কমল দাস

kamal

দক্ষিন দিনাজপুর জেলায় ইতিহাসের বহু ঘুমন্ত রত্ন পড়ে রয়েছে। তেমনি একটি জায়গা গঙ্গারামপুর শহরের কাছেই বানগড় বা বান রাজার ঢিবি।কাছেই ধলদীঘি এবং কালদীঘি দুটো দীঘি।পাশেই পুনর্ভবা নদী। বহু প্রাচীন এই নদী।এই বানগড় আসলে ইতিহাসের কোটিবর্ষ নগর।পুন্ড্রবর্ধন নগরের একটি বিষয়। বিষয় শব্দটি এখন কার মহকুমার মত। আমাদের আলোচনা মুলতঃ দুটি দীঘি নিয়ে। এই নগর কে ঘিরে জ্ঞান বিজ্ঞান, সাহিত্য ব্যবসা বানিজ্য ও অর্থনৈতিক বিস্তার যে সেই প্রাচীন কালেই ঘটেছিল তার প্রমান সন্ধ্যাকর নন্দীর বিস্তৃত বিবরনেই পাওয়া যায়। খ্রীষ্টপুর্ব 350 বছরেও কোটিবর্ষ নগরের উল্লেখ পাচ্ছি ঐতরেয় ব্রাম্মনে। বলা হয়েছে বঙ্গ ও পুন্ড্রজন জনপদ গুলিতে আর্য সংস্কার হীন একটি কৌম জাতি বাস করতো তারই একটা শাখা পুন্ড্রকৌম। পরে এই নগরের নাম দেবীকোট বা দেবকোট বলে নানা জায়গায় উল্লেখিত হয়েছে।

এই জায়গায় মৌর্য সময়ের কিছু প্রমান পাওয়া গেলেও নগরটি মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল কিনা তা এখনও জানা যায় নি। কিন্তু গুপ্তসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত যে ছিল তা অনেক আগেই জানা গেছে। হরিষেন রচিত বৃহৎ কথাকোষে বলা হয়েছে -

" পূর্বদেশে বরেন্দ্রবিষয়ে ধনভূষিত
দেবকোট পুরংরমাং বভুবভূবি বিশ্রুতাম।

এই নগরের খ্যাতি তখন কৌশাম্বী , প্রয়াগ, মথুরা, উজ্জয়নী পাটালীপুত্র নগরের মত। হেমচন্দ্রের ত্রিকান্ডশেষ গ্রন্থেও তিনি উল্লেখ করেছেন। কোটিবর্ষের কুমার মাত্য ক্ষেত্রবর্মন এবং সয়ম্ভুদেবের নাম দুটি তাম্রশাসনে পাওয়া গেছে যেখানে জমি দান করা হয়েছে। ১২০৪/৫ এ বকতিয়ার খলজী এই নগর এ তার রাজধানী নির্মান করেন। লোকমুখে এই জায়গার নাম হয়ে যায় দেওকোট। দেবীকোট নগর টি একটি পরিখা দিয়ে ঘেরা ছিল বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে। এই পরিখার জল সরবরাহ হত পুনর্ভবা নদী থেকে। যেখানে এই বিশাল নদীতে ব্যবসা বানিজ্য, পণ্য পরিবহন , সেচ কর্ম সব হত।এই নদীর পাশেই কেন বিশাল ও গভীর দুটো দীঘি খনন করতে হল? এখানেই প্রশ্ন টা। মুসলিম অধিকারের আগে এই নগরে একটি বিশাল বৌদ্ধ মন্দির ছিল । এবং বহু শিব মন্দির ছিল।কাছেই আজও শিব বাটি বা শিব বাড়ি বলে একটি জায়গা আছে। নয়পালের শিলালিপিতে শিবমন্দিরের প্রশস্তি পাওয়া গেছে। শৈব ধর্ম যে এখানে এক সময় এখানে ছড়িয়ে ছিল সেটা বোঝাযায়। বাণরাজার নামে এই জায়গারনাম লোকশ্রুতিতে রয়ে যায়। বাণ তো শৈবদের রাজা। বাণের নামে আরও অনেক জায়গার নাম পাওয়া গেছে। লোকশ্রুতি অনুসারে বাণ রাজার দুই রানী ধলো রানী আর কালো রানী। দুই রানীর নামে নাকি দূটো দীঘি খনন করা হয়েছিল। ধল দীঘি ও কালদীঘি। সত্যিই কি তাই? কবে করা হয়েছিল জবাব অস্পষ্ট। পাল আমলে বহু দীঘি খনন করেছিলেন মহীপাল । সব গুলোই পানীয় জলের জন্য অপেক্ষাকৃত নদীহীন অঞ্চলে।যেমন মহীপাল দীঘি ( মুর্শিদাবাদ) মহীপালদিঘী (দক্ষিন দিনাজপুর।) মহীপুর দীঘি ( বগুরা) মহীগঞ্জ দীঘি (রংপুর)। ধলদীঘির পাশে একটা সুরঙ্গপথ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।ধলদীঘী পুর্বে পশ্চিমে লম্বা ৪০৮০ফুট প্রস্থে ৮৭০ফুট। কালদীঘি উত্তর দক্ষিনে বিস্তৃত। ধলদীঘির চাইতে ছোট কিন্তু গভীর।দুটি দীঘিরই তিন দিকে উচু পার আছে একদিকে নেই।ধলদীঘি পুনর্ভবা নদীর কাছেই। বাণ রাজার কোন প্রমান কোথাও পাওয়া যায় নি। ধলদীঘির যেদিক টা নদীর অভিমুখে সেদিকে পাড়ে জলকপাট দিয়ে নদীর জলকে দীঘিতে ফেলা হত। 

কাশ্মিরী কলহন রাজতরঙ্গীনি তে একটা জায়গায় পুর্ব দেশের মানুষকে অত্যন্ত হীন নীচ ও বদরাগী বলেছেন কিন্তু পুর্ব দেশের নৌসেনাদের প্রচুর প্রসংশা করেছেন একই অধ্যায়ে। কালিদাসের রঘুবংশে বাঙ্গালীর নৌবলের প্রসংশা করেছেন প্রাণভরে। আজও গঙ্গারামপুরের সুকদেবপুর অঞ্চলে পুনর্ভবা নদীর প্রাচীন খাতে ত্রিশ বছর আগেও চিরুনীর দাড়ার মত খাড়ির আভাস। যেটা এখন পাথারী বিল বলে পরিচিত।সেখানে যে বড় পোতাশ্রয় ছিল একথা বলা যায়।

একটা নগর সেই গুপ্ত সময় থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী অবধি একই রকম ভাবে টিকে গেল কেন?

কোন শহর বা নগর টিকে থাকে তার সুনামের জন্য নয়। অর্থনৈতিক দৃঢ়তা জ্ঞান বিজ্ঞান, ও সংস্ক্রিতির জোরে। এবং শাসক বদলে গেলেও নগরের স্বার্থ রক্ষা করে সেই শাসকও। নদীমাতৃক বাংলায় নৌবহর ও তার যুদ্ধাস্ত সবকিছুতেই বাঙ্গালী বলীয়ান ছিল। আর মূল নগরকে রক্ষা করতে আচমকা বহিঃশত্রুকে আক্রমণ করার জন্য ব্যবহার করা হত দুই দীঘিকে। সেজন্যই এই সুরঙ্গ। এই সুরঙ্গপথ একেবারে দেবীকোট নগরের পরিখাতে গিয়ে মেলানো ছিল। গঙ্গারামপুর হাই স্কুলে যেতে একটা কাল্ভার্টের পাশে যে বিশাল গভীর ড্রেন কিছুদিন আগেও ছিল তার ইঁট গুলো দেখলেই বোঝা যেত এই সেই সুরঙ্গ পথের অংশবিশেষ। বহিঃশত্রু নগর আক্রমণ করলে পেছন দিক দিয়ে শত্রু নিধন করা যেত এবং নৌকা ও অন্যান্য যুদ্ধাস্তর সবই লুকোনো থাকত এই দুই দিঘীতে ও সুরঙ্গে। সে জন্যই করোতোয়া পুনর্ভবা তীরবর্তী পুন্ড্রবর্ধন ও কোটিবর্ষ খ্রীষ্ট পুর্বাব্দ থেকে ষোড়ষ শতাব্দী অবধি তার গরীমা নিয়ে ছিল।

সম্প্রতি ভারত সরকারের সর্বেক্ষন বিভাগও একই জায়গায় মৌর্য, কুষান, গুপ্ত,পাল,সেন, মুসলিম সময়ের নানা নিদর্শন পেয়েছে।

সুত্রঃ- 
১) মধুপর্ণী পশ্চিম দিনাজপুর জেলা সংখ্যা।
২) দধীচি শারদ সংখ্যা ১৪০১
৩) সাথী- দক্ষিন দিনাজপুর জার্নালিষ্ট ক্লাব প্রকাশিত পত্রিকায় নিজস্ব লেখা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ