আমাদের সবার মধ্যে একটা ‘তারাপদ’ থাকে। তারাপদকে চেনেন তো সবাই? রবীন্দ্রনাথের ‘অতিথি’ সেই তারাপদ! যে বার বার অজানার টানে, মায়ামমতার সোনার শিকল ছিঁড়ে, সুখীজীবনের একঘেয়ে যাপনকে কাঁচকলা দেখিয়ে পালাতো! চেনা মানুষদের দৃষ্টি থেকে হারিয়ে যেত! বিয়ে করে সংসার ফেঁদে গৃহস্থ মানুষ এক্কেবারে কলে পড়া ইঁদুর হয়ে যায়। তার পালানোর ইচ্ছে থাকলেও আর উপায় থাকে না, উপায় থাকলেও পথ থাকে না, পথ থাকলেও সাহস থাকে না।
আমার কত্তারও আছে, ঐ হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা। আমারও। আমরা পরস্পরকে ছোটখাট পালানোর সুযোগ দিই। এই যেমন, বাজারে গেলাম একসাথে। হঠাৎ দেখি ও হাওয়া। ব্যাপারটা বুঝি। মায়ের মুখে ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি। “তোর বাবুর সাথে আর কোথাও যাবো না রে! আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ‘একটু আসছি’ বলে কোথায় যে চলে গেল! আসে না আসে না, আমি দাঁড়িয়ে আছি মোড়ের মাথায়, কি অস্বস্তি! ওমা! এক ঘণ্টা পর এসে বলে কি, চুলটা বড় হয়ে গেছে, সেলুন থেকে ঘুরে এলাম!’ বোঝ কাণ্ড!”
তা বাবার এই ‘গুণ’ উত্তরাধিকার সূত্রে আমার পাওয়ার কথা ছিল, তা না, পেল তার জামাই! আমি তাই অপেক্ষা করি না, মোবাইলই বের করি না। আপনমনে কেনাকাটা করতে থাকি, কিছুক্ষণ পরে একগাল হাসি নিয়ে উপস্থিত। ছোটখাট কিছু মনে পড়ে গিয়েছিল, তারই খোঁজে... জিজ্ঞাসা করলে এসবই বলবে। তবে সবজির আইটেম কিছু কিছু ডবল কেনা হয়ে যায়। আমি পটল নিয়েছি, সেও নিয়েছে, আমি লাউ তো ও চালকুমড়ো, আমি কলমী, ও পাট শাক। তা ক্ষতি কিছুই নেই। সব নদী ফুরায়, ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন, সব সবজিরও সদ্গতি হয়।
তবে ছোটবেলায় আমি সত্যিকারের হারিয়ে যাওয়া অনুভব করতে কয়েকটা জায়গায় যেতাম। বেলঘরিয়া এক্সপ্রেস ওয়ে তৈরির জন্য তখন ডানলপ ব্রিজের পাশে (এখন আর এন টেগোর রোড) উঁচু করে কয়লার ঘেঁস ফেলে রাখা হয়েছিল দীর্ঘদিন ধরে। আমরা ছোটরা ওটাকে পাহাড় বলতাম। সঙ্গী না জুটলে একাই ওই পাহাড়ে অভিযানে যেতে খুব ভালো লাগত। অনেকটা উঁচুতে হ্যাচোড় প্যাচোড় করে উঠতাম। তারপর একলা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। কেউ কোত্থাও নেই। অস্তগামী সূর্যের আলোয় আকাশ লাল। প্রায় গা ঘেঁসে ঝমঝম করে ট্রেন চলে যাচ্ছে বরানগর রোড স্টেশন দিয়ে। কি নির্জন, কি অদ্ভুত ভালো লাগা! মনে পড়ে এখনও।
আরেকটা জায়গা ছিল ভালোলাগার। মালির বাগান। ঠাকুরবাড়ির (অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের) ‘গুপ্তনিবাস’ নামে খ্যাত একটা বিশাল বাগান ছিল আমাদের পাড়া-লাগোয়া। এক বুড়ো মালি থাকত। আমরা বলতাম ‘মালির বাগান’। সেটা এখন মস্ত আবাসন। টেগোর কোর্ট। আমাদের ছোটবেলায় সেখানে অনেক গাছ ছিল, বেশ কয়েকটা পুকুরও ছিল। একটা পুকুর পাড়ে জঙ্গল মতো জায়গায় কেয়া ফুল ফুটত। কি মিষ্টি গন্ধ! সেই ফুল সংগ্রহ করতে গিয়ে কতবার কাদা ভর্তি পুকুরপাড়ের বুনো ঝোপঝাড়ে পড়ে গিয়ে হাত-পা ছড়ে গেছে। বাড়ি ফিরলে মায়ের কি বকুনি! আরেকটা জায়গা ছিল ছোটদের পক্ষে বেশ দুর্গম। সেখানে ছিল একটা ফলসার গাছ। টক-মিষ্টি ফলসা পড়ে থাকত গাছের তলায়। জঙ্গল ভেঙে, সাপখোপের ভয় জয় করে ঐ ফলসা কুড়াতে যেতাম বিকেল বেলায়। এমন কত অভিযান ছিল আমাদের ছোটবেলার!এখন তো এক স্কুল থেকে ফিরে আরেক স্কুল—হয় অঙ্কের ট্যুশন, নয়তো কম্প্যুটার কিম্বা গানের ক্লাস। আমাদের সময়ে স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরা মানেনিখাঁদ ছুটিই। প্রত্যেক বিকেলে নতুন নতুন আবিষ্কার—নতুন নতুন খেলা, নতুন নতুন হারিয়ে যাওয়ার জায়গা।
কিন্তু কই, কখনও কোন বিপদ হয়নি তো! কত যুগ আর আগের কথা? অথচ এখন মেয়ে বড় হলে মায়ের শান্তির যাপন শেষ। পড়তে গেলে ভয়, কতক্ষণে ফিরে আসবে। কারু বাড়ি গেলে ভয়, কি জানি কি সংবাদ নিয়ে ফিরবে? পাড়ার কাকু, জেঠু, মামা, দাদা কাউকে ভরসা নেই। বাসের কন্ডাকটরকে বিশ্বাস নেই। স্কুলের দারোয়ানকে বিশ্বাস নেই। শুধু ভয়, ভয় আর ভয়! মুখ খুলতে ভয়, প্রতিবাদ করতে ভয়, বিরোধীতা করতে ভয়, সমর্থন করতেও ভয়! এমনকি চার বছরের শিশুকন্যাকে কারো কাছে একলা ছাড়তে ভয়! সব জায়গায় ভয় তার থাবা বসিয়েছে। দিনকাল কি এখন এতটাই বদলে গেছে? ভাবলেও অবাক লাগে। এখন কি কোন মিনির মা কাবুলিওয়ালাকে বিশ্বাস করতে পারবেন?নতুন প্রজন্মের কাছে আমরা কি কোনদিন ফিরিয়ে দিতে পারব আমাদের ছোটবেলার নির্ভার নিরাপদ দিনগুলো? কতকিছুই তো হারিয়ে গেল।
শাঁখা-সিঁদুর সন্ধ্যাবাতি
নকশি কাঁথা শীতলপাটি,
বিকেলবেলা মাঠে খেলা
দাদু-দীদার গল্প বলা।
নাকি যা হারিয়ে যায়, তা আর কোনদিন ফেরে না? হারিয়ে যাওয়ার সাহসের মতো হারানো পরিবেশ ফিরিয়ে আনবার ইচ্ছেরাও হারিয়ে যায়?
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন