গাঁজাখুরি লেখা আমি লিখি না। যা দেখি নি তা বিশ্বাস করব না, এমনটা আমি মনে করি না। মানুষের বুদ্ধির ধরা-ছোঁয়ার বাইরে এমন অনেক ঘটনা থেকে যায়, যাকে অলৌকিক বলা হয়, এ সব ঘটনার মান সম্মত কোন কারণ আছে, বিজ্ঞান যার এখনও গিট খুলতে পারেনি। হয়ত ভবিষ্যতে এমন দিন আসবে যখন ইহলোক আর পরলোকের দ্বার পরস্পরের জন্যে খুলে যাবে। মৃত্যুর পরেও আমরা চেনা-জানা ব্যক্তিদের সঙ্গে স্বাভাবিক মেলা-মেশা করতে পারব, সংবাদ আদানপ্রদান করতে পারব।
এবার আসল কাহিনীতে আসা যাক। আমি সস্ত্রীক জামাই মেয়ে নাতনীদের নিয়ে হিমাচল প্রদেশ ঘুরতে গিয়ে ছিলাম। দিল্লী, পাঠানকোট হয়ে গেলাম ডালহৌসি। ডালহৌসি থেকে চামের ডেম প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে। আমরা বেরিয়ে ছিলাম চামের ড্যাম দেখতে। কয়েক মাইল জুড়ে এ জলাশয়ের অবস্থান। জলের গভীরতা কোথাও কোথাও নাকি এক মাইলেরও বেশী ! নৌকা বিহারের প্রসস্থ জাগা। যথা সময় ড্যামে নৌকা বিহার সারলাম। চোখে পড়ল সেখানকার সুন্দর মনোরম দৃশ্য, চারিদিকের পাইন বৃক্ষ আবৃত উচ্চ পর্বত শৃঙ্খল।
ড্যাম থেকেই চোখে পড়ে ছিল দুরে পাহাড়ের ওপরে ভলাই মাতা মন্দিরের শীর্ষ চূড়া। সঙ্গের ড্রাইভার জানালো, এটি হচ্ছে প্রসিদ্ধ ভদ্রকালী মাতার মন্দির।
শোনা যায় ১৮ শতাব্দীতে তৎকালীন চম্বার রাজা প্রতাপ সিং এই মন্দির তৈরি করিয়ে ছিলেন। এমনি জনশ্রুতি আছে যে রাজাকে দেবী স্বপ্ন দেখিয়ে ছিলেন যে, দেবী ভরণ নামক জাগায় শায়িত আছেন। ভরণ ছিল বর্তমান মন্দির থেকে তিন মাইল দূরত্বে। রাজা প্রতাপ সং তাঁর সৈন্য-সামন্ত নিয়ে ভরন থেকে দেবী বিগ্রহ তুলে রাজধানী চম্বা ফেরার পথে পথি-মধ্যে এই ভলাই নামক জাগায় বিশ্রাম নিয়ে ছিলেন। বিশ্রামের পরে আবার যাত্রা শুরু করতে গিয়ে বাধল বিভ্রাট। দেবীবিগ্রহ কোন ভাবেই সে জাগা থেকে সরানো গেল না। কথিত আছে, সে সময় স্থানীয় ভলাই গ্রামের এক ব্রাক্ষ্মণ জানিয়ে ছিলেন, দেবী নাকি এ জাগা ছেড়ে যেতে চাচ্ছেন না। এর পর রাজা এ গ্রামেই তৈরি করিয়ে ছিলেন এই মন্দির, মাতা ভদ্রকালীর মন্দির।
চামের ডেম ছেড়ে আমাদের গাড়ি পাহাড়ের কিনারা পথে পাঁচ সাত চক্কর মেরে প্রায় তিন কিলোমিটার পার করে উঠে এলো ভলাই দেবীর মন্দির প্রাঙ্গণে। এ মন্দির সমুদ্রতল থেকে প্রায় ৩৮০০ফিট উচ্চতায় অবস্থিত। মাঝে মধ্যে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝোঁকা এসে গায়ে লাগছিল। এ সময় সূর্যদেব অনেকটা পশ্চিমে হেলে গেছেন। পাহাড় শীর্ষে এ মন্দির, ঢালান সিঁড়ি ঘুরে ঘুরে মন্দির পর্যন্ত উঠে গিয়েছে। সরাসরি রোদকে বাঁচাতে মাথার ওপর রয়েছে টিনের শেড। সিঁড়ির দু পাশেই ছোট ছোট দোকান। পূজার সরঞ্জাম ছাড়াও, টুকটাক মেয়েদের প্রসাধনী সামগ্রী দোকানের পসারা সেজে আছে। তারই মাঝে দু একটা চা ভাজিয়া জলখাবারের দোকানও আছে।
সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে ঘুরপাক খেতে খেতে উঠে আসলাম মায়ের মন্দিরে। সামান্য স্থাপত্যকলার নিদর্শন নিয়ে আজও বহালতবিয়তে দাঁড়িয়ে আছে মন্দির। ভালো ভাবে দর্শন হল। দেখলাম মা ভদ্রকালীও বড় ক্লান্ত! তাঁর কপাল ও গাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে আসছে। তা হলে কি আজের দুষ্ট-দুরন্ত ছেলে মেয়েদের সামলাতে গিয়ে তিনি নাজেহাল হয়ে পড়েছেন ? আজকাল আমি পূজা দেবার চেয়ে দর্শনটাকেই প্রাধান্য দেই বেশী। কেন জানি না, বয়সের শেষ সীমায় এসে এ ধারণাটা আমার মনে বসে গেছে ! পূজারীকে দক্ষিণা দিয়ে পাহাড় বেয়ে সেই ঘুরপাক খেয়ে নেমে আসছিলাম। সূর্যদেব পাহাড়ের আড়াল হতে চলেছেন। ছায়া-আলোর অন্ধকার চারদিক ঘিরে নিচ্ছিল। পথের শেডের তলে আলো জ্বলে উঠলো। আলো বাইরের আলো ছায়াকে খুব একটা সরাতে পারল না। বাইরে তাকালে দেখা যাচ্ছে, পাহাড় জঙ্গল ক্রমশ ছায়ার মত জটলা পাকিয়ে যাচ্ছে। নীচে চামেরা ডেমের একাংশের জলাধার তখন আর নজরে আসছে না।
ইতিমধ্যে আমরা আরও নেমে এসেছি। সামনে সামান্য দুরে আমাদের গাড়ি ও ড্রাইভারকে আবছা দেখা যাচ্ছিল। আমার নেশা বলতে এক মাত্র চা। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখছিলাম কোন চায়ের দোকান আছে কিনা--ওপরের দিকে ছিল কিন্তু নীচে পেয়ে যাবো ভেবে খুব একটা গরজ করিনি। চোখে পড়ল নীচের শেষ সিঁড়ির এক কিনারে টি-স্টলের মত বড় টিনের পাটাতন পড়ে আছে কিন্তু লোকজন তো কেউ ওখানে আছে বলে মনে হচ্ছে না! কয়েক সিঁড়ি নেমে বুঝতে পারলাম যে এখানে পরিতপ্ত জং ধরা কোন টিনের ধাঁচা পড়ে আছে। মনে হল কোন কালে টি-স্টলের ব্যবস্থা ছিল হবে, এখন আর নেই।
--না:, চা আর পাওয়া গেল না, আমার মুখ থেকে অবশেষে কথাটা বেরিয়েই গেল। জানি না কেন বাংলা না জানা স্থানীয় একটা লোক বলেই মনে হল, আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, নেহী বাবু, চায়ে কে লিয়ে উপর দুকান হায় ! আমি লোকটাকে টি স্টল গোছের ভাঙাচোরা জাগাটা দেখিয়ে বললাম, ইয়ে ক্যায়া চায় কী দুকান থী ?
লোকটা হিন্দীতে বলল, হ্যাঁ বাবু, আজ দশ বছরের ওপর হল এখানকার চাওয়ালা মারা গেছে। আমার সাথে তখন আমার স্ত্রী, মেয়ে আর দুই নাতনী ছিল। ওরা নিজেদের মধ্যে অন্য কথা নিয়ে ব্যস্ত মনে হল। চাওয়ালাকে নিয়ে আমাদের কথা ওদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় নি হবে। চারদিকে তখন অন্ধকার আরও ঘন হয়ে উঠেছে। তবু আশপাশের লোকগুলির অস্তিত্ব তাদের আকারে প্রকারে চিনতে অসুবিধা হচ্ছিল না। কেন যেন আমার অনুসন্ধানী মন বলে উঠলো--চাওয়ালা মারা গেছে দশ বছর হয়ে গেছে আর সেই সময় থেকে তার দোকানের চা বানানোর চত্বর, টিনের মঞ্চটা এখনও যথাবৎ একই স্থানে পড়ে আছে কেন ! কোন রহস্য এখানে লুকোনো নেই তো ? আমার আবার একটু আধটু ভুতের গল্প লেখার অভ্যেস আছে ! ভাবনার সূত্রটা বোধহয় সেখান থেকেই গজিয়ে উঠছিল !
স্থানীয় লোকটা দেখি তখনও দাঁড়িয়ে আছে। আমি তখনও টি স্টলের বর্গাকার ডাইসের সামনে দাঁড়িয়ে। লক্ষ্য কলাম, সপাট টিনের ওপর সমতলের অনেকটা জাগা এবড়োখেবড়ো গোলাকার হয়ে জং খেয়ে ভেঙ্গে পড়েছে। আমি দেখছিলাম, নিরীক্ষণ করছিলাম সে জাগাটা। এত দীর্ঘ সময় পরেও এ জাগায় অন্য কোন দোকান বসে নি কেন?--এমনি একটা প্রশ্ন মনের মাঝে বারবার উঁকি মারছিল।
লক্ষ্য করলাম, স্থানীয় লোকটা আমার একেবারে পাশটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। মেয়ের গলা কানে এলো, জাগাটার আশপাশে লোকজন থাকলেও বেশ থমথমে লাগছে না ? মা মেয়ের কথোপকথন চলছে বলে মনে হল। আমারও আশপাশের পরিবেশ বেশ থমথমে বলেই মনে হচ্ছিল।
চাওয়ালা মরে গেছে আজ দশ বছরের ওপরে হয়ে গেছে, নিজের মনেই কথা বলছিলাম আমি। স্ত্রীর কানে কথাটা পৌঁছে ছিল হবে হঠাৎ সে আমার কাছ ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে বলে উঠলো, কি যা তা বলছ গো তুমি ? নাতনীরা সঙ্গে আছে, ওরা শুনলে ভয় পাবে না ?
বড় নাতনী আন্দাজ করতে পেরে পা চালিয়ে আমাদের পাশে এসে বলল, কি দাদু, তুমি ভুতের গল্প খুঁজে বেড়াচ্ছ নাকি? ব্যাপারটা জমে উঠে ছিল। দেখলাম আমরা সবাই ভয়ে ভয়ে অনেকটা কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি। কেবল জামাই আমার ওপরে দোকানে কিছু কিনতে ব্যস্ত আছে। এ অবস্থায় স্থানীয় লোকটা হঠাৎ মুখ খুলল, খুব ধীর গলায় বলল, বাবু, আপলোগ ইহা মত ঠেহেরিয়ে !
কথাটা আমার কানে খট করে বেজে উঠলো। আচমকা আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, কিউ ? কিউ ??
--ইহা, ইস দুকান মে বহুতও নে চায়ওয়ালা, চমরু কো দেখা !
মনে মনে চমকে উঠলাম। গায়ে একটা শিহরণ খেলে গেল। ওই জং খাওয়া পুরনো টিনের বাক্সটা থেকে কিছুটা দূরে এসে দাঁড়ালাম। নাতনীরা আমায় জড়িয়ে ধরেছে, স্ত্রী ও মেয়ে কাঁপা গলায় বলে উঠছে, চল, তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলো--
এদিকে লোকটা তখনও ফিসফিস করে যেন আপন মনেই বলে চলেছে--রাত গভীর হলে অনেকে চমরুকে চায়ের দুকানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে।
আমিও লোকটার গলায় গলা মিলিয়ে ভিত মিহিন সুরে বলে উঠলাম--তুমি দেখেছ?
--না, আমি দেখি নি, আমি কারো কথায় কিছু বিশ্বাস করি না, চমরু মরে গেছে আজ দশ বছর হয়ে গেছে, ও এখন কি করে আসতে পারে! চা বিক্রি করতে পারে !
ঠিক এমনি সময় ঠুং ঠ্যাং ঢঙ এ ধরনের আওয়াজ কানে এলো, আর হঠাৎ, হঠাৎই দেখলাম চা স্টলের দোকানে দাঁড়িয়ে একটা কালো ছায়া--মনে হল জংগে ভাঙা টিনের পাটাতন ফুঁড়ে উঠে দাঁড়ালো একটা লোক ! অস্পষ্ট কালো একটা লম্বাটে ছায়া! মুহূর্ত মাত্র সময়, সামনের ছায়াটা কাঁপা স্বরে বলে উঠলো, কিস নে বলা মেয় মর গয়া ? ম্যায় চমরু, আভি ভী জিন্দা হুঁ !
ব্যাস স্তব্ধতার মাঝে কথা থেমে গেল, দেখলাম, কোন ছায়া নেই, খালি জঙ মারা বাক্সটা থুম মেরে পড়ে আছে ! যেন সম্বিত ফিরে পেলাম আমি। এক লহমায় আমার সামনে এ কি ঘটে গেল ! আচমকা হলেও ঘটনাটা স্পষ্ট অথচ স্বপ্নময় বলে মনে হল। চার পাশে ঘন দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম, কৈ কেউ নেই, পাশে দাঁড়ানো স্থানীয় লোকটাই বা কোথায় গেল ?
আমার স্ত্রী মেয়ে নাতনীরা আমার থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে জামাইয়ের সাথে জটলা করছে। প্রায় দৌড়ে গিয়ে ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
কি হয়েছে? কি হয়েছে??--ওদের সবার বিস্মিত মুখে একই প্রশ্ন ধরা ছিল। তার মানে ওরা কিছুই দেখতে বা শুনতে পায় নি। তার পর অনেক ভেবে দেখেছি, আমার একবারও মনে হয় নি যে সেদিন যা দেখেছি, যা শুনেছি তার একটুও অসত্য ছিল, স্বপ্ন ছিল।
![]() |
| পরিচিতি |
তাপসকিরণ রায়
Reviewed by Pd
on
জুলাই ১১, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
জুলাই ১১, ২০১৫
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন