"ফিরোজবাবু আমাকে একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেবেন।" আমিও হাসি হাসি মুখ করে বললাম, "ঠিক আছে দাদা।" আর, মনে মনে মানে ভাবলাম এই হলো অনুষ্ঠান করার জ্বালা। প্রত্যেকে এসেই নিজের কবিতা বা গল্পপাঠ করে বিদায় নেবে। ভদ্রলোক গিয়ে সবার পিছনের সারিতে বসলেন। নিরুক্ত পত্রিকার দ্বিতীয় অনুষ্ঠান নিরুক্ত সন্ধ্যা৷ এই অনুষ্ঠানে সম্মাননীয় অতিথি ছিলেন সাহিত্যিক ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্যিক প্রচেত গুপ্ত, কবি চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, কবি বীথি চট্টোপাধ্যায় ও কবি পিনাকী ঠাকুর। সঞ্চালক গল্পকার চুমকি চট্টোপাধ্যায় মঞ্চে যখন সম্মাননীয় অতিথিদের ডেকে নিচ্ছেন, তখন দেখছি পিছন থেকে উঠে আসছেন ওই ভদ্রলোক যিনি আমাকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেয়ার কথা বলছিলেন। আমি অবাক, উনি কবি পিনাকী ঠাকুর! ( পরে জেনেছিলাম মায়ের অসুস্থতা আর দূরত্বের কারণেই আগে যাওয়ার কথা বলেছিলেন)। ইনিই সেই কবি? এত সাধারণ মানুষ! আমি অবিভক্ত মেদিনীপুরের এক ছোট্ট মফস্বল থেকে বেড়ে ওঠা মানুষ। সেখান থেকেই আমার পড়া পিনাকী ঠাকুরের কবিতা। কিন্তু, কখনও চোখে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। সেই প্রথম পরিচয়। কবি পিনাকী ঠাকুর সেইদিন থেকেই আমার পিনাকীদা হয়ে গেলেন। তবু, পিনাকীদা কোনদিনও আমাকে ফিরোজবাবু ছাড়া আর কিছু বলে ডাকেননি এবং আপনি থেকে কখনও তুমিও বলেননি।
দিনে দিনে পিনাকীদার সাথে সখ্যতা বাড়তে লাগলো। নিরুক্ত তখন নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। পিনাকীদার একটা সাক্ষাৎকার ছাপা হবে ঠিক হলো। আমিই গেলাম সাক্ষাৎকার নিতে, সঙ্গে সুনিতা, কৃত্তিবাসের অফিসে। ফোন করেই গিয়েছিলাম আমরা। দিনটা কোনো এক মঙ্গলবার ছিলো, মনে আছে। গিয়ে দেখি পিনাকীদা কৃত্তিবাসের কাজে ভীষণ ব্যস্ত। চোখ তুলে ইশারাতেই বসতে বললেন। প্রশ্ন লিখেই নিয়ে গেছিলাম। উনি কাজ সেরে আমাদের সাথে কথা শুরু করলেন। কথাবার্তা চলছে, এমন সময় পিনাকীদা বললেন- "ফিরোজবাবু আপনি প্রশ্নগুলো আমাকে দিয়ে দেন আমি সময় করে লিখে আপনাকে দিয়ে দেব।"
আমি বললাম- "আমার যে তাড়া আছে দাদা, আপনার এই সাক্ষাৎকার গেলেই কম্পোজ হয়ে ট্রেসিং বেরুবে..."
"না, না বেশি দেরি করব না। সামনের সপ্তাহেই পেয়ে যাবেন" পিনাকীদা বললেন।
অপর দিক থেকে সুনিতা দেখেও বেশ চিন্তিত মনে হলো। কারণ বড় বড় মানুষেরা কথা দিয়েও বড্ড দেরি করেন ও ঘোরান, এসব আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতার ফসল। কিন্তু সে কথা তো আর বলা যায় না। আমিও খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। এছাড়া আমাদের কাছে আর কোনো উপায়ও দেখলাম না। অনিচ্ছা সত্বেও প্রশ্নগুলো দিয়ে যখন বেরিয়ে আসব ভাবছি, তখনই পিনাকীদা আরেকটু অপেক্ষা করতে বললেন। "চা না খাইয়ে আমি তো আপনাদের বিদায় দিতে পারি না"। কৃত্তিবাসের অফিস তিনতলায়। সেখান থেকে নীচে এসে আমাদের চা খাইয়ে তবেই ছাড়লেন।
আমরা নিশ্চিত ছিলাম, পিনাকীদার সাক্ষাৎকার আর পাচ্ছি না। যদিও পাই সেটা এ সংখ্যায় আর ছাপা যাবে না। কিন্তু ভুল ভাঙলো দু'দিন পর, বৃহস্পতিবার সকালের ফোনে, " ফিরোজবাবু, লেখা হয়ে গেছে। আপনি কি আজ কৃত্তিবাস অফিস থেকে নিয়ে যেতে পারবেন? নাকি অন্য কোথাও দেখা করবেন?" আমি কথাটা শুনে বিস্মিত হই। বলেই ফেললাম- "এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল দাদা!"
-"হ্যাঁ, আপনারা কত নিষ্ঠা নিয়ে এই পত্রিকা করেন। আমার জন্য অযথা দেরি করবেন কেন? অন্য কাজ বাদ রেখে তাই এটাই আগে লিখে দিলাম।"
আবার কখনও দিনের পর দিন ফোন করেছি, স্পষ্টভাবেই বলেছেন "কবিতা নেই ফিরোজবাবু। তিন/চার মাস একটাও লেখা আসছে না। লিখতে পারলেই অবশ্যই আপনাকে দেব।" এটা এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। সত্যি সত্যিই পরে লেখা হলে,আমাকে কবিতা পাঠিয়ে দিতেন।
নন্দীগ্রাম বইমেলা কমিটি থেকে আমার কাছে একটা ফোন আসে। ওরা জানত কবি পিনাকী ঠাকুরের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো। ওরা উদ্বোধক হিসেবে পিনাকীদাকেই চায়। আমি যেন পিনাকীদাকে রাজী করাই। এমন আবেদন পিনাকীদাকে কখনই করিনি, এমনকি কৃত্তিবাসের জন্য কখনও লেখাও দিইনি পিনাকীদার হাতে। ভয়ে ভয়ে ফোন করলাম, ওপার থেকে শুধু বললেন, "আপনি যদি যান তবে আমি রাজী।" একসাথে আমি, সুনিতা, পিনাকীদা আর শঙ্কুদা চললাম নন্দীগ্রাম বইমেলা। সে যে কী আনন্দ বলা যাবে না। উলুবেড়িয়া পেরোনোর সময় সুনিতা বলল, "সামনে বাগনান। দাভায়ের ছোটদির বাড়ি।" সুনিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই, পিনাকীদা বললেন- "চলুন ফিরোজবাবু, ছোটদির বাড়ি ঘুরেই যাই।" গাছ দিয়ে ঘেরা ছোটদির বাড়ি খুবই ভালো লেগেছিল ওঁনার। বলেছিলেন আবার আসবেন। রাস্তাতেই জানতে পারলাম ওই বইমেলাতে আসছেন ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় ও দেজ পাবলিশিং-এর সুধাংশু দে। নন্দকুমার পরিয়ে এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে অপেক্ষা। এরই মাঝে কবিতা নিয়ে কত আলোচনা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কত অজানা গল্প, কৃত্তিবাসের গল্প। সেদিনটায় উনি এত খুশি হয়েছিলেন যে, ফেরার সময় বললেন "ফিরোজবাবু আপনার সাথে আমি জাহান্নামেও যেতে পারি।"
কবি পিনাকী ঠাকুর কখনও কোনও বিতর্কিত মন্তব্য করতেন না। কখনও কোনও মানুষকে অপমান করেছেন বলেও শুনিনি। অল্প কথার মানুষ ছিলেন। একজন কবির সব গুণগুলোই তাঁর মধ্যে ছিল। কতবার ফোন করেছেন শুধু আমার লেখা পড়ে ওনার ভালো লেগেছে বলে। কখনও কখনও সকালে উঠে দেখেছি মাঝরাতে এসএমএস করে আমার লেখা ভালো লাগার কথা জানিয়েছেন। একজন অনুজের প্রতি তাঁর যে স্নেহ তা দিনে দিনে আমাকে শুধু অবাকই করেছে। কোনও কোনও সময় ব্যস্ততার কারণে ফোন রিসিভ করতে না পারলে, পরে ঠিক কল ব্যাক করতেন। তাঁর সাথে যেখানেই দেখা হয়েছে সেখানেই বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন।
এই তো ২০১৭তেই টার্মিনাস -এর অনুষ্ঠানে সিদ্ধান্ত হলো কবি পিনাকী ঠাকুর-কে দেয়া হবে সমাজসেবী সেখ আবুল কাসেম স্মৃতি সম্মাননা। কিন্তু এই কথা বলার স্পর্ধা দেখাবে কে? কে সম্মতি নেবে? আমার উপর দায়ভার চাপলো। আগে-পরের কথা না ভেবেই সরাসরি প্রস্তাব দিলাম। উনিও এক কথায় রাজী৷ এমনকি এও বললেন "এই সম্মানে সম্মানিত হতে পেরে আমি গর্বিত।" এখানে উল্লেখ করি প্রয়াত সেখ আবুল কাসেম আমার পিতা।
কিছুদিন আগেই 'সহজ সম্মাননা' ঘোষণার পর আমাকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। বাংলা আকাদেমি সভাগৃহে "সহজ সম্মাননা স্মারক" পিনাকীদার হাত থেকেই নিয়েছিলাম। আমার জীবনের এক উল্লেখযোগ্য সন্ধ্যা। আমার ওই সম্মাননা আমি উৎসর্গ করেছিলাম কবি পিনাকী ঠাকুর ও কবি বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কবি সম্পাদক পৌলমী সেনগুপ্ত-র মৃত্যুর কথা পিনাকীদাই আমাকে প্রথম জানিয়েছিলেন ফোনে। সেদিন উনি এতটাই বিষণ্ন ছিলেন যে কথাই বলতে পারছিলেন না। সম্প্রতি নন্দীগ্রামের স্রোত প্রকাশনী থেকে আমার বই প্রকাশ হচ্ছে শুনে বলেছিলেন, "আবার নন্দীগ্রাম ! চলুন, আমরা আবার যাবো।" না আর যাওয়া হলো না।
কাকতালীয় হলেও সত্য গত ২২ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আমি ও বন্ধু সমীরণদা (চক্রবর্তী) কলেজ স্কোয়ারে বসে আড্ডা দিচ্ছি। হঠাৎই আমি সমীরণদাকে বলি "পিনাকী ঠাকুর পড়েছেন?" সমীরণদা বলল, "পত্র-পত্রিকায় পড়েছি। তবে, বই পড়া হয়ে ওঠেনি।" চললাম পিনাকী ঠাকুরের বই কিনতে, সিগনেট তখন বন্ধ হয়ে গেছে, দেজ থেকে কেনা হলো " পিনাকী ঠাকুরের শ্রেষ্ঠ কবিতা"। রাত প্রায় ন'টা সমীরণদা আর আমি চা খাচ্ছি। কবিকে ফোন করলাম, বেশ কয়েকদিন কথা হয়নি বলে। এপ্রান্ত থেকে ডায়াল-টোন শুনতে পাচ্ছি। ভাবলাম ব্যস্ত আছেন হয়তো। পরে কল ব্যাক করবেন... অন্য সময় যেমন করেন। পরদিন জানলাম পিনাকীদা অসুস্থ, হাসপাতালে।
"ছুঁচের মতো শীত গায়ে ফোটে
আকাশে পূর্ণিমা, ভরা মাঘ,
মিষ্টি, মণিহারি, থালা-বাটি
সখের টুপি, জুতো, জামাপ্যান্ট..."
রাত জাগছে ভালবাসা (পিনাকীদার অপ্রকাশিত কবিতার চার পংক্তি )
না, আর কল ব্যাক করেননি। না, আর কোনোদিন কল ব্যাক করবেনও না। যাঁর বিরুদ্ধে এতদিন কোনো অভিযোগ ছিলনা, এখন তীব্র অভিযোগ ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে করে-
পিনাকীদা আপনিই বলেছিলেন, আমার সাথে জাহান্নামেও যাবেন। সে কথা ভুলে আমাকে জাহান্নামের পথে ফেলে, একা একাই জান্নাতে চলে গেলেন! আপনি পারলেন একাজ করতে? ছোটদির বাড়ি, নন্দীগ্রাম যে আপনার অপেক্ষায় থাকবে। তাদের কী বলবেন?
firozmdsahabuddin@gmail.com
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন