(পর্ব-১৩)
অসহ্য মাথা যন্ত্রণা করছিল। ট্রেনে আসতে আসতে বমি পাচ্ছিল খুব। ডান চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়ছিল। পার্সে ওষুধ নিতে ভুলে গেছে। এত দূরে আসবে জানা ছিল না; কোনক্রমে কষ্ট চেপে ছিল গৈরিকা। চোখ বন্ধ করে রেখেছিল। আলো অসহ্য লাগছে। নীলের কথাগুলো কানে বাজছিল। নীল অবিশ্বাস করে ওকে। ভাবে,একবার ঘর ভেঙেছে গৈরিকা। অক্লেশে সঙ্গীর পরিবর্তন করেছে,ভালোবাসার পাত্রও বদলে ফেলেছে-তাই আবারও সেরকম করতে পারে। প্রতিবিম্বকে লেখা দেওয়া সহ্য করতে পারে না। নিখিলেশের বাড়ি যাওয়ার নাম শুনতেই রেগে উন্মাদ হয়ে গেল-এত ইনসিকিওরিটি ওর? ভালোবাসা অনুভব করতে হয়,গৈরিকা যে নীলকে ভালোবাসে বুঝতে পারে না নীল? নীল কি ভালোবাসে ওকে? ভালোবাসলে এভাবে জোর ফলাতে পারে,যেভাবে গালিগালাজ করল,করতে পারে কেউ? নিখিলেশ তো কখনো এরকম করেনি,নীরবে সরে গিয়েছিল। ভালোবাসলে এতটা কষ্ট হয়তো দেওয়া যায় না। এর জন্য ভুগতে হবে গৈরিকাকে। নীল অসম্ভব রেগে গেছে। অশ্বত্থমা মিত্রর মতোহয়তো ওকেও ব্যান করে দেবে উচ্ছ্বাস। সব হাত থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে। সব কিছু। ছক কেটে গড়া সুখের প্রাসাদ তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়ছে সামান্য মনোমালিন্যের জেরে। এত ঠুনকো কি হয় সবকিছু? সম্পর্ক কি এত সহজে তেতো হয়ে যায়? এক লহমায় ভেঙে দেওয়া যায় এতদিনের প্রগাঢ়তা? ভেবেই থমকাল গৈরিকা। যায়,নিশ্চয় যায়। ও নিজেও তো ভেঙেছিল একই ভাবে। তাহলে ভাঙনকে আসতে দেখে ভয় পাচ্ছে কেন এখন? হয়তো এটাই ওর প্রাপ্য। নাকি সবটুকুই ভ্রম ছিল, ভালোবাসাটাও। নীল ব্যবসায়ী। সবকিছুর থেকে বেশি করে ব্যবসায়ী ও। ওর ব্যবসার ক্ষতির বিনিময়ে ও কোন কিছুই করবে না। করবেই না। গৈরিকাকে হয়ত ব্যবহার করে গেছে এতদিন। নাঃ,আর নীলের ব্যাপারে নরম হবে না গৈরিকা। আপোস করার প্রশ্নই ওঠে না। ব্যাপারটা এখন জেদাজেদির পর্যায়ে চলে গেছে। গৈরিকাকে চ্যালেঞ্জ করেছে নীল। গৈরিকাকে এই চ্যালেঞ্জের জবাব দিতেই হবে। প্রমাণ করে দিতে হবে উচ্ছ্বাস গৈরিকাকে তৈরী করেনি। প্রথম সুযোগটা দিয়েছিল মাত্র। কলমের জোর না থাকলে কেউই সেই উচ্চতায় যেতে পারে না,যেভাবে গৈরিকা পৌছছে। নীলকে ফোন করবে না আর। এত অপমান হজম করা যাবে না। প্রতিবিম্বে উপন্যাস দেবে ও। দেবেই,আর সেই উপন্যাসের চরম কাটতি হলে তবেই হবে মুখের মত জবাব। তবে এসব করতে মনের জোর লাগবে। মনের জোরটাই তো খুঁজে পাচ্ছে না আর। রিন্টুটা কেমন আছে,কে জানে। সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। রিন্টু সুস্থ না হলে,কোন কাজেই মন বসাতে পারবে না গৈরিকা।
রাণাঘাটে নেমে চমকে গেল ও। পাঁচবছরে শহরটার ভোল বদলে গেছে। পুরনো বাড়ি সব ভেঙ্গেচুরে বহুতল মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ওর শৈশব কৈশোরের সুগন্ধ মাখা শহরটার গা দিয়ে আধুনিকতার উগ্র পারফিউমের গন্ধ পেল গৈরিকা। বদলে যাচ্ছে রাণাঘাট। বড্ড তাড়াতাড়ি বদলে যাচ্ছে। এখানকার মানুষজনও কি বদলে গেছে? নিখিলেশ ওর আসাটাকে ভালোভাবে নেবে তো,নাকি অপমান করে তাড়িয়ে দেবে? না,নিখিলেশ এটা করতে পারবে না। ওর ভালবাসাটা ভ্রম নয়,জানে গৈরিকা। ভালোবাসার হস্তান্তর হয়ে যায়নি তো? কে জানে ঐ বাড়িতে গিয়ে কি দেখবে? শিঞ্জিনী নিশ্চয় থাকবে ওখানে। ওকি গৈরিকার সমস্ত শূন্যস্থান ভরিয়ে ফেলেছে এতদিনে? না,না। তা পারবে কি করে? ওর রিন্টুর মনে মামমামের জায়গা কেউ নিতে পারবে না। আজ সেটা গৈরিকার কাছে স্পষ্ট। নিখিলেশের মনেও গৈরিকার স্থানটা কেউ নিতে পারবে কি? গৈরিকা জানে না,অথচ জানতে চায়। যদি তেমনটা হয়,তাহলে রিন্টুকে ওখানে রাখবে না আর। নিজের সাথে নিয়ে যাবে। রিন্টু ছাড়া এ পৃথিবীতে আর কেউ নেই যে গৈরিকার সাথে একান্ত আপনার। ওকে নিজের থেকে আলাদা না রাখাই ভালো। আগে স্ট্রাগল করছিল গৈরিকা,কষ্টে ছিল,এখন তো প্রতিষ্ঠিত। এখন আর কোন বাঁধা নেই। নিখিলেশকে কথাটা বলে দেখবে একবার।
-রিন্টু কোথায়? কেমন আছে?
বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই গৈরিকার প্রশ্ন নিখিলেশের উপর আছড়ে পড়ল। ওকে ভালো করে দেখল নিখিলেশ। উদ্বেগের ছাপ চোখে মুখে স্পষ্ট। চোখদুটো ফোলা ফোলা লাগছে। কেঁদেছে নিশ্চয়।
-ঘরে আছে।
-ডাক্তার ডেকেছ?
-কাল রাতেই ডেকেছি। চিন্তার কারণ নেই বলেছেন।
-এত ঠাণ্ডা লাগাও কি করে বলো তো? যত্ন করতে পারো না যখন কাস্টডি নিয়েছ কেন?
-আমি না নিলে তুমি কি নিতে? তখন তো কোন আগ্রহ দেখাওনি। কাস্টডি তোমার ব্যস্ত জীবনে ওর জন্য একটা মুহূর্তও বার করতে পারতে?
গৈরিকা জানে নিখিলেশ যা বলছে,সব সত্যি। তবুও বলল
-নিশ্চয় মাফলার,সোয়েটার,টুপি ঠিকমতো পরাও না। যা ভুলো তুমি,যা অগোছালো...
গৈরিকার গলায় অভিযোগের সুর শুনতে পেল নিখিলেশ। ও নিজেও জানে ও অগোছালো। কিন্তু আর্চির ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র অসতর্ক হয় না কোনদিন। তবুও এবারের জ্বরটার জন্য হয়তো নিখিলেশই দায়ী। অত জোরে বাইক না চালালেই পারত। হঠাৎ শিঞ্জিনীর গলা পেয়ে চমকে তাকাল দুজনেই।
-নিখিলেশবাবু,আমি এখন আসি?
-যাবে? হ্যাঁ,ঠিকই তো,বেলা হল।
গৈরিকা ততক্ষণে জরিপ করে নিয়েছে শিঞ্জিনীকে। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি দেখে নিয়েছে। কত বয়স হবে মেয়েটার,মাত্র বছর বাইশ-এর সাথে নিখিলেশ? না,না-হতেই পারে না। ফর্সা বটে,আলগা চটক আছে একটা-ঐ পর্যন্তই। রোগা,বেঁটেখাটো-অত্যন্ত সাধারণ বলা যায়। এ মেয়েকে নিয়ে সন্দেহ কড়া বৃথা।
-তা হল। তাছাড়া আর্চি জেগে গেছে। ওর মায়ের গলা পেয়েছে-আর ঘুমাবে না। তাই আমি ওনাকে ডাকতে এসেছিলাম।
-তুমি?
জেনেই প্রশ্ন করল গৈরিকা।
-আমি শিঞ্জিনী। আর্চির মিস। ওকে পড়াই।
-আজকেও পড়ানো ছিল?
নিখিলেশ গৈরিকার প্রশ্নে অবাক হল। আর্চি তো গৈরিকাকে শিঞ্জিনীর ব্যাপারে অনেকটাই বলেছে। সব জেনেশুনেও এমন প্রশ্ন কেন?
-আজ ওর জ্বর। পড়াব কি করে? তবে,আমি তো ওকে শুধুই পড়াই না-নিখিলেশবাবু না থাকলে ওকে সঙ্গ দিই। ওকে খুব ভালোবাসি বলে মনের তাগিদেই এ সব করি।
গুছিয়ে কথা বলতে পারে মেয়েটা। যতটা সহজ ভেবেছিল গৈরিকা,ততটা নয়।
-সত্যি,শিঞ্জিনী আর্চির জন্য যা করে,তার জন্য কোন ধন্যবাদ যথেষ্ট নয়। ও না থাকলে আমি একা হাতে আর্চিকে কি করে সামলাতাম কে জানে?
নিখিলেশের স্বীকৃতিতে শিঞ্জিনীর মুখে হাসির ঝিলিক খেলে গেল। গৈরিকার নজর এড়াল না।
-চলি।
শিঞ্জিনী চলে যেতে মৃদু হাসল গৈরিকা।
-খুব ভালো মেয়ে বলতে হবে। পরের ছেলেকে এভাবে যত্ন করে। শুধু আর্চির জন্যই,নাকি...
-তুমি যা ভাবছ,তা নয়।
নিখিলেশ অন্য দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল। শিঞ্জিনীর কথাটা গৈরিকাকে বলা যাবে না। গৈরিকা নিখিলেশের সাথে তর্কে জড়াতে চাইল না। ও রিন্টুর জন্য এসেছে। রিন্টুর কাছেই যাবে স্থির করল।
-মামমাম!
-শুয়ে থাক্। উঠছিস কেন? জ্বর না তোর?
গৈরিকা ছেলের কাছে গেল। ওর খাটে বসল। কপালে হাত রাখল। জ্বর আছে। অল্প।
-জ্বর,কাশি...
-খুব দুষ্টু তো জ্বরটা,আমার রিন্টুকে কষ্ট দিচ্ছে!
-না,জ্বর ভালো।
-কেন?
-জ্বর হল বলেই না তুমি এলে।
-গৈরিকার সব মন খারাপ অরিনের একটা কথাতেই ভ্যানিশ হয়ে গেল। ওর কপালে চুমু খেল একটা।
-তুই ডাকলি,তাই তো এলাম।
-এবারই এলে। আগেও কত করে ডেকেছি,আসোনি।
-আগে কবে?
-যখন জ্বর হত। মনেমনে ডাকতাম কত করে। তুমি শুনতেই পেতে না।
-মনে মনে ডাকলে শুনব কি করে? আজ যেভাবে ডাকলে,সেভাবে ডাকলে যখনই ডাকতে,তখনই চলে আসতাম।
-আমি তো ডাকতে চাইতাম। তারপর মনে হত বাবা বলে,তোমার খুব কাজ,ডাকলে ডিস্টার্ব হবে। তাই...আজ তোমার কাজ নেই মামমাম?
-আছে তো।
-তাও এলে?
গৈরিকা চোখ মুছল।
-আসব না? কাজ বড়,না রিন্টু বড়?
-তাহলে তোমার কাছে গেলেও কাজ করো যে?
গৈরিকা বুঝতে পারছিল,ওর প্রত্যেকটা ব্যবহার রিন্টুকে কতটা কষ্ট দিয়েছে। উদাসীন হয়ে থেকে নিজের সন্তানকে যে কষ্ট দিয়েছে,তার জন্য অনুতপ্ত হল ও।
-আর বেশি কাজ করব না। রিন্টুর যখন ইচ্ছা করবে,আমাকে ডাকবে,আমি কথা বলব।
-যখন ডাকবো তখন চলে আসবে?
-আসবই তো। আসলে জানিস্ তো,তোর যেমন কাল আমার জন্য মন কেমন করছিল,আমারও তোর জন্য ঠিক একরকম মন কেমন করছিল। ডানা থাকলে ডানা মেলে উড়ে চলে আসতাম তোর কাছে। তোকে আদর করে,ঘুম পাড়িয়ে চলে যেতাম,
-মামমাম,তুমি অ্যাঞ্জেল হলে তোমার ডানা থাকত,বলো?
-তা থাকত। কিন্তু অ্যাঞ্জেল হলে তো হেভেনে থাকতাম। রিন্টুর কাছে আসতে পারতাম না তো।
-অরিন ওর ছোটছোট দুহাত দিয়ে গৈরিকাকে আঁকড়ে ধরল।
-কি হল?
-তুমি হেভেনে যাবে না তো মামমাম? হেভেন খারাপ। বাবা বলে ঠাম্মি নাকি হেভেনে চলে গেছে,তাই আর ফেরে না। ঠাম্মির জন্য বাবা কষ্ট পায়,কাঁদে। ঠাম্মি তো বাবার মামমাম বলো?
গৈরিকা কষ্টের মধ্যেও চেষ্টা করে হাসল
-একদম যাবো না। আমি হেভেনে চলে গেলে তো রিন্টুর কষ্ট হবে,কাঁদবে,রিন্টুকে আমি কষ্ট দেব কি করে?
অরিনের মুখটা হাসিতে ভরে গেল। গৈরিকা নিজের মধ্যে স্নেহের প্রাবল্য অনুভব করল। ছেলের দুগালে অনেক করে আদর করে দিল। নিখিলেশ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। নিজের অজান্তেই ওর চোখ দুটো জলে ভরে উঠল। এই জল কষ্টের নয়,আনন্দের। আর্চি এতদিন পরে ওর একান্ত চাওয়া মায়ের আদর পাচ্ছে। যতটা চায়,ততটাই পাচ্ছে। গৈরিকা নিজের মমতাকে কাঠিন্যের আবরণে ঢেকে রাখছে না আর। ওরা দুজনেই এতে খুশি হচ্ছে। নিখিলেশ ওখান থেকে সরে গেল। ওদের একা থাকতে দেওয়া ভালো।
-কি করছ?
গৈরিকার গলা শুনে তাকাল নিখিলেশ।
-রান্না,প্রায় হয়েই এল। রিন্টু ঘুমোল?
-ঘুমিয়েছে।
-ও,ওর গা স্পঞ্জ করে দেব ভাবলাম,জলটা বসিয়েও দিয়েছি...
-ঠিক আছে,আমি করে দেব।
-নিখিলেশ অবাক চোখে তাকাল
-তুমি পারবে?
-পারব,দিয়েই দেখো।
-না থাক। একদিন করে কি করবে? রোজই তো এসব আমাকেই করতে হয়।
-রিন্টুর ভালো লাগবে,আমারও।
নিখিলেশ রাগ দেখালেও গায়ে মাখল না গৈরিকা। নিখিলেশ কথা বাড়াল না। গৈরিকার ভালোলাগায় ও বাধা দেবে কি করে?
-রোজ নিজে রান্না করো?
-হুম।
-তুমি না থাকলে,শিঞ্জিনী?
নিখিলেশ বুঝল আর্চি বলেছে কথাটা।
-হ্যাঁ। বারণ করলেও শোনে না।
-ভালোবাসে শুনলে না?
নিখিলেশ বুঝল গৈরিকা শিঞ্জিনীর মনটা পড়ে নিয়েছে।
-ভালো মেয়ে। সংসার করতে পারবে। সারা বাড়িতেই পারিপাঠ্যের ছাপ দেখছি,তোমার দ্বারা এসব হয় না নিশ্চয়। খুব গোছালো মেয়ে,খুব কাজের।
-দূর থেকে সবাইকেই ভালো মনে হয়।
-অত জটিল ভাবে ভাবলে চলে না।
-সহজ ভাবে ভাবতে চাইনা আর। কাউকে জীবনে জড়াতেও চাইনা। আসলে ঘর পোড়া গরু তো,সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় করে।
মুখে হাল্কা হাসি বজায় রেখে বলল নিখিলেশ। গৈরিকা ইঙ্গিতটা বুঝল
-আমি তোমার ভালোর জন্যই বলছিলাম।
-জেনে খুশি হলাম। আমার আর কিছু ভালো হওয়ার নেই। তুমি ভাবছ,আর্চির চোখে ভালো সাজার জন্য আমি বিয়ে করিনি-ব্যাপারটা এতটা সহজ নয়। বিয়ে করতে গেলে কাউকে ভালবাসতে হয়। আমি হয়তো আর কাউকে...
নিখিলেশের চোখে বিষাদমাখা ভালোবাসার ছায়া স্পষ্ট দেখল গৈরিকা। ওর যা জানার ছিল,জানা হয়ে গেল। নিখিলেশ অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারে কি না-এই সত্যিটা জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল ও। মনের মধ্যে আশান্তির ঢেউ উথালপাথাল করছিল এতক্ষণ। নিখিলেশের উত্তরে শান্ত হল গৈরিকা। না,নিখিলেশের ভালোবাসার ভাগ কেউ পায়নি। কেউ পাবেও না। গৈরিকার অদ্ভুত রকমের ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিল একটা মৃত ভালোবাসার সামান্য টুকরো নিজের মনে সযত্নে সংরক্ষণ করে চলেছে নিখিলেশ। তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। নিখিলেশ যতদিন বাঁচবে ওর মনে এই ভালোবাসা আর তার সাথে গৈরিকাও রয়ে যাবে। পৃথিবীতে এমন কেউ একজন থাকবে যার বুকের মধ্যে গৈরিকা বেঁচে থাকবে,কাছে থাকুক,দূরে থাকুক-থেকে যাবে। কারোর মনে এই স্থানটা পাওয়া ভাগ্যের। মৃত্যুর মুহূর্তে গৈরিকা এটুকু শান্তি পাবে যে-কেউ একজন ওকে সত্যিকারের ভালো বেসেছিল।
-জল গরম হয়ে গেছে। স্পঞ্জ করলে নিয়ে যাও।
গৈরিকার চটক ভাঙল
-যাচ্ছি।
-শোনো,তোমার সব জামাকাপড় যত্ন করে আলমারিতে তোলা আছে। এই বাইরের জামাকাপড় চাইলে বদলে নিতে পারো।
-শাড়ি আছে?
-সব আছে। কিছুই ফেলিনি আমি। ওগুলোর মধ্যেই তো তুমি রয়ে গেছ।
-তোমার বাড়ির আর একটা জিনিসের মধ্যেও আমি আছি।
গৈরিকার চোখটা চিকচিক করতে দেখল নিখিলেশ।
-আর্চির মধ্যে তো?
-হুম।
-আর্চি আমার একার কেন হতে যাবে গৈরিকা? ও তো আমাদের। যতটা আমার,ততটাই তোমার। এই জন্যই তো প্রত্যেক শনিবার করে ওকে দিয়ে আসি তোমার কাছে। তুমি ব্যস্ত,সময় দিতে পারো না জেনেও দিয়ে আসি। কারণ মামমাম কে বড্ড ভালোবাসে ও। ওখানে গেলে আর্চি তোমায় চোখের দেখাটুকু তো দেখতে পায়। এই শনি-রবিবার গল্প বলেছ,আদর করেছ,খাইয়েছ-ছেলের খুশি আর ধরে না। কাল ঐ তুমুল জ্বরের ঘোরেও এক কথা “মামমাম যাবো” “মামমাম এসো...”
-কাল ডাকলে না কেন?
-রাত হয়ে গিয়েছিল। অত রাতে তোমাকে ডিস্টার্ব করব ভেবে কেমন একটা লাগল।
-কিছু ডিস্টার্ব হত না। কাল আমারও খুব মন কেমন করছিল ওর জন্য। হাতে তেমন কোন কাজ ছিল না। একবার মনে হল তোমার ফোনে ফোন করে রিন্টুর সাথে কথা বলি। ফোনটা হাতে নিয়েও করলাম না। এখন খারাপ লাগছে। যদি করতাম,তাহলে আরো আগে চলে আসতে পারতাম।
-তোমার মন তাহলে তোমায় আগে থেকেই সংকেত দিয়েছিল। মায়ের মন তো...
-ঠিকই বলেছ। আসলে রিন্টুর শরীর খারাপ হলে আমার মন উচাটন হয়। আগেরবার ও নার্সিংহোমে থাকাকালীনও বুঝতে পারছিলাম রিন্টুর কোন বিপদ হয়েছে,ও ভালো নেই।
-শনিবার ও না যেতেই ফোন করেছিলে তাই। সত্যি বলেছ গৈরিকা,নাড়ীর টান একে বলে। আমি আর্চিকে একা হাতে মানুষ করলেও কাল জ্বরের ঘোরে ও তোমার নামটাই করল,তোমাকেই চাইল। খারাপ লেগেছিল আমার অস্বীকার করব না। পরে বুঝলাম আর্চি যা করেছে-সেটাই স্বাভাবিক।
গৈরিকা মৃদু হাসল,নিখিলেশ ওকে দোষ দেওয়ার বদলে ওর আর রিন্টুর সম্পর্কটাকে গাঢ় করতে চাইছে। গৈরিকাও তাই চায়। মনের মধ্যেকার সমস্ত কষ্ট,সব ভার ঝেড়ে ফেলে রিন্টুর জন্য নতুন করে বাঁচতে চায়,জীবনের একটা মাত্র খাঁটি সম্পর্ক রয়েছে,তাকে কলঙ্কিত হতে দিতে চায় না। বাকি যা কিছু ছিল তা নিজের হাতে নষ্ট করেছে গৈরিকা। সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়াও হয়তো পেয়েছে তাই। ওসব নিয়ে ভেবে মন খারাপ না করে-যেটুকু ওর কাছে আছে তাকে দুহাতে আগলাতে চায়। নিখিলেশ তো বাধা দিচ্ছে না,দূরে ঠেলছে না-তাহলে রিন্টুকে কাছে টানতে সমস্যা কোথায়? ওকে ওর সমস্ত অভিযোগ,অভিমান ভুলিয়ে দিতে দোষ নেই তো। তাই করবে গৈরিকা। সব কিছুর থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে রিন্টুকে ঘিরে বাঁচবে এখন। শান্তি চাই ওর। একটা ব্রেক চেয়েছিল গৈরিকা। কলকাতা থেকে দূরে খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে চেয়েছিল। সমস্ত টেনশন ভুলে থাকতে চেয়েছিল। এর থেকে ভালো ব্রেক আর কোথায় পাবে?
(পর্ব-১৪)
নিখিলেশ আজ গৈরিকাকে যতই দেখছিল ততই অবাক হচ্ছিল। সারাক্ষণ ওর রিন্টুর সাথে গল্প করছে,ওর সমস্ত কাজ নিজে হাতে করছে,ওকে একমুহূর্তও চোখের আড়াল করছে না। গৈরিকার এই আকস্মিক পরিবর্তন কি সহজাত স্নেহ নিয়ন্ত্রিত,নাকি এর পিছনে অন্য কোন কারণ রয়েছে? গৈরিকা আজ একটু বেশিই কথা বলছে। আর্চির সাথে থাকার সময় বেশ হাসছে,আর্চিকেও হাসাচ্ছে। বেশি কিছু রান্না করতে পারে নি নিখিলেশ। ডাল,ভাত,আলুসেদ্ধ-গৈরিকার খেতে কষ্ট হবে ভেবেছিল,অথচ দিব্যি খেয়ে নিল ও। খেতে খেতে কথা বলছিল ঠিকই,কিন্তু বারবার কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। দু’একবার নিখিলেশকে লুকিয়ে চোখের জল মুছেছে। আর্চির কষ্টের জন্য কাঁদছে,নাকি ওর মনটাই খারাপ? বিকাল হতে এল। আর্চি ঘুমাচ্ছে। গৈরিকাও ছেলের পাশে শুয়ে রয়েছে। ওদের ঘরে যায়নি নিখিলেশ। আলাদা ঘরে বসে স্মোক করছিল। আজ সৌগতদাকে কয়েকটা কবিতা দিতে হত। ফেয়ার করা হয়নি। ফেয়ার করতে মনও করছে না। আর্চিটা সুস্থ না হয়ে উঠলে কোন কাজে মন বসবে না। গৈরিকা আজ শাড়ি পরেছে। সেই আগের মত। “ঘরের বৌ শাড়ি পড়লে লক্ষ্মীশ্রী বাড়ে।” মা বলত সবসময়। আজ যেন এই বাড়িটার হৃত লক্ষ্মীশ্রী ফিরে এসেছে। বাড়িটা আর ইট,কাঠ,সিমেন্ট,বালির নয়-তার মধ্যে প্রাণ ফিরে এসেছে,যে প্রাণ গত পাঁচবছরে উধাও হয়ে গিয়েছিল। প্রাণহীন কাঠামোর মত পড়ে ছিল বাড়িটা। সংসার বলতেও তো কিছু ছিল না। শুধু বাস করা হত,এই যা। এ সুখ কতক্ষণের কে জানে? গৈরিকা কখন ফিরবে? সন্ধ্যার ট্রেন ধরাই ভালো। বেশি রাত না করাটাই উচিৎ হবে। যতক্ষণ স্থায়ীই হোক না কেন,নিখিলেশের ভালো লাগছে। বেশ ভালো লাগছে। সরস্বতীকে আজ আবার লক্ষ্মীরূপে দেখছে,মাতৃরূপে দেখছে-যেন সুন্দর একটা স্বপ্নের ঘোর মনে হচ্ছে। ঘোরটা যেন ভেঙে না যায় মনে মনে কি চেয়ে ফেলল? ঘোর যখন,তখন তো ভাঙতেই হবে। আর্চিটার কষ্ট হবে,নিখিলেশেরও খারাপ লাগবে। শত চেষ্টাতেও গৈরিকার প্রতি কোন বিরূপ আবেগ নিজের মনে সৃষ্টি করতে পারেনি নিখিলেশ। না ঘৃণা,না রাগ,না ক্ষোভ-হ্যাঁ,অভিমান আছে,এতদিনের ভালোবাসাটাকে পায়ে মাড়িয়ে চলে গেলে অভিমান তো হবেই। তা বলে গৈরিকার মন্দ কখনোই চাইতে পারবে না।
চারটে বাজে। গৈরিকাকে ডেকে দেওয়া ভালো। ঘুমিয়ে পড়ে যদি? নিখিলেশ সন্তর্পণে ওর কাছে গেল। গৈরিকা জেগেই ছিল। চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়ছিল ওর। নিখিলেশকে দেখেই মুছে ফেলল
-ওষুধের সময় হয়ে গেছে?
-না। এমনিই এলাম। তোমার মন খারাপ?
-কই,না তো?
নিখিলেশ হাসল
-বলতে না চাইলে জোর করব না। তবে তোমার প্রত্যেকটা আবেগ,প্রত্যেকটা অভিব্যক্তিকে চিনি আমি। এত কষ্ট পাচ্ছ কেন? ঝগড়া করেছ?
-আমি কি শুধু ঝগড়াই করি?
-না। একদম করো না। ঘরে বন্ধ করে রাখো নিজেকে। কাঁদো আর কষ্ট পাও। যা চেয়েছ তাই তো পেয়েছ। তাও কষ্ট কিসের তোমার?
-দূর থেকে দেখে সব বোঝা যায় না।
-মানলাম। জীবনে সাফল্যটা যে কোন মূল্যেই চেয়েছ তুমি। আজ সাফল্যের শীর্ষে উঠে তোমার তো কোন কষ্ট থাকা উচিৎ নয়। ভালো থাকা উচিৎ,সাফল্যকে উপভোগ করা উচিৎ।
গৈরিকা হঠাৎই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। বিস্মৃতকাল পরে এভাবে নিজের আবেগের প্রকাশ ঘটাল ও। নিখিলেশ অবাক হয়ে গেল। কি হয়েছে? খুব বড় কিছু নিশ্চয়। না হলে তো এইভাবে কাঁদবে না।
-কি হয়েছে? বলো,বললে,ভাগ করলে কষ্ট কমে যায়,ভয় নেই,আমি কাউকে বলব না। আমাদের সম্পর্ক ভাঙ্গার কারণ যেমন কেউ জানতে পারে নি, তেমনি এই কথাগুলোও কেউ জানবে না...
নিখিলেশের কাছে আজ কিছু লুকাতে ইচ্ছা করছে না। গৈরিকা যে মানুষটাকে হারিয়ে জিততে চেয়েছিল,আজ সে মানুষটার সামনেই নিজের কষ্টগুলো বলে হাল্কা হতে চাইছে। নিখিলেশ ছাড়া কেউ এই কষ্ট বুঝবে না। এতে লজ্জার তো কিছু নেই...
-আমি ভালো নেই নিখিল।
স্বীকার করল গৈরিকা। এই প্রথমবার নিজের কাছেও এই কথাটা স্বীকার করল।
-কেন? ইন্দ্রনীল কিছু বলেছে নাকি? একসাথে থাকতে গেলে মান অভিমান হয়। ওসব নিয়ে ভাবতে নেই,তোমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসো,এই যথেষ্ট।
-সত্যিই কি ভালোবাসে?
-এত অভিমান? তুমি হাসালে গৈরিকা। তোমার জন্য ইন্দ্রনীল কতকিছু করেছেন বলো তো আর উনিও তো তোমার পছন্দের পুরুষ। সুদর্শন,অভিজাত,সুপ্রতিষ্ঠিত। তোমাদের সম্পর্কটা তো খুব মানানসই।
-তাই তো ভাবতাম এতদিন। এখন মনে হচ্ছে ভুল ভাবতাম। সবটুকুই আমার ভ্রম ছিল। যদি ভালোবাসত,তাহলে আমার ইচ্ছার মর্যাদা দিত। আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করত না।
-একটা কথা বলি? অনধিকার চর্চা ভেবো না। বিয়ে করে নাও। সেটেলড্ হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
-নীল বিয়ে করতে চায় না। ঐ কথাটা এড়িয়ে যায় সবসময়।
নিখিলেশ অবাক হল
-তাই?
-জানো,আজকাল আমার কাছে আসতেই চায় না। কাজের ছুতোয় এড়িয়ে যায়। আমাদের সম্পর্কের মধ্যে কাজের কথা ছাড়া কোন কথার কোন অস্তিত্ব নেই। আগে আমার প্রত্যেকটা লেখা নীল সবার আগে পড়ত খুঁটিয়ে পড়ে মতামত দিত। আজকাল সেসবেরও সময় পায়না। শুধু লিখে যেতে বলে আমায় যন্ত্রের মত লিখে যেতে বলে।
-লিখে তুমি আগের মত আনন্দ পাচ্ছ তো,নাকি...
-আনন্দ কোথায় নিখিল? এখন দায়ে পড়ে লিখি। তাও উচ্ছ্বাসের চাওয়া মত,অনিমেষ আঙ্কলের চাওয়া মত লিখতে হয় আমায়।
নিখিলেশ এতক্ষণে গৈরিকার আসল কষ্টের জায়গাটা উদ্ধার করল। ওকে নিজের মত লিখতে না দিলে খুব মুশকিল। খুব স্বাধীনচেতা লেখিকা ও। ফরমায়েশি লেখা লিখতে পছন্দ করে না।
-এখন কি লিখছ?
-দেশভাগের উপর একটা উপন্যাস। কাল শেষ করেছি।
-উদ্বাস্তুদের নিয়ে?
-না। দেশভাগ মেয়েদের উপর কিভাবে প্রভাব ফেলে,তার উপর। একজন হিন্দু কিশোরীকে নিয়ে গল্প যাকে দেশভাগের সময় মুসলিমরা ইলোপ করে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে-তারপর তাদেরই একজনের সাথে নিকাহ হয়ে যায়। নিজের মা,বাবা,ভাই,বোন সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মেয়েটা। তারা সবাই এদেশে চলে এলেও মেয়েটা ও দেশেই পড়ে থাকে। পরে খোঁজ পেয়ে বাবা,দাদা আনতে গেলে সে ফেরে না। ওখানেই রয়ে যায়। তার জীবনের ওঠাপড়া নিয়ে উপন্যাস।
-দারুণ প্লট তো? বাঃ! বেশ খাটতে হয়েছে নিশ্চয়। পড়তে হয়েছে অনেক?
-খুব। অনেক অজানা তথ্যই দুষ্প্রাপ্য সব বই ঘেঁটে,লাইব্রেরীতে পড়ে থেকে উদ্ধার করেছি।
-রাতজাগা পাখি আর অল্পবিরাম-এর মতো ক্লাসিক হবে একটা।
-বলছ?
-হুম,বলছি। তোমার লেখা নিয়ে আমার জাজমেন্ট ভুল হয় না। তা এত ভালো উপন্যাস লিখে খুশি মনে থাকবে,তা না কাঁদছ?
-উপন্যাসটা উচ্ছ্বাস ছাপবে না।
-কেন? এত ভালো উপন্যাস...
-ওরা এখন প্লট চায়না,মশলা চায়। মশলাদার লেখা চায়।
-চিরন্তনী কুণ্ডুর মত?
-গৈরিকা ম্লান হাসে
-হ্যাঁ। ও-ই তো এখন উচ্ছ্বাসের চোখের মণি। বিশেষ করে অনিমেষ আঙ্কেলের।
-মোহকুহক আর নিশিযাপন-ও নিশ্চয় উচ্ছ্বাসের চাপেরই ফল?
-বলতে পারো।
-আমি জানতাম। তা না হলে এমন নিমুরুচির লেখা তুমি লিখতে পারো না।
-মোহকুহক বেস্টসেলার,তুমি জানো?
-হবেই তো। টিনএজারদের তো ভালো লাগবেই। আমার ভালো লাগেনি। একদম ভালো লাগেনি। কেবল মনে হয়েছে আর্চি বড় হয়ে যখন মোহকুহক পড়বে,কি ভাববে?
গৈরিকা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর গভীরভাবে শ্বাস নিল।
-ঠিক বলেছ। আমিও খুশি নই ঐ দুটো উপন্যাস লিখে।
-যৌনতা তো তোমার জায়গা নয়। ওর জন্য তো চিরন্তনীরা আছে। তুমি কেন ওদের সাথে পাল্লা করে রেষারেষিতে নামলে বলো তো?
-আমি রেষারেষি করতে চাইনি। ওর সাথে আমার তুলনা কিসের? অথচ করতে হয়েছে,তুলনায় যেতে হয়েছে,রেষারেষিতে যেতে হয়েছে...
-এগুলো করে চাওয়ায় করতে হয়েছে?
-আঙ্কলের,নীলেরও।
-অনিমেষ বসু মিডিয়া ব্যারন। উনি পাঠকের পালসটা মাপতে জানেন। পাঠক কি চায়,না চায় বোঝেন
-কিন্তু ব্যবসাই কি সব নিখিল? ব্যবসাটাই কি সব? সাহিত্য ব্যবসা আদায়ের জন্য কি পর্ণোগ্রাফির সাথে তুলনায় নামবে? নিজের জাত এভাবে খোয়াবে?
নিখিলেশ মনে মনে খুশি হল। সাহিত্য নিয়ে আলোচনায় গৈরিকাকে ইনভলভ করতে পারলে ওর মনখারাপটা কমে যাবে। একটু তর্কও করতে হবে। নিজের মত জোর দিয়ে রাখে গৈরিকা। যেনতেন প্রকারেণ তর্কে জিততে চায়।
-তা নয়। কিন্তু যাই বলো,উপন্যাসকে কিন্তু লড়তে হচ্ছে সিরিয়ালের সাথে। খেয়াল করে দেখো,আগে যারা উপন্যাস পড়তেন যেমন আমাদের মা,মাসিমা,কাকিমারা-এখন সিরিয়ালে মুখ ডুবিয়ে রাখেন। আসলে অডিও ভিসুয়াল বিনোদন,প্রিন্টের থেকে বেশি মন কাড়ে।
-উনারা কি কোনদিন ক্লাসিক উপন্যাসের পাঠক ছিলেন? ঐ ঘরোয়া প্রেম,বিয়ে,বিরহ,পুনর্মিলন গোছের উপন্যাসেই আগ্রহ ছিল তাদের। এদের আমি গাদ বলি। লোহা থেকে গাদটা বেরিয়ে গেছে। খাঁটি ইস্পাত পড়ে আছে। যে পাঠকরা এখন বই পড়তে ভালোবাসেন,তারা কি কখনো সিরিয়াল দেখবেন? যেমন ধরো কলকাতায় যদি আমজাদ আলি খানের সরোদের অনুষ্ঠান হয় তাহলে পাঁচ হাজার লোক হবে,কিন্তু বেসুরো কোন একটা রক ব্যান্ড গাইলে একলাখ,কিন্তু ঐ একলাখে লোক আমজাদ আলিকে বুঝবে না আবার এই পাঁচ হাজারও কখনো বেসুরো ব্যান্ড শুনতে যাবে না। তা বলে কি আলি সাহেব বদলাবেন,নাকি রক ব্যান্ড সুরে গাইবেন?
-ভালো বলেছ তো! উপমাটা তুমি বরাবরই ভালো দাও। গৈরিকা,সিরিয়াল লিখলে নাকি অনেক পয়সা,তুমি লেখো না কেন?
-তুমি লিখবে? বলো,আমি করে দিচ্ছি। প্লটও দিয়ে দিচ্ছি তোমায়।
নিখিলেশ হাসল
-আরে না,না,আমি অলস মানুষ। গদ্য আমার দ্বারা হবে না। অত ধৈর্য নেই। তা প্লটটা কি,শুনি?
-একদম সহজ প্লট। একটা মেয়ে থাকতে হবে,যে কেন্দ্রীয় চরিত্র। অত্যন্ত গোবেচারা,সরল সিধা,দয়ার প্রতিমূর্তি,সাত চড়ে রা কাড়ে না,ক্ষমাশীল,শোষিতা,নিপীড়িতা,অত্যাচারিতা...
-ধর্ষিতা? ওটা তো খুব ‘ইন’ এখন।
গৈরিকা ঠোঁটে আঙুল দিল। নিখিলেশ লক্ষ্য করল আর্চি চোখ পিটপিট করছে। জেগে গেছে তাহলে। গৈরিকা ছেলের মাথায় হাত দিল
-কি হয়েছে রিন্টু?
-জল খাবো...
নিখিলেশ গ্লাসে করে জল দিল। গৈরিকা অরিনকে আস্তে আস্তে খাইয়ে দিল। নিখিলেশ মনে মনে হাসল। গৈরিকা ‘মোহকুহক’ বা ‘নিশিযাপনের’মতো উপন্যাস লিখতে পারে,কিন্তু ভেতরে ভেতরে রক্ষণশীল আর পাঁচটা মায়ের মতো গৈরিকাও চায় না আর্চি কোন বাজে কথা শুনুক।
-ঘুমু করো। মামমাম মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
গৈরিকা খুব দ্রুত অরিনকে ঘুম পাড়িয়ে দিল।
-সরি,আমি খেয়াল করিনি আর্চি জেগে যাচ্ছে।
-ইটস ওকে,ও ঘরে যাবে? না হলে আবার জেগে যাবে।
নিখিলেশ কিছু বলল না। নিঃশব্দে ঘর থেকে বেড়িয়ে পাশের ঘরে গেল। পাশের ঘরেও খাট আছে। একটা সোফা আছে। সেন্টার টেবিল আছে। নিখিলেশের বইয়ের আলমারি,পার্সোনাল কম্পিউটার সব এ ঘরে। বলা যায় নিখিলেশের কাজের ঘর। লিখতে লিখতে কিংবা পড়তে পড়তে এখানেই ঘুমিয়ে পড়ে অনেকদিন,যদি বেশি রাত হয়ে যায়। ন’টা সাড়ে ন’টা নাগাদ আর্চিকে খাইয়ে,ওর ঘরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে তবে এ ঘরে কাজ করতে আসে নিখিলেশ। আর্চি ভাবে বাবা ওর পাশেই ঘুমোচ্ছে। খুব গাঢ় ঘুম ওর। সকালের আগে ঘুম ভাঙে না। নিখিলেশের মোবাইলে ছ’টার অ্যালার্ম দেওয়া থাকে। ছ’টায় উঠে আর্চিকে তুলে ওকে রেডি করিয়ে স্কুলে দিয়ে আসে নিখিলেশ। আবার সাড়ে দশটায় ওকে স্কুল থেকে এনে খাইয়ে তারপর নিজে স্কুলে যায়। ওর স্কুলটা কাছেই। বাইকে মিনিট দশেকের পথ,যদি গেট না পড়ে। স্কুলে ওর একটু ছাড়ও আছে। সবাইকে জানেন নিখিলেশকে একা হাতেই সব করতে হয়। পাঁচ-দশ মিনিট লেট হলেও কেউ কিছু বলেননা। আবার টিফিনের পর ক্লাস না থাকলে হেডস্যারই নিখিলেশকে বাড়ি চলে যেতে বলেন,আর্চি একা থাকবে,এ চিন্তাটা ওনার মাথাতেও থাকে। সোফায় বসল গৈরিকা। নিখিলেশ চেয়ার টেনে ওর মুখোমুখি বসল।
-ধর্ষিতা মেয়েকে নায়িকা করলে মধ্যবিত্ত ভ্যালুজ মানবে না। বিশুদ্ধতা চায় ওরা। নায়িকার অসংখ্য অনুরাগী থাকলেও কেউ স্পর্শ করতে পারবে না।
-বাঃ,বেশ তো। আর বিপরীতে কেমন চরিত্র থাকবে?
-খলনায়িকা,এমন এক মেয়ে যার সবকিছুই খারাপ। বিষকন্যা টাইপের। চরম কুচুটে,খল,ষড়যন্ত্রকারী।
-নায়ক দুজনের মাঝে পড়ে পিষবে নাকি?
-একদম। নায়ক হবে দুর্বল চরিত্রের। তাকে নিয়ে দুই কন্যার মধ্যে টাগ অফ ওয়ার চলবে। খল চরিত্রটি ছলে বলে কৌশলে নায়ককে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে চাইবে,নায়িকা নিঃশব্দে সব সহ্য করবে,উফটুকু করবে না। তবে শেষে সত্যের জয় হবে।
-বাব্বাঃ! এটা রোম্যান্টিক গল্প নাকি কমিক? বাস্তবে এরকম হয় নাকি?
-হয় না তো,আর যা হয় না। তাই তো পর্দায় দেখতে ভালোলাগে গৈরিকার মুখে হাসি দেখে ভালো লাগল নিখিলেশের।
-তা ঠিক। তাহলে তোমার নতুন উপন্যাসের কি হবে? ওটা পড়তে আমার এখন থেকেই ইচ্ছা করছে।
-জানি না কি হবে। উচ্ছ্বাস তো ছাপাবে না...অনিমেশ বসু জেদ ধরে বসে আছেন,বলছেন নাকি ক্লিশে সাবজেক্ট।
-নাকি অ্যাজ ইউজুয়াল সংখ্যালঘু তোষণ করছেন? ওদের কাছে তো হিন্দুদের স্বপক্ষে কোন কথা বলা মানেই কমিউনাল,আর মুসলমানদের সমর্থন করা উদারতার পরিচায়ক। বরাবারই উচ্ছ্বাস এই স্ট্যান্ড নিয়ে এসেছে। এই দেখো না বাংলাদেশে হাজার হাজার হিন্দুদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে,তাদের মা বোনেদের সম্ভ্রম নষ্ট করা হচ্ছে,ছেলেদের হত্যা করা হচ্ছে,জোর করে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে,মন্দিরগুলোকে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে-তাও উচ্ছ্বাস নিশ্চুপ। কি চ্যানেল,কি পত্রিকা।
এমনভাবে কথাটা নিয়ে ভাবেনি কখনো গৈরিকা। ঠিকই তো। নিখিলেশ ঠিকই বলেছে। এই কারণেই উপন্যাসটাতে আঙ্কেলের এত আপত্তি।
-তুমি ঠিকই বলেছ। তাহলে কি করি বলো তো?
নিখিলেশ অবাক হল। গৈরিকা ওর কাজে পরামর্শ চাইছে?
-আমি কি বলব? আমার কি কিছু বলা সাজে? তবে তোমার জায়গায় আমি হলে অন্য প্রকাশনাকে উপন্যাসটা দিয়ে দিতাম। এই উপন্যাসের দিনের আলো দেখা আবশ্যিক। তবে,তোমার ব্যক্তিগত অনেক বাধা রয়েছে। দ্যাখো...
-আমি তো স্বাধীন লেখিকা,তাই না নিখিল?
-অবশ্যই। কেন তোমার সন্দেহ আছে?
-না,কিন্তু আমি দীর্ঘ পাঁচবছর উচ্ছ্বাসের বাইরে কোথাও লিখিনি। আজ যদি লিখতে চাই,তাহলে কি খুব অকৃতজ্ঞের মত কাজ হবে? এতগুলো বছর তো আমার সবটুকু দিয়ে কৃতজ্ঞতার ঋন মিটিয়েছি আমি। একের পর এক লেখা দিয়ে গেছি উচ্ছ্বাসকে। এবার যদি ওদের অপছন্দের কোন লেখা অন্য কাউকে দিই,খুব অন্যায় হবে?
নিখিলেশ বুঝল গৈরিকা দ্বিধায় ভুগছে। এই দ্বিধার কারণেই ওর মন ভালো নেই। কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে। জোরে কথা বলছে,হাত নেড়ে কথা বলছে...এসব তো ও করেনা...ওকে শান্ত করতে হবে।
-অন্যায় কিসের? অন্য কাউকে না দিলে উপন্যাসটা তো বেরোবেই না।
-একস্যাকটলি। এই সাধারণ যুক্তিটা নীল মানছে না। ওর ভয়ানক রাগ,আমি কেন উচ্ছ্বাস বাদে অন্য কাউকে লেখা দিতে সম্মত হয়েছি।
কেউ যদি কাউকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মত ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়,তবে তার নিয়ন্তা মনে করে নিজেকে। ভাবে সে উঠবে,বসবে,হাঁটবে,চলবে,হাসবে,কাঁদবে-ইশারা অনুসারেই। নীলের সেই অভ্যাস হয়ে গেছে গত পাঁচ বছরে। হঠাৎ করে সেই অভ্যাস ভাঙ্গা দুষ্কর। নিখিলেশ ইন্দ্রনীলের রাগের কারণ অনুধাবন করতে পারল।
-প্রতিবিম্বকে কি এই উপন্যাসটাই দিতে চেয়েছ?
-হ্যাঁ।
-বাঃ। তবে আমি আগেই বলেছিলাম মনোপলি ভেঙে বেরোতে গেলে সমস্যা হতে পারে।
-ব্যান তো? হয়তো সেটাই হতে যাচ্ছে।
অবাক হল নিখিলেশ। ইন্দ্রনীল থাকতেও ব্যান হয়ে যাবে? তা কি করে হয়? গৈরিকাকে যদি ইন্দ্রনীল ভালোবেসে থাকে,তবে এভাবে ইগোকে প্রশ্রয় দেবে কেন? নাকি ইন্দ্রনীলের দিক থেকে সম্পূর্ণটাই সুপরিকল্পিত ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত?
-ব্যান? তা কি হয়? তুমি উচ্ছ্বাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখিকা,তোমাকে ব্যান করবে কি করে? একটু বেশিই ভাবছ তুমি।
-ধমকি পেয়েছি। তাই বলছি। অশ্বত্থমা মিত্রকেও তো ব্যান করে দিতে একমুহূর্তও ভাবেনি ওরা। একই তো অপরাধ ছিল ওনার। অন্যকে লেখা দেওয়া।
-ব্যাপারটা এতদূর গড়িয়েছে তাহলে?
-গৈরিকা সান্যালকে ওরাই তৈরী করেছিলেন। ওরাই নাকি আমার ডানা ছেঁটে মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারেন।
মনের কথাগুলো উগড়ে দিচ্ছিল গৈরিকা। নিখিলেশের কাছে সবকিছু বলে হাল্কা হতে চাইছিল। নিখিলেশ সবটুকুই শুষে নেবে,ও জানে। বিশ্বাস করে ওকে।
-এটা ওদের ভুল ধারনা। কেউ কাউকে তৈরী করতে পারে না। তোমার কলমের জোর আছে,তাই তুমি তুমি আজ গৈরিকা সান্যাল হয়েছ। না হলে উচ্ছ্বাস থেকেও তো অনেক অসফল উপন্যাস বেরোয়,বেরোয় না?
-এটা আমার কাছে এখন একটা চ্যালেঞ্জ। এতটা অপমান আমি মুখ বুজে সহ্য করতে পারছি না। অন্য কোথাও লেখা দিয়ে আমাকে প্রমাণ করতে হবে আমি আমার লেখার জোরেই দাঁড়িয়েছি,ওদের পাবলিসিটির জন্য নয়। এতে আমি ব্যান হয়ে গেলে হয়ে যাব।
-ইন্দ্রনীলের সাথে সম্পর্কে অবনতি হবে জেনেও...
-আত্মসম্মানের থেকে কোন সম্পর্ক বড় হয় না।
-জানি। তবুও তোমাকে আরো একটু ভাবতে বলব। সম্পর্কও জীবনে খুব জরুরী। একের পর এক সম্পর্ক ভাঙ্গলে তুমি একা হয়ে যাবে। একাকীত্বটা বড় ভয়ানক। আমি জানি। আমার থেকে ভালো করে কেউ জানে না। তাই চাই না তুমিও একই কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাও।
-নিখিলেশের চোখে জল দেখল গৈরিকা। লজ্জিত হল। জীবনে প্রথমবার নিজের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হল।
-আমার জন্য তোমার খুব কষ্ট হয়েছে,না? অ্যাম সরি। অথচ...
-আমি জানি তোমার কিছু করার ছিল না। একটা ব্যর্থ,অবসাদগ্রস্ত মানুষের সাথে থাকতে আর পারছিলে না তুমি,ঠিকই করেছ। সাফল্য তোমাকে মানায়। সফল হয়েছ। আমার আর কি? “আমি রব নিস্ফল হতাশের দলে”... বিষাদ আর বিষাদ,মনে হয় বিষাদ লগ্নেই জন্মেছি আমি। এত বিষাদ নিয়ে চলা যায়? তবে তোমার সাফল্যে আমি খুশি। আর এই খুশিতে কোনও খাদ নেই। তোমাকে কখনো ঈর্ষা করিনি আমি। আজও করি না। এই যে প্রতিবিম্ব থেকে তোমার লেখা বেরোলে,আমার বই হয়তো উপযুক্ত প্রচারই পাবে না। মুখ থুবড়ে পড়বে। তাও আমি চাইব,তুমি উপন্যাসটা ওদের দাও। উপন্যাসটা প্রকাশ পাক।
নিজের মনের গহনে লজ্জায় আরো ডুবে গেল গৈরিকা। ও নিখিলেশকে চেপে দিতে চেয়েছিল,অথচ নিখিলেশ ওর সাফল্য চায়। নিজের ব্যর্থতার মূল্যেও ওর সাফল্য চায়। ভালোবাসা তো এমনই হয়।
-উপন্যাসটা আমি ওদের দেব নিখিল। অনেক হয়েছে। সোনার শিকল পায়ে পড়ে দম আটকে মরে যাওয়ার চেয়ে শিকল ছিঁড়ে উড়ে যাওয়া ভালো।
-শিকল কাটতে চাও তুমি?
-চাই। খুব করেই চাই। পারব না?
-তোমার কলমের জোর আছে যখন,পারবে। ভরসা রাখো। অশ্বত্থমা মিত্রকেও তো ফিরিয়ে আনল উচ্ছ্বাস। ব্যবসার জন্য ওরা সবকিছু করতে পারে।
কথাটা গৈরিকার কানে বিঁধল। ব্যবসার জন্য ওরা সবকিছু করতে পারে? তাহলে...
-কি ভাবছ? পাঁচটা বাজতে গেল। ক’টার ট্রেন ধরবে? বেশি রাত করা ভালো হবে না।
-আমাকে কয়েকটা দিন এখানে থাকতে দেবে নিখিল?
হঠাৎ করে বলে ফেলল গৈরিকা। বলেই সংকোচ বোধ করল। নিখিলেশের আপত্তি থাকতেই পারে। এখন তো ওরা আর স্বামী-স্ত্রী নয়। তাহলে কোন অধিকারে গৈরিকা ওর বাড়িতে থাকবে?
-থাকলে তোমার ভালো লাগলে থাকো।
-আসলে মনটা এত বিক্ষিপ্ত আছে যে...আবার ঐ পরিবেশে গেলে চিন্তাগুলো মাথায় ভিড় করবে। আবার টেনশন,অ্যানকসাইটি। তাছাড়া রিন্টুও খুশি হবে। ওকে কাছে পেলে আমিও ভালো থাকব।
-নিখিলেশ মৃদু হাসল
-সংকোচ করছ কেন? থাকো। এত স্ট্রেস নাও,ক’টা দিন একটু থামো। বিশ্রাম করো। দেখবে মনটা স্থির হয়ে যাবে। নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারবে।
-তোমার অসুবিধা হবে না তো?
-তোমাকে থাকতে দিতে আমার অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কে কি বলল,তার ধার আমি ধারি না। এই দেখো না-লোকে বলে আমি নিশ্চয় মাতাল,দুশ্চরিত্র,লম্পট,অত্যাচারী-না হলে তোমার মত বৌ ছেড়ে যায়? তাতেও কিছু যায় আসে না আমার। আমি জানি,আমি কেমন। তুমিও জানো-এটাই যথেষ্ট নয়?
গৈরিকা চুপ করে থাকল। এর কোন উত্তর ওর কাছে নেই।
পর্ব-১৫
-নিখিলেশ,কই রে? তোর ছেলে কেমন আছে? আর কবিতা গুলো রেডি হয়েছে?
সৌগতদার গলা পেয়ে আশঙ্কিত হল নিখিলেশ। কবিতাগুলো নিতে আসবেন জানা ছিল,অথচ গৈরিকা রয়ে গেছে,ওকে দেখলে তো সৌগতদার মাথার ঠিক থাকবে না। স্পষ্টবক্তা মানুষ। যা বলার মুখের ওপরে বলেন। ‘দাদা’ বলে ডাকলেও আসলে নিখিলেশের কাকার বয়সী। ওনার মেয়ে নিখিলেশের সাথেই পড়ত। শরণ্যা। খুব ভালো নাচত একসময়। শ্বশুরবাড়ি থেকে পণের চাপ দিয়ে,অত্যাচার করে পরে শ্বাসরোধ করে খুন করে ফেলে শরণ্যাকে। তাও বছর পনেরো আগের ঘটনা। শ্বশুরবাড়ি পলিটিক্যালি খুব শক্তিশালী। পুলিশকে হাত করে অসংলগ্ন কেস সাজিয়ে বেকসুর খালাস পেয়ে গেছে। সৌগতদা ছাড়েননি। আজও লড়ে যাচ্ছেন। মামলা এখন হাইকোর্টে। পঁয়ষট্টি বছর বয়সেও ডেট পড়লেই হাইকোর্টে হাজিরা দেন। আর একটা নতুন ডেট নিয়ে ফিরে আসেন। তবে ওনার আশা দেরিতে হলেও বিচার হবেই। টাকাপয়সা জলের মত খরচা করছেন মামলার পিছনে। একসময় ভালো লিখতেন। পত্রিকার সম্পাদনা করতেন। শরণ্যা চলে যাওয়ার পর সেসব থেকে বহুদূরে। নিখিলেশকে নিজের ছেলের মত দেখেন। ওর ভালোর জন্য তাই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। নিজের যতসব চেনাজানা রয়েছে,কন্ট্যাক্ট রয়েছে-সব নিখিলেশের জন্য ব্যবহার করেন এখন। উনি উদ্যোগ না নিলে নিখিলেশ প্রতিবিম্বে বই ছাপাবার কথা মাথাতেই আনত না। চিরদিনের অলস ও। ঘরে বসে থেকেই ওর শান্তি। বসে বসেই বই পড়া আর লেখা। ডায়েরিগুলো যত্ন করে রাখে নিখিলেশ। ওর মনে হয় জীব্বদশায় বিখ্যাত হওয়া ওর কপালে নেই। মৃত্যুর পর পাণ্ডুলিপিগুলো কারোর হাতে পড়লে যদি...
-হ্যাঁ সৌগতদা, চলো-ও ঘরে গিয়ে বসি। লেখাগুলো একটু পড়ে দ্যাখো। আর্চির ঘরে সৌগতদাকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। সে এখন তার মামমামের কোলে চড়ে গল্প শুনছে। ও ঘরে সৌগতদা ঢুকলেই বিস্ফোরণ হবে,ঠোঁটকাটা লোক। যা নয় তাই বলে দেবেন। গৈরিকা সহ্য করতে পারবে না। তার থেকে লেখা দেখার বাহানায় পাশের ঘরে ডেকে নিতে চাইল নিখিলেশ। লেখা দেখে দিতে বললে ভারী খুশি হন। নিখিলেশ যদিও জানে,ওর লেখা দেখার মত কিছু নেই,তবুও একটা অজুহাতে তো ডাকতে হবে।
-দাঁড়া,সেসব হবে। আগে আর্চিকে তো দেখে আসি। জ্বর কমল কি না দেখতে হবে না?
নিখিলেশ বুঝল কেলেঙ্কারী ঠেকানো যাবে না। চেষ্টা ছেড়ে দিল তাই। নিজের ঘরে গিয়ে বসে থাকল। চিৎকার চেঁচামেচি শুনবে ভেবেছিল,বদলে তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যেই সৌগতদাকে ওর ঘরে প্রায় ছিটকে যাওয়া গার্ডারের মত এসে ঢুকলেন। প্রশ্নবাণের জন্য প্রস্তুত ছিল নিখিলেশ। আগে থেকেই বলে উঠল
-আর্চি খুব ‘মামমাম,মামমাম’ করছিল,আমি ফোন করে সেটা জানাতে নিজে থেকেই চলে এল।
-মাঝে মাঝে ভাবি,তোর গায়ে মানুষের চামড়া আছে কিনা।
-মানে?
-মানে এত অপমানের পরেও কি করে ঐ মেয়েটাকে এ বাড়িতে আসতে দিলি,থাকতে দিলি...
-সৌগতদা,গৈরিকা আর্চির মা। আমি কি করে আটকাব বলো তো?
-সে না হয় না আটকাতে পারিস,তা বলে ওর সাথে এক ছাদের তলায় রাত কাটাবি? মনে পড়ে না,ও কার বিছানা গরম করার জন্য তোকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল? ইন্দ্রনীল বসুর সাথে শুয়ে তবেই না আজ ও......
-আমি মানি না। ও যা করেছে নিজের যোগ্যতায় করেছে। আমি যতদূর জানি কলকাতায় যাওয়ার পরে প্রথম দুই বছর ইন্দ্রনীল বসুর সাথে ওর বন্ধুত্বই ছিল। পরে ভালোবাসা এসেছে,হতেই পারে। দুজন মানুষ পাশাপাশি থাকতে থাকতে ভালোবেসে ফেলে। তা বলে ও লেখা ছাপানোর জন্য ইন্দ্রনীল বসুর সাথে শুয়ে পড়েছিল,তা নয়।
-বাঃ! কি অদ্ভুত যুক্তি! শুয়ে পড়েনি মানলাম। ফ্লার্ট তো করেছিল,ছলাকলা তো দেখিয়েছিল। না হলে ইন্দ্রনীল ওকে অন্ধের মত সাপোর্ট করবে কেন? বাদ দে! তোর চোখে মোহের পর্দা রয়েছে,তুই ভাবছিস আজকে যে ছেলে ভোলানো নাটকটা গৈরিকা করছে,ওটা করতে করতে তোকে আবার ভালোবেসে ফেলবে ও,তোর কাছে ফিরে আসবে। কিন্তু সেটা হবে না। বরং ও এসেছে তোকে ধ্বংস করতে। শেষ করে দেবে তোকে।
-ধ্বংস স্তুপকে কি আর ধ্বংস করা যায়? আর ভালোবাসার আশা,না-সেসব আমি আর কোন মতেই প্রশ্রয় দিই না। আমার যোগ্যতা আমি জানি। কোনদিন গৈরিকার যোগ্য ছিলাম না আমি।
-যা ভালো বুঝিস কর। তুই শেষ। এটা আমি বেশ বুঝছি,নে,এবার কবিতাগুলো দেখা। এ বাড়িতে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। কবিতাগুলো নিয়েই চলে যাব।
গৈরিকা দরজার বাইরে থেকে এই কথোপকথনের পুরোটাই নীরবে শুনছিল। শুনে ওর মনটা সান্ত্বনা পেল,আর সবার মত নিখিলেশ অন্তত এটা ভাবে না,গৈরিকা নিজের জোরে নয়-ইন্দ্রনীলের সাথে শুয়েই বিখ্যাত হয়েছে। পৃথিবীতে একজন অন্তত ওর ক্ষমতার বিশ্বাস করে,ভেবে সুখী হল ও।
শিঞ্জিনী আসেনি। নিশ্চয় বুঝেছে গৈরিকা এ বাড়িতেই আছে। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে তাই,ভালোই হয়েছে। ও একটা ভুল স্বপ্ন দেখছিল,একটা মিথ্যা আশা নিয়ে বাঁচছিল। স্বপ্ন যত তাড়াতাড়ি ভেঙে যায়,ততই ভালো। না হলে কষ্ট বেড়ে যায়। স্বপ্ন মনের গভীরে যত শিকড় ছড়ায়,তাকে উপড়ে ফেলতেও ততই রক্তাক্ত হতে হয়। ও নিজে যে কারোর পরিবর্ত হিসাবে একটা ভুল জীবন বাঁচছিল-তা নিশ্চয় বুঝে গেছে এতক্ষণে। পরিবর্ত,পরিবর্তই হয়। যে প্রকৃত,যে সত্য-সে এলে পরিবর্তকে সরে যেতে হয়। আসলে পরিবর্ত হল উদ্বাস্তু। যার কোন অধিকার থাকে না। জমির আগাছার মতো সে জমি কামড়ে ধরে রাখে,অথচ শিকড়ে সেই জোর থাকে না। অথচ যে প্রকৃত তারও এটা পুতুল খেলা। ব্যস্তজীবনে একটা যতিচিহ্ন মাত্র। ফেসবুক খুলেছিল নিখিলেশ। কয়েকজন লেখা চেয়েছিল,দিতে হবে। গৈরিকা আর্চির ঘরে। এতক্ষণে ছেলেকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে ঘুমিয়ে পরেছে নিশ্চয়,এগারোটা বাজে। ফেসবুকে গৈরিকার পেজটা মাঝে মাঝে দেখে নিখিলেশ। লাইক করে রাখেনি,তাও দেখে। গৈরিকার প্রোফাইলে এখন খুব সীমিত বন্ধু। সেলিব্রিটি হওয়ার পর আগের প্রোফাইলটা ডিঅ্যাকটিভেট করে দিয়ে নতুন করে প্রোফাইল খুলেছে। নিখিলেশের সেই বন্ধু তালিকায় থাকার প্রশ্নই নেই। গৈরিকার পেজটা মাঝেমাঝে দেখে,নেহাত কৌতুহলবশতঃ। অনধিকার চর্চা হলেও নিজেকে থামাতে পারে না। পাঠক গৈরিকার সম্পর্কে কি বলছে,কি ভাবছে-জানতে ইচ্ছা করে। আজ পেজটা খুলেই অবাক হল। একজন ওয়ালে পোস্ট করেছে-“ম্যাডাম,আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। উনত্রিশ তারিখ বাঁকুড়া বইমেলা উদ্বোধনে আপনি আসবেন,কথা দিয়েছেন। সেই বিষয়েই দেখা করা জরুরী। আমরা এখন কলকাতায় আছি। প্লিজ দেখা করুন।” ওরা অ্যাডভান্স দিয়ে গৈরিকার আসা নিশ্চিত করতে চায়। আজ কুড়ি তারিখ। ওদের বইমেলার তো তেমন দেরি নেই। নিশ্চয় কার্ডে নাম ছাপিয়ে ফেলেছে,উদ্বিগ্ন তো হবেই। গৈরিকাকে যোগাযোগ করতে পারছে না কেন? ফোন তো করতেই পারে। নাকি ওর ফোনটা সুইচ অফ? তাই হবে। ওর মুড ভালো না থাকলে ফোন সুইচড অফ করে রাখে। এটা ওর বরাবরের অভ্যাস। তা বলে এখন এভাবে চললে চলে? কত মানুষ ওর সাথে যোগাযোগ করতে চায়,তারা তো ওকে ভুল বুঝবে। ভাববে গৈরিকা খুব অহংকারী,নাক উঁচু...
-ফেসবুকে যাও এখন?
গৈরিকার গলা পেয়ে চমকে তাকাল নিখিলেশ
-ঐ আর কি,মাঝে মাঝে। কোন কাজ থাকলে, তবেই। আজ কয়েকটা কবিতা দেওয়ার ছিল। তুমি ঘুমাওনি?
-ঘুম আসছিল না। ভাবলাম তোমার সাথে একটু কথা বলি।
-তোমার ফোন সুইচড্ অফ?
-হ্যাঁ,কেন বলতো?
-এই দ্যাখো।
গৈরিকাকে পোস্টটা দেখাল নিখিলেশ
-ও,ছাড়ো তো...
-ছাড়ো তো মানে? তোমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে ওরা। কার্ডে নাম ছাপিয়ে ফেলেছে,অ্যাডভান্স করে শিওর হতে চায়...
-ধ্যাৎ! আমার এখন ওসব মেলা-ফেলা উদ্বোধন করতে যাওয়ার মুড নেই। যত্তসব উটকো ঝামেলা।
-সে কি? সবাই কত আশা করে রয়েছে বলো তো,গৈরিকা সান্যালকে চোখের সামনে দেখবে,কথা বলবে,অটোগ্রাফ নেবে...
-কে গৈরিকা সান্যাল? কি যোগ্যতা তার? উচ্ছ্বাসের তৈরি একটা রঙিন ফানুস মাত্র তো নই আমি। কবে যে ফেটে যাব তার ঠিক আছে?
নিখিলেশ গৈরিকার দিকে অবাক চোখে দেখল। ওর মন সত্যিই ভালো নেই। একবার চ্যালেঞ্জ নেওয়ার কথা বলেছে,প্রতিবিম্বকে উপন্যাস দেওয়ার কথা বলছে, আর একবার ভেঙে পড়া মানুষের মত কথা বলছে। অথচ গৈরিকা তো ভেঙে পড়ে না। হেরে যেতেও চায় না,সবসময় পজিটিভ থাকে,সবসময়। নিখিলেশের অবসাদ,নিখিলেশের হতাশাকে কখনোই মেনে নিতে পারেনি তাই।
-তুমি এই মুহূর্তে বাংলা সাহিত্যের সেরা লেখিকা।
-কে বলল? সেরা হল চিরন্তনী কুণ্ডু। যার ধারাবাহিক জাতিতে বেরোনোয় জাতির কাটতি বেড়ে গেছে।
-আবার আমার মত কেউ কেউ আছে,যে ঐ নিম্নরুচির উপন্যাস পড়বে না বলে জাতি নেওয়া ছেড়ে দিয়েছে।
-তারা সংখ্যালঘু।
-তুমিই তো একটু আগে বললে,তারাই নাকি আসল পাঠক,বাকি সব গাদ?
-বলেছিলাম? হয়তো আমারই ভুল। সবটাই আমার ভুল। জলে নামছি ভেবে চোরাবালিতে পা দিয়ে ফেলেছি।
ভুল শুধরে নিলে,ভুলটা ভুল থাকে না। আমার মনে হয়,তুমি ভীষণ অস্থির এখন,ভীষণ অশান্ত।
-শান্তির খোঁজেই তো এখানে রয়েছি নিখিল। তুমি খুব শান্তিতে আছো,মনে হয় আমার।
-ঠিকই। শান্তিতে আছি আমি। শ্মশানে শান্তি জিনিসটা সুলভ কিনা? নিখিলেশ হাসল। বিড়ি ধরাল একটা।
-বিড়ি খাও?
-হ্যাঁ। সস্তা। পুষিয়ে যায়। তুমি খুব স্মোক করো এখন,তাই না?
-হুম,
-ঐ করেই তো মাইগ্রেনটা বাঁধিয়েছ। কমিয়ে ফেলো। কি বলছিলাম যেন,শান্তিতে আছি কিনা জানি না,তবে আমার মধ্যে একটা সন্তোষ রয়েছে। জীবন আমাকে যা দিয়েছে,যেটুকু দিয়েছে-আমি তাতেই তৃপ্ত। নিজেকে এই বলে বুঝিয়ে নিয়েছি,যা পেয়েছি তার থেকে বেশি যোগ্যতা আমার ছিল না। তাই আমার কোন অাক্ষেপ নেই। সাফল্যের পিছনে ছুটি না। নিজের কাজটুকু নিঃশব্দে করে যাই। যদি মূল্যায়ন হওয়ার হয়-হবেই। না হলে আর কি? কত কবিই নিঃশব্দে ঝরে যায়,হেমন্তের শিশির-এর মত নীরবে চলে যায়। একে তুমি ব্যর্থ মানুষের অজুহাত বলবে। তবে আমার কাছে এটা শান্তিতে থাকার উপায়,সন্তুষ্ট থাকার উপায়।
-তোমার শান্তির ভাগ আমাকে দেবে নিখিলেশ?
গৈরিকা মনের দিক থেকে খুব বিধস্ত তাহলে। ইন্দ্রনীলকে ভালোবেসে ও। ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে আঘাত পেলে সামলানো দায় হয়ে যায়। নিজে এই কষ্টের মধ্যে দিয়ে গেছে। গৈরিকাকে যেতে দেখে খারাপ লাগল।
-শান্তির ভাগ যদি দেওয়া যায় তাহলে নির্দ্বিধায় দিতে পারি। তোমাকে অদেয় হয়তো কিছুই নেই...
-দিলেই কি আমি নিতে পারব? নাঃ! সবাই সব কিছু নিতে পারে না। সফল হওয়ার নেশা খুব খারাপ। শীর্ষে পৌঁছালে সব সময় একটা ভয়,একটা ইনসিকিওরিটি কাজ করে। নীচে পড়ে যাওয়ার ভয়,পদস্খলনের ভয়। মনে হয়,একদিন ঘুম ভেঙে উঠে যদি দেখি-যে জীবনটা আমি বাঁচতাম এতদিন-সেটা আসলে মায়া। আমি আসলে সেই অখ্যাতির অন্ধকারেই পড়ে রয়েছি।
-অখ্যাতির অন্ধকার থেকে তুমি তো মুক্ত হয়ে গেছ,কবেই। আর যে ক’টা উপন্যাস লিখেছ,তারপর আর একটা উপন্যাসও না লিখলেও-তুমি গৈরিকা সান্যালই রয়ে যাবে।
-আমি যে আরো অনেককিছু লিখতে চাই। নিজের মত করে লিখতে চাই। নিজে যা বিশ্বাস করি সব লিখে যেতে চাই। অনেক,অনেক কিছু বলা বাকি আছে এখনো,অনেক কিছু,অনেক দৃশ্য,অনেক প্লট,অনেক চরিত্র আমায় তাড়িয়ে বেড়ায়।
-বাঃ! তার মানে তোমার মধ্যেকার লেখিকা বেঁচে আছে এখনো। বাঁচিয়ে রাখো তাকে। তবে নিজের মত করে লিখতে গেলে সমস্ত শিকল কাটতে হবে,শরীরের,মনের,দুইয়েরই।
-শিকল তো কেটেই ফেলেছি। হাল্কা লাগছে তাই নিজেকে। হাওয়ায় ভাসছি মনে হচ্ছে।
ধীরে ধীরে সয়ে যাবে,তবে এবার ফোনটা খোলো। তোমার অ্যাটলিস্ট মায়ামাসিকে ফোন করে জানিয়ে দেওয়া উচিৎ যে তুমি ক’দিন ফিরবে না। না হলে সে বেচারি চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছে নিশ্চয়। ইন্দ্রনীলও ফোন করতে পারে,রাগের মাথায় কি না কি বলে ফেলেছে...
-রাগের মাথায় নয়। রীতিমত ঠাণ্ডা মাথাতেই বলেছে। ওর কথা ছাড়ো। আমি মায়াকে ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি।
-আর এই বইমেলাওয়ালাদেরও জানাও।
উফ্! বললাম না,আমার যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই।
-সেটাও ওদের জানিয়ে দাও তাহলে। ওনারা হয়রানির হাত থেকে বাঁচবেন।
গৈরিকা কিছু বলল না। মৌন সম্মতির লক্ষণ,জানে নিখিলেশ। কথা বাড়াল না তাই।
গৈরিকার রাগত গলার স্বরে নিখিলেশের তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল। এভাবে কার সাথে কথা বলছে এত রাতে? নিখিলেশ বালিশের পাশ থেকে চশমা নিয়ে চোখে দিল। আস্তে আস্তে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আর্চির ঘরে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল
-স্টপ দ্যাট ননসেন্স নীল! আমার ছেলেটার শরীর খারাপ। এই জন্যই এখানে রয়েছি আমি। কি বললে? নিখিলেশের সাথে থাকব বলে নাটক করছি? তুমি যা ভাবার ভাবো। আমার খুশি,আমি এখানে আছি। আর কিছু? ওকে ফাইন! তোমার যদি তাই মনে হয় তো তাই। তুমি আমাকে ভালোবাসলে কখনো এভাবে ভাবতে পারতে না। ডিসগাস্টিং!
ফোনটা কেটেই গৈরিকা খেয়াল করল নিখিলেশ দরজায় দাঁড়িয়ে
-সরি,এত রাতে এভাবে চেঁচানো উচিৎ হয়নি...
-সরি কিসের? জল খাও। তুমি হাঁফাচ্ছ। জলের গ্লাস এগিয়ে দিল নিখিলেশ
-আর্চির অসুখ,বলে আসোনি?
-বলেছি। অনিমেষ আঙ্কলের সাথে মিটিং ছিল আজ। আমাকে কন্ট্রাক্ট অফার করছিলেন। এইমাত্র নীল বলল বছরে দশলাখ দাম উঠেছে আমার। রয়্যালটি বাদে। আমি শুধুমাত্র উচ্ছ্বাসের হয়ে লিখব,এটা ওদের শর্ত।
-টাকার পরিমাণটা মন্দ নয় কিন্তু।
-তুমিও...
নিখিলেশ হাসল
-না। আমি তোমার স্বাধীনতার কোন দাম ধার্য করতে পারব না। আর্চির কাছে আসবে বলে মিটিং ক্যানসল করেছ?
-কি করব? রিন্টুর শরীর খারাপ জেনেও ওর কাছে না এসে মিটিংএ যাব?
-তোমার দশলাখ না হাতছাড়া হয়ে যায়। অবশ্য তুমি বললে যে তুমি ইন্টারেস্টেড নও। ফোনটা সুইচড অফ করে দাও এবার। ঘুমিয়ে পড়।
-আর ঘুম!
-বেশি ভেবো না। ইন্দ্রনীলের সাথে দেখা হলে আমি ওকে বলে দেব,দাঁড়িপাল্লায় আমি ওনার থেকে বেশ কিছুটা হাল্কা। তাই ইনসিকিওরিটির কোন কারণ নেই।
অরিণ বাবা-মায়ের কথায় জেগে গিয়েছিল। আধো আধো গলায় বলল
-মামমাম...
-বলো।
-বাবাকে বলো শুয়ে পড়তে।
-শুয়ে পড়ছি আর্চি।
-নিখিলেশ ঘর থেকে চলে যেতে উদ্যত হলেই অরিণ বলল
-ও ঘরে না। এখানে।
নিখিলেশ অপ্রস্তুত হল
-এখানে তো মামমাম আছে। আমি কোথায় শোব?
-কেন? ওপাশে...
-না আর্চি,আমি পাশের ঘরেই শুই।
-নিখিল,থাক্ না। রিন্টু যখন বলছে-এখানেই থাকো।
নিখিলেশ অবাক চোখে গৈরিকার দিকে তাকাল,গৈরিকা ওকে চোখের ইশারা করল,ছেলের সামনে কোন আলোচনা চায় না ও। নিখিলেশের অস্বস্তি হল। একঘরে একবিছানায় গৈরিকার সাথে রাত কাটাতে হবে ভেবে যে সংকোচ হচ্ছিল-তাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবে ভেবে পেল না নিখিলেশ। একান্ত চেনা নারী শরীর,একান্ত প্রিয় নারীর মন-পাঁচবছরের ব্যবধানে যেন অচেনা হয়ে গেছে। অচেনাতম নারীর থেকেও অচেনা। এই নারী একসময় ওর ছিল,সম্পূর্ণরুপেই ওর ছিল-আজ অপরের। পর নারীর থেকেও পর হয়ে গেছে তাই। তার সাথে এক বিছানায় রাত কাটানো কি সমীচীন,নাকি ন্যায়সঙ্গত? নিজেকে ধরে রাখতে পারবে,এ বিষয়ে নিশ্চিত নিখিলেশ। গৈরিকার প্রতি ওর মনে যতই ভালোবাসা থাকুক না কেন,গৈরিকার একটা অন্যায়ের কথা ভাবলেই ওর সারা শরীরে বিতৃষ্ণার স্রোত বয়ে যায়। বিকর্ষিত বোধ করে। অথচ সেদিন শিঞ্জিনীকে গৈরিকা ভ্রমেই তো...কেন? কেন এমন করল নিখিলেশ? ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না। যাকে ভালোবাসে সে হাতের সামনে থাকতে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছাও হচ্ছে না,অথচ তাকে কল্পনায় ভেবে অন্য নারীকে সম্ভোগ করা...অন্যায় হয়েছে। বড্ড অন্যায়। ঐ অন্যায়ের ভার নিখিলেশের আত্মা থেকে কি করে নেমে যাবে,কে জানে?
-রিন্টু,বাবা মনে হয় কাজ করবে,তুমি ঘুমোও।
-বাবা,শোও না...
-রিন্টু জেদ করে না।
অরিন ফোঁফাতে থাকল। গৈরিকা আহত চোখে নিখিলেশের দিকে তাকাল। রিন্টু বাবা মা’কে একসাথে চাইছে। নিখিলেশ বুঝেও বুঝছে না। অসুস্থ ছেলের ভালোলাগার কথা ভেবে ওর আব্দারটা রাখলে কি এমন হত? নিজেদের মধ্যেকার সমস্যার কারণে রিন্টুকে কষ্ট দেওয়া কি ঠিক?
-আর্চি কাঁদে না,জ্বর বাড়বে।বাবা তোর কাছে শোবে।
গৈরিকাকে অবাক করে বলল নিখিলেশ
-আর্চির খুশির জন্য সব কিছুই করতে পারি আমি।
অস্ফুটে বলল নিখিলেশ। গৈরিকা শুনতে পেল। নিখিলেশ সত্যিই রিন্টুর কথা খুব ভাবে। ওর জন্য সব করতে পারে। নাহলে গৈরিকার সাথে বেডশেয়ার করার মতো কঠিন কাজটা করতে পারত না। অবশ্য কাজটা কি খুব কঠিন? পাঁচবছর আগেও তো এটা নিত্যদিনের অভ্যাস ছিল। সময়ের ব্যবধানে অভ্যাসেও মরচে পড়ে যায়। অনভ্যাসের জাড্য ঘিরে ধরে। নিতান্ত স্বাভাবিক সমস্ত কিছুই অস্বাভাবিক হয়ে যায়।
-মামমাম,শুয়ে পড়ো।
-অরিনের কথায় গৈরিকার চটক ভাঙল। শুয়ে পড়ল ও। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশি মাথা খাটাতে নেই। যেমনভাবে ঘটনাপ্রবাহ এগিয়ে চলেছে,ঠিক তেমনভাবেই ঘটতে দিতে হয়। নদীর কোন বাঁকে কি অপেক্ষা করে আছে,তা স্বয়ং নদীও জানে না। তবুও চলা থামায় না সে,এগিয়ে যায়,এগিয়ে চলে যায়।
পূর্বের পর্ব পড়ুন -
পূর্বের পর্ব পড়ুন -
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন