে উঠলো,
___ "এই যে মিস কর্ডেলিয়া ঠিক এই কথাটাই আমারও বলা, যা স্বাভাবিক তাই করা হোক, না কম, না বেশি। তোমার মা-বাবাকেও সেটা বোলো...ওসব ষষ্ঠী ফষ্ঠী না করে দুজনকে একদিন নিমন্ত্রণ করুক। খাসির পাতলা ঝোল আর চাটনি। ব্যাস! আর এটাও বোলো, তাদের জামাই তাদের মেয়েকে এমনিই ভালো রাখবে, কোনো ইয়ারলি প্রিমিয়াম লাগবে না...শুধু মাথা থেকে ফেমিনিজমের ভূতটা নামিয়ে দিতে পারলে উপকার হয়।"
__"কে বলল আমায় তারা সম্মান দেবেন বলে আমার খাতির করেন? কোন্ শ্বশুর বা শাশুড়ি এমন করেন? জামাই ষষ্ঠী জামাইদের উৎসব এই কথাটা কোথায় বলা আছে? তুমি শুধু উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট আর জেন্ডার ইকুয়ালিটি নিয়ে নাচনকোঁদন করতে পারো, গভীরে গিয়ে কিসুই বোঝো না"।
পৌলমী কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে তাকালো, 'লোকটা বলে কী? জামাই ষষ্ঠী জামাইদের জন্য নয়?'
__" তোমরা মেয়েরা ক্ষুরধার বুদ্ধি ধর। ঠিক ছলেবলে এই জামাই ষষ্ঠী চালু করে দিয়ে যুগে যুগে নিজেদের জন্য একটা পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করে নিয়েছ। মেয়ের মা চব্য চোষ্য খাইয়ে জামাইটিকে কাবু করবেন আর তারপর আকারে ইঙ্গিতে বলবেন, 'অনেক রসগোল্লা, রসমালাই খাইয়েছি বাবা তোমায়, পরিবর্তে মেয়েটিকে রসেবশে রেখো'। ব্যাস! জামাই ঘুষ খেয়ে গেল। ঠিক এইভাবেই, প্রজন্মের পর প্রজন্ম জামাইরা ঘুষ খেয়ে চলেছে। যে মেয়েটির আজ রসেবশে থাকা নিশ্চিত হল সেই মেয়েটিই পরে তার মেয়ের রসেবশে থাকা নিশ্চিত করবে...তার জামাইটাও ভাববে, 'আহা কী সম্মানটাই না পেলাম'। কিন্তু আসলে জামাই ষষ্ঠী সম্মান নয়, সমন। বাড়ি ডেকে নিয়ে গিয়ে মিষ্টি করে বুঝিয়ে দেওয়া, 'একদম বেশি ট্যাঁ ফোঁ করবি না, মেয়ে দিয়েছি, ঠিকঠাক রাখবি তাকে। তাহলে আমরাও তোকে ঠিকঠাক রাখবো'।
তরুণ এবার সামনে থেকে দু'হাত পৌলমীর কাঁধে রেখে,
__" বুঝলে ম্যাডাম! আমাদের জামাই ষষ্ঠী আসলে তোমাদের মেয়ে ষষ্ঠী। এটা নামেই জামাইদের জন্য, আসলে উল্টো। এটা এক ধরনের ইনসিওরেন্স, মেয়ের দাম্পত্য জীবনের ইনসিওরেন্স...আর ওই খাওন-দাওন, ওইগুলো হল গিয়ে ইয়ারলি প্রিমিয়াম, দিতে হয়। আমরা ছেলেরা সব গবেট! কখনো ভেবেও দেখিনি এমন পলিসি আমাদের জন্যও দরকার। কোনোদিন কোনো বাবা কি তার বউমাকে এমন প্রিমিয়াম দিয়ে ছেলের দাম্পত্যের ইনসিওরেন্স করার কথা ভেবেছেন? ভাবেননি। আর তুমি বলছ আমরা পুরুষরা পেট্রিয়ার্কল ব্যবস্থায় অভ্যস্ত, ইগোয়েস্টিক? ধুর আমাদের মত পাঁঠা আর দুটো নেই। বুঝতেও পারি না যে, শাশুড়ির জন্য দইয়ের হাঁড়ি আর লাল পেড়ে শাড়ি নিয়ে সেখানে জামাই হতে নয়, জবাই হতে যাচ্ছি, এক্কেরে বলির পাঁঠার মত, সেজেগুজে, আতর ঢেলে গিয়ে সোজ্জা ঘ্যাঁচাং ঘ্যাঁচ।"
পৌলমী হাঁ করে তাকিয়ে তরুণের মুখের দিকে। কিছুই বলতে পারছে না, সব কেমন এলোমেলো লাগছে। লোকটা যে কী এক অদ্ভুত পদার্থ কে জানে! পৌলমীর তিলে তিলে আয়ত্ত করা ফেমিনিজমের তত্ত্বটাই ব্যাটা গুলিয়ে দিল। ওর নিজের জন্য ভিকটিম ভিকটিম ফিলিংসটাই ঘেঁটে গেল। মন'টা খিচখিচ করতে লাগলো পৌলমীর। এতদিন প্রাপ্য সম্মান পাচ্ছিল না বলে একটা ফেমিনিস্টিক ক্ষোভ ছিল, এখন ফেমিনিস্টিক ক্ষোভটাই থাকছে না দেখে নতুন ক্ষোভ হচ্ছে। খুব মুশকিল। মেয়েরা যেদিকেই যাক না কেন এই পুরুষগুলো হেয় করবেই করবে।
তাছাড়াও তরুণের ব্যাখাটা যদি ঠিক হয় তাহলে সেটাও তো মেয়েদের জন্য একটা অপমান! মেয়েরা এতই অবলা যে তাদের সুরক্ষা, নিরাপত্তার জন্য তাদের মা-বাবা জামাইকে মাছের মুড়ো খাওয়াবে? ছিঃ এমন সস্তা ডিল! এমন হিউমিলিয়েশন! শুধু মহিলা বলে!
__" এ্যাই শোনো, পারলাম না মানতে তোমার ফালতু যুক্তি, আমাদেরকে কী ভাবো তোমরা? আমরা এতটাই দুর্বল, অসহায় যে আমাদের ইনসিওরেন্স লাগে? আর আমাদের মা-বাবা বছর বছর প্রিমিয়াম ভরে? ছি ছি, এই চোখে মেয়েদেরকে দ্যাখো, হাউ চিপ! যেমন করেই হোক মেয়েদের সেকেন্ড সিটিজেন ভাবতেই হবে, না?"
__" লে হালুয়া, তোমাদেরও কি যেমন করেই হোক নিজেদের ভিকটিম ভাবতেই হবে? জামাই ষষ্ঠী জামাইদের জন্য হলে বলবে, 'কেন শুধু জামাইদের জন্য হবে? কেন মেয়ে-বউদের জন্য হবে না?'
আবার যদি বলি জামাই ষষ্ঠী মেয়ে-বউদের জন্যই, জামাইদের জন্য নয়। তখনও বলবে, 'কেন শুধু মেয়ে-বউদের জন্য? আমরা কি সব ফেলনা?'
আজব তো! তোমাদের সমস্যাটা ঠিক কী বল তো? তোমরা আমাদের টপকে সামনে যেতে চাও নাকি আমাদের পিছনে থেকে আমাদের বাঁশ দিতে চাও? কোনটা তোমাদের ঠিক আনন্দ দেয় বল তো?"
__" আমি কিছু জানি না"।
বলেই পৌলমী আবার নাকের সর্দি টেনে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্না জুড়ে দিল। তরুণ এবার আর কথা না বাড়িয়ে পৌলমীকে বুকে টেনে নিল,
__" থামো এবার, অনেক হয়েছে। এবার না হয় আমি তোমার শাশুড়িকে বলব তোমার ষষ্ঠী করতে, বাজারহাট সব আমি করব...তুমি কব্জি ডুবিয়ে খেও আর মা'কে কথা দিও যে তুমি তার ছেলেকে রসেবশে রাখবে...কী, ঠিক আছে?"
পৌলমী গোলগোল চোখ পাকিয়ে,
__"বয়ে গেছে তোমাকে রসেবশে রাখতে, চাই না ষষ্ঠী...আমি ঘুষ কোন দুঃখে নিতে যাবো? যা স্বাভাবিক, তাই করব, কমও না বেশিও না"।
তরুণ জোর হেসে উঠলো,
___ "এই যে মিস কর্ডেলিয়া ঠিক এই কথাটাই আমারও বলা, যা স্বাভাবিক তাই করা হোক, না কম, না বেশি। তোমার মা-বাবাকেও সেটা বোলো...ওসব ষষ্ঠী ফষ্ঠী না করে দুজনকে একদিন নিমন্ত্রণ করুক। খাসির পাতলা ঝোল আর চাটনি। ব্যাস! আর এটাও বোলো, তাদের জামাই তাদের মেয়েকে এমনিই ভালো রাখবে, কোনো ইয়ারলি প্রিমিয়াম লাগবে না...শুধু মাথা থেকে ফেমিনিজমের ভূতটা নামিয়ে দিতে পারলে উপকার হয়।"
পৌলমী কপট রাগ নিয়ে মাথা তুলে তরুণের দিকে তাকালো। তরুণ ফিচ করে হেসে পৌলমীকে বুকে জাপ্টে ধরল। অমনি ঘরের টেমপ্রেচার চড়চড় করে বাড়তে লাগলো, যদিও মেশিন তার সাধ্যমতো ঘরটা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছিল।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন