নিজের ipad টা সঙ্গে নিয়ে অনুশকা পা টিপে টিপে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। এখন দুপুর দুটো বাজে , মা আর বাবা জেট ল্যাগ এর জন্য ঘুমচ্ছেন অগাধে। সেও ঘুমচ্ছিল, কিন্তু তার ঘুমটা হঠাৎ ভেঙ্গে গেল। সে এই রায়বাড়ীটাকে explore করে দেখতে চায়। অনুশকা 6th grade এ পড়ে, আমেরিকার ওয়াশিংটন ডি সি তে একটি নাম করা স্কুল এ। বইয়ের পোকা সে। তার I pad এ kindle app লোড করা আছে। তাছাড়াও সে স্কুল লাইব্রেরি ও পাড়ার লোকাল লাইব্রেরির মেম্বার। বাবা বা মা যদি তাকে কিছু কিনে দিতে চান তবে তার প্রথম চয়স হয় বই। তার বিশেষ করে ভালো লাগে ভুতের গল্প আর গোয়েন্দা গল্প। Famous five, Nancy Drew, Harry Potter, এমনকি সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার ইংরাজি অনুবাদও সে পড়ে ফেলেছে। এতো বই পড়ার জন্যই বোধহয় এই বয়সেই তার নাকের উপর পুরু কাঁচের চশমা। ইন্ডিয়াতে তার এই প্রথম আসা। ছোটবেলা থেকেই মা বাবার কাছে ইন্ডিয়ার অনেক গল্প শুনেছে সে। এই প্রথম নিজের চোখে দেখল দেশটাকে । আসার আগে খুব excited ছিল অনুশকা, নিজের উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে সে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড ডরোথি কে বলেই ফেলেছিল ওর ইন্ডিয়া আসার কথাটা। শুনে ডরোথি নাক কুঁচকে বলেছিলে,” I have heard that is a very dirty place, poop here poop there , poop , poop everywhere.” শুনে খুব রেগে গিয়েছিলো অনুশকা , “ Have you ever been to India? Then how can you say so?” চেঁচিয়ে উঠেছিল সে। “My uncle went, and he said that, that place is full of bullock carts and snake charmers” বলে উঠেছিল ডরোথি । এর কোন জবাব ছিল না অনুশকা র কাছে। রাগে অভিমানে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল ও। আসার সময় bye ও বলা হয়নি। ভাবতে ভাবতে মনটা ভারি হয়ে উঠল অনুশকা র। হঠাৎ তাকিয়ে দেখল ভাবতে ভাবতে সে বাড়ির অন্য একটা অংশে এসে পড়েছে। এটা ওদের গ্রামের বাড়ি। এক সময় ওদের পূর্বপুরুষরা জমিদার ছিলেন এই এলাকার । এই বাড়িটি প্রায় দুশো বছরের পুরানো । জমিদারি যে খুব বিশাল আর প্রতিপত্তিশালী ছিল তা এই বাড়িটাকে দেখলেই বোঝা যায়। কাছারি বাড়ি , পুজোর দালান, দেউড়ী, অন্দরমহল মিলিয়ে বিশাল বাড়ি । বাড়ির চারদিকে বাগান । বাড়ির পিছন দিকে দুটো বড় বড় পুকুর। পুকুরের পাশে একটি পোড়ো শিব মন্দির, এ বাড়ির কুল দেবতার। এখন অবশ্য মন্দিরটার খুবই জীর্ণ অবস্থা, মন্দিরের দেয়ালে বট অশ্বত্থর গাছ গজিয়েছে। মন্দিরের দালান ভেঙ্গে গেছে, কিন্তু শিবলিঙ্গটি এখনও অক্ষত আছে। একজন পুরোহিত এসে নিয়মিত পুজো করে যান। গ্রামের কিছু লোক মাঝে মাঝে পুজো দিতে আসে। বাড়ির বেশির ভাগটাই ভাঙ্গাচোরা । কাছারি বাড়ি আর অন্দরমহলের কিছু ভাগ এখনও বাসযোগ্য আছে। অন্দরমহলের দোতলার সেরকম একটা ঘরেই ওরা আছে। বাড়ির দেখাশোনা করেন নায়েব দাদু। আরও পুরনো কিছু লোকজন আছে যারা দেউড়ীর কয়েকটা ঘরে থাকে। তারাই ওদের দেখাশোনা করছে। লক্ষ্মীর মা ওদের রান্না করে দেয় আর বলাইদা ওদের ফাই ফরমাশ কাজ করে দেয়। ওরা যেদিন এসে পৌঁছল সেদিনকার কথা মনে পড়তেই হাসি পেয়ে গেল অনুশকার। ওরা এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে এসেছিল। ট্যাক্সিটা বিরাট লোহার গেট পেরিয়ে নুড়ি বিছানো পথ দিয়ে এসে গাড়ি বারান্দায়ে দাঁড়াতেই হই হই করে তিন চার জন লোক বেরিয়ে এলো দরজা দিয়ে। তাদের সবার আগে ছিলেন নায়েব দাদু তার হাতে একটা গাঁদা ফুলের মালা। বাবা ট্যাক্সি থেকে নামতেই তিনি মালাটা পরিয়ে দিলেন বাবার গলায়। বাবা এতো হকচকিয়ে গিয়েছিলেন যে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন মায়ের ঘাড়ে। কাণ্ড দেখে অনুশকা ফিক করে হেসে ফেলেছিল। আমেরিকাতে সব কাজ ওদের নিজেদেরই করতে হয়। কিন্তু এখানকার সিস্টেমটা একটু আলাদা। নায়েব দাদু ওদের যত্ন করে ভিতরে নিয়ে গেলেন আর ওদের বড় বড় ভারী ভারী সুটকেসগুলো লোকজনেরা বয়ে ভিতরে নিয়ে গেল। কাল বিকালে আশার পর থেকে ওর কোন কাজ নেই। সব কাজই কেউ না কেউ এসে করে দিয়ে যাচ্ছে । ও মনের আনন্দে গল্পের বই পড়ে চলেছে। বাবা মা খাটে বসে গল্প করছেন। মাকে এতক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকতে দেখেনি কখনো অনুশকা । ও দেশে তো মা প্রায় সব সময়েই ব্যস্ত থাকেন।
এখন একটা বড় সিঁড়ির মুখে এসে পড়েছে অনুশকা । ধীরে ধীরে খুব সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল সে। সিঁড়িটার নিচে একটা ছোট্ট দরজা। দরজাটা অল্প একটু খোলা। ভিতরে কি আছে দেখার খুব ইচ্ছা হল অনুশকা র। যদিও মা বাবা দুজনেই অনুশকা কে বার বার বলে দিয়েছেন যে সে যেন ভাঙ্গা বাড়ির মধ্যে এদিক ওদিক না ঘোরে , সাপ খোপ থাকতে পারে। কিন্তু অনুশকা র পক্ষে এখন নিজেকে কন্ট্রোল করা খুব শক্ত। সে ধীরে ধীরে দরজাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আস্তে আস্তে হাত দিয়ে দরজাটা একটু ঠেলে ভিতরে উঁকি মারল । একটা ছোট্ট ঘর। বেশ পরিষ্কার। বাইরের দিকের দেয়ালে একটা ছোট জানালা আছে, যা দিয়ে ঘরের ভিতরে আলো আসছে। ঘরটার ভিতরে ঢুকে পড়ল অনুশকা । ঘরটার ভিতরে একটা অদ্ভুত গন্ধ, মাটির সোঁদা গন্ধ আর পুরানো জিনিষপত্রের গন্ধ মিলে যে গন্ধটা হয়। ঘরে আসবাব পত্র খুব একটা নেই। জানালার সামনে একটা ছোট টেবিল যার একটা পা একটু ভাঙ্গা আর তার সামনে একটা কাঠের চেয়ার। উল্টো দিকের কোনে অনেক পুরানো তোষক রাখা আছে। অনুশকা র ঘরটা খুব পছন্দ হল। গল্পের বই পড়ার পক্ষে ideal। ও ফুঁ দিয়ে চেয়ার আর টেবিলের উপরের ধুলো ঝেড়ে বসে পড়ল ipad এর kindle app খুলে গল্পের বই পড়তে। খানিকক্ষন পড়ার পর একটা শব্দ পেয়ে সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল পিছনের দেয়ালের কাছে তোষকের গাদার উপর একটি মেয়ে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। মেয়েটি তারই বয়সী, কিন্তু তার সাজ পোশাক একটু অদ্ভুত। তার পরনে ডুরে শাড়ি, মাথায় সিঁদুর , গলায় সোনার হার, হাতে সোনার বালা, শাঁখা-পলা, পায়ে মল, কপালে লাল সিঁদুরের টিপ আর পায়ে আলতা। মা বাবার বিয়ের অ্যালবামে মাকে অনেকটা এরকম সাজে দেখেছে সে । মা ই তাকে বলেছিলেন বিয়ের পর বাঙালি মেয়েরা হাতে সাদা bangle পরে তাকে শাঁখা বলে আর red bangle কে বলে পলা, পায়ের লাল রঙটা আলতা । মা অবশ্য এসব কিছু পরেন না আজকাল, বলেন western পোশাক এর সঙ্গে খাপ খায় না। মায়ের বিয়ের সময় খুব লম্বা চুল ছিল। এখন ছোট।
মেয়েটি বসে বসে পা দোলাচ্ছে আর তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। অনুশকা তার দিকে তাকাতেই সে বলে উঠল, “তুমি কে গো?”
অনুশকা হেসে উত্তর দিল,” আমি অনুশকা । তোমার নাম কি?”
“ রানী, পুরো নাম শ্রীমতী সন্ধ্যারানী দেবী।“
অনুশকা একটু অবাক হয়ে গেল , এভাবে নাম বলতে ও কাউকে কখনো শোনেনি, সে একটু দ্বিধার সঙ্গে বলল, “ Hi Rani! How are you? তুমি কি এখানেই থাক?”
রানী হেসে বলল,” হ্যাঁ গো, তুমি প্রথমে কি বললে আমি বুঝতে পারলাম না। ওটা কি অন্য কোন ভাষা?”
অনুশকা হেসে বলল “ওটা ইংলিশ, তুমি বুঝি ইংলিশ বোঝ না? Okay, আমি তোমার সাথে পুরো বাংলাতে কথা বলার চেষ্টা করব।“
“ তোমার হাতে ওটা কি?”
“এটা ipad, ipad এর বাংলা কি আমি জানিনা।“
“ওটা দিয়ে কি করে?”
“এটা দিয়ে অনেক কিছু করা যায়, যেমন ধর, বই পড়া যায়, খেলা যায় , কোন বন্ধুকে চিঠি পাঠান যায়...”
ওকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে রানী জিজ্ঞাসা করল, “ ওইটুকু পাতলা একটা পাটা তে কটা বই ই বা ধরবে?”
অনুশকা হেসে ফেলল,” ওর মধ্যে বই ভরা থাকে না ঠিক, বই এর soft copy, বা link থাকে”
“আমিও অনেক বই পড়েছি ক্ষীরের পুতুল, রূপকথা, মেয়েদের ব্রতকথা...”
“ব্রতকথা কি?”
“এমা তুমি ব্রতকথা জানোনা? তাহলে ইতু পুজো,মঙ্গল চণ্ডীর পুজো, পুণ্যি পুকুর এসব কর কি করে?”
“আমি তো এসব করি না?”
“অ্যাঁ ! সে কি? তাহলে তুমি কর কি?”
“কেন স্কুলে যাই, সাঁতার শিখতে যাই, সাইকেল চালাই, বন্ধুদের সাথে hangout করি।“
“ বন্ধুদের সাথে কি কর?”
“sorry, ক্ষমা কর, বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়াই মজা করি।“
“ জানতো আমার একটা সই ছিল, কমলা, আমার গঙ্গাজল।“
“সই কি?”
“ওমা সই জান না, সই হল প্রাণের বন্ধু, আমরা দুই বন্ধু খিড়কি পুকুরে একগলা জলে দাঁড়িয়ে আঁজলা ভরে জল নিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলুম, আমি মরলে ও কাঁদবে আর ও মরলে আমি কাঁদব। তা ও কথা রেখেছিল। যাক সে কথা, তোমার সই এর নাম বল।“
“ আমার best friend মানে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর নাম ডরোথি, কিন্তু এখানে আশার আগে ওর সাথে আমার ঝগড়া হয়ে গেছে। এখন ওর সাথে কথা বলছি না।“
“বন্ধুদের মধ্যে ওরকম হয়, দেখো ঠিক হয়ে যাবে।“
আরও কিছুক্ষণ কথা হতো হয়তো কিন্তু হঠাৎ অনুশকা শুনতে পেল বলাইদা চিৎকার করে তার নাম ধরে ডাকছে “ অণু দিদিমণি, অণু দিদিমণি , কোথায় তুমি?”
অনুশকা রানির দিকে চেয়ে বলল, “ আমায় যেতে হবে, কাল আবার এই সময় আমি এখানে আসবো, তুমিও এস”।
রানী হেসে ঘাড় নেড়ে “ বলল, “ কাল তোমাকে অনেক গল্প বলবো এই বাড়ীটার, আর বাড়ীটা ঘুরিয়ে দেখাব”
“ঠিক আছে” বলেই অনুশকা ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
“কোতায় ছিলে তুমি দিদিমণি? তোমায় খুঁজে খুঁজে হয়রান” ঘাম মুছতে মুছতে বলল বলাইদা। “চলো তোমার হবে খন। মা খুব রেগে গেচেন। তোমায় বারণ করেছেন না ঝোপ জঙ্গলে ঘুরতি?”
“ঝোপ জঙ্গলে কোথায় , আমি তো একটা ঘরের মধ্যে বসে ছিলাম” প্রতিবাদ করে অনুশকা ।
“ এসব পুরানো দিনের বাড়ীতে কত চোর কুঠুরি আচে , তল ঘর আচে, অলিগলি গোলকধাঁধা আচে সে সব তো তুমি জানো না কো, সে সবের মধ্যে একবার ফেঁসে গেলি আর রক্ষে নেই। তোমায় কেউ খুঁজে পাবেনি। “
“তুমি জানো কোথায় তলঘর, গোলক কুঠুরি এসব আছে”
ওর অজ্ঞতায় হেসে ফেলল বলাই দা,” গোলক কুঠুরি নয়, গোলক ধাঁধাঁ আর চোরকুঠুরি । না আমি সে সব দেখিনি। তবে গল্প শুনেছি প্রায় দেড়শো বছর আগে এই বাড়ীতে একবার ডাকাত পড়িছিল । সেকালের বিখ্যাত কালু ডাকাত। ইয়া বড় তার চেহারা, মিশকালো গায়ের রঙ, রনপা পড়ে সে আর তার দল ডাকাতি করতি আসতো”
“রনপা কি?”
“রনপা হল বাঁশের তৈরি লম্বা লম্বা পা, সেই পায়ে চড়ে ওরা বড় বড় প্রান্তর পগার পেরিয়ে ডাকাতি করতি যেত, ওদের কেউ ধরতি পারত না , ঝড়ের বেগে চলতো ওরা। “
“পগার কি?”
“পগার মানে গর্ত” বিরক্ত হয়ে জবাব দিল বলাই দা,” গল্পটা শুনবে তুমি?”
“আচ্ছা আচ্ছা বল”
“সেই যখন তারা হা রে রে করি এসি পড়ল তখন বাড়ির সবাই তাড়াতাড়ি সোনা দানা, ট্যাকা কড়ি নে একটা ওই রকম লোকানো ঘরে ঢুকে পড়লো। ডাকাতেরা এসে দেখলো বাড়ি খালি, পরিবারের লোকজন কেউ নেই দু এক জন পাইক বরকন্দাজ আর কয়েকজন চাকর বাকর ছিল। তারা সারা রাত তন্ন তন্ন করে খুঁজলো, চাকর বাকরদের ধমক ধামক দিল, দু এক ঘা লাগিয়েও দিল , আলমারি , দরজা, জানালা ভেঙ্গে একাক্কার করল, বাড়ি পুরো লণ্ড ভণ্ড করল কিন্তু ট্যাকা কড়ি দামি জিনিষ কিছুই পেলনি। শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে খালি হাতেই তাদের ফিরে জেতি হোলো। পরের দিন সকালে নায়েব মশাই এসে সেই ঘরের দরজা খুলি দিলেন তখন সবাই বাইরে এলো। এই সব লুকোনো ঘরের দরজা একবার ভিতর থেকে বন্ধ করি দিলে আর ভিতর থেকে খোলা যায় না। ভিতরের আওয়াজ বাইরে শোনা যায় না। আর বন্ধ করে দেবার পর বাইরে থেকে দরজাটা দেখতিও পাওয়া যায় না। যে জানে কোথায় দরজাটা আর সেটা কিভাবে খুলতি হয় সেই কেবল দরজাটা খুলতি পারবে। “
গল্প করতে করতে ওরা ওদের ঘরের সামনে এসে পড়েছিল, মা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন,” কোথায় কোথায় ঘুরছিস সারাদিন? চিন্তা হয়না? জানিস তো এখানে সব যায়গায় মোবাইল টাওয়ার পাওয়া যায় না। ফোন করেও যে জানব তুই কোথায় তাও সম্ভব না। যা ফ্রেশ হয়ে নে আর কিছু খা।“ অনুশকা “ ওকে মাম্মা “ বলে ipad টা বিছানার উপর রেখে টয়লেটের দিকে দৌড়লও । বিকালের জলখাবার চিড়ে আর বাদাম ভাজা, লক্ষ্মীর মা ওটা fantastic বানায়। বাবা , মার সঙ্গে খেতে খেতে অনুশকা বলাইদার কাছে শোনা গল্পটা ওদের বলল। বাবা বললেন ,”তুই তাহলে পুরো গল্পটা শুনিস নি। পরিবারের সবাই লোকায়নি, তাড়াহুড়োতে কেউ খেয়ালই করেনি যে, বাড়ির ছোট বউ ঢোকেনি ঘরে। কিন্তু it was too late. দরজা বন্ধ করা হয়ে গিয়েছিল কাজেই আর তাকে ডাকাও যায়নি। পরের দিন যখন তারা সবাই বাইরে বেরুলো তখন অনেক খোঁজা খুঁজি করেও তার কোন খবর পাওয়া যায়নি। তখন সবাই ধরে নেয় ডাকাতরা তাকে নিশ্চয়ই তুলে নিয়ে গেছে।“ অনুশকা র মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল গল্পটা শুনে। তারপর ভাবলো কাল রানীকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। সারা সন্ধ্যা অনুশকা বাবার সঙ্গে ওদের পরিবারের ইতিহাস, এই বাড়ির নানা গল্প নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। এই বাড়িতে কোন লোকানো কুঠুরিতে গুপ্তধন লোকানো আছে কিনা সে সম্বন্ধেও আলোচনা হল। বাবা বললেন ,” সেটার চান্সেস কম, কারণ এই বাড়ির লোকজন হঠাৎ করে কেউ বাড়ী ছেড়ে যায়নি। সবাই নিজের ইচ্ছা বা প্রয়োজনে planned way তে বাড়ি ছেড়েছে। তাই যে যার জিনিষপত্র গুছিয়ে সঙ্গে নিয়ে গেছে।“
অনুশকা একটু দমে গেল। এই সব লোকানো ঘর টরের গল্প শুনে তার একটা দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল যে এই বাড়িতে কোথাও না কোথাও লুকানো treasure আছে। আর সেগুলো খোজার জন্য সে অনেক প্লান ও করেছিল। যাক সে সব ভেবে আর লাভ নেই। কাল এই বাড়িটার নানা দিকের অনেক ফোটোগ্রাফ তুলতে হবে তাকে। Class teacher Mrs. Samuel specially বলে দিয়েছেন যে ওকে ইন্ডিয়া ভিসিটএর উপর একটা ক্লাস প্রোজেক্ট করতে হবে। এইসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে অনুশকা কখন ঘুমিয়ে পড়েছে ও জানে না।
পরেরদিন অনেক ভোরবেলায় ওর ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম ভাঙতেই ও তাড়াতাড়ি চশমাটা চোখে লাগিয়ে ঘরের সামনের বারান্দাটায় এসে দাঁড়াল । তখন সূর্য উঠবো উঠবো করছে। পুবদিকের আকাশটায় লালরঙের ছোঁয়া লেগেছে। হাল্কা ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে ফুর ফুর করে। হাওয়াতে খুব সুন্দর একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। গন্ধটা কোথা থেকে আসছে দেখার জন্য এদিক ওদিক তাকাতেই ও দেখলো ওর বারান্দার নিচেই একটা গাছে রাশি রাশি সাদা ফুল ফুটে আছে শুধু তাই না গাছটার নিচে প্রচুর ফুল পড়ে মাটিটাও সাদা হয়ে আছে। ও দেখল লক্ষ্মীর মা সেই ফুল মাটি থেকে কুড়োচ্ছে। ও জিজ্ঞাসা করল,”ওটা কি ফুল গো ?”
“শিউলি, এখন শরৎকাল তো , দুর্গা মা আসছেন, এই সময় এই ফুল ফোটে, দাঁড়াও তোমাকে উপরে এনে দিচ্ছি। তুমি ঘরে রেখে দিও । দেখবে সারা ঘরে কি সুন্দর গন্ধ হবে।“
সকাল থেকেই তার মনটা রানীর সঙ্গে দেখা করার জন্য উতলা হচ্ছিলো। কিন্তু রানীতো আসবে সেই দুপুরবেলা। রানী কোথায় থাকে তাও জিজ্ঞাসা করা হয়নি। আশপাশের কোন বাড়িতে হবে, এ বাড়িতে তো কখনো দেখেনি ওকে অনুশকা । তবে যা বিশাল বাড়ি, তার অর্ধেকও ঠিকমতো দেখা হয়নি ওর । আজ অবশ্য রানী দেখাবে বলেছে বাড়ীটা ঘুরিয়ে। দেখা যাক কি হয়। এখানে internet connection খুব খারাপ তাই ওকে I pad এ downloaded বই-ই পড়তে হচ্ছে আর downloaded games খেলতে হচ্ছে তাই ipad টা ওকে খুব একটা আকর্ষণ করতে পারছে না। একমাত্র treasure hunt game টা তবু ভালো লাগছে। ওই গেমটায়ে অনেক riddle solve করতে হয়, ওটা ওর খুব পছন্দ। কিন্তু আজ চোখটা বার বার দেয়াল ঘড়িটার দিকে চলে যাচ্ছে। সময় যেন আর কাটে না।
দুপুরের খাওয়াটা শেষ হতেই অনুশকা মা কে বলল ,” আমি দুপুরে ঘুমবো না ক্লাস প্রোজেক্ট এর জন্য আমাকে কিছু ছবি তুলতে হবে, আমি বিকালবেলায় ঠিক ফিরে আসবো। তুমি চিন্তা কোরো না।“ সে তার I pad টা নিয়ে বেরিয়ে গেল। আজ যাবার সময় ও খেয়াল করে দেখল যে, যে ঘরটায় ও কাল গিয়েছিলো সেটা অন্দরমহলের পুরানো অংশে। এই দিকটা বেশ ভাঙ্গাচোরা। ঘোরগুলোর দেয়াল গুলো বেশ মোটা , যেখানের প্লাস্টার খসে পড়েছে সেখানে ভিতরের ইট গুলো দেখা যাচ্ছে। খুব ছোট্ট ছোট্ট ইট গুলো। এই বাড়ির এক তলাটা বোধহয় দুতলাটার থেকে আরও পুরানো। নিচের ঘরের দরজা জানালা গুলো অনেক ছোট ছোট , দরজায় লোহার গোল গোল কড়া লাগানো আর তালা লাগানোর জন্য শিকল । মেঝেগুলো ঘসা ঘসা অসমান । অথচ দু তলার ঘর গুলির দরজা জানালা অনেক বড় বড় , দরজায় ডিজাইন করা হাতল লাগানো, তালা লাগানোর জন্য হ্যাচ বোলট লাগানো। মেঝেগুলো চক মিলানো । সেই সিঁড়িটার কাছে পৌঁছে গেছে সে। এবার সে লক্ষ্য করলো যে সিঁড়িটা কাঠের আর ব্যবহার হয়ে হয়ে তার উপরের অংশ গুলো কোথাও কোথাও ক্ষয়ে গিয়ে অসমান হয়ে গেছে। একটু অন্যমনস্ক হয়ে চললেই পা পিছলে পড়ার সম্ভাবনা।
ঘরে পৌঁছেই সে দেখলো রানী আগে থেকেই সেখানে বসে আছে। ওকে দেখেই এক গাল হেসে বলল,”কি গো এতো দেরি কেন?”
অনুশকা হাসল,” দেরি কোথায়? কাল তো আমি এই সময়েই এসে ছিলাম। আচ্ছা রানী তুমি সিঁদুর পরো কেন? তোমার কি বিয়ে হয়ে গেছে?”
“হুম...। কবে... তখন আমার সাত বছর বয়স।“
“ যাহ্ অত ছোট বয়সে কারুর বিয়ে হয় নাকি? আচ্ছা তোমার বরের নাম কি বলতো?”
“এ মা বরের নাম আবার নিতে আছে নাকি?”
“ধুর! তার মানে তোমার বিয়েই হয়নি”
“ বিয়ে হয়নি মানে, আমার বিয়েতে কত লোক খেয়েছিল জানো?”
“কত?”
“দু গ্রামের লোক , সে হবে কয়েক হাজার। জানো আমার বর ফিটন গাড়ি চেপে আমায় বিয়ে করতে এসে ছিল। সঙ্গে বিলিতি বাজনার দল। আমার বাবা এতো ঝাড় বাতি জ্বেলে ছিল যে লোকে বলেছিল চৌধুরী বাড়িতে দিনের মতো আলো হয়েছে। দুশো মুটে আমার তত্ত্ব বয়ে বয়ে থকে গিয়েছিলো। তারপর আমি পালকি করে শশুর বাড়ি এলুম। এ বাড়ীতেও কি ধুম বাপরে!“
“পালকি, হুম্, মানে palanquin? এখনও ইন্ডিয়াতে পালকি চলে?”
রানী একটু ভেবে বলল,” কি জানি , আমার বিয়ের সময় তো চলতো, আমরা পালকি করেই তো গঙ্গা স্নানে জেতুম, থ্যাটার , বায়স্কোপ জেতুম।“
“বায়স্কোপ! “
“হ্যাঁ ছবি গো ছবি, আমার মনে আছে মনসামঙ্গল দেখেছিলুম, সেই সাপ এসে কামড়ে দিলো...।।“
“Oh god ! I am afraid Dorothy was right” মনে মনে বলল অনুশকা । মেজাজটা খিঁচড়ে গেলো। অনুশকা র আর কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না, ও ipad টা বার করে খেলতে শুরু করলো ।
“তুমি কি করছো ?”
“খেলছি।”
“তুমি একা একা খেলো? আমি আমার সইয়ের সাথে খেলতাম। খেলনা বাটি, পুতুলের বিয়ে। আমার ছেলে পুতুল ছিল আর সইয়ের মেয়ে পুতুল। আমরা দুজনে ওদের বিয়ে দিতুম। আমার বাবা আমার বিয়েতে আমাকে একটা খেলনা বাটি উপহার দিয়েছিল। ওটা আমার খুব প্রিয় ছিল। সই অনেকবার চেয়েছিল, বলেছিল একবার দে, আজ নিয়ে যাব আর কালই তোকে ফেরত দিয়ে যাব, আমি রাজি হই নি। বলেছি রোজ এখানে এসে খেলচিস তো ভাই আবার নিয়ে যাবার কি দরকার? ও একটু দুঃখ পেয়েছিল। কিন্তু আমি দিই নি।“ বলে দুষ্টু দুষ্টু করে হাসল রানী। “আমি ওটা একটা গোপন জায়গায় লুকিয়ে রাখতাম। সেই জায়গার কথা কেউ জানত না। আমি হঠাৎ একদিন ওই জায়গাটা খুঁজে পাই।“
“ তুমি এখনও খেলনা বাটি খেলো?” অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল অনুশকা ।
“রানী বলল “এখন আর খেলি না, একা একা ভালো লাগে না খেলতে। যাক সে কথা, তুমি খেলনা বাটি খেলোনা”
“উহু”
“তা হলে তোমার প্রিয় খেলা কি?”
“ আমার riddles মানে ধাঁধাঁ ভালো লাগে, treasure hunt মানে গুপ্তধন খোঁজার গেম খেলতে ভালো লাগে।“
“ কোথায় খোঁজো গুপ্তধন?”
“আরে নানা , আমার এই জিনিষটা আছে না যাকে বলে I pad , ওটার মধ্যে এসব খেলা যায়, কোথাও যেতে হয় না।“
“তোমার তো খুব বুদ্ধি!”
অনুশকা একটু লাজুক হাসি হাসল।
“তাহলে আমি তোমায় একটা ধাঁ ধাঁ বলছি যদি তুমি ওটার উত্তর খুঁজে পাও তাহলে সত্যি সত্যি তুমি একটা গুপ্তধন পাবে, আর অনেক দিনের পুরানো একটা রহস্যের ও সমাধান হয়ে যাবে। রাজি?”
অনুশকা র চোখ আনন্দে নেচে উঠলো,”রাজি।”
মন দিয়ে শোন -
“ এঙ্কুরি মেঙ্কুরি সময়েস্বরি
কোমরে চিমটি কেটে পা দেখি সিঁড়ি
জোড় সোপানে দিয়ে ভর
যা দেখি চিলের ঘর
পাঁচ পদ্ম আগে
মা কমলা জাগে
ঝাঁপির পর দিয়ে কর
যা নিয়ে আমার বর”
অনুশকা তাড়াতাড়ি I pad এ ধাঁধাঁ টা টাইপ করে নিল। বার কয়েক পড়েও তার মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলো না। শেষে হতাশ হয়ে রানীকে বলল,” তুমি আমায় বাড়িটা ঘুরে দেখাবে বলেছিলে, তা দেখাবে না? “
রানী বলল “ চল , আমি আগে আগে যাই আর তুমি পিছনে পিছনে এসো “
অনুশকা রানীকে অনুসরণ করে চললো। রানী ওকে পুরানো বাড়ির দিকে নিয়ে গেল। রানী ওকে এক একটা ঘরের সামনে নিয়ে যায় আর সেই ঘর সম্বন্ধে গল্প বলে, আর অনুশকা সেই ঘরের ছবি তুলে নেয়। একটা বিরাট হল ঘরে নিয়ে গিয়ে রানী বলল এটা নাচ ঘর। অনুশকা দেখলো ঘরটার জীর্ণ অবস্থা কিন্তু এখনও বোঝা যায় এক সময়ে ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো ছিল । ঘরটার ছাদ থেকে এখনও কয়েকটা ঝাড় লণ্ঠন ঝুলছে। সেগুলোর খুবই পুরনো । ঘরের কোনে কিছু কার্পেট ও শতরঞ্চি গুটিয়ে রাখা আছে। কিন্তু সেগুলো আর ব্যবহারের উপযুক্ত নেই, তাই জন্যই হয়তো পড়ে আছে ভাবলো অনুশকা ।
একটা ঘরের সামনে গিয়ে রানী বলল ,”এটা ফুল ঠানদির ঘর। খুব ভালো গল্প বলতেন উনি। আর সবাইকে ওনার হাতের তৈরি নারকোল নাড়ু দিতেন। “
অনুশকা র একটু অদ্ভুত লাগল , ও জানল কি করে? তারপর ভাবলো হয়তো গল্প শুনেছে। এবার একতলা থেকে ওরা একটা পুরানো সরু সিঁড়ি বেয়ে দোতলাতে এলো। রানী বলতে বলতে এগিয়ে চলল,” এটা বড় ঠাকুরের ঘর, এটা সেজ ঠাকুরের ঘর, এটা গোলাপ ঘর, এটা রাঙা পিসির ঘর...” ওরা চলতে চলতে বারান্দার একদম কোনে এসে গিয়েছিলো। এতক্ষণ পর্যন্ত ওরা যে সব ঘর দেখেছে সেগুলোর দরজা খোলা ছিল, আর বেশিরভাগ ঘরই একদম ফাঁকা ছিল। কোনো কোনো ঘরে হয়তো একটা ভাঙ্গা টেবিল বা একটা ভাঙ্গা তক্তপোষ । একদম কোনের ঘরটা তালা লাগানো ছিল। বারান্দার দিকের জানালা দিয়ে ঘরের ভিতর উঁকি দিয়ে অনুশকা দেখল ঘরটা আসবাবে ভরা , খাট আলমারি সব রয়েছে। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে যে ঘরটা বহুদিন ব্যবহার হয়নি। অনুশকা জিজ্ঞাসা করলো ,” এটা কার ঘর?” রানীর মুখটা শুকনো দেখালো,” এটা একটা অভাগী মেয়ের ঘর, অনেক দিন আগে এ বাড়িতে ডাকাত পড়ে ছিল , সেদিন সেই মেয়েটা কোথায় যে হারিয়ে গেল তাকে আর কেউ খুঁজে পেল না।“
“ও হ্যাঁ আমিও সেই গল্প শুনেছি, তাকে ডাকাতে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো তো?” বলল অনুশকা ।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রানী আবার বলতে শুরু করল,” তার বর কয়েক মাসের মধ্যেই আবার বিয়ে করল, তখন থেকেই এ ঘর বন্ধ। নতুন ছোট বউ নতুন ঘরে থাকতে শুরু করল......” রানীর চোখের কোনে জল চিক চিক করে উঠল।
অনুশকা মন দিয়ে ছবি তুলছিল, হঠাৎ কি মনে হতে রানীর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, ” তা তুমি এতো কথা জানলে কি করে?”
রানী বিষণ্ণ হেসে উত্তর দিল ,” আমি তোমায় পরে একদিন বলবো,” তারপরই তাড়া দিয়ে বলল “চলো তাড়াতাড়ি এখনও অনেক দেখা বাকি, খিড়কি পুকুর, শিব মন্দির, আম বাগান...”
বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে খিড়কির পুকুর। তার চার দিকে চারটি বাধানো ঘাট । উত্তর দিকের ঘাটের সামনে এসে রানী বলল “এই ঘাটে আমি আর সই দুজনে সই পাতিয়ে ছিলুম।” অনুশকা বলে উঠল,” রানী তুমি আমার সই হবে? আমি সাঁতার কাটতে জানি। চলো পুকুরে নেমে সই পাতাই। “
রানী খিল খিল করে হেসে উথল,”আচ্ছা বাবা আচ্ছা, আর জলে নেমে কাজ নেই , তুমি এমনিই আমার সই হলে। আমি মরলে তুমি কেঁদো কেমন? আর আমার সব গয়না আর সম্পত্তি আমি তোমায় দিলাম।“
অনুশকা প্রতিবাদ করে উঠল,” কি সব মরা আর সম্পত্তির কথা বলছো ধ্যাত, ভালো লাগে না।“
রানী হেসে এগিয়ে শিব মন্দিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল “প্রতি সোমবার এখানে পুজো দিতাম।“ অনুশকা র একটু অবাক লাগলো, দিতাম কেন বলছে রানী এখন কি আর পুজো দেয় না? জিজ্ঞাসা করার জন্য পিছনে ঘুরতেই দেখে বলাইদা আসছে খিড়কির পুকুরের ধার দিয়ে। ওকে দেখতে পেয়েই ছুটে এলো ওর দিকে,”দিদিমণি তুমি আবার একা একা ঘুরতিচ বনে বাদাড়ে?”
“একা নয়, আমার ফ্রেন্ড রানী আছে আমার সঙ্গে দেখ “ বলেই ঘুরে দেখে রানী ওখানে নেই। “বোধ হয় তোমাকে দেখে ভয়ে পালিয়ে গেছে।”
বলাইদা তাড়া দিয়ে বলল ,” সন্ধ্যে হতি চলল, এই জঙ্গলে আর ঘুরতি হবে না, কোতায় মশা পোকা কাটবে, চল দিনি।।“
ফেরার পথে অনুশকা অনেক বার এদিক ওদিক দেখল কিন্তু কোথাও রানীকে দেখতে পেলোনা। চলতে চলতে ও বলাইদাকে বলল ,” জানো বলাইদা আজ আমি এই বাড়িটার অনেক জায়গা দেখলাম রানীর সাথে। রানী কতো জানে এই বাড়িটার সম্বন্ধে, ও আমাকে সেই মেয়েটার ঘর দেখাল,”
“কোন মেয়েটার?”
“আরে সেই মেয়েটা গো যাকে ডাকাতে তুলে নিয়ে গেছিল, তার ঘর। সেখানে এখনও তার খাট আলমারি সব আছে,।“
বলাইদা একবার অদ্ভুত ভাবে তাকালো ওর দিকে, তারপর কোনো কথা না বলে আরও জোরে জোরে চলতে লাগলো। ওদের ঘরের সামনে পৌঁছে বলাইদা ওর মাকে ডাকল ,” বউদিদিমনি...”
মা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন,” কি বলাইদা?”
“দিদিমণি কিন্তু এই বাড়িতে একেনে সেকেনে ঘুরতিচেন, কে নাকি একটা বন্দু হয়েচে, আপনি বারণ করেন, এসব জায়গা ভালো না। আমি আপনাকে বলে দিলুম , পরে আমাকে দোষ দিতি পারবেন না।“
উৎকণ্ঠিত মুখে মা বললেন,” আচ্ছা। “ তারপর অনুশকা র দিকে তাকিয়ে বললেন,” অণু I need to talk to you.’ বলাইদা চলে যাবার পর মা জিজ্ঞাসা করলেন,” অণু বলাইদা কি বলছে?”
“ কিছু নয় মা, Rani is my friend, she stays nearby, আমি ওকে বলেছিলুম আমার project এর জন্য কিছু ফোটোগ্রাফ চাই তাই ও আমাকে বাড়িটা একটু ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল। আমি একা কোথাও যাইনি। ও কতো অদ্ভুত জায়গা আমাকে দেখালো জানো মা। ওই পুরানো বাড়িতে এমন কয়েকটা দরজা আছে যেগুলো নকল, তুমি যদি দরজাটা খোলো তার পিছনে দেয়াল, আর এমন কিছু দেয়াল আছে যা সরে যায় তার পিছনে দরজা। বাইরে থেকে বোঝাই যায় না। আমি সব ছবি তুলে এনেছি। তুমি দেখবে? “
“ কই দেখা।“
অনুশকা তার তোলা ছবি গুলো মাকে দেখাতে দেখাতে অনর্গল গল্প বলে যেতে লাগলো, সেই সব গল্প যা রানী ওকে বলেছে। মা ছবি গুলো মন দিয়ে দেখছিলেন, হঠাৎ বলে উঠলেন , “ ছবিগুলো তো খুব ভালো হয়েছে, কিন্তু তুই তোর বন্ধুর একটাও ছবি তুলিস নি?”
চমকে উঠল অনুশকা , তাইতো কোন ছবিতেইতো রানীকে দেখা যাচ্ছে না। ইস বড় ভুল হয়ে গেছে, কাল যখন দেখা হবে তখন মনে করে ওর একটা ছবি তুলতে হবে। ওকে চুপ করে যেতে দেখে মা বললেন,” মণ খারাপ করছো কেন? কাল তুলে নিও। তা তোমার এই বন্ধুটি থাকে কোথায়?”
“কাছেই কোথাও, ঠিক জানি না। জানো মা ও আমারই বয়সী কিন্তু ওর বিয়ে হয়ে গেছে। ইন্ডিয়া তে মেয়েদের এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়?”
মা বললেন ,” না না এখন আর হয় না , অনেক দিন আগে হত। ও বোধ হয় মজা করেছে।“
“ না মা ও আমাকে ওর বিয়ের গল্প বলছিলো। ও হ্যাঁ জানো, ও আমাকে একটা Bengali riddle দিয়েছে solve করার জন্য, তোমার একটু help লাগবে।“
মা বললেন “ ঠিক আছে ডিনার এর পর বসা যাবে।“
মা নিচে রান্না ঘরে চলে গেলেন , লক্ষ্মীর মার কাছে। হয়তো ডিনারের তদারক করতে। আজ জলখাবার মুড়ি আর নারকোল কুরো, ঘি চিনি দিয়ে মাখা। চামচ দিয়ে মুড়ি খেতে খেতে অনুশকা আবার তার তোলা ছবিগুলো দেখছিল। নাহ কোথাও রানী নেই। হঠাৎ একটা ছবি দেখে ও একটু অবাক হলো। ছবিটা সেই কোনের ঘরের যেটাতে ওই বাড়ির ছোট বউ থাকতো। ছবিটাতে ঘরটার বারান্দার দিকের খানিকটা অংশ আর তার পাশের ঘরের খানিকটা অংশ দেখা যাচ্ছে। দুটো ঘরের মাঝখানে একটা সরু গলি আর সেই গলির শেষে অন্ধকারের মধ্যে ঝাপ্সা একটা grand father clock দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ওইখানে তো রানী দাঁড়িয়ে ছিল। রানী ছবিতে নেই কেন? তাহলে কি রানী ছবি তোলার আগে সরে গিয়েছিলো? কি জানি? তার জায়গায় ওই ঘড়িটা দেখা যাচ্ছে। রানী এই ঘড়িটা ওকে দেখায় নি । একটু অদ্ভুত লাগলো অনুশকা র। এরকম অদ্ভুত জায়গায় কেউ ঘড়ি রাখবে কেন? অনেক ভেবেও সে কোন কুল করতে পারল না।
বাবা ফিরে এলেন সদর থেকে , আজ বাবা নায়েব দাদুর সাথে জেলাশহরে গিয়েছিলেন কিসব কাজে। খুব ক্লান্ত, তবুও অনুশকা কে দেখেই হেসে জিজ্ঞাসা করলেন,” কি কেমন হল ছবি তোলা?”
“দারুণ! জানো বাবা আমার একটা বন্ধু হয়েছে, রানী, সে আমাকে এই বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। ও আমাকে একটা riddle solve করতে দিয়েছে, বলেছে যদি সল্ভ করতে পারি তো আমাকে একটা দারুণ প্রাইজ দেবে। তোমার হেল্প লাগবে।“
“সে হবেখন , after dinner”
“ok”
বাবা স্নান করতে চলে গেলেন।
রাত্রে খাবার পর অনুশকা মা আর বাবাকে দেখালো কবিতাটা।
“ এঙ্কুরি মেঙ্কুরি সময়েস্বরি
কোমরে চিমটি কেটে পা দেখি সিঁড়ি
জোড় সোপানে দিয়ে ভর
যা দেখি চিলের ঘর
পাঁচ পদ্ম আগে
মা কমলা জাগে
ঝাঁপির পর দিয়ে কর
যা নিয়ে আমার বর”
কবিতা পড়ে বাবা বললেন “ বেশ শক্ত ধাঁ ধাঁ “ তারপর বললেন,” এই সময়েস্বরি আবার কোন দেবী? ভুবনেশ্বরী শুনেছি রাজরাজেশ্বরী শুনেছি কিন্তু ইনি ...। আমি আজ খুব ক্লান্ত তাই ঘুমিয়ে পড়ছি , কিন্তু কাল আমি সাহায্য করবো,” বলে বিশাল একটা হাই তুলে বাবা পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লেন।
অনুশকা করুন মুখে মায়ের দিকে তাকাল,” আমি শিওর হেরে যাব মা তুমি না হেল্প করলে।“
মা বললেন “ ঠিক আছে বাবা ঠিক আছে। সময় মানে টাইম। ঈশ্বরী মানে দেবতা, সময়ের দেবতা...”
অনুশকা বলে উঠল,” time….time…. timetable….time line…. Time frame….time…..clock…..আচ্ছা মা ঘড়িকে কি সময়েস্বরি বলা যায়?”
মা বললেন,” হ্যাঁ, বলা যেতে পারে।“
“জানো মা সেই ঘরটার কথা তোমায় বলছিলাম না। তার পাশে একটা গলির মধ্যে একটা ঘড়ি আছে, কাল আমার সঙ্গে যাবে ওই ঘড়িটা দেখতে?”
“সে না হয় যাব, কিন্তু কোমরে চিমটি কি করবে কাটবি?”
‘আমার মনে হয় ওখানে গেলে সব ক্লিয়ার হোয়ে যাবে।“
“তাই হবে । এখন শুয়ে পড়।“ বলে মা আলো নিভিয়ে দিলেন।
পরের দিন সকালবেলায় জলখাবার খেয়ে অনুশকা আর মা সালওয়ার কামিজ, আর স্পোর্টস শু পরে সাথে টর্চ , জলের বোতল, মুখ বাঁধার জন্য বড় বড় রুমাল, একটা লাঠি এসব নিয়ে ঘড়ি দেখার জন্য তৈরি হল।
বাবা বললেন,” এসব কি? তোমরা ঘড়ি দেখতে যাচ্ছো না ট্রেসার হান্টএ যাচ্ছো? “
মা হেসে বললেন,” আরে না না অণু বলল ঘড়িটা একটা অন্ধকার গলির মধ্যে তাই টর্চ, আর পুরানো জায়গায় মাকড়সার জাল থাকবেই তাই লাঠি আর রুমাল।“
“তোমরা একা যেও না আমি আর বলাইদাও সঙ্গে যাব।“
ঘরটার সামনে পৌঁছাতে খুব একটা অসুবিধা হল না অনুশকা র। সরু গলিটা দিয়ে ঢুকে ওরা একটা লম্বা হল ঘরে পৌছালো। সেই ঘরের শেষে দেয়ালে দাঁড় করানো আছে ঘড়িটা। ঘড়িটার কাছে গিয়ে ওরা দেখলো যে ঘড়িটা সাধারণ গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকের চেয়ে একটু বড়। ভীষণ ধুলো পড়েছিল ঘড়িটার উপর।
বাবা বলাইদা কে বললেন ,”একটু কাপড় দিয়ে মুছে দাও তো বলাইদা। “
বলাইদা মুছতে লাগল ঘড়িটা । অনুশকা দেখছিল কি অপূর্ব কারুকার্য ঘড়িটার উপর। হঠাৎ বলাইদার মোছার কাপড়টা ঘড়িটার পাশে এক জায়গায় আঁটকে গেলো। অনুশকা ছুটে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো ।
বলাইদা বলল “ ছাড়ো দিদিমণি আমি করছি।”
“ না না দেখো কোথায় আটকেছে কাপড়টা, একটা ক্লিপ এর মতো জিনিষ, দাঁড়াও দেখি,” বলেই অনুশকা ওই ক্লিপটার দুদিকে দু আঙ্গুল দিয়ে ঠিক চিমটি কাটার মতো করে চাপ দিতেই ওদের সবাইকে চমকে দিয়ে একটা অদ্ভুত ঘড় ঘড় শব্দ করে ঘড়িটা বাঁ দিকে সরে গেলো আর তার পিছন দিকে দেখা গেলো একটা কাঠের ঘোরানো সিঁড়ি উপর দিকে উঠে যাচ্ছে।
অনুশকা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। মা বাবা দুজনেই অবাক। অনুশকা তাড়াতাড়ি ঢুকতে যাচ্ছিল, মা বললেন “ দাঁড়াও এটা যদি তোমার ধাঁধাঁর জায়গা হয় তাহলে ভিতরে ঢোকার আগে বাকি লাইন গুলো পড়ো “।
“জোড় সোপানে দিয়ে ভর,যা দেখি চিলের ঘর। সোপান মানে কি?”
“সোপান মানে সিঁড়ি, জোড় মানে ইভেন।“ বাবা বললেন।
“ তার মানে ইভেন নাম্বার সিঁড়িতে পা দিয়ে উপরে উঠতে হবে।“ বলেই সে একটা করে সিঁড়ি টপকে টপকে উপরে উঠতে গেলো, কিন্তু সিঁড়ি ভর্তি মাকড়সার জাল, অনুশকা ভয়ে পেছিয়ে এলো । মা বাবা দুজনেই ওকে উৎসাহ দিয়ে বলে উঠলেন ,” ভয় পেও না অণু আমরা তোমার সঙ্গে আছি।“ মা ওর মুখে স্কার্ফ বেধে দিলেন । বাবাও মুখে স্কার্ফ বেঁধে হাতে লাঠি নিয়ে তৈরি হয়ে মাকে বললেন,” আমি ওর সঙ্গে যাচ্ছি তুমি আর বলাইদা নিচে থাকো।” মা বাবার হাতে টর্চটা দিয়ে দিলেন। বাবা আগে আগে আর অনুশকা পিছনে পিছনে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো ওরা। উপরে উঠে একটা মাঝারি আকারের ঘরে পৌঁছল । ঘরটা খুব অন্ধকার আর ধুলো ভর্তি। বাবা টর্চ জ্বালালেন । পা দিয়ে ঘসে মেঝের ধুলোটা একটু সরাতেই দেখা গেলো মেঝেটা পদ্ম আঁকা টালি দিয়ে তৈরি। বাবা টর্চটা জ্বেলে ঘরের চারদিকে ঘোরাতেই ঘরের কোনে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসা একটা কঙ্কাল দেখা গেলো আর সঙ্গে সঙ্গে অনুশকা “ Oh my God! “ বলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো।
বাবা চিৎকার করে ডাকলেন “ বলাইদা জলের বোতলটা নিয়ে উপরে এসো, আর বউদিকে বাইরে থাকতে বল।“
বলাইদা জলের বোতল নিয়ে তাড়াহুড়ো করে উপরে উঠতে গিয়ে ভুল সিঁড়িতে পা দিতেই ঘড়িটা ঘড় ঘড় শব্দ করে সরে ঢোকার দরজাটা বন্ধ করে দিলো। বলাইদা ভয়ে ভীষণ চিৎকার করতে শুরু করে দিলো “দাদাবাবু দরজা বন্ধ হয়ে গেলো, আমরা আর বেরতে পারবনি।“ বাবা টর্চ জ্বেলে রাস্তা দেখালেন আর বললেন “ ভয় পাবার কিছুই নেই, তোমার বউদি বাইরে আছেন, উনি দরজা খুলে দেবেন।“ তখন বলাইদা শান্ত হয়ে উপরে এলো। তারপর বাবা জল ছিটিয়ে অনুশকা র জ্ঞান ফেরালেন।। তারপর বলাইদা কে বললেন ,” আর চেঁচিও না তোমায় একটা জিনিষ দেখাই।“ ঘরের কোনে টর্চের আলো ফেলতেই কঙ্কালটা দেখা গেলো আর বলাইদা আঁতকে উঠল। কঙ্কালটি একটি দশ বারো বছরের মেয়ের । মেয়েটির গা ভরতি গয়না। বাবা বললেন ,” এই মেয়েটি এই ঘরে ঢুকে পড়েছিল, তারপর ভুল সিঁড়িতে পা দেওয়াতে ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যায় তাই আর বেরোতে পারেনি বোধ হয়।“
বলাইদা বলল,”তাই হবে।“
ততক্ষণে মা ঘড়ির ক্লিপটা টিপে আবার দরজাটা খুলে দিয়েছেন। বাবা আনুস্কার হাতে টর্চ টা দিয়ে বললেন “তুই টর্চটা দেখা, আমি আর বলাইদা কঙ্কালটা নিয়ে নামি। বলাইদা কঙ্কালটা তুমি কোলে নিয়ে নামতে পারবে তো? মনে থাকে যেন একটা সিঁড়ি ছেড়ে ছেড়ে।“
বলাইদা হেসে ঘাড় নাড়লো।
বাবা আর বলাইদা স্কার্ফ দিয়ে কঙ্কালটাকে ভালো করে জড়িয়ে নিলেন। তারপর খুব সাবধানে কঙ্কালটাকে বাইরে বার করে এনে মেঝের উপর শুইয়ে দিলেন। এইবার অনুশকা কঙ্কালটার কাছে গিয়ে ভালো করে দেখল আর দেখেই চমকে উঠল। কঙ্কালটা গলায় হার, হাতে বালা, শাঁখা পলা, পায়ে মল পরে আছে।। অনুশকা চেঁচিয়ে উঠলো, “ মা এই গয়না গুলো রানীর। ও এই গয়না গুলোই পরে থাকে সবসময়। শুধু কানের দুল আর নাকের নথটা দেখছি না।“
“ওই গুলোও আছে।“ বলে বলাইদা সেগুলো বার করে দিলো, “নিচে পড়ে গিয়েছিলো।“
“ কি বলছিস তুই অণু, এও কি সম্ভব?” মা বললেন।
বলাই দা বলল,” এ মনে হতিচে সেই মা ঠাকরুনের কঙ্কাল যাকে কেউ খুঁজে পায় নে। আহা গো! যাই নায়েব মশাইকে ডেকে আনি গে।“
আনুস্কা মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো, “ মা রানী...” মারও চোখ জলে ভরে উঠল।
বাবা বললেন, “এটা মন খারাপ করার সময় নয় মা, তোমাকে ওনার দেওয়া ধাঁধাঁটাও তো সল্ভ করতে হবে? পরের লাইন টা কি?”
“পাঁচ পদ্ম আগে মা কমলা জাগে”। চোখ মুছতে মুছতে বলল অনুশকা । “তাহলে আমাদের আবার ভিতরে যেতে হবে বাবা?“
“তা তো হবেই, চল।“ বলে বাবা টর্চ হাতে উঠে পরলেন। আবার ওরা গেলো উপরের চিলেকোঠার ঘরে। সিঁড়িটা খুলেছে একদম ঘরের মাঝখানে।
“ বাবা পদ্মটালি গুলোর ওপর পা দিয়ে পাঁচ পা আগে যাই?”
বাবা বললেন “যা “
অনুশকা গুনে গুনে পাঁচটা পদ্মর ওপর পা দিয়ে এগুলো। কিন্তু পঞ্চম পদ্মে পা দিতেও কিছু হল না। অনুশকা বাবার দিকে তাকাল, খুব নিরাশ হয়েছে সে। “ বাবা আমি পাঁচ পদ্ম আগে গেলাম কিন্তু কিছু হল না তো!“
“দাঁড়া দাঁড়া, সাধারণত এই ধরনের সঙ্কেতে দিক নির্দেশ ও দেওয়া থাকে , পাঁচ পদ্ম আগে, আগে মানে পূর্বে ও হয়। তুই ফিরত আয় । ইস্ট কোনটা?”
অনুশকা তার সর্বক্ষণের সঙ্গী I pad দেখে বলল,” ওইটা ইস্ট ।“
অনুশকা পূর্ব দিকে পঞ্চম পদ্মে পা দিতেই দেয়ালের একটা ভাগ সরে গিয়ে একটা মা লক্ষ্মীর মূর্তি বেরিয়ে এলো।
“দেখ মিলে যাচ্ছে, আমরা ঠিক রাস্তায় চলছি, মা কমলা মানে মা লক্ষ্মী।“ বাবা বললেন।
অনুশকা খুশিতে চিৎকার করে উঠলো “ ইয়ে”
বাবা বললেন “দাঁড়া দাঁড়া। এখনও কবিতাটা শেষ হয়নি। পরের লাইন টা কি?”
“ ঝাঁপির পর দিয়ে কর, যা নিয়ে আমার বর, মানে?”
“ কর মানে হাত আর বর মানে স্বামী বা আশীর্বাদ”
“বুঝেছি “ বলেই অনুশকা গিয়ে মা লক্ষ্মীর ঝাঁপিটাতে হাত দিয়ে চাপ দিতেই মূর্তিটা সরে গিয়ে বেরিয়ে এলো পিছনে লুকানো একটা আলমারি। আর সেই আলমারিতে পাওয়া গেলো একটা বাক্স। বাক্সটা হাতে নিয়েই বাবা বললেন “কি আছে এতে, বেশ ভারী তো?”
“খুলে দেখি?” অধৈর্য ভাবে বলল অনুশকা ।
বাবা হেসে বললেন,” অত অধৈর্য হলে চলে? বাইরে গিয়ে খোলা যাবেখন “
তারপর ভালো করে আলমারিটা ও ঘরটা পরীক্ষা করে ওরা দুজন বাইরে বেরিয়ে এলো । বাইরে এসে দেখল নায়েব দাদু এসে গেছেন ততক্ষণে। সব শুনে উনি বললেন ,” ইনিই হচ্ছেন শ্রীমতী সন্ধ্যারানীদেবী মানে এ বাড়ির ছোটবউ রানী, যাকে ডাকাত পড়ার পর আর কেউ খুঁজে পায় নি। উনি ছিলেন এ বাড়ীর ছোট ছেলে শ্রীমান নবকুমার রায়ের স্ত্রী। ছোট বউরানি ছিলেন অধুনা বাংলাদেশের বরিশাল এলাকার এক বিরাট জমিদার বাড়ির মেয়ে। আমি আমার বাপ ঠাকুরদার কাছে গল্প শুনেছি যে সে বিয়ের মত জাক জমক নাকি আর কোনদিন কারো বিয়েতে হয়নি, কলকাতার থেকে বাজন্দার গাইয়েরা সব এসেছিলেন। ইংরেজদের বড়লাট আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিরা সবাই নেমন্তন্ন খেতে এসেছিলেন এই বাড়িতে। সাত দিন ধরে উৎসব চলেছিল। বিয়ের পরই নবকুমার বিলেতে চলে গেলেন ব্যারিস্টারি পড়তে, আর বউরানি চলে গেলেন বাপের বাড়ি। পাঁচ বছর পর যখন নবকুমারের ফিরে আসার সময় হল তখন তাকে আবার নিয়ে আসা হল এ বাড়িতে। কিন্তু নবকুমার ফেরার আগেই বাড়িতে ডাকাত পড়ল। আর তার পর থেকেই ওনাকে আর কেউ কোন দিন দেখেনি। নবকুমার দেশে ফিরে সব শুনলেন, তারপর কয়েক মাস বাদে দ্বিতীয়বার বিবাহ করলেন। আমার মনে হয় এই বাড়িতে আসারপর কোনোদিন খেলতে খেলতেই উনি এই চোর কুঠুরিটার সন্ধান পান। যখন ডাকাত আসে তখন ভয়ের চোটে উনি ওখানে ঢুকে লুকিয়ে পড়েন কিন্তু আর বেরোতে পারেন নি।“
অনুশকা র চোখ আবার জলে ভরে উঠলো।
নায়েব দাদু বললেন, “ কেঁদো না মা তোমার চেষ্টাতেই আজ এতদিনের একটা রহস্যের সমাধান হল । “
বাক্সটা খুলে দেখা গেলো তার মধ্যে রয়েছে এক সেট খেলনা বাটি। ছোট ছোট কড়া, হাঁড়ি, উনুন, হাতা, খুন্তি, থালা, গেলাস, বাটি ইত্যাদি প্রায় পঞ্চাশটি । সবই খাঁটি সোনার তৈরি । সূর্যের আলোতে সেগুলো ঝলমল করে উঠলো।
নায়েব দাদু বললেন,” ছোট বউরানীর বাবা হয়তো তার আদরের মেয়ের জন্য এগুলো গড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই খেলনা বাটি আর গয়না সব তোমারই প্রাপ্য। উনি তোমাকে দিয়ে গেছেন। এটা ওনার আশীর্বাদ । যাই এখন আমার অনেক কাজ , ছোট বউরানীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে আমায়।“
খেলনা বাটি গুলো নেড়ে চেড়ে দেখছিল অনুশকা , প্রত্যেকটার নিচে ছোট ছোট অক্ষরে কিছু লেখা আছে। মাকে দেখাতেই মা পড়ে দিলেন, “ আদরের রানীকে আশীর্বাদ সহ বাবামশাই।“ রানীর মুখটা মনে পড়ে গেলো অনুশকা র, ও বলেছিল,” তুমি এমনিই আমার সই হলে। আমি মরলে তুমি কেঁদো কেমন?” ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল অনুশকা ।
aparna.chaudhuri9@gmail.com
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন