বাড়ীটা খুব উঁচু। যেন আকাশছোঁয়া। রেলিং ছাড়া বারান্দা থেকে ঝুঁকে নীচটা দেখছিল তুতুল। ক’তলা হবে ? পনেরো -কুড়ি না পঁচিশ ? এতটা ওপরে তুতুল উঠল কি করে ? ঐ নড়বড়ে সিঁড়িটা বেয়ে ? আশ্চর্য তো ! উঠে আসা পথের দিকে আবার ফিরে তাকায় ও। আর তক্ষুণি ভীষন ভাবে চমকে ওঠে। সিঁড়িটা কই ? সেই লম্বা, খাড়া রেলিং ছাড়া সিঁড়িটা ! নেই তো ! শুধু কয়েক হাত ফারাকে খোলা দরজাটা যেন দাঁত বার করে হাসছে ওর দিকে চেয়ে। আতঙ্কে চুল খাড়া হয়ে যায় ! নীচের সীমাহীন গহ্বরের দিকে তাকিয়ে ভয়ে চীৎকার করে ওঠে ও।
আর ঠিক তক্ষুনি ঘুমটা ভেঙ্গে যায় রোজের মত। পাশের ঘর থেকে চাপা অথচ স্পষ্ট কথার আওয়াজ ভেসে আসছে। রাত এখন কত ! চোখ ফিরিয়ে মেঝেয় শুয়ে থাকা লতিকা পিসীর দিকে চায় তুতুল। চিত হয়ে শুয়ে মুখটা অল্প হাঁ করে দিব্যি ঘুমোচ্ছে। ওর যে কেন এমন রোজ ঘুম ভেঙ্গে যায় ! নিজের অজান্তেই খাড়া হয়ে যায় কান ! মার নাক টানার আওয়াজ ! সঙ্গে বাপীর ধমকানি।
“ফ্যাচ ফ্যাচ করে কেঁদোনা তো। বিশ্রী লাগে।’’
“তা তো লাগবেই--’’, আক্রোশে ফেটে পড়ে মার গলা ”, আমি তো আর কেতকী মিত্রের মত ন্যাকা গলায় কাঁদতে পারিনা--”
“উফ ! সেই এক কথা ! হরিব্ল ! তুমি ভুলে যাচ্ছ শ্রী--- কেতকী আমার সেক্রেটারি।’’
“হ্যাঁ। তাতেই তো সুবিধা বেশী। যা খুশী করে বেড়ানো যায়---’’
“যা খুশী মানে ? হোয়াট ডু ইউ মিন ?”
ভয়ে বিছানায় উঠে বসে তুতুল। বাপী রেগে গেছে নাকি ! মাম কেন চুপ করছে না ? আগে আগে মাম তো চুপ করে যেত !
“যা খুশী মানে-- যা খুশী। কেউ কিছু বোঝে না--- না ? এত ঢলাঢলি কিসের একটা দু টাকার সেক্রেটারির সঙ্গে ?”
“ওঃ ডিসগাস্টিং ! সন্দেহ করাটা তোমার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে।’’
“সন্দেহ ! শুধু সন্দেহ ! সত্যি নয় ! পরশু হোটেল ব্লুফক্সে ওই মেয়েটাকে নিয়ে তুমি ডিনারে যাও নি ? মিস্টার আর মিসেস ডাট নামে ঘর বুক কর নি ? লাস্ট উইকে যেদিন রাত দুটোয় ফিরে বললে--- কনফিডেনশিয়াল মিটিং ছিলো। সেদিন মিটিংটা কোথায় হয়েছিল ? কোন রিসর্টে ? ”
“তুমি কি আমার পিছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছো ? সহ্যের সীমা ছাড়াচ্ছো কিন্তু ---“
“তার অনেক আগেই তুমি ছাড়িয়েছো। তোমার রোজ রোজ অফিস ট্যুরের মানে আমি বুঝি না ? ডিবচ্ ! এক ছেলের বাবা – লজ্জা করেনা তোমার ?”
“ লজ্জা তোমার করা উচিত। অনিমেষের এ বাড়ীতে আসার কারন আমি বুঝি না ভেবেছো ?”
“ মানে ? তুমি কি বলতে চাও ? আমাকে সন্দেহ কর?
“করি করি একশোবার করি।’’
তীব্র এক ঝনঝন আওয়াজে কেঁপে ওঠে তুতুল। ওরা কী মারামারি করছে নাকি ? ধড়মড় করে উঠে বসেছে লতিকা পিসী।
“ ওঃ ! বোতল ভেঙ্গে পৌরুষ দেখানো হচ্ছে ! ভুলে যেও না-- পাশের ঘরে ছেলে ঘুমোচ্ছে।’’
“সে খেয়াল তোমার আছে ?”
“তোমার চেয়ে একশো গুন বেশি আছে। মাসে মাসে টাকা ফেলে দেওয়া ছাড়া বাবার কোন কর্তব্যটা তুমি করো ?”
“ওঃ কর্তব্য ! ওই অনিমেষ স্কাউন্ড্রেলটার সাথে ঢলাঢলি করার সময় এত নীতি বোধ কোথায় থাকে শুনি ?”
“বেশ করি-- ঢলাঢলি করি। তুমি করো না ? আগে নিজের দিকে তাকাও”
ধাতব শীতল ব্যঙ্গের হাসি ভেসে আসে। “ তা বেশ তো। রাস্তা দেখে নিলেই তো হয়।’’
“ ভারী সুবিধে হয় তাহলে। তাই না ? ওই বাজারের মেয়েছেলেটাকে ঘরে এনে ঢোকাতে পারো—’’
“একজন ভদ্রমহিলার সম্বন্ধে সম্মান দিয়ে কথা বলতে শেখো-’’
“ওঃ ভদ্রমহিলা ! মাই ফুট।’’
“শ্রী-“
“চোখ রাঙিয়ো না। ইউ ড্যাম লায়ার ! বকখালি, চাঁদিপুর রিসর্টের রিসিট হাতে পড়েনি আমার ! তার পরেও কথা বলছ? এত নির্লজ্জ তুমি !”
“ওঃ হো !’’
গমগমে জড়ানো গলার হাসির শব্দে ভয়ে লতিকা পিসীর বুকে মুখ গুঁজে দেয় তুতুল।
“তোমার তো আবার রিসর্টের ও দরকার হয় না। আমার এই ফ্ল্যাট-ই যথেষ্ট। কি বলো ? মাঝে মাঝে আমার তো সন্দেহ-ই হয় ছেলেটা আমার কিনা ?”
“কী বললে ? কী বললে তুমি? এত নীচে নেমে গেছো ?”
“কুল ডাউন। কুল ডাউন। এত উত্তেজিত হবার কিছু নেই। তুমি অস্বীকার করতে পার ---- যে অনিমেষের সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই ?’’
“তোমার মত একটা ঘৃণ্য শয়তানের সঙ্গে কথা বলতে ও ঘেন্না করে আমার। কালই আমি টালিগঞ্জে চলে যাব। ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেব—সই করে দিও।’’
দড়াম করে দরজা বন্ধের আওয়াজ পেয়েই লতিকা পিসীকে ছেড়ে দ্রুত বিছানায় উঠে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে তুতুল। মাম আসবে এক্ষুনি। আজকের মত শেষ। এবার ওরা আলাদা আলাদা শোবে। শোবার আগে শেষবার তুতুলকে আদর করে যাবে মাম। আসলে মাম দেখতে আসে ও ঘুমোচ্ছে কি না। জোর করে চোখ বুজে তখন ভীষণভাবে ঘুমিয়ে থাকে তুতুল। মামকে কষ্ট দিতে আর ওর ইচ্ছে করে না। মনে মনে ভেবে রেখেছে তুতুল-- বড় হয়ে মাম কে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবে। যেখানে থাকলে মাম শুধুই হাসবে।
মাম চলে যাবার পর বাপী আসবে। সেই মিষ্টি মিষ্টি নেশা ধরানো একটা অদ্ভূত গন্ধতে ভরে উঠবে ঘর। ওর বুজে থাকা চোখে আলতো ঠোঁট ছোঁয়াবে। তারপর চলে যাবে আস্তে আস্তে। তখন এত মায়া লাগে বাপীর জন্য ! মনে হয় বাপীর বুঝি কেউ কোত্থাও নেই। বুক ফুলে ফুলে ওঠে তুতুলের। কেমন যেন ভীষণ কান্না পায় ! বালিশে মুখ গুঁজে প্রাণপণে কান্না গেলে ও !
এরপর একেবারে নিঃশব্দ হয়ে যাবে ফ্ল্যাট। লতিকা পিসীর ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ, রাস্তার দুএকটা কুকুরের ডাক, কখনো সখনো হুশ করে চলে যাওয়া কোন গাড়ী। শুনতে শুনতে -----বুজে আসবে ওর চোখ। শুধু রোজকার মত ঘুমের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে চোখের ওপর জেগে থাকবে একটা ছবি।
বিহারের সিংভুমে একবার বেড়াতে গিয়েছিলো ওরা। তখন বাপী এতবড় অফিসার ছিলো না। তুতুলও ছিলো এই এত্তোটুকু। মাম বাপীর মধ্যে একটু ও ঝগড়া ছিলোনা তখন। কতবার দেখেছে তুতুল আড়ালে আবডালে লুকিয়ে মামকে আদর করছে বাপী।
সেবার খুব মজা হয়েছিলো। ছোট্ট গ্রাম। পাহাড় ঘেঁষা খোলা একটুখানি জায়গায় ছোট্ট হাট। আদিবাসী মেয়েদের নাচ। যেটা সবচেয়ে মজার ব্যাপার তা হল মোরগের লড়াই। দুটো মোরগ পায়ে ছুরি বেঁধে একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে একদম রেডি। সে কী উল্লাস মানুষের !
আজ ও ঘুম জড়ানো চোখে সেই মোরগদুটোকে যেন রোঁয়া ফুলিয়ে, ছুরি শানিয়ে সামনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে স্পষ্ট দেখলো তুতুল।
(দুই)
তালা খুলে ধাক্কা দিয়ে ছেলেকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় শ্রীতমা। ছিটকে সোফার উপর পড়ে তুতুল।
চীৎকার করে ওঠে শ্রীতমা, “এত অসভ্য হয়েছ তুমি ! এত ! তোমার জন্য স্কুল থেকে কমপ্লেন এলো ? আমাকে প্রিন্সিপাল ডেকে যা তা বললেন ? কী ভেবেছো তুমি ? কেন মেরেছ তুমি স্নেহাংশুকে ? বলো- কেন ?”
বিস্ফারিত চোখে মা’র দিকে চেয়ে থাকে তুতুল। ভয়ঙ্কর রেগে গেছে মাম। লাল মুখ। নাকের পাটা ফুলছে। চোখ দিয়ে যেন আগুন ছুটছে ! এখন এমনিতেই সব সময় রেগে থাকে মাম। বাপিও হয়ত। এখানে আসার ক’দিন আগে কেউ কারোর সাথে কথা বলল না। ঝগড়াও বন্ধ। আর তাতেই বেশি আতঙ্ক তুতুলের ! তবু ঝগড়া করলে মনে হয় ----- আছে ওরা। দুজনেই আছে। নাহলে কেমন যেন ... ! বাপী আবার ট্যুরে গেল। ফিরলও। এবারে মাম কোনো কথাই বলল না। কেমন যেন চুপচাপ সব। এই চুপ করে যাওয়াটাকেই বড় বেশী ভয় পাচ্ছিল তুতুল। ঠিক তাই হল। বাপী ট্যুর থেকে ফেরার ঠিক দুদিনের মধ্যেই গম্ভীর মুখে দু-খানা ঢাউশ স্যুটকেস ট্যাক্সিতে চাপিয়ে তুতুলকে বগলদাবা করে টালিগঞ্জে দিদুনের বাড়ি এসে ঊঠল মাম। এমনিতে দিদুনের বাড়ি থাকতে তুতুলের ভালোই লাগে। কিন্তু এভাবে নয়। এ তো বেড়াতে আসা নয়। মামকে দেখে তো মনে হচ্ছে না আর লেকটাউনে ফিরে যাবে বলে। বিচ্ছিরি লাগে ওর। বাপীর জন্য মন কেমন করে। ভয়ে কিছু বলতে পারে না। মাম যদি বলে----- ও তোমার মন কেমন করছে-- যাও তবে-- বাপীর কাছে গিয়ে থাকো---
কী করে বোঝায় তুতুল, ও তো দুজনকেই একসাথে নিজের দুপাশে চায়। বলা যাবে না। মাম বুঝবেই না। শুধু রেগে যাবে আর কীরকম ঠান্ডা চোখে তাকাবে, ওই চাঊনিকে বড় ভয় পায় তুতুল। তার মধ্যেই আবার প্রিন্সিপালের চিঠি। স্নেহাংশুর মা কমপ্লেন করেছে। স্নেহাংশুকে মেরেছে তুতুল। হ্যাঁ, মেরেছে তো। বেশ করেছে। দরকার হলে আবার মারবে। মরে যাবে ? কেয়ার করে না তুতুল।
“কী হল ? স্পিক আউট... চুপ করে আছো যে ?”
চুপ করে না থেকে উপায় কী ? কী বলবে ও ? একদিনের কথা কী-- যে বলে দেবে ! রোজ রোজ ওরা তুতুলকে বাজে কথা বলে না ! কতদিন চুপ করে থাকবে ! মাম কী জানে ? কী ? --- কতটা সহ্য করে তুতুল ? মাম কী জানে ওরা কী ভাবে টিজ্ করে তুতুলকে ?
এবার ফার্স্ট ইউনিটে ম্যাথে ফিফটিতে ফিফটি পেল তুতুল। মিসেস জোনাথন ডেকে কত আদর করলেন। ব্যাস্। হিংসেয় পেট ফুলতে শুরু করলো স্নেহাংশুর। ফার্স্ট বয়। ওই সবচেয়ে বেশী পাবে সেটাই যেন রুল হয়ে গেছে। কীরকম ভালোমানুষি করে তুতুলের খাতাটা চাইলো, “ সাত্যকি, তোর কপিটা দেখি ?”
তুতুল তো তখন খুশিতে ডগোমগো। দিয়ে দিয়েছে। একটু পরেই দুম করে স্নেহাংশু বলে ঊঠল, “ কার কাছে ম্যাথ করিস রে ? ”
এতদিন তো তুতুল মা’র কাছেই করেছে। আজকাল মা’র মুড ঠিক থাকে না বেশির ভাগ সময়। তবু অনিমেষ আঙ্কেল এলে মা’র মুখটা কেমন জ্বলজ্বল করে। আর আঙ্কেল এখন প্রায় রোজ-ই আসে। বেশ লাগে তুতুলের-- অনিমেষ আঙ্কেলকে। কেমন হা-হা করে হাসে, দিদুনকে দরাজ গলায় চায়ের ফরমাশ করে--- তুতুলকে নিয়ে লোফালুফি খেলে। একদিন খেলাচ্ছলেই ম্যাথটা দেখিয়ে দিয়েছিল। তুতুল বেশ মজা পেয়ে গেলো। অঙ্ক যে এমন মজার হতে পারে-- এত সহজে করা যায় এতদিন তা ওর জানাই ছিল না। ব্যস। মাম ও জো পেয়ে গেল।
“তুমিই তাহলে ম্যাথটা করাও ওকে। ও তো বেশ ইন্টারেষ্ট পাচ্ছে দেখছি ’’
আঙ্কেল ও তক্ষুনি রাজি। আর ফল যা হল তা তো হাতে হাতেই।
সরল মনে সেটুকুই বলেছে তুতুল, “ অনিমেষ আঙ্কেলের কাছে ম্যাথ করি।’’
চাপা খুকখুক হাসির শব্দে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে ! হাসছে ওরা ! স্নেহাংশু, নিলাদ্রী।
“ অনিমেষ আঙ্কেল কি তোর নিজের কাকা ?”
“না তো। আঙ্কেল তো বাপীর বন্ধু ! কত ভাল জানো ! নিজের নয় তো কী হয়েছে ?”
“হুম। রোজ তোদের বাড়ী আসে ?”
মাথায় ঢোকে না তুতুলের --- ওরা কী যে বলতে চায় ! আঙ্কেল তো আজকাল প্রায় রোজই আসে তুতুলকে অঙ্ক করাতে। কী হয়েছে তাতে ! এতে হাসির কী আছে !
“শুধু সন্ধ্যেবেলা ? দুপুরে আসে না ? যখন তুই স্কুলে আসিস আর তোর দিদুন অফিসে যায় ?”
আশ্চর্য তো ! ওরা জানল কী করে যে এখন আর তুতুল লেকটাউনে থাকে না ! তুতুল তো বলেনি ! বলেনি তো মাম আর বাপী আলাদা থাকে। তবু কেমন করে জানতে পারল ওরা ! আর এরকম অদ্ভুত কথা বলছেই বা কেন ! আঙ্কেল দুপুরে কেন আসবে ? হাঁ করে তাকিয়ে থাকে তুতুল।
“আসে। আসে। তুই জানিস না।”
কী রকম অসভ্যের মত হাসছিল ওরা। বুঝে ও যেন বুঝে উঠতে পারছিল না তুতুল। কেমন ধোঁয়াশা লাগছিল।
ইংলিশ ম্যাম ক্লাশে ঢুকতে সবাই চুপ করে গেল। কিন্তু আবারও বুক চড়চড় করে উঠল স্নেহাংশুর। হবে না ? ইংলিশ ওয়ানেও তো তুতুল হাইয়েস্ট ! ইংলিশ ম্যাম তুতুলকে মাথা নেড়ে আদর করছেন। আর কী সহ্য হয় ! তাও তখনও কিছু বোঝে নি ও।
বুঝল টিফিন টাইমে। কী চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলার ধুম স্নেহাংশুর !
“ইংলিশ ওয়ান কার কাছে পড়িস রে ? কেতকী আন্টির কাছে ?”
ধাঁই করে যেন একটা পাথর এসে লাগল বুকে। কেতকী আন্টি ! ওরা জানল কী করে ? কেমন যেন গা ঘিনঘিন করছিল তুতুলের ওদের হাসি দেখে।একটা চাপা কষ্ট বুকের ভেতরটা গুঁড়িয়ে দিচ্ছিল। সে সব কী মাম জানে? জানলেও বুঝবে ? সবাই যে ওকে নিয়ে হাসে, ঠাট্টা করে। দিন দিন যে কত একা হয়ে যাচ্ছে তুতুল ! তবুও তো চুপই থেকেছে। বলেনি তো কিছু। হয়ত বলত ও না। কিন্তু সেদিন --------
“তুতুল---”
প্রচন্ড জোরে চমকে ওঠে ও। ভীষণ ভাবে ওর কাঁধ ঝাঁকাচ্ছে মাম।
“বল ? কেন মেরেছ তুমি ? কবে থেকে এত অসভ্য, বেয়াদপ হয়ে উঠলে ? এত সাহস তোমার ! এমন মেরেছো যে ওর নাক মুখ দিয়ে রক্ত বার ক’রে দিয়েছ ? কোথায় শিখলে তুমি এরকম লোফারদের মত মারপিট ?”
ফ্যালফ্যাল ক’রে চেয়ে থাকে তুতুল।মাম শুধু স্নেহাংশুর কথাই বলছে।ওর নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে --সেটাই দেখছে! আর তুতুলের! রোজ রোজ ওর চোখ ফেটে যা বেরোয় তা কী শুধু জল ! রক্ত নয় ! মাম কী কোন খবর রাখে !
“স্টাবর্ন ! বাবার মত হ’চ্ছ ? ভালো কিছু শিখছো না –না ? কথার উত্তর দাও। কেন মেরেছো? ”
“বেশ করেছি ’’ , ফুঁসে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ায় তুতুল, “ অমন বললে আবার মারব। একদম মেরে ফেলব---’’
“কী ! ’’, অসহ্য ক্রোধে আর বিস্ময়ে ফেটে পড়ে শ্রীতমা , “ কী বললে ! আবার মারবে ! ”
“মারবই তো। কেন বলবে ওরা ওরকম ? কেন হাসবে আমাকে দেখে ? কেন গুজগুজ করবে আমার পিছনে ? ”
“তুতুল ”, থমকে যায় শ্রীতমা, “ কী বলেছে ? কে হেসেছে ? ”, কেমন যেন স্তিমিত শোনায় ওর গলা। রাগ নয় এক তীব্র অসহায়তা যেন ঝরে পড়ে গলা দিয়ে ,” কী হয়েছে তুতুল? ”
কয়েক পল। ঝাঁপিয়ে মার বুকে প’ড়ে চীৎকার করে কেঁদে ওঠে তুতুল। এতক্ষণের জমাট রুদ্ধ অশ্রু তীব্র বেগে বেরিয়ে এসে ভাসিয়ে দেয় শ্রীতমার বুক, মুখ, চোখের পাতা।
“ওরা যে সবসময় বলে মাম। তোমাকে নিয়ে, বাপীকে নিয়ে। অনিমেষ আঙ্কেল, কেতকী আন্টি। ওরা যে সব জানে মাম। কী ক’রে জানে ? আমি তো বলিনি কখনো ? কী ক’রে মাম ?”
“তুতুল—“
শুধু বিস্ময় নয় ---এক তীব্র চটচটে অস্বস্তি ঘিরে ধরে শ্রীতমাকে। দ্রুত হাতে ছেলেকে সামলাতে সামলাতে (নাকি নিজেকে !) চোখের জল মুছিয়ে দেয়, “ বলুক না। ব’ললে কী হয় ? তা ব’লে তুমি মারবে ?
“আমি তো মারিনা।কোনদিন মারিনি। কিন্তু সেদিন---- ! সেদিন ওরা খুব খারাপ কথা বলেছে মা— ওই স্নেহাংশু ---’’
বুকের ভিতরটা গুরগুর করে ওঠে শ্রীতমার। মস্তিস্কে কোন অজানা নিষিদ্ধ সংকেত ! ,
“কী বলেছে-- তুতুল ?”, প্রায় ফিসফিস করে ওঠে ও। নিজের কন্ঠস্বর নিজের কাছেই অচেনা লাগে।
অনেকটা কান্না একসাথে গিলে নেবার চেষ্টা করে তুতুল। থরথর করে কেঁপে ওঠে ওর ছোট্ট ঠোঁটদুটো।
“ওরা কেন এমন বলল মাম ? কেন বলল ? অনিমেষ আঙ্কেলকে এবার থেকে বাপী বলা অভ্যেস কর। তোর মা তো অনিমেষ আঙ্কেলকে বিয়ে করছে।’’
একসঙ্গে বুকের অনেকটা পর্যন্ত চমকে ওঠে শ্রীতমার, “ তুতুল----’’
“ কেন বলল মাম ? কেন ? ”
পাগলের মত ওর বুকে মাথা ঝাঁকাচ্ছে তুতুল। অজস্র চোখের জল ঝরে পড়ছে শ্রীতমার সর্বাঙ্গে। কী তীব্র দাহ ওই অশ্রুতে ! পুড়ে যাচ্ছে শ্রীতমা। গলে যাচ্ছে। কুঁকড়ে যাচ্ছে ওর সর্বাঙ্গ। গলা শুকিয়ে কাঠ। তবু কে যেন ওর মুখ দিয়ে বলিয়ে নেয়,
“ তুমি তো অনিমেষ আঙ্কেলকে পছন্দ কর তুতুল। যদি আমরা একসাথে-----’’
কথা শেষ হয় না। বিদ্যুৎগতিতে মাথা তুলে তাকায় তুতুল। জলভরা চোখে সামনের সবকিছু যেন ঝাপসা ! কেমন ধোঁয়ার মত মিলিয়ে যাচ্ছে এই ঘর, মায়ের মুখ, সামনের বারান্দা সব—-সব ! তীব্র আতঙ্কে-- অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে দেখে তুতুল ! স্বপ্নে দেখা সেই মস্ত বাড়ীটা ! তার ইঁট, কাঠ,পাথরের খাঁচা নিয়ে নড়তে নড়তে যেন ওর সামনে এসে দাঁত বার ক’রে দাঁড়িয়েছে ! অনেক উঁচুতে ভাঙা বাড়িটার নির্জন ছাদে সেই নিঃসীম শূন্যতায় নিজেকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তুতুল। সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন –নিঃসঙ্গ--অনন্ত আকাশের নীচে ! একা ! ঝড়ের মুখোমুখি !
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন