নীলাঞ্জনা মল্লিক

নীলাঞ্জনা মল্লিক

অফিসের ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে একবার ভালো করে দেখে নিল শ্রেয়া। টিপ টা কখন যে খুলে পড়ে গেছে কে জানে! ব্যাগের মধ্যে থেকে আর একটা বের করে লাগিয়ে নিল কপালে। টিপ ছাড়া তাকে কেমন যেন অসম্পূর্ণ দেখায়! তার নিজেরই কিরকম একটা অস্বস্তি লাগে। বহুদিন বাদে বর্ষা নামলো। আজ সকাল থেকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। বৃষ্টি পড়লে মনটা বেশ অদ্ভুত একটা আনন্দে ভরে ওঠে শ্রেয়ার।জানালার কাঁচের শার্সি ভিজে যাচ্ছে বৃষ্টির জলে। কাজের ফাঁকে বার বারই চোখ চলে যাচ্ছে ওদিকে। ইশ্! এইসময়ে যদি এককাপ কফি আর একটা প্রিয় কবিতার বই নিয়ে বসা যেত!! কিন্তু সে উপায় কোথায়? কাজের যা প্রেসার!!.. এ এক অদ্ভুত অনুভূতি! তারাই বুঝবে- যারা শ্রেয়ার মত বৃষ্টি আর কবিতা ভালোবাসে, ঠিক যেমন অরূপ। গত দুদিন হলো, অরূপ জ্বরে ভুগছে। অফিসে আসতে পারছেনা। ও না এলে আজকাল ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগে শ্রেয়ার।একবছর হলো এই অফিসে জয়েন করেছে অরূপ। সেই প্রথম দিন থেকেই তার শ্রেয়ার সাথে বন্ধুত্বের সূত্রপাত। শ্রেয়ার প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো এই কোম্পানীতে।

একইরকম মানসিকতার মানুষদের মধ্যে, বিনি সুতোয় গাঁথা একটা সম্পর্ক যেন আগে থেকেই তৈরি হয়ে থাকে। অরূপের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকেই শ্রেয়া সেটা টের পেয়েছে। অরূপ ঠিক তারই মত স্বল্পভাষী, কবিতা পছন্দ করে, কাজের ফাঁক পেলেই গান শোনে.... ঠিক সেইসব গান- যেগুলো শ্রেয়ারও পছন্দের তালিকায় উপস্থিত। অদ্ভুত মিল দুজনের রুচিবোধে। রোজ অফিস থেকে বেরোবার আগে কিছুক্ষণ ক্যান্টিনে বসে একসাথে সময় কাটিয়ে তারপর বাড়ি ফেরে ওরা। দুদিন ধরে অরূপ না আসায় মন মেজাজ ঠিক ভালো নেই শ্রেয়ার। তার ওপরে আজ এত ভালো ওয়েদার.. কত ভালোই না হত, যদি আজ অফিসের শেষে অরূপের সাথে একটু সময় কাটানো যেত! বন্ধুত্বের বাইরেও ওর প্রতি একটা বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করে শ্রেয়া। কিন্তু সেটা আজ পর্যন্ত কোনওদিন প্রকাশ করেনি সে। কে জানে, অরূপের মনে তার জন্যে আদৌ সেরকম কোনোও জায়গা আছে কিনা! শ্রেয়া নিজের সমস্ত আবেগ মনের গভীর অন্ধকারেই লুকিয়ে রেখেছে। কাউকে জানায়নি । মা কেও না। কেমন একটা কুন্ঠাবোধ কাজ করে মনের ভেতর। অরূপ তার থেকে তিন বছরের ছোট। দেখতেও বেশ ভালো। ফর্সা,লম্বা... এককথায় বেশ সুদর্শন। চেহারার দিক থেকে একেবারেই বেমানান শ্রেয়ার পাশে। আপাত দৃষ্টিতে শ্রেয়াকে কোনমতেই সুন্দরী বলা যায়না। গায়ের রং খুব কালো হওয়ার জন্যে তার মা কে বরাবর শুনে আসতে হয়েছে- "এই মেয়ে কে পার করবে কি করে গো সুতপা?".. খুব রাগ ধরতো ওর। ‘পার করা’ মানে টা কি? সেকি অক্ষম নাকি যে তাকে পার করতে হবে? শ্রেয়ার মা সুতপাদেবী অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা। বাবা মারা গেছেন বারো বছর আগে। পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে জয়েন করার কয়েকদিন পরে তার ছোটমামা একজন সুপাত্রের সন্ধান দিয়েছিলেন সুতপাদেবীকে। সেই পাত্রপক্ষ একদিন দল বেঁধে শ্রেয়াকে দেখতেও আসে। কুৎসিত মেয়েকে যতটা সম্ভব সুন্দর করে তোলা যায় - সে ব্যাপারে সেদিন চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেনি তার বাড়ির লোক। কাকিমা তিন চারটে বাছাই করা শাড়ি নিয়ে এসে তার গায়ে ফেলে পরখ করে দেখছিল- কোন রঙটায় একটু উজ্জ্বল দেখাতে পারে তাকে। পিসি নিয়ে এসেছিল বেশ নামী দামী ব্র্যান্ড্রের বহুমূল্যবান সব প্রসাধনী। পাশের বাড়ির জেঠিমা খুব ভালো সাজাতে পারেন। তিনিও সেদিন সুতপাদেবীর অনুরোধে এসে নিজের সমস্ত পারদর্শিতা উজাড় করে দিয়েছিলেন শ্রেয়াকে সুন্দর করে তোলার চেষ্টায়। কিন্তু এতসব কিছু সত্ত্বেও, সেদিন তাকে দেখামাত্রই ভ্রু কুঁচকেছিলেন পাত্রের মা। খুব রুক্ষ গলায় বলেছিলেন সুতপাদেবীকে- "ছবি যেটা পাঠিয়েছিলেন, তাতে তো গায়ের রঙ টা বোঝা যায়নি!!"

নিজেকে খুব ছোট মনে হয়েছিল শ্রেয়ার সেদিন। সে কি এতটাই ফালতু আর সস্তা? শুধুমাত্র বাহ্যিক সৌন্দর্য্যই কি একজনের যোগ্যতার মাপকাঠি ? শ্রেয়ার শিক্ষা, রুচি, স্বভাব - এসবের কোনও দাম নেই এদের কাছে? সেদিনই মা কে জানিয়ে দিয়েছিল .... আর কোনওদিন ওভাবে সেজেগুজে কারোর সামনে নিজেকে এক্সহিবিট করবে না সে। দরকার নেই তার বিয়ের পিড়িতে বসবার। সুতপাদেবী যদিও অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন মেয়েকে... কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। হাজার বোঝানো সত্ত্বেও কিছুতেই নিজের সিদ্ধান্ত থেকে বিচ্যুত করা যায়নি শ্রেয়াকে।বয়স বাড়তে বাড়তে এখন চৌত্রিশে পা দিয়েছে সে। মাঝে মাঝে মনে হয় ওর... অরূপও কি আর পাঁচজনের মত ওকে শুধুমাত্র বাইরের রূপটা দেখেই বিচার করবে? ওকে দেখে তো সেরকম মনে হয়না.. আর অরূপ যদি ওকে পছন্দ করেও- ওর বাবা মা? ওনারা কি মেনে নেবেন শ্রেয়াকে? বেশ কিছুদিন ধরে এসব নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ওর মাথায়।তবে আস্তে আস্তে প্রস্তুত হচ্ছে সে। আর দেরি নয়। এবার ও বলেই ফেলবে অরূপকে সবকিছু। সমস্ত কুন্ঠাবোধ এবার কাটিয়ে উঠতে হবে।

অনেকক্ষণ ধরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। আজ আর বাসের জন্যে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছেনা । এসময়টা বেশ ভিড় থাকে বাসে। চটপট একটা শেয়ার ক্যাব বুক করে নিল শ্রেয়া। সেক্টর ফাইভ থেকে বারাসাত যাবে সে। ওঠার সময় গাড়িটিকে খালিই পেল সে। বন্ধ গাড়ির ভেতর থেকে বৃষ্টি দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে। যাওয়ার পথেই একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার কল করলো অন্য এক সহযাত্রীকে- "আপনার লোকেশনে দাঁড়িয়ে আছি স্যার।" কয়েক মুহুর্ত পরে একটা ছাতা মাথায় দুই যুবক-যুবতীকে গাড়ির দিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। মেয়েটা এসে পিছনের সিটে শ্রেয়ার পাশে বসলো। ছেলেটি বসলো সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটটাতে।

"সেই ভিজিয়েই ছাড়লে তো আমাকে? বার বার বলেছিলাম আর একটা ছাতা নাও..."

-মেয়েটা বললো বসার পরে। ছেলেটা কিছু উত্তর দেওয়ার জন্যে ঘাড় ঘোরাতেই দৃষ্টি বিনিময় ঘটলো শ্রেয়ার সঙ্গে। আরে, এ যে অরূপ! গাড়ির ভেতর প্রায়ান্ধকারেও চিনতে অসুবিধা হলোনা...

-"একি তুই? আজ ক্যাবে বাড়ি ফিরছিস?"

পুরো ব্যাপারটায় কেমন যেন হকচকিয়ে গেল শ্রেয়া । কোনওভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো...

-"আসলে আজ এত বৃষ্টি হচ্ছে তাই আর কি... কিন্তু তুই এখানে কোথায়.....?"

-"বলছি। তার আগে আলাপ করিয়ে দিই। লিপিকা - আমার ফিয়ন্সে, জামশেদপুরে থাকে ..এখানে এসেছে ইন্টারভিউ এর জন্যে ...তোকে বলবো বলবো করেও বলা হয়নি ওর কথা....."

কথার মাঝখানেই অরূপকে থামিয়ে বলে উঠলো মেয়েটা- "আর তুমি হলে শ্রেয়া দি.... তাই না?"

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে হেসে অরূপের দিকে তাকালো শ্রেয়া। নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে একটু ঠাট্টামিশ্রিত ভঙ্গিতে বললো-"কিরে? তোর নাকি জ্বর?"

শ্রেয়ার কথায় চোখ টিপে হেসে অরূপ কৌতুকপূর্ণ স্বরে বললো- "ওসব না বললে ওই কুমড়োপটাশ বস ছুটি দেবে ? কাল জয়েন করবো.."

বৃষ্টিটা আজ থামছেই না একেবারে। গাড়ি এগিয়ে চলেছে।

"তুমি এখানে কতদিন আছ?" - ফের লিপিকার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো শ্রেয়া।

- "এই উইকটা থাকবো। এখানে কৈখালিতে আমার মাসির বাড়ি। ওখানেই আছি এখন.. দেখি এই জব টা যদি পেয়ে যাই, তাহলে তো...."

-"এই আর একটু এগিয়ে নামবো দাদা.."- ড্রাইভারকে নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি থামাতে বলে শ্রেয়ার দিকে ঘুরে তাকালো অরূপ। -"চলি রে শ্রেয়া.. ওকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। কাল দেখা হচ্ছে অফিসে।"

দুজনেই নেমে গেল গাড়ি থেকে।শ্রেয়া অত্যন্ত সাবলীলভাবে ওদের বিদায় জানালো। বৃষ্টিটা আরও জোরে এলো যেন। বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো শ্রেয়ার। বেশ মিষ্টি দেখতে লিপিকাকে। ভালো মানাবে ওদের। ফোনটা ভাইব্রেট করছে ব্যাগের ভেতর। মায়ের ফোন। কলটা রিসিভ করে ক্লান্ত গলায় বললো-"আমি ক্যাবে ফিরছি মা, বাড়ির সামনেই নামবো। চিন্তা কোরো না।"

শহরের কোলাহলের সাথে বৃষ্টির শব্দ মিশে একাকার হয়ে কিরকম একটা মনখারাপের আবরণ তৈরি করছে চারপাশে। রুমালটা নিয়ে চোখ ঢাকলো শ্রেয়া। গাড়ি ছুটে চলেছে গন্তব্যের দিকে।অনেকক্ষণ ধরে চেপে রাখা কান্না হঠাৎ নিঃশব্দে বেরিয়ে এসে ভিজিয়ে দিলো রুমালটাকে।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ