দোলনচাঁপা ধর

dolon



গন্ধেশ্বরী পুজোর আগের রাত, একা হাতে দোকান সাফ করতে করতে স্বাধীনের মনে হল এ বছর সে একা। সমস্ত টিন, বয়াম, ছোট কৌটোগুলো টেনে নামাতে নামাতে ভাবছিল এই প্রথম হয়ত সে তার ইচ্ছেমত সাজিয়ে নিতে পারবে এই দোকান। দাদুদের পৈতৃক হার্ডওয়ারের দোকান ছিল পার্কস্ট্রীটে একদম সিরাজের উল্টোদিকে, সে দোকান ভাগাভাগির পর দাদু অংশ না নিয়ে টাকা নিয়েছিলেন যা দিয়ে ওনার বাসাবাড়ির লাগোয়া একটা ঘর নিয়ে একই জিনিষের দোকান দিলেন স্বাধীন ভাবে। ছেলে মেয়েদের বড় করা বিয়ে দেওয়া সব ঐ দীপালি হার্ডওয়ার থেকে। 

সবাই বলে মা নাকি উত্তমকুমারের জন্য সংসার করতে পারে নি, স্বাধীন যখন সাত মাসের মা দাদুর বাড়ি ফিরে এসেছিল।  বলরামপুর তখন অজ গাঁ, সিনেমা হল দূরের কথা সেখানে ময়দা পর্যন্ত পাওয়া যেত না। বাবার জমি জিরেত ছিল জমিদারের মত কিন্তু জমিদারী ঠাটবাট ছিল না, সে পরিবারে ধান সেদ্ধ থেকে ক্ষার কাচা সবই করতে হত বাড়ির মেয়েদের।  উত্তমকুমারের অদর্শন না সেই ভীষণ কায়িক পরিশ্রম কি জন্য মা ফিরে এসেছিল তা জানার উপায় আর নেই।

মামা মাসিরা স্বভাবতই খুশী হয়নি এই আকস্মিক প্রত্যাবর্তনে, পার্কস্ট্রীটের বাসাবাড়িতে এমনিতেই জায়গা অকুলান তারপর মাসী তখন বাড়ির ধারার বাইরে গিয়ে রীতিমত পড়াশোনা করছে, দিদিমা ক্যান্সারে শয্যাশায়ী এর মধ্যে বাচ্চা নিয়ে বিবাহিতা মেয়ের অকারণে ফিরে আসা কারই বা ভাল লাগতে পারে। অবস্থা সামাল দিতে মা বাড়ির গিন্নীর ভুমিকা নিল, রান্না, দেখাশোনা, অতিথ কুটুম যাবতীয় সব। এখানেই স্বাধীনের পড়াশোনা বড় হওয়া করুণভাবে শুরু হল, করুণ এইজন্য যে তার বন্ধুরা জানত যে সে মামাবাড়িতে থাকে, তারা সহজ কারণটাই ভাবত আর স্বাধীনও ঠিক ঠিক জানত না যে কেন তার নিজের বাড়ি নেই।ক্রমে মামার বিয়ে হল, মামী এ সংসারে থাকতে চাইলেন না তাদের পিকনিক গার্ডেনে বাড়ি কিনে দিলেন দাদু, মামা যদিও রোজ দোকান করতে আসতেন এবং মাসের খরচও নিয়ে যেতেন। মাসী পাস করে একটা স্কুলে চাকরী জোগাড় করে বাড়িতে জানাল তার পছন্দ করা ছেলের কথা, সাধ্যমত খরচে সে বিয়েও হয়ে গেল।  দিদিমার মৃত্যু বাদে মাসী আর কখনো এ বাড়ি আসে নি। ইতিমধ্যে দাদুদের শ্রীরামপুরের সাবেক বাড়ি আর সুন্দরীমোহন অ্যাভিনিউর বাড়িটিও ভাগাভাগি হল, প্রথমটির জন্য কিছু টাকা আর দ্বিতীয়টির জন্য একটা দোকান ঘর পেলেন দাদু।  মামাও এবার এসে তার ভাগ বুঝিয়ে দিতে বললেন কারণ এতদিন বিয়ে দেওয়া মেয়ের সংসার টানার ব্যাপারে কিছু বলেন নি, কিন্তু এখন তার নিজের দুটি ছেলের কথাও ভাবতে হবে। বয়স সবার হচ্ছে তিনি চান না ছেলেদের এই ভাগাভাগির মধ্যে রেখে যেতে।  দাদু দীপালি হার্ডওয়ার মামার নামে লিখে দিলেন, আর নতুন দোকান ঘরে যদিও খুব ছোট এটা তবু আবার দোকান দিয়ে স্বাধীনকে বললেন “দাদু, এটা তোর, পটলের মায়ের নামের দোকান তাই ওটা ওকে দিলাম এটা যখন তোর তুই নাম রাখ মালতী হার্ডওয়ার”।

সেই থেকে দাদু হাতে কলমে শিখিয়ে যেতেন ব্যবসা, গালার টিন কোথায় থাকবে, ছেঁড়া কাপড়, রং, তার্পিন, মোম আর গ্যারেজের মাল নিতে আসা পুঁচকে ছোঁড়াগুলোর জন্য লজেন্স, যাতে ওরা বারবার এখানেই আসে। পাকা মিস্তিরিদের জন্য তো বিলের বখরা থাকেই ওরা কতদিন দাদুকে চেনে, দাদু বলে যান এবার থেকে নাতির কাছেই মাল নিও।  দাদুর চলে যাওয়ার পর দোকানটা আস্তে আস্তে স্বাধীনের হয়েছে, পুরোটা কেন হয় নি তা এই আজ রাতে বুঝতে পারছে সে, বিভিন্ন কৌটোর মধ্যে নানা চিরকুট মোড়া টাকা, গায়ে লেখা ‘অসময়ের জন্য’, এছাড়াও নির্দেশ, উপদেশ, ব্যবসায়িক বুদ্ধি যখন যা মনে এসেছে বুড়ো লিখে গেছে। এরই মধ্যে রঞ্জনার চিঠিটা গজালের কৌটোর মধ্যে, এ জিনিষটা এ অঞ্চলে বড় একটা চায় না মানুষ, তাই ওরই মধ্যে লুকিয়েছিল সে।

নখপালিশ তোলার থিনার নিতে আসত রঞ্জনা, মাথা নিচু হাতে দু টাকার কখনো কয়েন কখনো নোট।  ছোট্ট বোতলটা বেরং এর মিশ্রণে ভরে দিতে একটু বেশীই সময় নিত সে আর কখনো দাদু সামনে থাকলে বলত দু টাকায় হবে না, দাদু আবার দিয়ে দিতে বলত হেসে। মায়ের সাথে বেশ ভাব ছিল রঞ্জনার মায়ের, দাদু বেনারস বেড়াতে যাবার সময় যখন আর দুপুরে বাড়ি যেতে পারত না তখন মা খাবার আনত দোকানে সেই সময়েই পিছনে রঞ্জনাদের বাড়ি গিয়ে দুপুরটা কাটাত, রঞ্জনা লেখাপড়ায় ভাল, তার চুল কোমর ছাড়ায়, সে মিষ্টি কথা বলে এসব মায়ের থেকেই শোনা।  সে ভরসাতেই রঞ্জনাকে ভালবাসার কথা বলে একটি চিঠি দেওয়া যার জন্য এই ফেরত চিঠি--

“ এমন কথা আর কখনো লিখবেন না, আর একথা লেখার আগে দাদুকে জানিয়েছেন কি? তিনি ফিরে এসে যদি শোনেন যে নাতি এতদূর ‘স্বাধীন’ হয়েছে তাহলে কি হবে? শিগগির বড় হয়ে উঠুন এই কামনা...”

সে মেয়ে এখন জাঁকিয়ে সংসার করছে স্বামীর ঘরে, দাদু চলে গেছে গেল বছর, এখনও কি সে স্বাধীন হতে পেরেছে? নাকি মা দাদু মামা মাসী আরও সব জীবনের নানা ভাঁজের স্মৃতির হাতে সে পরাধীন? সে চিঠিটা মুড়ে রাস্তায় ছুঁড়ে দেয়, আজকাল সুভদ্রা দোকানে বসে মাঝে মাঝে ছেলেকে পড়তে দিয়ে এসে, নতুন করে সাজাতে তারও হাত ফেরে চারদিকে, এ চিঠি তার হাতে পড়া ঠিক নয়।  রাত ফুরিয়ে আসে, স্বাধীন হাত চালায় আরও দ্রুত। 
dolon
পরিচিতি
দোলনচাঁপা ধর দোলনচাঁপা ধর Reviewed by Pd on আগস্ট ১৫, ২০১৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

সুচিন্তিত মতামত দিন

banner image
Blogger দ্বারা পরিচালিত.