‘আমি আজীবন ছাত্রভাবে আছি। আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবন কখন চলিয়া গিয়াছে বুঝিতে পারি নাই। আজ বার্ধক্যে পা দিয়া আমি সেই ছাত্রই আছি। আমি দিনের মধ্যে দুই ঘন্টা নিভৃতে ভাল পুস্তককে সঙ্গী করিয়া কাটাইয়া দেই। দিন সার্থক হয়। জগতে যাহা কিছু সৎচিন্তা, উৎকৃষ্ট ভাব আছে, যাহা কিছু উদ্দীপনার সৃষ্টি করে এবং মানুষের প্রেরণা দেয় তাহার সব পুস্তকে নিহিত। অধ্যয়ন আমার কাছে সাধনার মত, ধ্যান–ধারণার সমতুল্য। প্রতিদিনকার কর্তব্যবোধের সময়ের সদব্যবহার করা চাই।’—প্রফুল্লচন্দ্র রায় ।
বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের নাম শুনেননি এমন ব্যাক্তি বাংলাদেশে বিরল । উনার মত কৃতি সন্তান আমাদের সমগ্র বাংলাদেশের এক গৌরব বয়ে আনে। বিজ্ঞান সাধনায় তার ন্যায়নিষ্ঠার চিত্র দেখে আমাদের বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়। তাছাড়াও ভারতবর্ষে সেই উপনিবেশিক শাসন আমলে তিনি প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই নিজের চেষ্টায় বিজ্ঞানকে প্রয়োগ করেছিলেন দেশীয় শিল্প গড়ে তোলার কাজে। তার মৌলিক গবেষণার পাশাপাশি তিনি দেশের মানুষের কল্যাণকল্পে অনেক ক্ষুরধার লেখা প্রবন্ধাকারে লিখে গেছেন, মানুষের ভেতরে যে অশিক্ষা কালিমা রূপে রয়ে গেছে তা থেকে তারা যেন দূরে সরে নতুন আলোকে জীবনকে দৃষ্টিপাত করতে পারে সে উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ১৮৬১ সালের ২ আগস্ট খুলনা জেলার পাইকপাছা থানার রাড়ুলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৬১ সাল বিভিন্নভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে এই জন্য যে এই সালেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। আবার এই বছরেই জনপ্রিয় চিকিৎসক ডাক্তার নীলরতন সরকার ছাড়াও সাহিত্যিক জলধর সেন কবি বিজয়চন্দ্র মজুমদার জন্মেছিলেন। কপোতাক্ষ নদের সঙ্গে মাইকেল মধুসুদন দত্তের কল্যাণে আমরা কমবেশি পরিচিত। যশোর জেলার কপোতাক্ষ নদের এক তীরে সাগরদারি গ্রাম, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মভূমি। অপর তীরে সাগরদাড়ি থেকে আট মাইল দূরে খুলনা জেলায় রাড়ুলী গ্রাম। প্রফুল্লচন্দ্রের জন্মের বছর আরো একটি উল্লেখযোগ্য সূত্রে ইতিহাসেও চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। ১৮৬১ সালেই ‘থ্যালিয়াম’ আবিষ্কৃত হয়েছিল।
আমি সরাসরি তার সমাজকল্যাণ মূলক অবদানের কথা লিখে যেতে পারতাম। কিন্তু তিনি পারিবারিক ঐতিহ্যের দিক দিয়ে সমৃদ্ধ ছিলেন বিধায় কিছুটা সেই সম্পর্কে আলোকপাত করে যাই। উল্লেখযোগ্য যে তাঁর পিতা হরিশচন্দ্র রায় ছিলেন বহু ভাষাবিদ, পন্ডিত ও বিদ্যোৎসাহী আর জমিদার ছিলেন বিধায় আর্থিক স্বচ্ছলতা দ্বারাও তিনি সমাজে প্রভাবশালী ব্যাক্তি হিসাবে সমাদৃত ছিলেন। প্রফুল্লচন্দ্রের সৌভাগ্য বলতে হবে এই কারণে যে তাঁর সাহিত্য অনুরাগী পিতার পাঠাগারেই তিনি নিমগ্ন থাকতেন অধ্যায়নের নিমিত্তে।
পিতা হরিশচন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত গ্রামের মাইনর স্কুলে তিনি নয় বছর পর্যন্ত অধ্যায়ন করে ১৮৭০ সালে কলকাতায় চলে আসেন। প্রফুল্লচন্দ্রের আত্মকথায় “১৯৭০ সালে আমি প্রথম কলকাতায় আসি।তখন আমার মনে যে ভাব জেগেছিল, তাঁর স্মৃতি এখনও আমার স্পষ্ট হয়ে আছে। আমার বাবা সামাপুকুর লেন ও রাজা দিগম্বর মিত্তিরের বাড়ির উল্টো দিকে একটা বাড়ি ভাড়া করেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদি ব্রাক্ষ সমাজ থেকে পৃথক হয়ে কেশবচন্দ্র সেন তখন সবেমাত্র তাঁর নতুন ব্রাক্ষ সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমাদের বাসা ঐ সমাজের খুব কাছে ছিল।আমি আগস্ট মাস খুব আনন্দে কলকাতায় কাটালাম।
আমার চোখের সামনে এক নতুন জগতের দৃশ্য দেখা দিল। তখন নতুন জলের কল কেবল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আর শহরের লোক জলের কল ব্যাবহার করতে আরম্ভ করেছে। গোঁড়া হিন্দুরা ঐ জল ব্যবহার করতে তখনো সংকোচ বোধ করতেন।”
দরিদ্র ও হতভাগ্য মানুষের সেবাকে কেন্দ্র করেই প্রফুল্লচন্দ্রের জীবনব্যবহার সাধনাতে সদা জাগ্রত ছিল। তাই প্রফুল্ল সম্পর্কে কিছু লিখতে গেলেই তাঁর মেধার যে স্বার্থক রূপায়ন ঘটেছিল প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার ফলাফল ধরে মানে সেই সুরের সপ্তকের পরিচয় পরিপূর্ণভাবে অব্যার্থ ব্যাক্ত করা চাই। প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিজ শ্রম ব্যয়ে দিনে দিনে ঘটিয়েছিলেন, প্রতিটি সময়কে নিপুণভাবে কাজে লাগিয়েছেন তাঁর সাধনার বৃত্তে আর সর্বোপরি মানুষের কল্যাণে সেগুলোকে ব্যাপ্ত করেছেন আন্তরিকতা ও সততার সাথেই।
১৮৭১ সালে প্রফুল্লচন্দ্রকে হেয়ার স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়। সেই সময়ে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হেয়ার স্কুল আর হিন্দু স্কুলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল আর প্রফুল্লচন্দ্র এই প্রতিযোগিতাকে উপভোগ করতেন । কারণ বিষয়বস্তু ছিল এই দুই স্কুলের কোন স্কুলটির ছাত্র কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করবে তাই নিয়েই প্রতিযোগিতাটা । হেয়ার স্কুলের ছাত্র প্রফুল্লচন্দ্রের পড়ার নেশা বাল্যকাল থেকেই। এই স্কুলে অধ্যায়নকালে তিনি মধ্যরাত পর্যন্ত পড়ে শুয়ে পড়তেন। আবার শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসতেন। আর তাঁর পিতার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে অসংখ্য পুস্তকের সাথে পরিচিত হন। চেম্বার, নিউটন, গ্যালিলিও, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের জীবনী পড়েতেন। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের মতো একজন প্রেসের কম্পোজিটার থেকে নিজের অধ্যাবসায়ে বিশ্ববরেণ্য হয়েছিলেন, এটা ভেবে তিনি বিস্ময়ে অবাক হয়ে যেতেন। ওপার বিস্ময়ে তিনি বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের কথা ভাবতেন এবং তাঁকে জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
প্রফুল্লচন্দ্র রক্তামাশায় আক্রান্ত ছিলেন কিশোর বয়স থেকেই। তবু অসুস্থ অবস্থাতেও পিতার লাইব্রেরি থেকে Selection from Modern English Literature পড়েছিলেন এই কিশোর বয়সেই যা কিনা তখন ম্যাট্টিকুলেশন স্ট্যান্ডার্টের টেকস্ট বই। কেমব্রিজের এই বইটি ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেয়। এছাড়া সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র প্রফুল্লচন্দ্র তখন আরো পড়েছেন গোল্ডস্মিথের ‘ভিকার অব ওয়েকফিল্ড, জুলিয়াস সীজার, মার্চেন্ট অব ভেনিস, হ্যামলট ইত্যাদি। এই বইগুলি ইংরেজি সাহিত্যের প্রাণপুরুষ সেক্সপীয়ারের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের সুযোগ করে দেয়। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের বিবিধার্ত সংগ্রহ, যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের আর্যদর্শন ইত্যাদি গ্রন্থপাঠে কিশোর বয়সেই তিনি পুরাতত্ত্বের প্রতি আকৃষ্ট হন। আর নিয়মিত তিনি সকল ধরণের পত্রিকার এক নিষ্ঠ পাঠক ছিলেন । আরও একটু নজরে রাখলে দেখব উনি শিক্ষকের সাহায্য ছাড়াই পিতার বিশাল লাইব্রেরির সহয়াতে গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষা সেই কিশোর বয়সেই শিখেছিলেন আর পরবর্তীকালে তাঁর জ্ঞান চর্চায় ল্যাটিন ভাষা যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। তের বছর বয়সেই পড়েছিলেন Roman Empire, স্মিথের Principia Latina(দুই খণ্ড), রোলিনের ancient History, আরনল্ডের Lecture of roman history –মূল্যবান গ্রন্থাবলী। এই সকল বিষয়ে তিনি তাঁর অসুস্থকালীন রপ্ত করেছিলেন, তবে উনার সহপাঠীরা দুই বছরে তাঁর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতায় এগিয়ে গিয়েছিলেন।
প্রফুল্লচন্দ্র যখন সুস্থ হন তখন বছরের মাঝামাঝি সময়, তাই কোন স্কুলে ভর্তির সুযোগ ছিল না –তাই সদ্য প্রতিষ্ঠিত এলবার্ট স্কুলে তাঁকে ভর্তি করে দেয়া হয়। সেটা ১৮৭৪ সালের কথা। তিনি ১৮৭৮ সালে এন্ট্রান্স(বর্তমানে মাধ্যমিক) পরীক্ষায় প্রথম বিভাগেই উত্তীর্ণ হন। এনট্রান্স( বর্তমানের মাধ্যমিক) পাশ করার পর তিনি বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হন। সে সময়ে কলেজে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যা পড়ার সুযোগ না থাকায় তাঁকে প্রেসিডেন্সি কলেজে বহিরাগত ছাত্র হিসেবে পাঠ গ্রহন করতে হতো। আলেকজান্ডার পেডলার ছিলেন তখন সেই কলেজের রসায়নশাস্ত্রের প্রধান অধ্যাপক। সাহিত্য ও ইতিহাসের প্রতি প্রফুলচন্দ্রের অগাধ আকর্ষণ সত্তেও আলেকজান্ডার পেডলারের অধ্যাপনায় আকৃষ্ট হয়ে রসায়নশাস্ত্রের প্রতি উনার আগ্রহ দৃঢ়মূলে সংযোগ ঘটে । আর আলেকজান্ডার প্রফুল্লচন্দ্রের মেধা ও অধ্যবসায় দেখে অধ্যাপক পেডলার ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন এই বলে-- এ ছেলে একদিন বড় রসায়নবিদ হবেন। সে কথাই অক্ষরে অক্ষরে ফলেছিল।
১৮৮০ সালে তিনি বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এফ. এ(বর্তমানে এইচ.এস.সি) পাশ করেন। ) ১৮৮১ সালে তিনি বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার অভিপ্রায়ে বি কর্সে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে (বি. এ ক্লাসের ছাত্র হিসাবে) । এই অধ্যয়নের সময়েই তিনি নিজেকে প্রস্তুত করে নেন এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যে । কিন্তু এই বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের জন্যে প্রার্থী হিসাবে তালিকাভুক্তির জন্যে কিছু শর্ত ছিল । প্রার্থীকে ল্যাটিন, গ্রীক কিংবা সংস্কৃত, ফারসি অথবা জার্মান ভাষা জানা থাকতে হবে। প্রফুল্ল চন্দ্রের ল্যাটিন ভাষা জানা ছিল । দেখা গেল ভারতের দুজন ছাত্র এই বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। বোম্বাই থেকে বাহাদূরজী নামে জনৈক পার্শি ছাত্র এবং বাংলাদেশ থেকে প্রফুল্লচন্দ্র রায় । বাঙালির মধ্যে প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রথম গিলক্রাইস্ট বৃত্তি পেয়েছিলেন। আর এই বৃত্তির টাকাকে সম্বল করেই উচ্চ শিক্ষার জন্যে মাত্র একুশ বছর বয়সেই ১৮৮২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রেসিডেন্সি কলেজ ছেড়ে বিলেত যাত্রা করেন ক্যালিফোর্নিয়া নামক জাহাজে করে। উল্লেখযোগ্য যে প্রফুল্লচন্দ্রের দু’বচর আগে জগদীশচন্দ্র বসু উচ্চ শিক্ষার্থে বিলাতের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। এই জাহাজে তাঁর সঙ্গে ছিলেন ডাঃ বি.কে রায়ের ছোট ভাই দ্বারকানাথ রায়। তিনি ডাক্তারি পড়তে বিলাত যাচ্ছিলেন। অতি অল্পে বলা যত সহজের,তখনকার দিনে জাহাজে সাগর পাড়ি দিয়ে বিলাতে যাওয়া চারটিখানি কথা ছিল না। তেত্রিশ দিনের পথ অতিক্রম করে তাঁদের জাহাজ গ্রেভসএন্ডে এসে পৌঁছে। এখান থেকে ট্রেনে লন্ডনের ফেনচার্চ স্ট্রিট ষ্টেশনে। এই ষ্টেশনে জগদীশচন্দ্র বসু ও সত্যরঞ্জন দাস প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে অভ্যর্থনা করেন। তারপর এডিনবার্গে পৌঁছে বাড়ির মালিকের সঙ্গে পেয়িংগেস্ট হিসেবে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। ১৮৮২ সালে তিনি এডিনবার্গ বিশবিদ্যালয়ে B. Sc ক্লাসে ভর্তি হন।
১৮৮৫ সালে তিনি এডিনবার্গ থেকে বি এস সি পরীক্ষায় পাশ করেন। এরপর তিনি D.SC (Doctor of science) ডিগ্রির জন্যে গবেষণা করে যথারীতি ১৮৮৭ সালে D. SC ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রফুল্লচন্দ্রের আগে এডিনবার্গ থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন সরোজিনী নাইডুর পিতা অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়। অঘোরনাথ প্রথম বাঙালি যিনি এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছিলেন।
প্রফুল্লচন্দ্রের থিসিসটি উচ্চমান বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে বছরে একশ পাউন্ডের ‘হোপপ্রাইজ’ দিয়ে সম্মানিত করে। তিনি আরও এক বছর সেখানে গবেষণা করার সুযোগ পান। এসময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কেমিক্যাল সোসাইটির সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। অপরদিকে গিলক্রাইস্ট বৃত্তির ‘অছি পরিষদ’ বৃত্তির টাকা ছাড়াও প্রফুল্লচন্দ্রকে পঞ্চাশ পাউণ্ড পুরষ্কার দেন । এই টাকা দিয়ে তিনি স্বদেশে ফিরে যান।অনেক ঘটনার শেষে তিনি ১৮৮৮ সালের আগস্টে কলকাতা ফিরে যান। কিন্তু মিতব্যায়ী স্বভাবের প্রফুল্লচন্দ্র দেশে ফিরে যাবার দিন-তারিখ দেশবাসীদেরকে জানান নি এই কারণে তারা যেন প্রফুল্লচন্দ্রের খাতিরে অযথা পয়সা খরচ করে তাঁকে অভ্যার্থনা না জানায়।
কর্ম বা চাকরি জীবনে প্রফুল্লচন্দ্রকেও নানান বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তখন ভারতের শিক্ষা বিভাগে ইম্পেরিয়াল আর প্রভিন্সিয়াল এই এই দুই শ্রেণীর চাকরির প্রচলন ছিল। প্রথম শ্রেণীর চাকরি ছিল ইংরেজদের জন্যে, আর প্রভিন্সিয়াল চাকরি ছিল ভারতীয়দের জন্যে। সমযোগ্যতাসম্পন্ন কোন ভারতীয় শুধু গায়ের রঙের কারণে ইম্পেরিয়াল সার্ভিসে চাকরি পেতেন না। পরাধীন দেশের এই অভিশাপ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু চাকরির প্রথম তিন বছর প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসের বেতন নিতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁর এই প্রতিবাদে কাজ হয়েছিল তদানিন্তন সমাজে। তবে প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর ছাত্র জীবনেই ইংরেজদের মুখোস খুলে দিয়েছিলেন সেই গল্প এখানে কিছুটা সংযোগ করছি। ১৮৬৭-৬৮ সালের ভারত সচিব এবং এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপচার্য স্যার স্টাফোর্ড নর্থকোট India Before and after the sepoy mutiny ( সিপাহী বিদ্রোহের পূর্বে ও পরে ভারতের অবস্থা) এই বিষয়ের উপর ছাত্রদের জন্যে একটি রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর পরীক্ষার সময়েও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিধায় রচনাটি লিখে কতৃপক্ষের কাছে জমা দেন। তিনি সিপাহী বিদ্রোহের জন্যে ব্রিটিশ সরকারকে দায়ী করেছিলেন বলেই মূলত এই কারণে পুরষ্কার পান নি। কিন্তু পণ্ডিত মহলে তাঁর লেখা ভূয়সী প্রশংসা তো পায়ই এবং ছাত্রসমাজে ভারতের সমস্যা মোকাবেলার জন্যে তাঁর এই লেখাটি বিশেষ অবদান রাখে।
অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা ভারতবর্ষে এসেছিলেন ভারতের অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে বৃটেনের বাণিজ্যিক উদ্যোগকে ফলপ্রসূ করার উদ্দেশ্যে। এই উদ্দেশ্যেই প্রথমে তারা ভারতবর্ষের মানচিত্র তৈরি এবং সেনাবাহিনী ও অন্যান্য যাতায়াতের প্রয়োজনে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটান। সেই সূত্রে ভারতীয় লোকবলের প্রয়োজন ছিল কিন্তু গোপন এক চুক্তিনামায় লিখা ছিল—‘ Throw cold water on all natives being taught or employed in making Geographical discoveries.’ ইংরেজ প্রভুত্ব শুরু করলেন এই উপমহাদেশে এসে। বাঙালীদের উন্নতির দ্বারে গুড়ায় গলদখানি রেখে দিয়েই, বাঙালিদের বঞ্চনার কবলে রেখেই শুধুমাত্র ইংরেজদের স্বার্থের কারবারে তারা যেন ব্যবহৃত পারে সুকৌশলে তারই ওঁত পেতে রাখা চতুর্মূখী করে। এই উপমহাদেশে বিজ্ঞানের প্রথম পদক্ষেপ ঘটে চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতির মাধ্যমে। এখানেও সেই একই বিড়ম্বনার স্বীকার ছিল ভারতবাসীরা । ১৮৩১ সালে রামকমল সেন আত্মভোলা গ্রান্ট সাহেবের সহযোগিতায় কলকাতার সংস্কৃত কলেজে একটি ছোট হাসপাতাল(Sanskrit College Hospital) চালু করেন। ভারতবর্ষ বহুভাষাভাষীর বিশাল দেশ বলে মাতৃভাষায় ডাক্তারি পড়ানো হত আর শিক্ষার মানগত দিক উঁচু স্তরের ছিল না । কারণ ইউরোপীয় ডাক্তার নিয়োগ খরচ সাপেক্ষ। কাজেই কিছুটা ডাক্তারি শিখিয়ে নেবার ভাবধারায় ১৮৩৫ সালে সালে গড়ে উঠে কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ। এখান থেকে পাশ করে কেউ উচ্চপদে চাকরি পেতেন না তাঁদের জন্যে সর্বোচ্চ পদ নির্ধারিত ছিল ‘ সাব এসিস্টেন্ট সার্জন’ পদটি।
এই বঞ্চনার পরিপ্রেক্ষিতেই উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে সম্পূর্ণ ভারতীয় উদ্যোগে কলকাতার দু’টি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। অনেক পরিকল্পনা শেষে ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুল এবং কলেজ অব সার্জন এন্ড ফিজিশিয়ান নামের প্রতিষ্ঠান দুটি ১৯০৪ সালে একত্রীকরণ করে নাম করা হয় বেলগাছিয়া মেডিক্যাল কলেজ বা আজকের আর. জী. কর মেডিক্যাল কলেজ। ১৮৩৫ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার রোগী দেখে প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেও চড়া দামের ঔষধ কেনার সঙ্গতি এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্যে সম্ভব ছিল না। জনহিতকর বিজ্ঞানী ও দরদী প্রফুল্লচন্দ্র দুটি উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে বেঙ্গল কামিক্যাল প্রতিষ্ঠার সংকল্প করেন যাতে করে ঔষধের ক্রয় ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নাগালভুক্ত হতে পারে আর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষিত তরুণদের কর্ম সংস্থান এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও উন্মুক্ত হতে পারে। এই উদ্দেশ্যে ১৮৯২ সালে নিজের বেতনের সঞ্চয়কৃত ৮০০ টাকা দিয়ে ৯১, আপার সার্কুলার রোডের বাড়িতে ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস’-এর গোড়াপত্তন করেন। তিনি নিজহাতে ঔষধ তৈরি করতেন না শুধু কলকাতা পাইকারী মার্কেট বড়বাজারে গিয়ে বিক্রি করতেন এবং সেই টাকা দিয়ে কাঁচামাল কিনে এনে আবার ঔষধ তৈরি করতেন। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট প্রেসিডেন্সি কলেজের খ্যাতনামা অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র রায় এটা করেছিলেন স্বদেশের স্বার্থে । ভারতীয় উপমহাদেশে প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রথম ব্যাক্তিত্ব যিনি এই জাতীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে আশানুরূপ ফলাফল না পেলেও ভেঙ্গে পরার লোক তিনি ছিলেন না, নতুন উদ্যোমে করার জন্যে চেষ্টার ত্রুটি রাখতেন না যতক্ষণ না উদ্দিষ্ট ফলাফল পেতেন। বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠার গোঁড়ার ইতিহাস হচ্ছে প্রফুল্লচন্দ্রের ব্যর্থতার পর ব্যর্থতা, শ্রম ও মেধা দ্বারা এভাবে অতিক্তান্ত করার অনেক ঘটনার ইতিকথা। বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকের দিনগুলির কথা স্মরণে রেখে আত্মচারিতে প্রফুল্লচন্দ্র লিখেছেন, ‘তখন সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করিতে হইত। নিজের সুখ–সুবিধা ও স্বাস্থের দিকে নজর দেবার মত বিন্দুমাত্র অবকাশ ছিল না; আর সে সময় কাহারও নিকট হইতে কোন রকম উৎসাহ বা সাহায্য পাওয়ার সুবিধা ছিল না। চারিদিকেই ছিল বাধা ও নিরুৎসাহ। সকল বাধাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে এক সময়ে তিনিই প্রথম দেশীয় গাছগাছড়া থেকে ঔষধ তৈরি করে বেঙ্গল কেমিক্যাল লেবেল এঁটে বাজারে ছাড়তে লাগলেন। প্রফুল্ল চন্দ্রি প্রথম বেঙ্গল কেমিক্যালের মাধ্যমে দেশীয় গাছ-গাছড়া থেকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ঔষধ তৈরির দৃষ্টান্ত এদেশে প্রথম স্থাপন করেন। ফলে বিলেতি অনেক ঔষধ বেঙ্গল কেমিক্যালের ঔষধের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হেরে যেতে থাকে।
১৯২১ সালে খুলনায় ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করতে গিয়ে দেখেন দেশের লক্ষ লক্ষ বেকার নারী পুরুষ চরকার দ্বারা কিছু হলেও আয় করতে পারেন। এরপরে তিনি খদ্দরের প্রচারকাজ শুরু করেন গান্ধীজীর সমর্থক হিসাবে। প্রফুল্লচন্দ্রের প্রচেষ্টায়ই বাংলাদেশে খাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। প্রফুল্লচন্দ্রের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল জাতীয় উন্নতির প্রকল্পকে ঘিরেই যাতে ব্রিটিশদের প্রতারণা থেকে বেরিয়ে এসে আমরা মানবজাতি হিসাবে উন্নতির শিখরে অবস্থান করতে পারি।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যায় ভারতীয়দের অধঃস্থপদে নিয়োগের সংখ্যা ১৮৮০ সালের পর থেকে কিছুটা বৃদ্ধি পায়। ভারতীয়দের দ্বারা খুব কম খরচে কাজ করিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যেই এই বৃদ্ধি ঘটে। ১৮৮০ সালে ব্রিটিশ সরকারের আন্ডার সেক্রেটারি Mr. C.S. Baley –র একটি রিপোর্টে লেখা হয়েছে, Why incur-extra-expenditure by importing qualified geologists from England. As an official hand noted earlier, the native are very much cheaper: if the works is to be really done thoroughly in future generations, it must be done by the natives of India. ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের এই নীতির ফলে দেখা যায় গোটা ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রকাশিত ৩৫০ গবেষণার মধ্যে ভারতীয়দের দ্বারা মাত্র তিনটি প্রবন্ধ লেখানো হয়েছিল।
আমরা বাঙালি হিসাবে খ্যাতির চুড়ান্তে যেতে পারিনি যা আমাদের দূর্ভাগ্য বলে ধরে নিতে পারি। অথচ এক সময় ইউরোপীয় মানুষেরা যখন গুহায় বাস করত আমাদের দেশে তখনো দু’ডজনের বেশি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত ছিল। যেমনঃ পাহাড়পুর , মহাস্থানগড়, শালবন বিহার, আনন্দ বিহার ইত্যাদি। আমাদের উপমহাদেশ বিজ্ঞানকে চরম অবহেলা করে আসছে আবহমান কাল থেকেই যেখানে ইউরোপীয় সভ্যতা বিজ্ঞানের হাত ধরে বিশ্বনন্দিত হয়ে প্রচুর সুযোগ সুবিধার উপযোগী হয়ে উঠতে পারছে। আমাদের উপমহাদেশের এই ক্রান্তিকালে বিজ্ঞানের জগতে দুই মহাপুরুষের আবির্ভাব। একজন জগদীশচন্দ্র বসু, অপরজন প্রফুল্লচন্দ্র রায় যার কথা প্রায় সবিস্তারে জানাবারর চেষ্টা করছি এই প্রবন্ধের আলোকে।
যা হোক অনেক অনিচ্ছায় প্রফুল্লচন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়ন বিভাগেই ভারপ্রাপ্ত একটি সহকারী পদে মাত্র দুইশত পঞ্চাশ টাকার বেতনে যোগদান করেন। তিনি শিক্ষাবিভাগের পরিচালক আলেকজান্ডার ক্রফটের সঙ্গে দেখা করে নিজের অসন্তুটি জানালেও বিমাতাসুলভ জবাব পেয়েছিলেন ‘ আপনার জন্যে জীবনের অনেক পথ খোলা আছে । কেহ আপনাকে এই পদ গ্রহণের জন্যে বাধ্য করিতেছে না। আপনি অন্য চাকরি করিতে পারেন।’ কিন্তু কলেজ ছাড়া অন্যত্র কাজ নিলে প্রফুল্ল চন্দ্রের গবেষণার কাজ সম্ভব হবে না বলে সেখানেই তিনি রয়ে গেলেন। তিনি মারকিউরাস নাইট্রাইটের আবিষ্কারক হিসাবে বিশ্বব্যপী খ্যাতি লাভ করেন। অবিস্মরণীয়ভাবে হিন্দু রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাস রচনা, বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠা এবং ভারতীয় রাসায়নিক গোষ্ঠীর সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছিল প্রেসিডেন্সি কলেজে চাকরি করার ফলেই।
ভারতীয় অধ্যাপকদের মধ্যে তিনিই প্রথম বাংলায় লেকচার প্রদানের নিয়ম প্রচলন করেন। মাতৃভাষায় ছাত্রদের বিজ্ঞান পড়ার সুবিধার্থে তিনি ‘সরল প্রাণী বিজ্ঞান’ নামে একটি বই লিখেন। বাঙালিরা যাতে বিজ্ঞানে আকৃষ্ট হোন সেই উদেশ্যে নেচার ক্লাব নামে বিজ্ঞান ক্লাব গঠন করেছিলেন। মুলতঃ বিজ্ঞানী হয়েও প্রফুল্লচন্দ্র নিজেকে সবসময় গবেষণার চৌহদ্দির মধ্যে আবদ্ধ রাখেননি। দেশ ও জাতির বৃহত্তর প্রয়োজনেই বরাবর তিনি এগিয়ে এসেছেন।
১৮৯৪ সালে প্রথম প্রফুল্লচন্দ্রের রসায়ন বিভাগের ল্যাবরেটরিটি সম্প্রসারণ ও আধুনিক হয়। তাঁর গবেষণার প্রথম বিষয় ছিল সরিষা তেল ও ঘিতে ভেজাল নির্ণয় করা। তিনি বলেছিলেন বর্তমান সভ্যতার একটা আনুষঙ্গিক ব্যাধি, খাদ্য দ্রব্যে ভেজাল বাড়িয়ে তোলা। তাঁর এই গবেষণা সফল হবার কিছুদিন পরেই ‘মারকিউরাস’ নামক রসায়ন দ্রব্য আবিষ্কার করে দুনিয়া জোড়া খ্যাতি অর্জন করেন ১৮৯৫ সালে। বিশ্বের প্রথম সারির রাসয়নিকবিদগণ প্রফুল্লচন্দ্রকে অভিনন্দন বার্তা পাঠান।
এবার আসি ইংরেজ সরকার প্রফুল্লচন্দ্রের প্রতি কিরূপ বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন তাঁর কিছুটা নমুনা দিই আলোচনার সূত্র ধরে। ১৮৯৭ সালে প্রফুল্লচন্দ্রকে পদোন্নতি দিয়ে রাজশাহী সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ করা হল অর্থ ও সম্মানের প্রতি বিশেষ ইঙ্গিত রেখেই। কিন্তু সেখানে গবেষণাগার ছিল না বলে প্রফুল্লচন্দ্র সেই লোভনীয় পদ গ্রহণ না করে জুনিয়র অধ্যাপকের পদে থাকাকেই উত্তম মনে করে প্রেসিডেন্সি কলেজেই থেকে গেলেন আর তিনি ব্রিটিশের চক্রান্তের কথা মানে প্রফুল্লচন্দ্রকে গবেষণা থেকে দূরে রাখার অভিপ্রায়কে এভাবেই প্রতিহত করেছিলেন ।
প্রফুল্লচন্দ্রের গবেষণালব্ধ সকল বিষয়ের স্বার্থক চিত্র স্বল্প পরিসরে তুলে ধরা সম্ভব নয় এবং তা আমার জ্ঞানের স্তরেরও নয়। অসাম্প্রদায়িক প্রফুল্লচন্দ্র জাতিভেদ ও শ্রেণী বৈষম্যের ঘোর বিরোধী ছিলেন। দানশীলতা ছিল তাঁর চরিত্রের এক প্রধান বৈশিষ্ট, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, দুস্থ ও পীড়িতদের তিনি সারাজীবন দান করেছেন। সাধারণ মানুষদেরকে সেবার উদ্দেশ্যে নিজ বাড়িতে ‘কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক’ নামে ঋণদান কেন্দ্র খুলেছিলেন। ১৯০৯ সালে এই ব্যাংক সরকার কর্তৃক রেজিস্ট্রিকৃত হয়। জেলে, তাঁতি, কুমারসহ বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ সমবায় ভিত্তিতে এই ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ গ্রহণ করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠে। তাঁর মতে দেশের উন্নতি শুধু শহরের গুটিকয়েক মানুষের উন্নতি নয়। গ্রামের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর উন্নতির উপরেই নির্ভর করে সারাদেশের উন্নতি। প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে তাঁর ছাত্রের সম্পর্ক ছিল পিতাপুত্রের। তিনি শ্রেণী কক্ষেই শুধু নয় ছাত্রদের হোস্টেলে গিয়েও তাঁদের সুখদুঃখের খবর রাখতেন। মহাত্মা গান্ধী মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো যখন শুনলাম তিনি(পি. সি. রায়) রাজকীয় বেতন থেকে নিজের জন্য রাখতেন মাত্র কয়েকটি টাকা, আর বাকী সমুদয় সাধারণের কাছে বিশেষ করে দরিদ্র ছাত্রদের জন্যে ব্যয় করতেন।’ প্রফুল্লচন্দ্রের শৈশবের ঘটনার উল্লেখ পূর্বক বলা যায় তিনি কতদূর সুদূর পিয়াসী ছিলেন মানুষের দুঃখ লাঘব করার ক্ষেত্রে-! তিনি তাঁর গ্রামের বাড়িতে থাকাকালীন নিজ হাতে হলুদ, মরিচ, বেগুন ইত্যাদি চাষ করতেন আর বিক্রি করে উপার্জিত টাকা গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের হাতে দিয়ে বললেন , ‘স্যার, এটা আমার নিজের উপার্জিত টাকা। আপনি স্কুলের কোনো গরীব ছাত্রকে এই টাকাটা দান করলে আমার শ্রম সার্থক হবে।’
প্রফুল্লচন্দ্র বরাবর ছিলেন মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের পক্ষপাতী। ইংরেজ সরকারের শিক্ষানীতি, শিক্ষাদানের পদ্ধতির বিরুদ্ধে তিনি সবসময় ছিলেন প্রতিবাদমুখর ।
১৯২৬ সালে যশোরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের অধিবেশনে প্রফুল্লচন্দ্র প্রস্তাব রাখেন যে, উচ্চতর বিদ্যালয় সমূহে বাংলা ভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান চর্চার শিক্ষা দেওয়া হোক। ১৯৩২ সালে তাঁর Life and Experience of a Bengal chemist নামক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
তা ছাড়া সার্টিফিকেট সর্বস্ব বাস্তবতা বিবর্জিত শিক্ষার প্রতি তিনি ছিলেন বীতশ্রদ্ধ। পাঠ্যপুস্তকের ধরাবাধা গণ্ডির মধ্যে মেধার বিকাশ পরিপুর্ণভাবে সম্ভব নয়--- এ কথা তিনি বিশ্বাস করতেন।
জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা, হিন্দু মুসলমানের হানাহানি সহ সবরকম সামাজিক অনাচারের তিনি বিরোধিতা করতেন। এ প্রসঙ্গে প্রফুল্লচন্দ্র লিখেছেন, ‘আমি কোনো সমাজভুক্ত নই, আমি রাসায়নিক, আমি নিক্তিতে ওজন করে সকলের ভালমন্দ বিচার করতে চাই’। নারীমুক্ত আন্দোলনে তিনি সদা তৎপর ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে নারীদের প্রতি তাঁর বক্তৃতার সার অংশ ছিল--- ‘ এই যে একই সমাজে স্ত্রী ও পুরুষের বিপুল ব্যবধান, ইহা আমাদের সমাজকে পঙ্গু করিয়া রাখিয়াছে। আমাদের দেশের নারী জাতি প্রকৃতপক্ষে অনুন্নত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। মাতৃজাতির হীনতা ও অজ্ঞানতা দূর করিবার চেষ্টা আমাদের নাই। কোন মুখে আমরা স্বরাজ লাভের যোগ্য মনে করি!’
প্রফুল্লচন্দ্র ব্যাক্তি জীবনে চিরকুমার আর উদারপন্থী ব্রাক্ষধর্মের অনুসারী ছিলেন । শৈশবে ব্রাক্ষধর্মের সুখপত্র ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা নিয়মিত পাঠ করে এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, বাজনারয়ণ বসু, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখের রচনা পাঠ করে ব্রাক্ষধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর ভাষানুযায়ী কোন শক্তিশালী ব্যাক্তি বিশেষের প্রভাব তাঁর ধর্মবিশ্বাস গড়ে তুলেনি, কোন অপৌরষের ধর্মে তাঁর বিশ্বাস ছিল না। মৃত্যুর আগে তাঁর অবশিষ্ট সম্পত্তি ব্রাক্ষসমাজে এক উইলের মাধ্যমে তিনি দান করে গেছেন। ব্রাক্ষসমাজের পক্ষে দেশবাসীর প্রতি তাঁর আহ্বান ছিল, ‘আমি আমার অন্তরের অন্তস্থল হইতে এই ভবিষ্যদ্বাণী করিতেছি যে, এক জাতি, এক স্রষ্টা, এক দেশ, এক আত্মা—ব্রাক্ষসমাজের এই চিরন্তন আদর্শ যদি এই দেশ গ্রহণ না করে তাহা হইলে ভারতবর্ষ শত বছরেও প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করিতে পারিবে না।’ রবিঠাকুরের প্রশংসার বাণী প্রফুল্লচন্দ্রকে নিয়ে যা ছিল সরাসরি তাঁর খানিকটা লিখে আমি প্রফুল্লচন্দ্রের বিশাল ব্যক্তিত্বের পরিচয় তুলে ধরার প্রয়াস করছি। ---
‘আমরা দুজনে সহযাত্রী। কালের তরীতে আমরা প্রায় এক ঘাটে এসে পৌঁছেছি। কর্মের ব্রতেও বিধাতা আমাদের কিছু মিল ঘটিয়েছেন। আমি প্রফুল্লচন্দ্রকে তাঁর সেই আসনে অভিবাদন জানাই, যে আসনে প্রতিষ্ঠিত থেকে তিনি তাঁর ছাত্রের চিত্তকে উদ্বোধন করেছেন,--কেবলমাত্র তাঁকে জ্ঞান দেন নি, নিজেকে দিয়েছেন, যে দানের প্রভাবে সে নিজেকেই পেয়েছে।
বস্তুজগতে প্রচ্ছন্ন শক্তিকে উদঘাটিত করেন বৈজ্ঞানিক, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর চেয়ে গভীরে প্রবেশ করেছেন, কত যুবকের মনোলোকে ব্যক্ত করেছেন তার গুহাহিত অনভিব্যক্ত দৃষ্টিশক্তি, বিচারশক্তি, বোধশক্তি। সংসারে জ্ঞানতপস্বী দুর্লভ নয়, কিন্তু মানুষের মনের মধ্যে চরিত্রের ক্রিয়া প্রভাব তাঁকে ক্রিয়াবান করতে পারেন, এমন মনিষী সংসারে কদাচ দেখতে পাওয়া যায়।
উপনিষাদে কথিত আছে, যিনি এক তিনি বললেন—আমি বহু হব। সৃষ্টির মূলে এই আত্মবিসর্জনের ইচ্ছা। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের সৃষ্টিও সেই ইচ্ছার নিয়মে। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে তিনি বহু হয়েছেন, নিজের চিত্তকে সঞ্জীবিত করেছেন বহু চিত্তের মধ্যে। নিজেকে অকৃপণভাবে সম্পুর্ণ দান না করলে এ কখনও সম্ভব হতো না।
১৯৩২ সালে প্রফুল্লচন্দ্রের সত্তর বছর পুর্ণ হলে রবীন্দ্রনাথ উদ্যোগে টাউন হলে বর্ণাঢ্য নাগরিক সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। এই যে আত্মদানমূলক সৃষ্টিশক্তি, এ দৈবশক্তি। আচার্যের এই শক্তির মহিমা জরাগ্রস্ত হবে না। তরুণের হৃদয়ে হৃদয়ে নব নবোম্মেষশালিনী বুদ্ধির মধ্য দিয়ে তা দূরকালে প্রসারিত হবে।দুঃসাধ্য অধ্যবসায় জয় করবে নব জ্ঞানের সম্পদ। আচার্য নিজের জয়কীর্তি নিজে স্থাপন করেছেন উদ্যমশীল জীবনের ক্ষেত্রে, পাথর দিয়ে নয়--প্রেম দিয়ে। আমরাও তাঁর জয়ধ্বনি করি।
প্রেম রসায়নে ওগো সর্বজনপ্রিয়,
করিলে বিশ্বের জনে আপন আত্মীয়।
তাঁর এই সত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ সহস্থে লিখেই উপরোক্ত দুটি লাইন প্রফুল্লচন্দ্রকে উপহার দিয়েছিলেন। প্রফুল্লচন্দ্রের আশি বছর পূর্তি উপলক্ষে জন্মোৎসব কমিটির কাছে প্রেরিত রবীন্দ্রনাথের শুভেচ্ছাবার্তা---
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের প্রতি আমার এবং দেশের অর্ঘ্য দেয় তা বিপুল। কিন্তু আমার অসুস্থ শরীরের শক্তি সামান্য, অতএব অধিকাংশ রইল মৌনের মধ্যে প্রচ্ছন্ন। -রবীন্দ্রনাথ । (বাংলা অনুবাদ)
সূত্রঃ প্রফুল্লচন্দ্র রায়
সালাম আজাদ

ঝিলিমিলি
Reviewed by Pd
on
মে ০৯, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
মে ০৯, ২০১৫
Rating:

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
সুচিন্তিত মতামত দিন