মাদুরে পাতা হারমোনিয়াম আর সামনে যোগাসনের ভঙ্গীতে বসে পনেরো বছরের তান্নী। সে লংস্কার্ট ছড়িয়ে বসে আছে। এখন গাইতে হবে, সামনে আম্মু। ''কি গাইবো বলে দাও আম্মু,'' আহ্লাদী গলায় সে বললো।
'চোখের আলোয় দেখেছিলেম গাও। প্রতিদিন এক গান তান্নী একটু গাঁইগুঁই করলো।
-'অন্যটা গাইইই'
-'অন্যটা গাইইই'
- আগে এটা গাও ', আম্মু উদাস 'পরে তোমার অন্য গান শুনব । মুন মুন হাতে চায়ের জাপ নিয়ে মেয়ের গান শোনার বসেছেন। দুপুরে আজ তার ঘুম পাচ্ছিলো। কিন্তু মেয়ের গান তার বড় প্রিয় গানের সময়টুকু তিনি তন্ময় হয়ে থাকেন।
অগত্যা হারমোনিয়াম টেনে ''চোখের আলোয়'' গাইতে শুরু করল। তান্নীর কিন্নর কন্ঠ ।সপ্তাহে একদিন শুদ্ধ সঙ্গীত শেখে ওস্তাদ শ্যামল মোহান্তের কাছে । এছাড়াও রবীদ্র সঙ্গীত শেখায় সাব্রিনা মিস। কনাজারভেটিভ এই ফ্যামিলিতে যেখানে গান শেখার অনুমতিই মিলছিলো না সেখানে আলাদা ওস্তাদ রেখে শেখার কৃতিত্ব পুরো তান্নীর মা মিসেস মুনমুনের। তিনি যে কোন শর্তে মেয়ের গানের জন্য রাজী হয়েছেন। কাজেই হাসিমুখে তাকে হিজাব নেবার শর্ত রাখেন তান্নীর আব্বু । শর্ত আরো আছে,তান্নী কোন অনুষ্ঠানে গাইতে পারবেনা, শুধু পারিবারিক ভাবে গাইবে। মুনমুন রাজী হলেন।
তান্নি্র আম্মুও এক সময় চমৎকার গাইতেন। চান্স পেলেই মা মেয়ে মিলে গান করেন। তিনি নিজের কলেজের অনুষ্ঠানের দৃশ্যগুলো আজো দেখতে পান। নিজের ভুলে তার গান বন্ধ হয়েছে, তিনি মেনে নিয়েছেন। কিন্তু তান্নীর গানের ব্যাপারে জেদ ধরে আছেন।মেয়েকে গান নিয়ে শান্তি নিকেতনে পড়াবেন তিনি।
কথামত মুকুল সেদিন আসেনি স্টেশনে। তাদের সে রাতে চলে যাবার কথা ছিলো। মুনমুন কিছুতেই বাসায় মুকুলের কথা বলে কনভিন্স করতে পারেন নি। আব্বা খুঁজে বিদ্বান পাত্র পেয়েছেন। তার ইচ্ছে এর সাথেই মেয়েকে জোড় বাঁধবেন । পাত্র প্র্যাক্টিসিং,দারুন ধার্মিক। পর্দা ছাড়া তাদের বাড়ির মহিলাদের বাইরে দেখা যায় না। বাইরে যাবার হাজারো নিয়ম আছে। নানা সাজগোজ তারা করে থাকেন সবই হিজাবের উপরে।
এই সব দেখে দারুন ডি্বেটর এবং শখের গান করা মুনমুন ঘাবড়ে গেলেন। মুকুলের সাথে দেখা করলেন সেদিনই। একই পাড়ার বাসিন্দা তারা , সহপাঠী। এটাও তাদের সম্পর্কের অন্তরায় ছিলো। ঠিক হলো রাতেই তারা মুকুলের দেশের বাড়ি চলে যাবে এবং সেখানেই দাদা- দাদীর তত্তাবধানে হলুদ বাটো মেন্দী বাটো।
মুকুলের সাথে এসব কথা হবার পর ফুরফুরে মেজাজে রান্না ঘরে মুনমুন। মায়ের জন্য রাঁধতে বসেছে সে মাকে সরিয়ে। বাবার জন্য এক চাপা কষ্ট হচ্ছে । যত রাগী হোক বাবা তো। বুকে রেখে ঘুম পাড়াতেন। সেই প্রাণের লোকজন ছেড়ে সে আগামী কাল চলে যাবে... মা কে ছেড়ে কিভাবে যাবে মুন মুন।চোখের পানিতে ভাসতে ভাসতে রাঁধতে লাগলেন তিনি।
মুকুল সে যে আসেনি তো আর আসেই নি । এত বছরেও তার মুখ দেখেনি মুনমুন। সেদিন তার কি হয়েছিলো, কি কারণে একজন জীবিত মানুষ অতর্কিতে অদৃশ্য হয়ে গেলো তার কোন সুরাহা মুনমুন আজো পায়নি। সেদিন স্টেশনে সে প্রায় সারারাতই বসে থাকতো যদি না তার মামাতো ভাইয়েরা তাকে খুঁজতে খুঁজতে স্টেশনে না আসতো।
সে রাতের ঘটনা পাত্র পক্ষের কাছেও ধামাচাপা দেযা য়ায় নি। তারা বিয়ে ভেঙ্গে দিক মুনমুন তাই চেয়েছিলেন। কিন্তু ঈশ্বর ভাবেন তার মত । সে ভাবনা বোঝা মানুষের সাধ্য নেই। কি এক অদ্ভুত কারণে সেই পরিবারেই তার বিয়ে হলো। স্বামী ইমামূল বিয়ের রাতে ছোট করে বলেছিলেন, তিনি এই ঘটনার বিষয়ে জানতে চান না। তার আত্মীয় স্বজন সবাই এই বিয়ের কথা জেনে গেছে, কাজেই এখানেই তাকে বিয়ে করতে হবে।
ইমা্মূল আর কোনওদিন সে রাতের ঘটনা তোলেননি ঠিকই, তবে মুনমুনকে পুরোপুরি নিজের আওতায় আনার সুযোগও তিনি ছাড়েন নি। এক অপরাধ বোধে আক্রান্ত স্ত্রীকে যে সারা জীবনের মত বশ করতে পারবেন তা দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ইমা্মূল ঠিকই বুঝেছিলেন। ডানা কেটে দেবার পর পাখী আর উড়তে পারেনা । এবং এক সময় সে উড়তে চেষ্টাও করেনা। নাকি ভুলেই যায় সে কখনো বা উড়তে পারতো।
মেয়ে তান্নী তার একমাত্র ডানা যার পাখায় তার মুক্তি। যার কথায় জলের কলকল ,যার গানে সমুদ্র অতল... সেই অতল শীতল স্পর্শে নিদারূন দুরূহকাল ভুলে যান মুনমুন। মেয়ের দিকে একপলক তাকান। তান্নী বেনী দুলিয়ে গাইছে ''দুই হাতে কালের মন্দিরা যে সদাই বাজে''...। সত্যি কালের মন্দিরা বেজেছে । এখন আর ডানে বায়ে নিষেধের বেড়াজাল দেখতে পান না মুনমুন।দেখতে চান না। নিজের বিপদে নিজেকেই সব চেয়ে বেশী সাহায্য করতে হয়। দিনের সূর্য বিদায়ের এই তীব্র লগ্নে তান্নীর মদির সুরে এক অজানা তৃপ্তিতে একাকার হয়ে যায় মায়ের মন। মেয়ের সকল বিপদে তিনি মা হয়ে বন্ধু হয়ে আগলে রাখবেন। লক্ষীসোনা মেয়ে তার কখনও যেন ঠকে না যায়।
মুনমুন এক সময় অজান্তেই মেয়ের সাথে গলা মেলান ।' ডাইনে বাঁয়ে , দুই হাতে কালের মন্দিরা যে সদাই বাজে'.........।।
![]() |
| পরিচিতি |
সুমী সিকানদার
Reviewed by Pd
on
আগস্ট ১৫, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
আগস্ট ১৫, ২০১৫
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
সুচিন্তিত মতামত দিন