শ্রী কমলেশ গোস্বামী

19



এবারের আড্ডায় আমাদের মুখোমুখি কবি , গল্পকার , সম্পাদক , নাট্যাভিনেতা , প্রাবন্ধিক , শিক্ষাবিদ এবং সমাজসেবী শ্রী কমলেশ গোস্বামী ।  সর্বজনপ্রিয় , অদম্য প্রানশক্তি সম্পন্ন মানুষটির সাংগঠনিক শক্তিও প্রশংসনীয় ।  উনি যেভাবে আমাদের প্রতিটি জিজ্ঞাসার উত্তর দিয়েছেন তার ব্যস্ত শিডিউল থেকে আমরা কৃতজ্ঞ ।  ওনার সৃষ্টিমুখর সুস্থ আগামী কামনা করি ।  আমাদের পক্ষ থেকে অনাবিল শুভেচ্ছা এবং কৃতজ্ঞতা ...



আপনার জন্ম কর্ম বেড়েওঠা সবই কি রায়গঞ্জ এ ? বন্দর এলাকার গোস্বামী বাড়ি তো এখানকার বনেদি বাড়ি গুলির অন্যতম । ব্যাবসা বাণিজ্য , জমিজমার প্রতিই স্বাভাবিক আগ্রহ থাকার কথা ।  সেখান থেকে সাহিত্যের অঙ্গনে এলেন কিভাবে ? বাড়িতে কারুর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এ বিষয়ে ? ব্যাকগ্রাউনডটা যদি একটু বলেন আমাদের ...


স্নেহের শর্মিষ্ঠা আগে কেউ আমাকে এভাবে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে নি ।  আমি আমার মত উত্তর দেবার চেষ্টা করলাম ।  জানি না এটা কাউকে আকর্ষণ করবে কিনা , তবে উত্তর দেবার ক্ষেত্রে সৎ থাকব কথা দিচ্ছি ।  রাইগঞ্জ , অধুনা রায়গঞ্জ আমাদের সাত পুরুষের বাস ।  ১৭৭৩ সালে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সময় এক সন্ন্যাসী সৈনিক রায়গঞ্জে আসেন ।  এখানে তার মঠের নাম ছিল গিরি গোঁসাই এর মঠ ।  সন্ন্যাসীরা ত বিবাহ করতেন না ।  মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি জানকী নামে এক শিশুকে উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেন ।  তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন নি ।  তিনি ইংরেজি ও ফার্সিতে পারদর্শী ছিলেন ।  রায়গঞ্জের প্রথম অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট , রেজিস্ট্রার ও জমিদার রূপে স্বীকৃতি পান ।  আমরা তাঁর উত্তর পুরুষ ।  আমার ঠাকুরদা ঈশ্বর যতীন্দ্র মোহন গোস্বামী নাটক , সঙ্গীতের সাথে যুক্ত ছিলেন ।  আমার বাবা কল্যাণ কুমার গোস্বামী নাটক , সমাজসেবার সাথে যুক্ত ছিলেন ।  সাহিত্যের অঙ্গনে এসেছি ২০০১ সালের গোড়ার দিকে ।  স্ত্রী সুনন্দা লেখালেখি করে ।  মাঝে কিছুদিন সরে ছিল ।  পরে আবার আমরা একসঙ্গে সাহিত্য চর্চা শুরু করি ।

আপনার গল্প সংকলন , ‘প্রান্তিক’, প্রকাশ পেয়েছে ২০০৮ সালে । আর কোনও নতুন সংকলন আছে , বা আসছে ?অগুন্তি ম্যাগাজিনে গল্প লেখেন । সেগুলি উৎসাহী পাঠকের হাতে পৌঁছনোর বন্দোবস্ত কি ?

আমার প্রথম লেখা ২০০৩ এ আনন্দমেলাতে প্রকাশিত হয় ।  ঐ বছর ই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য সংস্কৃতি দফতরের আলোর ফুলকিতে এবছিছোটদের কচিপাতাতে প্রকাশিত হয় ।  তারপর অনেক গল্প জমে গেলেও গল্প সংকলন করা হয় নি ।  পরে উত্তরবঙ্গের ওপর তিনটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে ।  রাইগঞ্জের ইতিহাস ‘, (নির্বাহী সম্পাদক ), ‘বিদ্রোহ ও আন্দোলনে উত্তরবঙ্গ ‘, (সম্পাদক) , ‘উত্তরবঙ্গের ইতিহাস- পরিবেশ ও পর্যটন ‘(সম্পাদক) , এছাড়া রায়গঞ্জ ইন্সটিটুটের পঁচাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ইন্স্টিটিউটের পঁচাত্তর বছরের ইতিহাস রাই ১৯৩৯-২০১৫নামে প্রকাশিত হয়েছে । এগুলো ছাড়াও কিছু লিটিল ম্যগাজিন , নন্দন , কিশোর জ্ঞানবিজ্ঞান , আমার রুপসি বাংলা , দিবারাত্রির কাব্য , শৈব ভারতী , দৈনিক স্টেটসম্যান , উত্তরবঙ্গ সংবাদ ইত্যাদিতে নিয়মিত লেখা প্রকাশ হয়েছে । বন্ধু , তোমাদের নবপ্রযুক্তিতে আমি নবাগত বৃদ্ধ , পাঠকের হাতে পৌঁছনোর রাস্তা আমার জানা নেই ।  বিদ্রোহী কবির ভাষায় বলতে ইচ্ছে করছে – ‘আকাশেতো আমি রাখিনাই মোর উড়িবার ইতিহাস / তবু উড়েছিনু সেই মোর উল্লাস । 

আকাশবাণী শিলিগুড়ির প্রান্তিকঅনুষ্ঠানে আপনাকে গল্প পরতে শুনি ।  কতবছর ধরে পড়ছেন ? রেকর্ডিং নিয়ে মজার কোনও অভিজ্ঞতা আছে ? প্রথম রেকর্ডিং এর অনুভুতি কেমন ছিল ?

আকাশবাণী শিলিগুড়িতে প্রায় দশ বারো বছর হোল ।  প্রান্তিক অনুষ্ঠানে গল্প পাঠ করি ।  রেকর্ডিং নিয়ে মজার গল্প নয় । তীব্র আত্মগ্লানি আছে ।  গল্পকার রূপে আমাকে স্বীকৃতি দেন উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ সম্পাদক স্বর্গীয় অজিতেশ ভট্টাচার্য মহাশয় । রায়গঞ্জে এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে এসে আমার লেখা বাণগল্পটি শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন ।  প্রথম রেকর্ডিং করতে গিয়ে দেখি অজিতেশবাবু রেকর্ডিং করতে এসেছেন । তখন আমার গল্প অনেক পত্র পত্রিকায় বের হচ্ছে ।  হয়তো মনে মনে একটু অহংকারও জন্মেছে ।  ওনার সাথে কথা বলছিলাম । রেকর্ডিঙের জন্য ডাক পড়ল । আমি চলে গেলাম , বাড়ি ফেরার বাসে ওঠার পর আমার বিবেক যেন চাবুকের ঘা খেয়ে জেগে উঠল , রেকর্ডিং এ যাবার সময় আমি ওনাকে প্রণাম করতে ভুলে গেছিলাম , ওনাকে গুরু মানি ।  পরে অনেকবার দেখা হয়েছে , প্রণামও করেছি ।  সেদিনের না করার ভুলটা আজও বিবেককে রক্তাক্ত করে । সেটা কি নার্ভাসনেসের জন্য নাকি আমার - ।  নিজেকে আজও ক্ষমা করতে পারিনি ।

উত্তরবঙ্গের জনজীবন , প্রাকৃতিক প্রাচুর্য , ঐতিহ্য , সংগ্রামের ইতিহাস এসব কিছু নিয়েই তো আপনি তিন তিনখানি প্রবন্ধ সংকলন সম্পাদনা করেছেন ।  কেবল উত্তরবঙ্গে আটকে থাকাটা কি ইচ্ছাকৃত ?

আমি উত্তরবঙ্গের সন্তান ।  উত্তরবঙ্গের প্রকৃতি , মানুষের সাথে আমার নাড়ির টান ।  উত্তরবঙ্গ চির অবহেলিত । এখানকার সন্তান হিসেবে আমি সমস্ত অবিচারের প্রতিকার চাই , তাছাড়াও এখানকার প্রাকৃতিক প্রাচুর্য , ঐতিহ্য , নয়নাভিরাম সৌন্দর্য আমি বিশ্বের ভ্রমণ পিপাসু মানুষের কাছে তুলে ধরতে চাই । এটা উপ্ততরবঙ্গে আটকে থাকা নয় ।  কোন ভালো কাজ করতে হোলে বাড়ি থেকেই তা শুরু করা ভালো । সেক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গ আমার প্রথম পছন্দ ।  এক জায়গায় বদ্ধ হয়ে থাকা আমার স্বভাব নয় । কবিগুরুর লেখা আমায় ভাবায় – ‘হেথা নয় অন্য কোথা অন্য কোন খানে ‘’। মানুষের জীবন অনন্ত খজ , এ খজ সারা জীবনের ।

কোন পরিচয়ে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন ? গল্পকার না প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক ?

 
আমার পরিচয় গল্পকার , প্রাবন্ধিক না সম্পাদক রূপে পাঠকের কাছে গ্রাহ্য হবে তা কেবলমাত্র পাঠকই বলতে পারেন ।  তবে আমি নিজেকে সংস্কৃতি মনস্ক অনুসন্ধিৎসু একজন সমাজকর্মী রূপে ভাবতে ভালোবাসি । 


কিছুদিন আগে আপনার বাগান বাড়ি সুহাসিনীতে চৈতন্যপত্রিকার প্রকাশ , গুণীজন সম্বর্ধনা কে উপলক্ষ করে উত্তরবঙ্গ , দক্ষিণবঙ্গ এমনকি দিল্লী থেকেও কবি , সাহিত্যিক , সমাজতাত্ত্বিক সকলকে নিয়ে তিনদিনের বিশাল মিলনমেলা করলেন । এত বড় মাপে সবকিছু আয়োজনের শক্তি ও সাহস পান কোথা থেকে ? বিশাল আর্থিক দায় ও তো বইলেন ।  কিসের তাগিদে ?

প্রথমেই আপত্তি জানাচ্ছি বাগানবাড়ি শব্দটিতে ।  একজন প্রখ্যাত কবি অসিত বরণ চট্টোপাধ্যায় এ বাড়িটার নাম দিয়েছেন লেখাবাড়ি। চৈতন্য পত্রিকার অনুগল্প সংখ্যা লুপগল্পে এর উল্লেখ আছে ।  ছোটবেলা থেকেই সংগঠনমূলক বিভিন্ন কাজে যুক্ত ছিলাম ।  হরিজন বিদ্যালয় , উদয়চন্দ্র বিদ্যাপীঠ , টেন ক্লাস গার্লস , অজয় সঙ্ঘ প্রভৃতি নানা শিক্ষা ও জনহিতকর কর্মকাণ্ডে উদ্যোক্তার ভূমিকা নিয়েছি । ফলে হরিজন সম্প্রদায়ের সীতারাম জমাদার যেমন আমার বন্ধু তেমনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শ্রী প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সীও আমার কাছের মানুষ ।  কোনকিছু আয়োজন করার ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতাগুলোই আমাকে শক্তি যোগায় ।  আর সাহসটা চিরকালই আমার আছে ।  আর্থিক দায় আমরা স্বামী স্ত্রী বিলাসিতা বাঁচিয়ে করেছি ।

আপনার বাড়ির পাশেই সুহাসিনীপল্লী প্রতিষ্ঠা করলেন ।  কে এই সুহাসিনী দেবি ? হঠাৎ এমন একটা চিন্তা মাথায় এল কেন ?

সুহাসিনী দেবী একজন মহীয়সী নারী । যতীন্দ্রমোহন গোস্বামীর স্ত্রী ।  নয় বছর বয়সে রায়গঞ্জ এ বিয়ে হয়ে আসেন । যতীন্দ্রমোহন তখন পাশ্চাত্যই শিক্ষায় শিক্ষিত ।  ব্রাহ্মসমাজ সহ উচ্চ মহলের অনেকের সাথে যোগাযোগ ।  বউ শিক্ষিতা হবেন এই তার ইচ্ছে ।  সুহাসিনী দেবীর দাদা বানেশ্বর গোস্বামী এস্টেটের তহশিলদার ছিলেন ।  লেখাপড়ায় অত্যন্ত মেধাবী এই ভদ্রলোক বোনকে বাংলা এবং ইংরেজি শেখানোর দ্বায়িত্ব নিলেন ।  শাশুড়ি হৃদিভারতী দেবী ও সুহাসিনী দেবী স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন ।  ছোটবেলায় মা মারা যাবার পর বেশির ভাগ সময় ঠাকুমার সাথেই থাকতাম , শুতাম , গল্প শুনতাম ।  আমাদের পাড়ার নাম বন্দর , কুলিক নদীর বন্দর ।  কথিত আছে নাবিকদের বন্দরে বন্দরে বউ থাকে ।  প্রাচীন কাল থেকেই বন্দরে পতিতা পল্লী ছিল ।  ঠাকুমা বলতেন , ‘দাদা, এখানে মেয়েদের চরম অপমান সহ্য করতে হয় , তুই বড় হয়ে পারলে মেয়েদের জন্য কিছু করিস । আমার যুবক বয়সে রায়গঞ্জ গার্লস স্কুলের মর্নিং সেকশানে দশম শ্রেণী বালিকা বিদ্যালয় নামে একটি মেয়েদের স্কুল ছিল ।  সকালে হওয়ায় তিন ঘণ্টার বেশি ক্লাস হতো না ।  আমার উদ্যোগে এবং বন্দর বাসীর সহায়তায় প্রথমে পতিতা পল্লীতে বসবাসকারীদের সাথে সভা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল , পতিতা পল্লীর পাশের জমিতে মেয়েদের স্কুল হবে ।  এই পল্লী এখানে থাকবে না। দুই একজন জারা ব্যবসায় থাকতে রাজী তাদের বহরমপুর পতিতা পল্লীতে পুনর্বাসন দেওয়া হয় ।  তাদের জমি জমা উপযুক্ত দামে প্রতিবেশীরা কিনে নেন । অন্যরা সংসারী হয়ে যান ।  যে জমিতে নিম্নবিত্ত মানুষেরা সুহাসিনী পল্লী গড়ালেন সেই জমিটিও সুহাসিনী দেবীর সম্পত্তি ।

আপনার গল্পের উপজীব্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গাঁ মাটির গন্ধমাখা মেহনতি মানুষ ।  প্রচুর দেহাতি শব্দের ব্যবহার দেখি আপনার লেখায় ।  এসব উপাদান ই কি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লব্ধ নাকি বিশেষ স্টাইল অনুশীলনে আয়ত্ত করা ?

বাড়িতে দেখেছি সুহাসিনী দেবী দরিদ্র , মেধাবী দশজন ছাত্রকে কাছেরেখে পড়াশোনা করাতেন ।  একটু বড় হতেই আমাকে দিয়ে নিয়মিত তিনবার মহাভারত পড়াতেন ।  আমার উচ্চারণের ভুল শুদ্ধ করতেন , কঠিন অর্থ বোঝাতেন ।  এটি আমার প্রিয় গ্রন্থ হয়ে ওঠে ।  রামায়ণ ঠাকুমাকে আটবার পড়ে শুনিয়েছি ।  অনেক জ্ঞানলব্ধ আলোচনা শুনেছি পণ্ডিত সীতাকান্ত আচার্যর কাছে ।  জমিদার বাড়ি ছিল বলে , বর্গাদাররাও আসতেন ।  এদের মধ্যে সাঁওতাল , মুসলমান , রাজবংশী , বিহারী , তুরী ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন ।  ঠাকুমা এদের খাওয়াতেন , অর্থ সাহায্য করতেন , অসুখবিসুখে খোঁজ খবর নিতেন , এদের কোলেপিঠে আমি মানুষ । ওদের ঘরে গিয়ে দেখেছি ওদের জীবন । ওদের ভালোবাসা কখনো ভুলবো না ।  যখন গল্প লিখবো ভাবলাম , ভেবে দেখলাম , উচ্চবিত্ত , মধ্যবিত্ত বা ড্রয়িংরুমের গল্প লেখার অনেক শিক্ষিত মানুষ আছেন , কিন্তু আমি প্রান্তিক মানুষজনের কাছের লোক ।  কবিগুরুর কথায় ,’যে আছে মাটির কাছাকাছি / সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি । তাই গল্পগুলি জীবন থেকেই নেওয়া , কোন তৈরি স্টাইল নয় ।

আপনি যন্ত্রশিল্পীও বটে ।  কি বাজান ? চর্চা আছে নিয়মিত ? কার কাছে শিক্ষালাভ করেছেন ?

 
 ছোটবেলায় দিদির গানের জন্য প্রথমে তবলা বাঁয়া কেনা হয় , আমাকেও ভর্তি করা হয় স্বর্গীয় কৈলাস ছন্দ্র দাস মহাশয়ের কাছে ।  ৬৯ এ গুরু শ্রী বাব্লু মজুমদার । তিনি বিভিন্ন যন্ত্র বাজানোয় দক্ষ ছিলেন ।  আমি সেখানে তবলা , খোল , ঢোলক , নাল , কঙ্গ , চামড়ার তৈরি বাদ্য যন্ত্রগুলো বাজাতে পারতাম ।  বাংলাদেশ , নেপাল , বিহার , উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় অনুষ্ঠান করেছি আমরা ।  এছাড়া সঙ্গীত শিল্পী শ্রী অচিন্ত্য সেন , শ্রী নারায়ণ কুণ্ডু এবং আরো অনেকের সাথে সঙ্গত করেছি ।

অভিনয়ের সাথে যোগাযোগ আছে এখনও ? এই বিশেষ সখের ব্যাপারটা যদি একটু বিশদে বলেন...

 
অভিনয় আমাদের বংশে ।  আমার প্রথম পছন্দ অভিনয় ।  বাবা কাকাকে নাটকে অভিনয় এবং পরিচালনা করতে দেখেছি । ছোট বেলায় মামাবাড়িতে থাকাকালীন অজয় সঙ্ঘে’ ‘কালোমাটির কান্নানামে এক্তি নাটক মঞ্চস্থ করি খনি শ্রমিকদের নিয়ে , বাবা যখন রায়গঞ্জ পৌরসভার পৌরপতি তখন ইন্স্টিটিউটে বাহান্ন সপ্তাহে বাহান্নটি একাঙ্ক নাটক অভিনীত হত , একটিতে আমি বাবার সাথে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলাম ।  বন্দরের যুবনাট্য সম্প্রদায় যাত্রা করতো , পৌরাণিক পালা সব , উনিশ পয়সা টিকিত ।  আমি এখানে যোগ দিলাম , প্রথম যাত্রা লালবাঈ।  নতুন আঙ্গিক আমদানি করলাম । টিকিত হল দুটাকা , তিনটাকা । মানুষের ঢল নামত ।  একে একে ,’নাচমহল’, ‘সবার দেবতা’, ‘বেগম আশমান তারা, রাজা যদুর জালাল্লুদ্দিন হবার কাহিনী , পটভূমি দিনাজপুর , মালদা ।  ইন্স্টিটিউটে শ্রী অচিন্ত্য সেনের পরিচালনায় অনেক নাটক করেছি , এর মধ্যে মারীচ সংবাদ’, ‘স্পারটাকাস’, ‘এই নারী এই তরবারিআরও অনেক ।  এখানথেকে আমরা কোলকাতায় রবীন্দ্রসদনে গিয়েও নাটক করেছি । ১৯৮৬ তে, রিভিউ ছাপা হয়েছিল যুগান্তর’, ‘দেশএবন আরও কিছু পত্রিকায় । আমার নিজের কোরাসনামে একটি দল আছে , এর দুটি প্রডাকশান বিনয় বাদল দীনেশ’, ‘সন্ন্যাসীর তরবারি। আমার স্ত্রী ও কন্যাও আমার সাথে অভিনয় করেছে ।  আজ থেকে ১০০ বছর আগে আমাদের বাড়িতে মেবার পতন মঞ্চস্থ করেছিলেন ঠাকুরদা ।  রায়গঞ্জে নাট্য চর্চার শতবর্ষ উৎযাপন করা হচ্ছে ২০১৫ র ডিসেম্বর থেকে ২০১৬ র ডিসেম্বর পর্যন্ত ।  সকলকে আমন্ত্রণ জানাই ।

অনুমতি দিলে একটু ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি ... আপনার সহধর্মিণী শ্রীমতী সুনন্দা গোস্বামীও প্রতিষ্ঠিত কবি এবং সম্পাদক । বাড়িতে তো চাঁদের হাট । সমমনস্ক দুটি প্রতিভাবান মানুষ যখন জীবন কাটান একসঙ্গে তারা সহযোগী হবেন বলাই বাহুল্য , কিন্তু জানতে ইচ্ছে করছে , কখনও কি ইগোক্ল্যাস হয় না ? কখনও কি প্রতিযোগী মনে হয় না একবারের জন্যও একে অপরকে ?

আমার ক্লাস এইট আর সুনন্দার ক্লাস সিক্স থেকে আমাদের পরিচয় ।  আমি তখন মামাবাড়িতে । সুনন্দা আমাকে পোস্টকার্ডে চিঠি লিখত ।  খুবসুন্দর চিঠি লিখত ও । আমি রায়গঞ্জ থেকে নদীয়ায় গেছি , জেলার টান কথায় , লেখায় ।  ক্লাস ইলেভেনে খাদ্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত হই । আমার বন্ধু আনন্দ হাইত পুলিশের গুলিতে মারা যায় ।  আমার নামে পি ডি একটে ওয়ারেন্ট বের হয় ।  আমি বাড়িতে পালিয়ে আসি । বাবা তখন এখানকার পৌরপতি ।  রাজনীতি ছাড়তে হবে , বাড়িতে ঢুকতে হলে , বাবার শর্ত ।  ঘুরছি এখানে ওখানে ।  সুনন্দার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ।  প্রাইভেটে স্কুল ফাইনাল পাশ করি ।  সুনন্দা বহরমপুর গারলস কলেজে ফার্স্ট ইয়ার ।  বাবা মারা গেলেন। আমার একুশ ।  ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম ।  সেই তিন ভুবনের পারের গল্পের মত সুনন্দা প্রভাবিত হয়ে থাকবে । আমার লেখালেখিতে আসা ওর প্রেরণায় ।  আমি ওর কাছে ঋণী ।  সুতরাং ক্ল্যাস হয় নি ইগোর ।  রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ,’তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান / গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়

ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছেন , বাবাকেও ।  আপনার কথাসাহিত্যে বিশেষ কোন লেখা আছে কি যেখানে এই বেদনার প্রতিফলন ঘটেছে ?

না, আমার গল্পে আমার মা , বাবার ছায়া এখনও পড়েনি । হয়তো আগামীতে আসবে ।

 

সংগঠক হিসেবে আপনি অসাধারণ ।  কখনো মনে হয় নি রাজনীতিতে এই গুণটিকে কাজে লাগানোর কথা ?

 
ছাত্রজীবনে বাম আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম ।  আমাদের বাড়ি জমিদার বাড়ি হিসেবে পরিচিত ছিল বলে উগ্র রাজনীতির সমর্থকরা বাড়ির পাশ দিয়ে স্লোগান দিয়ে যেত ,’জোতদার জমিদার নিপাত যাক , নিপাত যাক। বাবা মারা গেছেন ।  আমার উনিশ । নাবালক ভাইবোন ।  পরিবারকে বাঁচাতে তখনকার ছাত্র যুব নেতা শ্রী প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সীর নেতৃত্বে যুব কংগ্রেসে যোগ দি । উনি যতদিন সুস্থ ছিলেন আমি তার সমর্থক ছিলাম ।  তিনি অসুস্থ হবার পর রাজনীতি আমাকে আর টানে না ।

আপনার সম্পাদিত বিদ্রোহ ও আন্দোলনে উত্তরবঙ্গইংরেজিতে অনুবাদ হচ্ছে শুনেছি ।  কে করছেন ? হঠাৎ ইংরেজিতেই বা কেন ?

কবি প্রাণেশ সরকার ।  দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর রাজীব নন্দী জে এন ইউ র নৃতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ডক্টর আর কে জৈন কে বইটি দেন ।  ওনার স্ত্রী বাঙালি । তিনি স্বামীকে পড়ে শোনান । উনি বলেন , উনি মুগ্ধ ।  এত তথ্য বহুল বই ইংরেজিতে অনুদিত হলে বিশ্বে প্রচার হবে ।

সম্পাদক হিসেবে কোন কোন ম্যাগাজিনের সাথে যুক্ত আছেন ?

 
আমি চয়নপত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীতে চার বছর ছিলাম । সেই সময় পত্রিকাটি লিটিল ম্যাগাজিন মেলায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমি প্রদত্ত সেরা লিটিল ম্যাগাজিন এর পুরস্কার পায় ।

 
আপনার পরবর্তী প্রোজেক্ট কি ?

 
বর্তমানে উত্তরবঙ্গের বাউল সম্প্রদায় নিয়ে একটা কাজ করছি ।  সুহাসিনীনামে একটি উপন্যাস লেখার ইচ্ছে আছে ।

 
আপনার সম্পাদিত উত্তরবঙ্গের পরিবেশ ও পর্যটনকলকাতায় বাংলা একাডেমীতে অত্যন্ত সফল অনুষ্ঠানে হলভরা দর্শকের উপস্থিতিতে মোড়ক উন্মোচিত হয়েছিল শ্রী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর হাতে ।  দক্ষিণবঙ্গের অনেক নামকরা ম্যাগাজিনের সম্পাদকরাও উপস্থিত ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে । উত্তরবঙ্গকে এভাবে দক্ষিণবঙ্গের সংস্কৃতির মক্কায় উপস্থাপনের সাহস, দূরদর্শিতাকে শ্রদ্ধা করি ।  আপনি কি মনে করেন উত্তরবঙ্গের লেখক সমাজ সত্যিই প্রান্তিক ?

উত্তরবঙ্গের সমস্ত অঞ্চলটাই প্রান্তিক । উত্তরবঙ্গ বহু ভালো লেখকের জন্ম দিয়েছে । তার মধ্যে দু একজন ছাড়া সবাই কোলকাতা গিয়ে বিখ্যাত হয়েছেন ।  এক্ষেত্রে আমরা প্রান্তিক ।

শর্মিষ্ঠা জানিনা , তোমার প্রশ্নের জবাব ঠিকঠাক দিতে পারলাম কি না ।  সব বন্ধুদের আমার ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা জানাই । তোমরা ভালো থেকো , ভালো রেখো , ভালো লেখো ।

আপনাকেও প্রনাম ।  ভালো থাকুন ।।




শর্মিষ্ঠা ঘোষ
শ্রী কমলেশ গোস্বামী
পরিচিতি
পরিচিতি
শ্রী কমলেশ গোস্বামী শ্রী কমলেশ গোস্বামী Reviewed by Pd on আগস্ট ১৫, ২০১৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.