রবীন বসু

কালবৈশাখী








সাইকেলের প্যাডেলে পা-রেখে একবার আকাশ দেখল শাহানা। বৈশাখ শেষ হতে চলল, অথচ এবছর তেমন ভাবে কালবৈশাখীই হল না। আকাশ কালো করে গাছেদের মাথা ধরে ঝুঁটি নাড়িয়ে ধুলো আর শুকনো পাতা বুকে নিয়ে গর্জনে গর্জনে চৌচির হয়ে সে এল না। 

ছোটবেলায় খুব ডাকাবুকো ছিল শাহানা। ঝড় এলেই  মাঠে কিংবা বাগানে গিয়ে দাঁড়াত। তারপর দুরু দুরু বুকে রুদ্র ঝড়ের দাপট দেখত। ওই তাণ্ডবের মধ্যে কেমন যেন একটা মোহ ছিল। সেই ঘোরলাগা মোহ আজ পঁচিশ বছরের যুবতী শাহানাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সে মনেপ্রাণে চাইছে আর একবার কালবৈশাখী আসুক। আর একবার তাণ্ডব এসে তাকে খান খান করে দিক।

আসলে অনেকদিন ধরে সমরেশ তার সাথে যোগাযোগ রাখছে না। না ফেসবুকে, না হোয়াটস্অ্যাপে। ফোন করা তো দূরের কথা, মেসেজ পাঠালে তার উত্তরও দিচ্ছে না । হঠাৎ করে সমরেশের এই অবহেলা, এড়িয়ে যাওয়া শাহানার নারীত্বকে আঘাত করছিল। সে মনে মনে বেশ আহত হচ্ছিল।

সমরেশ তার স্কুলজীবনের বন্ধু। ওরা একসঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছে। তখন শাহানা কিছু বোঝেনি। কলেজ জীবনে সমরেশ চলে গেল শিবপুরে আর ও প্রেসিডেন্সিতে।এক বৃষ্টিস্নাত বিকেলে একহাঁটু জলে দাঁড়িয়ে শাহানার প্রথম মনে হয়েছিল, সে সমরেশকে ভালোবাসে। সেদিনই কফিহাউসে বসে শাহানা সমরেশকে কথাটা বলেছিল। ও তো অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল,’সত্যি ! 

আমিও তো সেই কবে থেকে তোকে ভালোবাসি। সাহস করে বলে উঠতে পারিনি।’
‘কেন?’ শাহানা জানতে চেয়েছিল।
‘তুই যা মুডি মেয়ে। যদি না বলে দিস, সেই ভয়ে।’
‘দুর্ বোকা। প্রেমের ব্যাপারে ছেলেদের একটু সাহসী হতে হয় । ঠিক আছে, সে-ব্যাপারে পাঠ না হয় তোকে আমিই দেব।’

সেই শুরু। তারপর এতগুলো বছর, কত হাজার ঘণ্টা, কত লক্ষ মিনিট তারা পায়ে পা-মিলিয়ে হেঁটেছে। চোখে চোখ রেখে কথা বলেছে। একে অন্যের উপলব্ধির কাছে গেছে। পছন্দ অপছন্দ শেয়ার করেছে।

কিন্তু হঠাৎ এই ছন্দপতন। শাহানা মাস্টার্স করার পর পি এইচ ডির ফেলোশিপ নিল। সমরেশ কোর্স কমপ্লিট করে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে ঢুকে গেল টেলকোতে। প্রথম প্রথম বলত, ‘নতুন চাকরি, নানারকম ট্রেনিং, খুব ব্যস্ত।’ শাহানার মন তাতে সায় দেয়নি। সে অন্য গল্পের গন্ধ পেয়েছিল।তার গল্পটা সত্যি করল অনল।ওদের দুজনের কমন বন্ধু। সেই স্কুললাইফ থেকে ছিনে-জোঁকের মত শাহানার পেছনে পড়েছিল। বহুবার বহুভাবে সে উত্যক্ত করেছে।

শাহানা ঠাণ্ডা মাথায় ওকে বুঝিয়েছে, ‘দ্যাখ, তোর প্রতি কোন ফিলিংস্ আমার নেই। আমি কী করতে পারি? তাছাড়া আমি এখন সমরেশের সঙ্গে রিলেশানে আছি ।’

তবুও অনল থামেনি। শেষমেশ বাধ্য হয়ে শাহানা একদিন অনলের স্কুল-মিস্ট্রেস মায়ের কাছে গিয়ে হাজির। ব্যাপারটা বাবুর ইগোতে লেগেছিল। সেই থেকে অনল আর শাহানামুখো হয়নি।

কাল উইকএন্ডে বাড়ি ফেরার পথে স্টেশনে অনলের সাথে দেখা। পাশ কাটিয়ে চলে আসছিল। অনলই ওকে দাঁড় করাল।
‘দাঁড়ান ম্যাডাম, খবর আছে। আপনার তোতাপাখি তো এবার পাকাপাকি ভাবে অন্য ডালে।’।
‘মানে । ‘ শাহানা থমকে যায়।
অনল একটু কাছে সরে আসে । তারপর অনেকটা প্রতিশোধের হিসহিসে গলায় বলে, ‘সমরেশের তো বিয়ে ঠিক হয়েছে। সামনের মাসে।


পরদিন সকালে সাইকেল নিয়ে সোজা সমরেশের বাড়ি ।
অনল যা বলেছিল, তা বর্ণে বর্ণে সত্যি। সমরেশ জানাল, ‘তার মায়ের এক বান্ধবী এই সম্বন্ধটা এনেছেন। দু-বাড়ির সবাইয়ের পছন্দ।

তাহলে আমাদের এতদিনের সম্পর্ক?’ শাহানা ককিয়ে ওঠে ।
‘ওসব ভুলে যা, বি প্র্যাক্টিক্যাল। আমার মা কোনমতে তোকে মেনে নিচ্ছে না ...
‘তুই মানিস তো?’ শাহানা মরিয়া চেষ্টা করে। ওর গলায় আকুলতা ...
‘না মানে, মাকে কষ্ট দিয়ে, মায়ের অমতে আমি কিচ্ছু করতে পারব না ।
‘বাঃ। এই না হলে পুরুষ!

শাহানা আগুনের ফুলকির মত ছিটকে বেরিয়ে এসেছিল সমরেশের বাড়ি থেকে।তারপর সারাদুপুর বৈশাখের দাবদাহ মাথায় নিয়ে শুষ্ক রুক্ষ এই পৃথিবীর বুকে হাঁটছিল। একা একা । শাহানার সর্বাঙ্গে এখন আগুন। অথচ ওর বুকের গোপন কোটরে কান্নার শীতল স্রোত বইছে। নিজেকে কেমন নিঃস্ব প্রতারিত আর অসহায় লাগছিল তার। একটা ঝাঁকড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ও নিজের মধ্যেকার জেদি অহংকারী মেয়েটাকে জাগিয়ে তুলছিল।

মনেপ্রাণে চাইছিল কালবৈশাখী আসুক। সমরেশের ওই অসভ্যতা, কারণহীন প্রত্যাখ্যানের একটা মোক্ষম জবাব দিতে। একটা প্রত্যাঘাত ফিরিয়ে দিতে ।

আর কি আশ্চর্য, ঠিক তখনই শাহানার চোখের সামনে অনলের মুখটা ভেসে উঠল। যাকে সে একদিন ফিরিয়ে দিয়েছিল। শাহানা সাইকেল নিয়ে অনলের বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করল।

ডোরবেলের আওয়াজ শুনে অনলই দরজা খুলল।  আজ ছুটির দিন, ও বাড়িতেই ছিল। শাহানাকে দেখে অবাক !
‘কিরে, তুই এসময়?’
‘কেন, আসতে নেই? ভেতরে আসতে বলবি না?’
হতচকিত অনল দরজা থেকে সরে দাঁড়ায় 
‘আয়, ভেতরে আয় 

সাইকেল ফেলে একছুটে শাহানা ঘরের মধ্যে। অনল বুঝতে পারল না শাহানা কখন কালবৈশাখী ঝড় হয়ে তার বুকে আছড়ে পড়েছে ...।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ