পর্দার ফাঁক দিয়ে একদৃষ্টে ঘরের ভিতরে তাকিয়ে ছিল আশালতা। দেওয়ালে টাঙানো একটা অনেক পুরনো সাদা-কালো তিনজনের ফটো। আশালতার মনে আছে, খোকনের দুবছরের জন্মদিনের দিন দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিয়ে ফেরার মত তোলা হয়েছিল ফটোটা। ঘরে কোণে পুরনো চেয়ার টেবিলে সুন্দর পরিপাটি করে গোছানো কয়েকটা বইখাতা, তারপাশে সযত্নে রাখা কলমদানিটা। খোকন তখন কলেজে পড়ে, বন্ধুদের সঙ্গে হাজারদুয়ারী বেড়াতে গিয়ে বাবার জন্য নিয়ে এসেছিল। সামান্য কাঠের তৈরি একটা কলমদানি, কতবছর আগের জিনিস; তবু খোকনের আনা প্রথম উপহার বলে সযত্নে সবসময় চোখের সামনে রাখা আছে। ছোট শোকেসের মাথাটা টিভিটা ঢাকা দেওয়া। শোকেস ভর্তি খোকনের স্পোর্টসে পাওয়া প্রাইজ। আলনায় জামাকাপড়গুলো পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা আছে। কোন জিনিসটা এতটুকু অগোছালো পছন্দ নয় মানুষটার। বিছানার চাদরটা এখনও টানটান। গায়ের চাদরটা বুক অবধি টানা। নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে অনেকদিন পর। টেবিলের সামনের জানলাটার একটা পাল্লা খোলা। শিরশিরে উত্তরে হাওয়া এসে গোটা ঘরটাতে কেমন যেন একটা ছায়ামাখা হিম হিম ভাব। ফাল্গুনের মাঝামাঝি, তবু যেন শীতের আমেজ থেকে গেছে। বিদায় নেওয়ার আগে সকাল-সন্ধে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে যাচ্ছে।
অনেকদিন হল যেন ভালো করে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে আজ।
-খোকন হয়ত এখনও জেগে, তাই না গো?
চুপ করে থাকত আশালতা।
-প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে চিঠি লেখে খোকন। একদিনও ফোন করে না কেন কে জানে!
-মোবাইলের টাওয়ার থাকে না হয়ত।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, নাকটা টেনে নিয়ে জবাব দিত আশালতা। কান্নাটাকে গোপন করতে পাশ ফিরে শুলেও টের পেত পাশের মানুষটা জেগে আছে। অন্ধকারেও আশালতা বুঝতে পারত মানুষটা যেন প্রতিদিন একটু একটু ক্ষয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই তো ডাক্তারবাবু বলে দিয়েছেন, খুব বেশি হলে আর হয়তো একটা বছর।
মনে মনে হিসাব করে আশালতা, এক বছর হতে এখনও আড়াই মাস বাকি ছিল।
-মাসিমা, এখানে দাঁড়িয়ে কেন? ভিতরে গিয়ে মেসোমশায়ের পাশটাতে বসুন একটু।
একটু বেশিই বোধহয় আনমনা হয়ে পড়েছিল আশা, তাই সামান্য এইটুকু কথাতেই কেমন যেন চমকে ওঠে। পিছন ফিরে দেখে, পাশের বাড়ির সাগরের বৌ। সকালবেলা আশালতার কান্না শুনে ওরাই প্রথম ছুটে এসেছিল। তারপর অবশ্য পাড়ার সবাই এসেছে, খোকনের বন্ধুরা এসেছে। বাড়িতে এখন অনেক লোকজন।
-বসুন এখানে।
হাত ধরে এনে বিছানা এনে বসায় আশালতাতে। অভ্যাস মত গায়ের চাদরটা টেনে দিতে গিয়েও হাতটা সরিয়ে নেয়। গতরাতে বিছানার এখানটাতেই শুয়েছিল। এই তো কিছুক্ষণ আগেই উঠে গেছে বিছানা ছেড়ে।
বেলা অবধি শুয়ে থাকার অভ্যাস কোনদিনই নেই আশালতার। এখনও ছ'টার আগেই উঠে পড়ে ঘুম থেকে। আজও তেমনই উঠেছিল। তখনও কিছুই বুঝতে পারেনি। স্নান, পুজো সব সেরে চা করে ডাকতে এসে চমকে গিয়েছিল, গা টা অমন ঠাণ্ডা কেন! বারবার ডেকেও আর মানুষটার সাড়া পায়নি। পাশে থেকেও কখন চলে গেল মানুষটা বুঝতেও পারল না আশালতা!
-দাদা বড় ভালো মানুষ ছিলেন, এইভাবে চলে যাবেন কেউ ভাবতেও পারিনি।
কাঁদতে কাঁদতে বিছানার পাশে এসে বসলেন মিলির মা। এই পাড়ার পুরনো বাসিন্দা সবাই। এই পাড়াতে যখন প্রথম আসে, খোকন-মিলি সবাই কত ছোট; প্রাইমারী স্কুলে পড়ে। কতগুলো দিন কেটে গেল এই পাড়াতে।
আরও অনেকে আসছেন। সান্তনা দিচ্ছে আশালতাকে। চোখের জলে শোকপ্রকাশ করছেন। অদ্ভুত ভাবে এতটুকুও কান্না আসছে না আশালতার। চোখের সামনে শুধু রাশি রাশি স্মৃতির আনাগোনা।
আত্মীয়স্বজন বলতে আশালতার এক ভাইপো এসেছে। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আসার মত আর কেউ তেমন নেই। সবাই বলছে খোকনকে খবর দিতে। খোকনের মোবাইল নম্বর চাইছে। অতদূর থেকে ছেলেটার আসতে তো লাগবে! একমাত্র সন্তান সে, তার আসার জন্য অপেক্ষা তো করতেই হবে।
খাটের বাজুতে হেলান দিয়ে বসে আছে আশালতা। স্থবিরের মত সবার কথা শুনছে। অধিক শোকে মানুষ বোধহয় এমন পাথরই হয়ে যায়।
একসময় ধীর পায়ে উঠে গিয়ে আলমারীটা খোলে আশালতা। বেশ খানিক্ষণ সময় নিয়ে কী যেন খোঁজে। তারপর একটা খাম বের এনে ধরিয়ে দেয় মণীষবাবুর হাতে। মণীষবাবু এ পাড়ারই মানুষ, খোকনের বাবার বন্ধু স্থানীয়।
আলমারী থেকে বের করা চিঠিটা মণীষবাবু পড়ার পরেই সারা ঘরে ছি ছি রব ওঠে।
আশালতা যা করেছে, তা কোন মা করতে পারে!
বেশিরভাগ জনই ছি ছি করতে করতে ফিরে গেছে। পাড়ার ছেলেরাই শেষ কাজের সব ব্যবস্থা করেছে। আশালতার ভাইপোই মুখাগ্নি করবে।
ওরা চলে যাওয়ার পরেই ঘরে এসে খিল দিয়েছে আশালতা। আলমারীর কাপড়ের ভাঁজ থেকে কতগুলো মুখবন্ধ করা খাম এনে টেবিলে রেখেছে। আগামী কয়েক সপ্তাহ এই চিঠিগুলোই খোকন পাঠাত মুম্বাই থেকে।
ডাক্তারবাবু বারবার বলে দিয়েছিলেন, মানুষটার হৃৎপিণ্ডটার আর কোন মানসিক আঘাত সহ্য করার মত ক্ষমতা নেই। তাই মানুষটা ঘুমিয়ে গেলে রাত জেগে চিঠিগুলো লিখে রেডি করে রেখেছিল আশালতা। এগুলোর আর কোন দরকারই থাকল না।
-বলি এখনও কী সধবার পোশাকেই থাকবে! সেই নিয়মটুকু তো অন্তত পালন করে মানুষটার আত্মাটাকে একটু শান্তি দেবে! তোমার তো বাছা সবই আবার অন্য ধারার....
দরজার বাইরের থেকে বিমল নাপিতের মায়ের বলা কথাগুলো শুনতে পাচ্ছে আশালতা।
সাড়ে তিনমাস আগে যেদিন মুম্বাই থেকে চিঠিটায় খোকনের মৃত্যু সংবাদ এসেছিল, সেদিন থেকে তো মানুষটার কথা ভেবেই বুকে পাথর বেঁধে ছিল আশালতা।
চেয়ার থেকে উঠে এসে জানলার গ্রিলে মাথা রেখে দাঁড়ায় আশালতা। বাইরের গেটটা খোলা। পথে খই ছড়ানো। পাঁচিলের বাইরে লাল ডাকবাক্সটাও যেন তারই মত বোবা দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে। আশালতার মত সেও যেন মুহূর্তে মূল্যহীন হয়ে গেল পৃথিবীর কাছে। আর কখনও দুপুরবেলায় চুপিচুপি এসে বাবাকে পাঠানো খোকনের লেখা মিথ্যা চিঠিটাও ফেলে যাবে না এই ডাকবাক্সে.....
■ পরিচিত
বনবীথি_পাত্র
Reviewed by Pd
on
অক্টোবর ২১, ২০২০
Rating:
Reviewed by Pd
on
অক্টোবর ২১, ২০২০
Rating:

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
সুচিন্তিত মতামত দিন